আর সবার লেখা পড়ার পর মনে হল আমিও লিখি না কেন আমার ছেলেবেলা নিয়ে? অন্ত:ত বল্গটার শুরু করি একটা কিছু দিয়ে।
***
আব্বুর চাকরি সূ্ত্রে আমাদের থাকতে হয়েছিল লিবিয়া নামক দেশটিতে। আম্মু তো এখনো সুযোগ পেলেই দেশটার বদনাম করে। বুয়েট থেকে পাশ করবার পর আব্বুর সরকারি চাকরি করার কোন ইচ্ছা ছিল না। তাই বেশ কিছুদিন শিল্প ব্যাংকে চাকরির পর এক সময় দাইয়ু নামক এক কোরিয়ান কোম্পানিতে চাকরি নিয়ে লিবিয়া চলে যায়। তিন বোনের মধ্যে মেঝ আর আমার জন্ম ওখানেই। দীর্ঘ আট বছর পরে যখন ঢাকায় নামলাম, কাহিল হয়ে পড়লাম সহজেই আট মাসের আমি। জ্বর, পেট খারাপ ইত্যাদি। বড় দুবোন কিছুদিনের মধ্যে মানিয়ে নিলেও আমার খাপ খাওয়াতে সময় লাগল অনেক। সেই মাশুল দিতে বুঝি আজও আমি ৪২ কেজি ওজনদার! তো যাই হোক ঢাকায় এসে আব্বু একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে চাকরি পেয়ে গেল। মাঝে গার্মম্টেসের ব্যবসা করতে চাইল। কিন্তু বরাবর রিস্ক এ্যার্ভাস হওয়ায় সে পথে আর যায়নি।
ছবি: আব্বু, আম্মু।
ছোটবেলার বাড়িগুলো:
খুব ছোটবেলায় লিবিয়া থেকে ঢাকায় এসে আমরা মিরপুর-পল্লবীতে উঠি। এই বাসার স্মৃতি খুব একটা মনে নেই। পরবর্তীতে আমরা এই বাসারই খুব কাছে আরেকটা বাসায় উঠি। পল্লবীর এই বাসায় আমাদের তিন বোনের ছোটবেলার একটা বড় অংশ কেটেছে। এই বাসাটা ছিল এক ডাক্তার আন্কেল আন্টির। তাদের ছেলে-মেয়ে দুটি বয়সে আমার বড় বোনের সমান হবে। আমার থেকে আমার বড় ও মেঝ বোনের বয়সের তফাৎ আট ও দেড় বছরের। তো এই বাসার উলটো দিকেই ছিল কাচা মাটির বিশাল খেলার মাঠ। তবে ছোট থাকতে ওখানে কখনো খেলতে গিয়েছি বলে মনে পড়েনা। বস্তির ছেলেমেয়েদের দখলেই ছিল বেশির ভাগ সময় মাঠটা। আমাদের বাড়িটা ছিল লাল ইটের দোতলা দালান। নিচতলায় থাকতাম আমরা। এখনো বেশ স্পষ্ট মনে পড়ে বাসাটার কথা। ছোটবেলায় আম্মু কাজে গেলে মেঝ বোন আর আমার দখলে থাকত বাসা। এসময় কাজের মেয়ের সাথে রান্না-বান্না খেলায় মেতে উঠতাম আমরা। বেশির ভাগ সময়ই আমরা হতাম অতিথি, আর কাজের মেয়ে সামছা হতো গৃহকত্রী। মুড়ি আর চিনি দিয়ে ৈতরী তেলে ভেজে কিরকম যেন কটকটির মতন একটা রান্না করে সামছা খাওয়াত বেশ মনে আছে।
এই বাসায় আমার চার থেকে আট বছর বয়স পর্যন্ত কাটে। মনে আছে প্রতিদিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠতাম আব্বুকে অফিসে যেতে দেখব বলে। আব্বু তখন আমাদের তিন বোনের কাছে ছিল সুপার-হিরো! প্রতিদিন আব্বু সেজে গুজে, স্যুটেড-বুটেড হয়ে যখন পারফিউমের গন্ধ উড়িয়ে ঘর থেকে বের হত আমরা তিন বোন হা করে সেই দৃশ্য দেখতাম। অবশ্য সকাল সকাল উঠার আরো আরেকটা কারণ ছিল-- আব্বুর কাছ থেকে ৫ টাকা পাব বলে। আব্বু প্রায় সকালেই আমাকে ৫ টাকা দিয়ে যেত যা কিনা তখন আমার কাছে ৫০০ টাকার সমান! এই পাঁচ টাকা সারাদিনেও খরচ করে শেষ হত না। কি কিনবো আর কি কিনবো না! বেলা ১০টা ১১টা বাজলে কাজের মেয়েকে সাথে নিয়ে কিংবা পরবর্তীতে আমি নিজেই একা গিয়ে আট আনা দামের মুঠো ভর্তি নারকেল দেয়া চকলেট কিনতাম। যখন সারাবেলা খেয়েও শেষ করতে পারতাম না তখন স্কুল ফেরত বোনেদের ভাগ দিতাম।
আমার প্রথম সাইকেল পাওয়া, প্রথম চিঠি লেখা (বলে রাখি, ছোট বেলায় ঠিকভাবে লেখাপড়া শেখার আগেই আমার বাতিক হয়ে যায় সদ্য মেডিকেল পাস খালাতো বোনকে গোটা গোটা শব্দে চিঠি লেখা), ম্যাকগাইভার দেখা, রেসলিং দেখা কিংবা থান্ডার
ক্যাটস দেখা সবই শুরু হয়েছিল এই বাসায়। এখনো খুব মায়া লাগে একবার বাসাটায় যাবার জন্য। কিন্তু সেই যে বিরানব্বুই সালে বাসাটা ছাড়লাম আর কখনো ওদিক যাওয়া হয়নি আমার।
'৯২ সালের দিকে যখন ক্লাস টুতে পড়ি, হই হট্টগোল করে একদিন আমরা সবাই নতুন বাসা দেখতে গেলাম। নিউ ইস্কাটনে বিশাল তিনটা লাগোয়া বিল্ডিং, আন্ডারগ্রাউন্ড কার পার্কিং, বাচ্চাদের জন্য খেলার ফ্লোর ইত্যাদি বিতং দেখে আমার চক্খু ধাঁধা! খেলার মাঠকে যে প্লে-গ্রাউন্ড বলে কিংবা খোদ দালানের মধ্যেও যে 'শিশু পার্ক' গড়ে উঠতে পারে সেই প্রথম জানলাম।
আমি যখনকার কথা বলছি তখনো ঢাকা যথেষ্টই ফাঁকা ছিল এবং এ্যাপার্টমেন্ট কালচার বলে তখনো কিছু ছিলনা। ইস্টার্ণ হাউজিংয়ের শুরুর দিকের কিছু প্রজেক্ট ততদিনে চালু হয়েছে এবং সেসব 'কবুতরের খুপরি' হিসেবে সেসময় পরিচিতি লাভ করে। যাই হোক। নতুন বাসায় আসা নিয়ে বহু উত্তেজনা ছিল আমদের তিন বোনের। সারাদিন পারলে প্লে-গ্রাউন্ডে কাটিয়ে দিতাম তখন। শিশু পার্কের রাইডগুলো যখন পুরোনো হয়ে আসতে শুরু করল তখন শুরু হল পাল্লা দিয়ে আমার সাইকেল চালানো আর ক্রিকেট খেলা। কিংবা শীতকালে ব্যাডমিন্টন খেলায় সুযোগ পাবার আশায় বিশাল লাইন ধরে থাকা।
নতুন বাসায় আসার বেশ কিছুদিন পর একবার আম্মুর কাছে বায়না ধরেছিলাম পুরোন বাসায় যাব বলে। রাম ধমক খেয়ে এরপর দ্বিতীয় কোনদিন ঐ বাসায় যাব বলেছি বলে মনে পড়েনা।
আমার সাইকেল:
যখন আমার বয়স পাঁচ, ১৯৮৯ এর দিকে আব্বু একদিন আমার জন্য একটা সাইকেল কিনে আনল। নীল রংয়ের, পেছনে হেলান দেবার সীট সহ সেই সাইকেলটা এতই বড় ছিল যে আমার পা প্যাডেলে নাগালই পেত না। সেই সাইকেল বেশ কিছুদিন পড়ে থাকল বারান্দায়। একদিন বাসার সবাই খেয়াল করল সাইকেলে জং ধরে যাচ্ছে অথচ এখনো সাইকেলই চালানো বা শেখা হলো না। শেষমেশ অনেক চেষ্টা করানো হল আমাকে 'ব্যালেন্স চাকা' দিয়ে সাইকেল চালানো শেখানোর। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়না! তখন আমদের লতিফ নামের এক ড্রাইভার ছিল। ছোট খাটো, হাসি খুশি মানুষটা গাড়িতে খুব হর্ণ বাজাতে পছন্দ করত বলে মনে আছে। ওর আরো একটা বদঅভ্যাস ছিল যখন তখন, যেখানে সেখানে গাড়ি থামিয়ে টেম্পুয়ালা বা ট্রাকয়ালার সাথে কুশল বিনিময় শুরু করত। এ নিয়ে আব্বুর কাছে বিশাল ধমকও খেয়েছিল একদিন। যাই হোক শেষমেশ লতিফ ড্রাইভারই আমাকে বল্লো হাল ছাড়তে না। সে নাকি আমাকে সাইকেল চালানো শিখিয়েই ছাড়বে। প্রথম প্রথম আমি পা তুলে থাকতাম সাইকেলে চড়ে। আর লতিফ ভাই সা-আ করে সাইকেল টান দিয়ে নিয়ে যেত। খুব মজা লাগত। আস্তে আস্তে পা দিয়ে নাগাল পাবার চেষ্টা করতাম। একদিন হাল্ফ প্যাডেল মেরে রিকশায়ালা স্টাইলে সাইকেল চালানো শিখে গেলাম। ব্যাস! এরপর থেকে আমাকে আর পায় কে! সকালে হোক কি ভর দুপুরে; বাসায় জানিয়ে কি পালিয়ে পারার মধ্যে আমার সাইকেল চালানো শুরু। এই সাইকেল চালানোর নেশা আমাকে এমনি পেয়ে বসলো যে শেষে স্কুলে গেলেও বসে বসে সময় গুনতাম কখন স্কুল ছুটি হবে আর বাসায় গিয়েই সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ব। পরবর্তীতে যখন বাসা বদলিয়ে নতুন 'প্লে-গ্রাউন্ড' পেলাম সেখানেও ছোটবেলার অনেকটা সময় কেটেছিল সাইকেল চালিয়ে। আমার মন খারাপ হলেও প্রায়ই সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম আর সাইকেল চালাতে চালাতে আপন মেঘে ভাসতাম।
ছবি: আমার সাইকেল
"মির্জা কেন গেল?":
তখনও মনে হয় স্কুলে ভর্তি হই নাই। প্রতি সোম আর বুধবার নাটক দেখতে বাসার সবাই মিলে টিভি সেটের সামনে বসতাম। পরিবারের সবাই মিলে একসঙ্গে নাটক দেখার বিষয়টা সত্যি খুব উপভোগ্য ছিল। তো যাই হোক, অয়োময় নাটকটা সেসময় বিরাট হিট! মির্জা বলতে বাঙ্গালীরা অজ্গান। তার চিবিয়ে চিবিয়ে বিখ্যাত 'পাংখা চালাও' বলাটা এখনও স্পষ্ট মনে আছে। শেষ পর্বের দিন সবাই টানটান উত্তেজনা নিয়ে দেখছি মির্জা বাড়ি ছাড়ছে। কি জন্যে মির্জা এত বড় প্রাসাদ, বিলাসিতা ছাড়ছে আমার ছ' বছরের মাথায় তা কিছুতেই ঢুকছেনা! আমি আম্মুকে জিগ্গেস করি, "মির্জা কই যায়?" আম্মু তখন টিভিতে মগ্ন। তাড়াতাড়ি বলে, "মির্জা মনের দু:খে বনে চলে যায়।" আমার বিশ্বাস হয়না। নাটকের হিরো মির্জার এই করুণ পরিনতি কিছুতেই মানতে পারছি না। এদিকে আমার মেঝ বোন বরাবরের মতো নাটক দেখে আর আড়ালে জামার কোনা দিয়ে চোখের পানি মুছে! হঠাৎ টিভি রুমে শুরু হয়ে গেল আমার চিৎকার আর কান্নাকাটি। কেউ কেন বলতে পারছে না "মির্জা কেন গেল!" মির্জা সাহেব আমাকে এতই বিমোহিত করেছিল যে পরবর্তীতে কারো নাম মির্জা শুনলেই আমার ভক্তি এসে যেত তার উপরে!
'চুলটানা বাবুয়ানা':
খুব ছোট্টকাল থেকেই আমার বদঅভ্যাস ছিল ডান হাতের বুড়ো আঙ্গুল খাওয়া। এই অভ্যাস এমন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়াল যে স্কুলে বসেও টেবিলের তলায় মাথা লুকিয়ে এক-দুবার আঙ্গুল খেয়ে নিতাম। আঙ্গুলে কাপড় বাধাঁ থেকে শুরু করে মরিচ লাগানো কোন পদ্ধতিই কাজ করেনি। একদিন গভীর রাতে শুনলাম দূরে কোথাও কুকুর কাঁদছে। ভয়ে আম্মুকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে জিজ্গেস করলাম, "কুকুরগুলো এমন করছে কেন?" আম্মু চান্স পেয়ে বুঝি বল্লো "ওরা আঙ্গুল খাওয়া বাচ্চাদের ধরে নিয়ে যায়।" এরপর কোনদিন বোধহয় আঙ্গুল আর খাইনি।
ছোটবেলায় আঙ্গুল খাওয়ার সাথে সাথে আরেকটা ভয়ংকর অভ্যাস ছিল, বাম হাতের বুড়ো আঙ্গুল খেতে খেতে ডান হাত দিয়ে নিজের চুলে গিট্টু মারা। সারাদিন শেষে দেখা যেত আমার মাথা ভর্তি গিট্টু আম্মু আর বড় বোন মিলে কঁাচি দিয়ে কাটছে। আমার আর আমার মেঝ বোনের মধ্যে বয়সের ব্যবধান কম হওয়ায় দেখা যেত আমাদের প্রিয় জিনিসগুলো নিয়ে খুব মারামারি লাগছে। তার মধ্যে একটা ছিল আব্বুর সঙ্গ। ছোটবেলার চাকরির ব্যস্ততার কারণে সপ্তাহের দিনগুলোতে আব্বুকে পাওয়া যেত না বলেই বোধ করি উইকেন্ড গুলোতে আব্বুকে নিয়ে আমাদের দু-বোনের টানাটানি পরে যেত। আব্বুর সাথে কার্টুন দেখা, গল্পের বই পড়া বা শোনা কিংবা আব্বুর ঘাড়ে চড়ে নাপিতের দোকানে বসে আব্বুর চুল কাটানো ইত্যাদি চলত শুক্র-শনিবার গুলোয়। আরেকটা কাজ যেটা রুটিন বেধে করতাম- আব্বুর কোলে চড়ে ঘুমানোর সময় নিজের আঙ্গুল খেতে খেতে যত্ন করে আব্বুর চুলে গিট্টু মেরে দেয়া! এই অভ্যাস শেষতক কি ভাবে কাটিয়েছিলাম মনে নেই।
ছবি: চুলে গিট্টু মারতে ব্যস্ত আমি, সাথে বড় দু-বোন।
হুজুরপনা এবং গানবাজনা:
আমার হাতে বই খাতা ওঠার আগেই বোধ করি আমাকে হুজুরের কাছে 'আলিফ-বা-তা-সা' পড়তে পাঠানো হল। হুজুরের কাছে পড়ার থেকে উনার কাছ থেকে নানান গল্প শুনতেই আমার আগ্রহ বেশি। ফলে তার কাছে বেশিদিন পড়া হলো না আমার। তবে হুজুর কাজের কাজ যেটা করল সেটা হল আমাকে ২৫-৩০টা সুরা শিখিয়ে দিলেন। এরপর সারাদিন আমি বাসায় সবার উপর মুন্সিয়ানা ফলাতাম। সকালে উঠে দোয়া, রাতে শুতে দোয়া এমনকি মনে আছে বাথরুম যেতেও দোয়া পড়তাম। আত্মীয়-স্বজনদের কাছেও তখন আমি হুজুরাইন হিসেবে পরিচিতি লাভ করলাম। পরবর্তীতে এক মহিলা হুজুরের কাছে আরবি পড়া শিখি এবং অনেক হুজুরই বলত আমি নাকি ভালো আরবি পড়তে পারি। যারা ব্যক্তিগত ভাবে আমাকে চিনেন বোধ করি তারা এতটুকু পড়লে আমাকে এখন আর মিলাতে পারবেন না।
স্কুলে যখন কেবল ভর্তি হয়েছি তখন খুব শখ করে আম্মু আমার আর আমার মেঝ বোনের জন্য একজন গানের মাস্টার ঠিক করলেন। ভদ্রলোক বয়সে চেংরা, খুব সম্ভবত ইউনিভার্সিটিতে পড়ত। শুকনা, পাতলা, ফাঁকিবাজ গোছের টিচার। শখের বশেই হয়ত আড্ডা মারতে গিয়ে কিংবা ইউনিভার্সিটিতে খেপ মারতে মারতে তার হারমোনিয়াম বাজাতে শেখা। এতসব কথা কেন শুধুশুধু বলছিনা বাকিটুকু পড়লেই বুঝবেন। তো সেই ভদ্রলোক আমাকে, আমার মেঝো বোনকে আর উপর তলার এক আন্টির মেয়েকে গান শেখানো শুরু করল। মনে আছে ডেইলিদিন খেলা বাদ দিয়ে সা-রে-গা-মা করতে আমার একদম ভালো লাগতো না। এর কিছুদিন পর শুরু হলো অন্যরকম অত্যাচার। স্যার প্রতিদিন 'পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে, রক্ত লাল, রক্ত লাল' শেখায়। আমরাও প্রতিদিন একই গান, একই প্যারা হেড়ে গলায় গাইতে গাইতে বিরক্ত। প্রতিদিনই গান শেষে নিচে নেমে এসে দেখতাম বড় বোন আমাদের একই গান গাই বলে ভেঙ্গাচ্ছে। সে সময় Q&Q নামক একটা কোম্পানির হাতঘড়ি বাজারে খুব চালু হয় যা কিনা হালের 'টাচ স্ক্রিণ' সুবিধা দিত। টাচ করলেই টাইম থেকে ডেট দেখাতো। আমি খুব মজা পেয়ে গেলাম। গান শিখার থেকে স্যার এর ঘড়ি নিয়েই আমার আগ্রহ বেশি। স্যার ঘড়ি নাড়তে দিবেন না, আর আমি চুরি করে স্যার এর ঘড়ির বাটন টিপে দিতাম। শেষে একদিন স্যার আমাকে হাত দেখায় বল্লো ”মার দেবো!” ব্যাস..আমার রাগ দেখে কে! ব্যাটা বলে কি! আমাকে মারবে! তেড়ে গিয়ে আমিই বেচারার শার্ট এর কলার ধরে দিলাম হেঁচকা টান। স্যার এরও রাগে চোখ মুখ লাল হয়ে গিয়েছে। এদিকে আমার মেঝো বোন আর উপর তলার নিশু ঘটনার আকস্মিকতায় চুপসে গেছে! শেষে আমি কি করবো বুঝতে না পেরে ভ্যা করে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে নিচে বাসায় পালিয়ে আসি। স্যার পরে নিজেই একটা ৫ টাকা দামের ব্যানানা চিউইং গাম কিনে পাঠালো। ওই আমার প্রথম ও শেষ কোন গানের টিচারের কাছে যাওয়া। আমার অবস্থা দেখে আম্মু দ্বিতীয় বার আর সাহস করেনি আমাকে দিয়ে গান শেখানোর।
সম্পর্ক:
ছোট বেলায় যদি খুব কাছে থেকে কোন সম্পর্ক গড়ে ওঠে , খুব যত্ন করে যদি কারো সাথে বন্ধুত্ত করি তা হলো আমার সাইকেল! এই নীল রং এর সাইকেলটা এখন পর্যন্ত যে কয়বার বাড়ি বদল করেছি, প্রতিবারই আমার সাথে সাথে গিয়েছে। ১৯৮৯ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত আজ আঠারো বছর। এখনো সাইকেলটি আমার সাথে আছে। রোদে পুড়ে. জং ধরে ঝরঝরে হয়ে গিয়েছে, কিন্তু তার রংটা এখনো ঠিক চকচকে গাড় নীল রয়েছে; ঠিক যেন আমাদের বন্ধুত্ত কে স্মরণ করে।
এবার আসি আমার মেঝো বোনের কথায়। খুব ছোট বেলায় দেখতে যেমন মিষ্টি ছিলো ও, তেমনি পড়াশোনাতেও আমার থেকে ভালো ছিল। তাই বরাবরই ওর সাথে আমার একটা প্রতিযোগিতা চলতো খেলাধুলা কিংবা পড়াশোনা নিয়ে। বাসায় যত রকমের খারাপ কাজ গুলো হত সেগুলো আমাদের দুই বোনের করা। আম্মু না থাকলে উপর তলার বাসায় প্র্যাংক কল করতাম। বিছানায় লাফালাফি করতে গিয়ে মাথা ফাটানো, চালতায়ালাকে ডাক দিয়ে আট আনা, এক টাকার চালতা কিনানো সবই আমাদের দুই বোনের কুকীর্তি ছিলো। আমাদের দুই বোনের ছোটো বেলাটা এতো পাশাপাশি কেটেছে যে আমার গল্পগুলো বল্লে সব যেন ওরই গল্প বলা হয়ে যায়। ছোট বেলায় আমাদের প্রিয় কাজ ছিল ঘরের মধ্যে টেপ টেনিস বল দিয়ে ক্রিকেট খেলা কিংবা খোদ ব্যাডমিন্টন খেলার ব্যাট দিয়ে টেনিস খেলা। প্রায়ই দুম দাম কিল পড়তো পিঠে ঘরের মধ্যে এসব খেলার জন্য। তবে সৌভাগ্যজনক ভাবে ড্রয়িং রুম থেকে শুরু করে শোয়ার ঘর যেখানেই ক্রিকেট বা টেনিস খেলি না কেনো একটা কাঁচেও আঁচড় পড়েনি কখনো।
ক্লাস ফাইভে এ যখন পড়ি, অংকে ১০০ তে ১০০ পাওয়ায় শর্ত মতে আম্মু আব্বু একাট ভিডিও গেম কিনে দিল। ভিডিও গেম পাওয়ার সুখে কিনা জানি না, এরপর সারা জীবনেও কখনো ১০০ তে ১০০ পাওয়া হয়নি অংকে। যাই হোক, খুব ইচ্ছা ছিলো সেগা গেমস কেনার, কিন্তু আম্মু আগেই বলে দিয়েছে দামীটা কিনে দিবে না। কাজেই মোটামুটি সাধারণ মানের ভিডিও গেমস হাতে পেয়েই নাচতে নাচতে বাসায় ফিরলাম। এরপর শুরু হল সুপার মারিও থেকে শুরু করে ব্যাটল অফ দি ফিল্ড গেমস খেলা। পরের দুই বছর বোধহয় আমি আর আমার মেঝো বোন পড়ে রয়েছিলাম এই ভিডিও গেমস নিয়েই। যখন ক্লাস টু কিংবা থ্রিতে পড়ি, তখন টিভিতে দুপুর বেলা ”রেমিংটন স্টিল” দেখাতো মনে আছে। ক্লাস ফোর ফাইভে পড়ার সময় আবিষ্কার করলাম রেসলিং নামক বস্তু। প্রতি শুক্র শনিবার WWF দেখতেই হবে। WWF দেখার নেশা যখন তুঙ্গে, মনে পড়ে তখন গভীর রাতে উঠেও লাইভ 'কেজ ম্যাচ' দেখেছিলাম দু'বোন।
আমাদের দু'বোনের একটা বড় রকমের টাইম পাস ছিল 'প্র্যাংক কল' দেয়া। আমরা আস্তে আস্তে এই ব্যাপারে এতই পারদর্শী হয়ে উঠলাম যে বড়রা কোনো ভাবে ধরতেও পারতো না এটা প্র্যাংক কল। তারা খুব সিরিয়াসভাবে আমাদের প্রশ্নের উত্তর দিত, কিংবা আমাদের কথা খুব গুরুত্ব দিয়েই শুনতো। খুব মারাত্নক রকমের প্র্যাংক কল চালিয়েছিলাম আমরা দু'বোন, টানা দুই বছর ধরে এক বাসায়। আমরা গাজের্ন সেজে আমাদেরই বাসার এক হোম টিউটরের নামে রেগুলার কমপ্লেন দিতাম তার বোনের বাসায়!! আরেকটা যেটা মনে পড়ছে, সেই সময় ইত্তেফাক পেপার রাখা হত বাসায়। পড়ি ক্লাস টু-থ্রি তে। স্কুল থেকে ফিরে, দুপুরে যেই পেটে ভাত পড়তো অমনি মাথা দিয়ে শয়তানি বুদ্ধির উদ্রেক! ইত্তেফাক হাতে নিয়ে বসে ডেইলি যে কাজটা করতাম সেটা হল সেদিনের সবচেয়ে বাজে পোস্টারটা কোন সিনেমার সেটা বের করতাম! প্রতিটা পোস্টোরের আ্যাডের সাথে সিনেমা হল কিংবা ডিলার কাদের যেনো ফোন নম্বর দেয়া থাকতো। ব্যাস। আমরা ফোন করে বলতাম, ”কি ভাই আজকে এত বাজে ছবি ছাপাইসেন যে?” আরেক আন্টি ছিল যার বাসায় প্রায়ই ফোন করে বলতাম ”আপা! হাঁস এর মাংস দিয়ে ভাত খাইলাম!” চিন্তা করেন ফোন তুলে হ্যালো বলার সাথে সাথেই যদি আপনি এমন কথা শুনতে পান তাহলে আপনার কেমন লাগবে?
আমার বড় বোনের সাথে আমাদের দু'বোনের বয়সের ব্যবধান বেশি হওয়ায় ওকে সব সময় আমরা 'বড়' হিসাবেই দেখতাম। আমাদের বড় বোনও ঠিক যেন বড়বোন সুলভ দায়িত্ব পালন করতো। মনে পড়ে আমার যখন ৬/৭ বছর বয়স তখন আম্মু ব্যাস্ত থাকলে আমাদের দু'বোনকে বড় বোন গোসল করিয়ে দিত। গোসল শেষে সুন্দর করে চুল আঁচড়ে দেয়া, পাউডার লাগিয়ে দেয়া কাজগুলিও খুব যত্ন নিয়েই করতো। আমার ছবি আঁকা শেখা, কিংবা পরবর্তী সময়ে অংক করা --সবই বড় বোনের কাছে শেখা। স্পষ্ট মনে আছে একবার "যেমন খুশি তেমন সাজো”তে পাঠানোর জন্য আমাকে মাস্তান সাজানো হল। মাস্তান সাজিয়ে আমার নীল সাইকেলে চড়িয়ে পোজ দিয়ে ছবিও তোলা হল। এখনো এই স্মৃতিটা খুব মনে পড়ে।
ছবি: আমি 'মাস্তানের' পোজে, পাশে মেঝ বোন।
খুব ছোট বেলায় একবার আমার বড় বোনের ইচ্ছা হল আমাকে দিয়ে যতীন্দ্রমোহন বাগচী’র 'কাজলা দিদি' কবিতাটি স্কুলের অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করাবে। কিন্তু আবৃত্তি করার কায়দা কানুন, ঢং ঢাং আমার একদম আসছিলো না! শেষ মেষ রেগে গিয়ে বড় বোন বল্লো ”মনে কর আমি কাজলা দিদি, আমি তোমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছি। এটা ভেবে আবৃত্তি কর”। বিরস মুখে আমি ঘোষণা দিলাম ”আমাকে দিয়ে এটা হবে না”। আমাকে দিয়ে কবিতাটা ও আর আবৃত্তি করাতে পারেনি। যখন আবৃত্তি সারা জীবনে একবারই করলাম কলেজে উঠে তখন ইন্টার-কলেজ রিসাইটেশন কম্পিটিশনে সেকেন্ড প্রাইজ পেয়েছিলাম। তবে তখন'কাজলা দিদি' সত্যি আমাদের সাথে ছিল না। পড়াশোনা করতে ততদিনে দেশ ছেড়ে বাইরে চলে গিয়েছে। সেদিন বাসায় কাউকে জানাইনি আমার পুরষ্কারের কথা। 'কাজলা দিদি' থাকলে হয়তো তাকে বলেই আনন্দটুকু ভাগ করা যেত।
ছবি: 'কাজলা দিদি' আর আমি।
বি:দ্র: আমার ছেলেবেলা নিয়ে লিখতে গিয়ে মনে হল আমার সম্পূর্ণ ছোট বেলাকে যেন তুলে ধরতে চেয়েছি এক লেখায়। কিন্তু তার পরেও তা সম্ভব হল না। বিশেষ করে স্কুল এবং বন্ধু--একটা বিরাট অংশ বাদ পড়ে গিয়েছে। শেষমেষ আমাকে একটা অসম্পূর্ণ এবং এলোমেলো লেখা জমা দিতে হল। আশা করি এই আনাড়ী লেখক কে ক্ষমা করবেন।
২ নভেম্বর ২০০৭
রাত ১২:৪০
মন্তব্য
ক্ষমা করতে পারলাম না বলে আন্তরিক ভাবে দুঃখিত
লেখাটা তো ভালই লাগলো, তয় পার্ট কইরা দিলে মানে পর্ব-১,২ এইভাবে দিলে পড়া আরাম হইত আর কি। বয়েস হইতেছে তো এত বড় লেখা পড়তে পারি না।
লেখা কিন্তুক ভালোই হৈছে। চালায়া যান।
-------------------------------------------------------------
অলমিতি বিস্তারেণ
অলমিতি বিস্তারেণ
ফ্রন্ট পেজে দাও। নইলে পড়বো না।
আবার লিখবো হয়তো কোন দিন
লিখতে লিখতে বড় হয়ে গেছে! একবার ভাবছিলাম আলাদা আলাদা পার্ট করব। কিন্তু করলাম না।
ফ্রন্ট পেজে দিলাম:-)
.if I could wake up at a different place, at a different time, could I wake up as a different person?.
ঠিকাছে... ধইরা নিলাম এইটা পার্ট ওয়ান... এইবার পার্ট টু চালান দেন...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
এইবার পড়লাম।
বিচ্ছুগিরির গল্প আরো চাই।
গিট্টু দেওয়ার ছবিটা চমৎকার।
উত্তম জা-ঝা।
(জা-ঝা র মানে টা আন্দাজ করার চেষ্টা করো!)
আমি ও আমার স্বপ্নেরা লুকোচুরি খেলি
আবার লিখবো হয়তো কোন দিন
ধুরো, তোরা আমার লেখা কঠিন কইরা দিতাছোস। মাশীদেরটা পড়ার পর তোরটা পড়লাম। এখন ভয়ে লিখতে ইচ্ছা করতাছে না। আবার লোভো হইতাছে
তোর জন্য আকাশ থেকে পেজা
এক টুকরো মেঘ এনেছি ভেজা
বৃষ্টি করে এক্ষুনি দে তুই
বৃষ্টি দিয়ে ছাদ বানিয়ে শুই
তোর জন্য আকাশ থেকে পেজা
এক টুকরো মেঘ এনেছি ভেজা
বৃষ্টি করে এক্ষুনি দে তুই
বৃষ্টি দিয়ে ছাদ বানিয়ে শুই
চমৎকার হয়েছে লেখাটা। কিন্তু অন্যদের সাথে আমিও একমত। দ্বিতীয়, তৃতীয় পার্ট চাই। অপেক্ষায় রইলাম
- ইশতিয়াক
আরেকজন মিরপুইরা! চমৎকার হইছে লেখা। চলুক আরো আরো ছোটবেলার, বড়বেলার গল্প।
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
পিয়াল ভাই, তাত্তারি!!
ইশতি ভাই, মুরশেদ ভাই, এই লেখার আর সিরিয়াল করা সম্ভব না মনে হয়। এমনেই বেশি লিখে ফেলেছি। তবে কথা দিচ্ছি সামনে আরও কিছু লেখা নিয়ে আসব।
সৌরভ ভাই, বান্দরামি নিয়া লিখতে গেলে এপিক হয়ে যাবে বল্লাম। তবে চেষ্টা করা যায়।;-)
.if I could wake up at a different place, at a different time, could I wake up as a different person?.
পাপী রাবাব , জা-ঝা মানে বাইর করতে পারলা ?
------------------------------------------------------------
অলমিতি বিস্তারেণ
অলমিতি বিস্তারেণ
লেখা বেশ ভাল হয়েছে।
আরেকটা পর্ব আসলে মন্দ হয় না।
ভালবাসি, ভালবাসি, ভালবাসি তোমায়!
ব্লগস্পট | ফেসবুক | ইমেইল
অনেক ব্যস্ত, তাই সচলে অচল অনেক দিন। আচমকা চেনা নাম দেখে পড়া শুরু করলাম। অনেক বড়, পরে শেষ করবো নে। তুমিও মিরপুরের? এখনো থাকো ওখানে। অধম ১২ নম্বরের বাসিন্দা।
ধন্যবাদ অমিত ভাই।
ইশতিয়াক ভাই, ছোটবেলার অনেকটা সময় মিরপুর পল্লবীতে কাটাই। '৯২ সালের দিকে চলে আসি।
.if I could wake up at a different place, at a different time, could I wake up as a different person?.
রকাতমচ !
লেখাটা এখানে না দিয়ে "ফেলে আসা ছেলেবেলা - ২" ই'বুকের জন্য আরিফ ভাইকে ইমেইল করে দিলেই ভালো হতো।
ভালবাসি, ভালবাসি, ভালবাসি তোমায়!
ব্লগস্পট | ফেসবুক | ইমেইল
অনেক দেরীতে এই চমৎকার লেখাটি পড়লাম। ছোট্ট রাবাবের দুষ্টুমীতে ভরা ছবিগুলো জাঝা!
আমাদের চিন্তাই আমাদের আগামী: গৌতম বুদ্ধ
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
লেখাটি বেশ পুরোনো হলেও পড়লাম।ছোট বেলায় আমরাও এক সময় পল্লবীতে থাকতাম।সিডনী আসার আগে পর্যন্ত মিরপুরেই থাকা হয়েছে আমাদের।তোমার ছেলে বেলার ঘটনাগুলো পড়তে পড়তে আমার কিছু কিছু ঘটনা ভেসে উঠছিল মনে।তুমি করেই বললাম তোমাকে কারন ১৯৯২-তে আমিও ক্লাস টুতেই পড়তাম তাই আমরা সমবয়সী সেটা বলে দিতে হবেনা।প্রাংক কলের ঘটনা পড়ে খুব মজা পেয়েছি।চোটবেলা নিয়ে আরো লিখবে আশা করি।আচ্ছা বড়বেলার বাদরামির কথাও কিছু লিখ পারলে।
শুভকামনা রইল।
~~টক্স~~
লিবিয়ার কোথায়? '৮২-'৮৭ বাপ মায়ের চাকরী সূত্রে বেনগাজী থাকতে হয়েছিল।
নতুন মন্তব্য করুন