সমুদ্র দেখা হয়নি আমার। কেবল শুনেছি বিশাল ওই জলরাশির সামনে গেলেই নাকি মানুষ শিশু হয়ে যায়। আকাশ জলের মিলনে এত উদারতা!
আমি বলি মেঘ-পাহাড়ের গল্প। সঙ্গ দেয় আকাশ। আকাশছোঁয়া কালো পাহাড়ের ফাঁকে উঁকি দেয় সাদা সাদা গতিময় জলের ধারা। যেনো মেঘের ভেলায় কেউ একটা ছিদ্র করে দিয়েছে। আমরা মুগ্ধ হই কেবল। মেঘ-পাহাড়-আকাশ কেমন জড়াজড়ি করে আছে। এবং তারা আমাদের সংকীর্ণতা স্বার্থপরতার কথা মনে করিয়ে দেয় প্রতিক্ষণ।
নজরুল ভাই স্বপরিবারে সিলেটে আসবেন। ছুটিটা কেবল এ কারনেই নেয়া। আমার বাবাই আনন্দের চুড়ায় উঠে যখন লিখতে চায় তখন বলে, ‘মা যা খুশি তা লিখি’। আমার এই ছুটিটাও যা খুশি তা লিখার মতোই ভালো কাটলো।
নজরুল ভাই তার লিখার মতই ঝরঝরে। নুপুর ভাবী খুব মিষ্টি। কিছুটা ভাবুকও মনে হলো। নিধিমনিটা যে কেমন তা বোঝাতে পারবো না। ১০/১৫ মিনিট লাগলো তার বাড়ির পিচ্চিদের সাথে মিশতে। এ ঘর থেকে ও ঘরে যায়। খেলনার ঘর বদল করে। বগলদাবা করে বলে, ‘এগুলো আমি নিয়ে দাবো’ হাটে আর বলে... খাওয়া নিয়ে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়। নুপুর ভাবী কোলে নেন। নজুভাই স্যুপের চামচে করে পাতলা সুজিটা তুলে দেন নিধির মুখে। (আজকালকার বাচ্চারা খাবার নিয়ে এমন করে কেনো বুঝি না।)
আমি বেশি কাজের না। তাই নাস্তা করে বের হতে হতে ১২ টা বেজে যায়। প্ল্যান কিছুই জানি না। কই যাবো, কি করবো কিছুই বলা হয়নি আমায়। বের হয়ে ভাবী প্রথমেই বল্লেন মাজার দেখবেন। সেখানেই গেলাম। বাবাইর জন্যে কেনা হলো খেলনা। নিধি আর নজু ভাইকে পরিয়ে দেয়া হলো রাখি। বাবাইকেও রাখি পরিয়ে দিলেন ভাবী। (এখনকার শ্বাশুড়িরা কি এভাবে রাখি পরিয়ে দেয় নাকি? আমি বাবা অনেক কিছুই জানি না দেখি)
মুস্তাফিজ ভাই সিলেটে সেটা শুনেছিলাম সকালেই। কিন্তু তিনিও যে আমাদের সাথে যোগ দেবেন সেটা জানলাম দরগাহ তে গিয়ে। একটু পর পর তিনি ফোন করছিলেন। প্রতিবার ফোন ধরেই নজরুল ভাই ভাংগা রেকর্ডের মতো ৫ মিনিট ৫ মিনিট বলে সময় চেয়ে নিচ্ছিলেন। দরগা থেকে যাওয়া হলো নুপুর ভাবীর এক আত্মীয়ের বাড়ি। মুস্তাফিজ ভাই এস এম এস দিলেন, ‘বসে বসে মাছি মারছি। ১০০ টা হয়ে গেছে’।
এম সি কলেজের সামনে গিয়েই পাওয়া গেলো মুস্তাফিজ ভাই আর ফখরুল ভাইকে। ফখরুল ভাই কথাকলি’র মানুষ। দারুণ ছবি তোলেন। জৈন্তিয়া কলেজের শিক্ষক। তার এলাকা জাফলং এ যাচ্ছি আমরা। রওয়ানা দিতেই টিপ টিপ বৃষ্টি শুরু হলো। একটু পরেই আবার নাই। থামলাম গিয়ে সারী নদীর পাড়ে। শীতে এই নদী অসাধারণ দেখতে। বর্ষাতেও যে এমন অপরূপ, এই প্রথম তা জানলাম। নিধিমনি ততক্ষণে ঘুমে। বাবাই জেগে আছে, মোটা মোটা চোখ করে চারপাশে তাকাচ্ছে।
প্রায় চার বছর পর এ পথে আসা হলো আমার। কেমন অচেনা অচেনা লাগে। ভাংগা ব্রিজগুলো চকচক করছে। দোকানপাটগুলোয় নগরের ছোঁয়া। কিন্তু দৃষ্টির সীমানায় দাড়ানো ভীষণ সুন্দর প্রকৃতি অকৃপনভাবে বিলিয়ে যাচ্ছে তার অপার সৌন্দর্য বিলিয়ে যাচ্ছে ঠিক আগেরই মতো করে। আমরা যখনই কেউ বলে উঠছি আহ্ কি সুন্দর, অপু ভেটো দিচ্ছে, এইগুলা আমাদের না বলে। তার এক কথা, ‘সমৃদ্ধির শেষ, বাংলাদেশের শুরু!’ আরে বাবা না হয় হলোই অন্য দেশ। সৌন্দর্য কি ছুঁয়ে দেখতেই হবে? এটাতো অনুভবের বিষয়। জাফলং হিল রিসোর্টে দাড়িয়ে যখন ঝর্ণার শো শো গর্জন শুনি, তখন আর মন হিসাব খোঁজে না, এই ঝর্ণাটা কোন দেশের। ফিরতে মন চায় না এমন সুন্দর ছেড়ে। তবু ফিরতে হয়।
হরিপুরের কাছে আসতেই গাড়ি থামালো অপু। ঝুপড়ি মতো একটা ঘরের সামনে থেমে বললো, এখানে ভাত খাবে! একেবারে ভাঙাচুড়া একটা ঘর। এক বুড়ো দম্পতি সেখানে হোটেল খোলে বসেছেন। পুরনো স্মৃতি ঘেটে এই দোকানে নিয়ে এসেছে অপু। গ্রামের মায়ায় সেখানে ভাত বেড়ে দেন এক আধা বয়েসি মহিলা। কুড়া আর বালিহাসের মাংসে চলে আমাদের ভুড়িভোজ। রান্নার গুনে কি না জানি না আমরা সবাই ই অনেক খাই। নিধিমনিটা শুধু ঘুরে ফিরে বেড়ায়। সব শেষে বেরিয়ে আসার সময় হলে বুঝা যায়, কতোটা আপন করে নিয়েছে সেই ঘরটা সে। মায়ের সাথে আসবে না বলে বসে সে, বলে- ‘ না দাবো না!’ মাটির কাছে এলেই শিশুদের প্রকৃত রূপটা খোলো।
একটা ঝলমলে পেট্রোলপম্পে এসে বাপকে জিজ্ঞেস করে নিধি, ‘বাবা এতা কি?’ নজরুল ভাই খুব দ্রুত উত্তর দেন, ‘এটা হলো তেলের দোকান!’ বাপ মেয়ের কথোপকথনে দারূণ মজা লাগে।
খাওয়া শেষ করে রওয়ানা দিতেই শুরু হলো প্রচণ্ড বৃষ্টি। বৃষ্টি জিনিসটার ক্লান্তি নেই এই শহরে। দিনে দেয়নি, তো রাতে আসবেই। প্রচন্ড রোদ, গরমে অতিষ্ঠ, এমন অবস্থা সিলেটে টানা এক সপ্তা থাকেনি কোনোদিন। বৃষ্টি হবেই হবে।
শহরে আসতে আসতে রাত আট টা। মৌলভী বাজার যাবার জন্য যখন ভাবীরা গাড়ি বদল করছেন, তখনও গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। বাবাই ঘুমে। কাজে লাগলো তার রঙিন ছাতাটা।
কোন কোন সম্পর্ক এমন হয় যে, এর কোনো ব্যাখ্যা দাড় করানো যায় না। এমনি এক অনুভূতি কাজ করলো আমার সারাদিন। বিনা সুতোর এমন সম্পর্ক অটুট থাকুক সারা জীবন।
আমি সাধারণত অসুখ বিসুখে না পড়লে, ছুটি ছাটা নেই না। রাতে অপু জিজ্ঞেস করলো, দিনটা কি খুব খারাপ কাটলো? আমি বলি এমন খারাপের অপেক্ষায় থাকবো আমি সবসময়।
মন্তব্য
আহা......কতদিন ছুটি পাই না!
কতদিন মেঘ পাহাড় দেখতে যাই না!!!
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-
সেই সুদুরের সীমানাটা যদি উল্টে দেখা যেত!
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
বাঃ এমন ভ্রমণের গল্প বহুকাল পড়ি নি। এ কি ভ্রমণের গুণ না আপনার হাতের?
সত্যিই তো!
চমৎকার লাগল তুলি আপনার লেখা।
এত কম লিখেন কেন?
চোখ দু'টা একটু ডলে নিলাম। লেখিকার নাম ঠিক দেকতেছি তো! আইহায়! ভাবী তাইলে লিখসেন অবশেষে। দিলটা বেশ গার্ডেন গার্ডেন লাকতেছে।
আর কী বলবো ভাবী। আপনারা থাকেন অনেক দূরে, ব্যস্ততার চাপে কথা-বার্তাও হয় না। দ দু'একটা লেখা পেলে মনে হয় আপনারা আশেপাশেই আছেন। দেখুন না আরেকটু বেশী আসা যায় কীনা?
ঝরঝরে বর্ণনাভঙ্গি। খুব আরাম লাগলো পড়ে।
নুপুর ভাবী ভাবুক নাকি? আমার তো দেখে উল্টাটা মনে হইসিল।
ঠোঁটের কোণে একটা চিলতে হাসি সবসময় লেগেই আছে।
আমি কখনো সিলেট যাইনি। এখন খুব যেতে ইচ্ছে করছে।
---------------------------------
তবে যে ভারি ল্যাজ উঁচিয়ে পুটুস্ পাটুস্ চাও?!
---------------------------------
বাঁইচ্যা আছি
লেখা ভাল লাগল
আপনার কথা গিন্নি প্রায়ই বলে ।
এটা জানতাম "নজরুল ভাই তার লিখার মতই ঝরঝরে। নুপুর ভাবী খুব মিষ্টি" কিন্তু "কিছুটা ভাবুকও মনে হলো" এটা জানা ছিল না ।
নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)
নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)
সেলিনা, আমিও টিলার উপড়ে আপনাদের বাংলোতে আসতে চাই, আমার ভীষন সাধ ...............।।
লেখা অপূর্ব, আপনার নামটা চেনা, মনে হচ্ছে কোথাও আপনার লেখা আরো পড়েছি। আপনি কলামিষ্ট ?
---------------------------------------------------------
রাত্রে যদি সূর্যশোকে ঝরে অশ্রুধারা
সূর্য নাহি ফেরে শুধু ব্যর্থ হয় তারা
*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়
আমিও চাই এমন একটি খারাপ দিন , খুব ভালো লাগল লেখাটা। আপনে তো দেখি কঠিন শীতনিদ্রায় যান, শেষ লেখা ছিল মার্চ মাসে, আরেকটু ঘন ঘন লেখলে পারেন
=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী
বুঝলাম, নজরুল-নজমুল সম্পর্ক বেশ সুদৃঢ় হয়েছে
অলমিতি বিস্তারেণ
অলমিতি বিস্তারেণ
আহা, এমন লিখিয়ে নিয়মিত লিখতেন!
"এমন খারাপ" আমাদের কপালে তো নাই-ই একদম।
একটা কথার উত্তর দিবেন, যখন আসেন- আচ্ছা আপনারা কি সত্যি সত্যিই নিধি-বাবাইয়ের সম্বন্ধ স্থাপনের সিদ্ধান্তটা নিয়ে নিলেন এখনই?!
আপু, লেখা অনেক ভালো হয়েছে। প'ড়ে প'ড়েই বেড়ানো হয়ে গ্যালো আমার একটু। আক্ষেপগুলো অবশ্য আরো বেড়ে যায় এমন ক'রে।
আপনি নিয়মিত লিইখেন টিইখেন একটু। আজকাল অপু ভাই-ও নিয়মিত লেখেন না, আপনি তো আরো না।
___________
স্বাক্ষর?!
মাঝেসাঝে বুঝতে পাই- আমি
নিরক্ষর!
___________
সবকিছু নিয়ে এখন সত্যিই বেশ ত্রিধা'য় আছি
সুন্দরৈছে লেখা। আপনি ভালো লিখেন।
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
হঠাত্ একটা অবাক ব্যাপার পায়া আরো একটু বাকবাকুম করতে আইলাম।
চুপে চুপে খালি আপ্নেরে কই কানে কানে-
আপ্নের মতো কাইলক্যা আমারও সেইদিন! হ, ২৪ জুলাই।
জানি না আপ্নে এইটা কবে দেখবেন আরেক্বার, তবু-
শুভ ২৪ জুলাই, অগ্রিম।
___________
স্বাক্ষর?!
মাঝেসাঝে বুঝতে পাই- আমি
নিরক্ষর!
___________
সবকিছু নিয়ে এখন সত্যিই বেশ ত্রিধা'য় আছি
আমরাও একদিন এমন করে ঘুরতে বাইর হমু।
খুব ভাল লাগল লেখাটা-----
আরো অনেকের মত বলছি---আরেকটু ঘন ঘন লিখলে কী হয়??
নিরন্তর শুভেচ্ছা
খুব, খুব ভালো লাগলো পড়ে! আপনার লেখার ভঙ্গি চমৎকার!
এই লেখাটা সবচেয়ে ভাল্লাগলো তুলিপু ...
মন-টন খুব খারাপ থাকলে আমি জাফলং এর ছবিগুলো বের করে দেখি, যদিও পাহাড়ের চাইতে সাগর আমাকে অনেক বেশি টানে...তবুও...
বাবাই <>নিধি; সত্যি সত্যি নাকি?? এহেম
--------------------------------------------------
"আমি তো থাকবোই, শুধু মাঝে মাঝে পাতা থাকবে সাদা/
এই ইচ্ছেমৃত্যু আমি জেনেছি তিথির মতো..."
*সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
সারাদিন প্রায় সচলে পরে থাকি তারপরও আমার চোখ এড়িয়ে গিয়েছিলো লেখাটা, ভালো লাগা জানিয়ে গেলাম।
...........................
Every Picture Tells a Story
কী ছুইট লেখা!
-----------------------------------------------------------------------------------
...সময়ের ধাওয়া করা ফেরারীর হাত থিকা যেহেতু রক্ষা পামুনা, তাইলে চলো ধাওয়া কইরা উল্টা তারেই দৌড়ের উপরে রাখি...
**************************************************
“মসজিদ ভাঙলে আল্লার কিছু যায় আসে না, মন্দির ভাঙলে ভগবানের কিছু যায়-আসে না; যায়-আসে শুধু ধর্মান্ধদের। ওরাই মসজিদ ভাঙে, মন্দির ভাঙে।
মসজিদ তোলা আর ভাঙার নাম রাজনীতি, মন্দির ভাঙা আর তোলার নাম রাজনীতি।
সমুদ্র দেখার নিমন্ত্রন। কবে আসছেন?
সুমিমা ইয়াসমিন
আপু! এক বছরের উপ্রে হল! এবার তো আরো মানুষ বেড়ায়ে আসল, আরেকটা লেখা দেবার সময় হয়েছে কিনা??
___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।
___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।
কোন কোন সম্পর্ক এমন হয় যে, এর কোনো ব্যাখ্যা দাড় করানো যায় না।
- সত্যি তাই...
পড়তে পড়তে ভালো লাগলো লেখাটি...
শুভকামনা রইলো আপু...
-------------------------------------------------------------------
নির্জলা নৈবেদ্য
-----------------------------------------------------------------------------------------------------
" ছেলেবেলা থেকেই আমি নিজেকে শুধু নষ্ট হতে দিয়েছি, ভেসে যেতে দিয়েছি, উড়িয়ে-পুড়িয়ে দিতে চেয়েছি নিজেকে। দ্বিধা আর শঙ্কা, এই নিয়েই আমি এক বিতিকিচ্ছিরি
নতুন মন্তব্য করুন