তিনি আসলেন। খুব সাবধানে পা ফেলার চেষ্টা করেও পা’টা যথাস্থানে পড়তে চায়না। তবুও তিনি আসলেন। সোফায় বসলেন। সাদা রঙের হাফ হাতা গেঞ্জী ,সাদা লুঙ্গি পরনে। সাদা চুল পুরো মাথা জুড়ে। শত ভাগ নিশ্চিত আমি এই চুলের কোমলতার ব্যাপারে। সাদা রঙের মনিটরে টিভি কার্ড লাগানো। রিমোট হাতে নিলেন। পছন্দের চ্যানেল খুঁজতে লাগলেন। নিজের জন্য যে না বুঝতে পারি সেটা। না-এই মানুষ নিজের জন্য কিছুই করতে পারেননা। আমরা তিনটা মানুষ (অপু, আমি, বাবাই) গেছি তার বাসায় তাই তার এই ব্যস্ততা...
আমি স্পষ্ট একজনের ছায়া দেখতে পেলাম এই মানুষটার মাঝে। গত ৯ ডিসেম্বর থেকে আমাদের বাসার সোফার ঐ কর্ণারটাতে তিনি আর বসেননা। বসবেন ও না কোনদিন। তবু আমি কাঙালের মত অপেক্ষা করবো তাঁর। রাত-দিন।
পৃথিবী তাকে কিছুই দেয়নি। আমরাও। ভাই- বোনরা ও কেবল নিজেদের নিয়ে থেকেছি। হয়তো। আর এখন প্রতিটি মূহুর্তে মনে মনে বলি,ভালো থাকো বাবা, যেখানেই থাকো। জাবেদভাই স্বপ্ন দেখে, শাম্মী স্বপ্ন দেখে-একটা খোলা সবুজ প্রান্তরে একটা গাছ, সেই গাছের ছায়ায় চেয়ার পেতে বসা বাবা আমার। -আমি দেখিনা, একটিবারও দেখিনা। আমার কেবল চোখে ভাসে সেই সোফায় বসা রিমোট হাতের বাবা, টিভিকার্ড লাগানো মনিটরে চোখ। আমরা রুমে ঢুকতেই বলে উঠেন “আজ এত দেরী হল? ছোটভাই আমার সাথে একই অফিসে কাজ করে,তাই লাঞ্চটা একসাথে বাসায় সেরে আসতাম। প্রায় প্রতিদিন একবার দেখা হত বাবা-মার সাথে। ডায়াবেটিসের রোগী বাবা আমার অপেক্ষায় থাকতেন, কখন আসবো, একসাথে খাবার টেবিলে বসবো। মা বলতেন, ওদের দেরি হবে হয়তো তুমি খেয়ে নাও। বাবা বলতেন “আসুক তারা একসাথে খাবো।” খাবার পরিবেশনের দায়িত্ব এখনও কাজের লোকের হাতে যায়নি আমাদের বাসায়। মাকে দু’বার কষ্টের হাত থেকে বাচাঁনোর জন্য হয়তো বাবা এমনটা করতেন। এই মানুষটা যে নিজের জন্য কিছুই করেননি কোনদিন...
২০০৬ এর ২ফেব্র“য়ারি অতিরিক্ত সুগারের কারণে স্ট্রোক করেন বাবা। ভাল হয়ে যান খুব তাড়াতাড়ি। তিনমাসের মাথায় ব্যবসা দেখাশুনা শুরু করেন। আমরা ভাবি ভাল হয়ে গেছেন। প্রচন্ড মনের জোর ছিল বাবার। কাউকে বুঝতে দিতেননা তিনি যে অসুস্থ। ২০০৯ এ আবারও স্ট্রোক করলেন, এবারও ভালো হলেন কিন্তু শারীরিক সমস্যা দেখা দিল। কথাবার্তা জড়িয়ে যেত, হাঁটতে অসুবিধা হত। তারপরও নিজের কাজ নিজেই করতেন। বাথরুম থেকে সেভ করে বের হতেন -জায়গায় জায়গায় কেটে রক্ত বের হচ্ছে তবুও কারো সাহায্য নিতেননা। ডান হাতে সমস্যা বেশি ছিল- চামচ দিয়ে ভাত খেতেন তবু কেউ খাইয়ে দিক এটা চাইতেননা। দুপুরের খাবার হাত দিয়ে খেতে চেষ্টা করতেন। পারতেননা তবুও। বাচ্চাদের মত প্লেটের চারপাশে ছড়িয়ে পড়ত ভাত-হয়তো লজ্জা লাগত-তোলার চেষ্টা করতেন। আমি বলতাম “থাক বাবা মাছেরওতো খাবার লাগবে... তাছাড়া কবুতরগুলোও অপেক্ষায় আছে খাবারের...। ”
২০১০এর নভেম্বরে খাবার টেবিলে বসা অবস্থায়ই শেষবারের মত স্ট্রোক করেন বাবা। সেন্সলেস থাকলেন ৩৩ দিন। ৯ ডিসেম্বর রাত ৯টায় আমাদের ছেড়ে চলে যান বাবা। শেষের ৩৩ দিন খুব কষ্ট করেছেন বাবা। হয়তো। কষ্টের সে ছাপ ছিল উনার মুখে। কিন্তু প্রাণহীন বাবার মুখটা উজ্জল হয়ে গিয়েছিল,মনে হয়েছে হাসিমুখে যেন অন্য এক জগতকে বরণ করে নিলেন তিনি।
এখনও প্রায় প্রতি দুপুরে ভাই-বোন মিলে লাঞ্চ করতে বাসায় যাই। আমার ভাইয়ের মনে আসে কিনা জানিনা-কিন্তু আমি ঢুকেই ডান দিকের ঐ কর্ণারে তাকাই ভাবি একটিবার, শুধু একটিবার যদি বাবাকে দেখতাম... ।
সবাই বলে যত দিন যায় স্মৃতি তত হালকা হয়। মিথ্যে স-ব। আমার তো কেবলই মনে হয় কতদি--ন দেখিনা বাবাকে...।
০৯ ডিসেম্বর (গতকাল) বাবা ছাড়া এক বছর হয়ে গেল আমার।
(গৌরিশ, ১১ ফেব্র“য়ারি ২০১১ আমরা তোমার বাসায় গিয়েছিলাম।)
মন্তব্য
বাবারা বুঝি এমনই হন।
হয়তো।
ভাগ্যবতী আপনি, তাও সময় পেলেন বাবাকে দেখার, এতো মনে রাখার। আমি পাইনি। উনার এবং সব বাবার আত্মার শান্তি কামনা করি।
সত্যিই ভাগ্যবতী আমি। বিয়ে হয়েছে বাসার কাছাকাছি তাই আট বছরের মাঝে মনে হয়না টানা এক সপ্তাহ বাবাকে না দেখে থেকেছি।
এ ধরনের পোস্ট পড়ে কষ্ট হয়। সবাইকে একদিন চলে যেতে হবে।
চিরসত্য। তবুও বড় কঠিন মেনে নেওয়া।
facebook
এতদিন পর লিখলেন তাও মনখারাপ করা একটা লেখা।
সব বাবারাই আসলে একইরকম তার সন্তানদের কাছে। বাবা চলে গেলেই কেবল আমরা বুঝতে পারি তিনি কতটা কাছের ছিলেন।
বাবাইর বাবা ঢাকা গেলে ফোনে যে কতবার বাবাগো বাবাগো বলে তার সীমা নাই। সামনে থাকলে সারাদিন হয়তো কাছেই পাওয়া যায়না।অপু হয়তো বোঝে তার প্রতি ছেলের টান। আমরা হয়তো কোনদিনও এমনটা বোঝাতে পারিনি।
চলে যাঁরা যান তাঁরা থাকেন ঠিকই, কেমন থাকেন কীভাবে থাকেন মাঝে মাঝে জানতে ইচ্ছে করে খুব...
আপনার লেখা আগে পড়া হয়নি। এবার একে একে পড়ে নেব।
ভাল থাকুন। সচল থাকুন।
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
আমি কিন্তু সবসময় ভাবি ওখানে আমার দুই বাবা (আমার বাবা চলে যাওয়ার ছয় মাসের মাথায় শ্বশুরও চলে যান) দিব্যি গল্পগুজব করছেন। আর আমি যখন মোনাজাতে দু'হাত তুলি তখন আমার সাথে সাথে তারাও কাঁদেন।
অনেকদিন পর আপনার পোস্ট দেখে ভাবলাম ঝাড়ি দিবো, পোস্ট পড়ে মনটা খারাপ হয়ে গেলো...
হায় ৯ ডিসেম্বর
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
মনটা খারাপ করে দিলেন রে ভাই।
ছোট থাকতে দাদার বয়সীদের চলে যেতে দেখেছি,এখন যেমন বাবাইরা দেখে। এবয়সে এসে খেয়াল করলাম বাবা মা'র বয়সীরা একে একে হারিয়ে যাচ্ছেন, ফাঁকে ফাঁকে বন্ধুবান্ধব্দের কেউও, বুঝতে পারি আমাদের সময়ও কাছাকাছি, সিরিয়ালে প্রায় চলে এসেছি।
ভালো থাকবেন।
...........................
Every Picture Tells a Story
তুলি আপা,
এত কষ্ট, এত মন খারাপ করা লিখা, দোয়া করি আপনার বাবার জন্য, আল্লাহ তাকে ভাল রাখুন। জানেন, আমিও বাবাকে স্বপ্ন দেখি, প্রায়ই, কাউকে বলিনা, খুব সাবধানে স্বপ্নগুলো নিজের মাঝেই রেখে দেই। babaবাবার কবরের পাশ দিয়ে প্রায় প্রতিদিনই বাড়ি ফিরি, মনটা হু হু করে ওঠে; এই কষ্ট শুধু বাবা-হারা সন্তানই বুঝবে; আর কেউনা।
মনটা খারাপ হয়ে গেলো। চোখও ঝাপসা হয়ে গেলো। বাবা-মা'কে কি ভোলা যায়! যায় না!!
বাবা-মা এখনো বেঁচে আছে, তাই হয়ত সেভাবে বুঝিনি কখনোই; তবে প্রবাসে এসে বোধগুলো কিছুটা তীব্র হচ্ছে! বাবা যখন সেই সুদূর থেকে মোবাইলে এখনো খাওয়া ঘুম নিয়ে উতকন্ঠিত হয়, চোখ ভিজে আসে!
বাবারা এমনই, যেমন আপনি দেখেছেন; বা আর কেউ। বাবারা আসলে বাবাই!! হায় আমরা সবাই যদি ঠিকমত বুঝতে পারতাম সময়কালে!!
ভালো থাকুক আপনার বাবা, অনেক ভালো।
আপনিও ভালো থাকবেন।
সব বাবারাই একরকম হয়।
অনেক অনেক অনেক দিন পরে তোমার লেখা পড়লাম।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
বুঝতে পারছিলাম কী নিয়ে লেখা... তাই আজকে সব শেষে পড়ার জন্যে ফেলে রাখা... আপনাদের কষ্ট বুঝতে পারার ক্ষমতা নেই, আমি বুঝি যে বাবাইরা এঁদের ছায়া থেকে বঞ্চিত হয়ে গেল...
কত দিন পরে লিখলেন... তাও যে লিখলেন...
___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।
_______________
আমার নামের মধ্যে ১৩
নতুন মন্তব্য করুন