সেই শত শত মেসন আর ব্যারিয়নই শুধু না, আরো গেরো ছিলো।
এমনিতে শ্রোডিংগারের সমীকরণ দিয়ে দিব্যি কোয়ান্টাম পার্টিকলের গতিবিধি বের করা যায়। ওয়েভ ফাংশন, এনার্জী -এসব বের করা যায়। একটু আনসার্টেনটি থাকে অবশ্য, কিন্তু সেতো থাকবেই। সেতো কোয়ান্টাম জগতের ফান্ডামেন্টাল ব্যাপার! পাওয়া যায় শুধু এক্সপেক্টেশন ভ্যালু,আসলে কি হচ্ছে জানা যায় না। এতো স্বীকৃত ব্যাপার! তো এই যে পাওয়া যায় এই তো অনেক। লোকে এতেই বহুকিছু সঠিক প্রেডিক্ট করে ফেললো! হাইড্রোজেন স্পেকট্রা ভালো করে বোঝা গেলো এই দিয়েই। কয়েকটা খটকা অবশ্য তখনও ছিলো বটে। কিন্তু মোটের উপর শ্রোডিংগারের সমীকরণ খুব সফল।
তবে প্রথম থেকেই একটা লিমিটেশান এর ছিলো, এটা নন-রিলেটিভিস্টিক। তাই খুব উচ্চশক্তির বা খুব উচ্চগতিবেগের যেখানে কিনা স্পেশাল রিলেটিভিটি লাগাতে হয়, সেসব সিস্টেমে এ সমীকরণ চলে না।
চলে না তো চলে না, রিলেটিভিটি লাগা বললেই লাগানো যায় নাকি? বহুত ঝামেলা!
বড় বড় দুরস্ত বিজ্ঞানীরা অনেকেই চেষ্টা করছিলো, কেউ পারছিলো না। বাঁদরের পিঠাভাগের মত এইদিক মেলে তো ঐদিক হড়কে যায়!
তারপর একদিন! শান্ত ধীরস্থির ছেলে পল ডিরাক, তার যে ভেতরে ভেতরে এত কেরদানি তা কে জানতো! তখন সে ছোকরামতন, বয়স কুড়ির ঘরের মাঝামাঝি। সে মিলিয়ে ফেললো! একদম ঠিকঠাক! নাকি সাতদিন ধরে ভেবে ভেবে সাজিয়ে সাজিয়ে দুইদিকের পাল্লা সমান করেছে!
আর যায় কোথা! তুড়িলাফ খেতে খেতে বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করতে লাগলেন। কিন্তু খুঁত পেলেন না অংকে।
ডিরাকের এই সমীকরণ ই জন্ম দিলো আরেক গন্ডগোলের। রিলেটিভিটি লাগানো আছে বলে এই সমীকরণে এনার্জীর এক্সপ্রেশন আসে বর্গমূলের আকারে। কে না জানে যেকোনো পজিটিভ সংখ্যার বর্গমূল থাকে দুইটা! একটা পজিটিভ, একটা নেগেটিভ! যেমন +৪ আর -৪ দুজনাই +16 এর বর্গমূল।
এখন একই কণার সমীকরণের সমাধান করতে গিয়ে একটা পজিটিভ আর একটা ঠিক তার সমান নেগেটিভ এনার্জী পাওয়া গেলে তার মানেটা কি হয়? অংকে খুত নাই, কিন্তু এ কি আপদ! বাস্তবে এইটা কি? কণার এনার্জী নেগেটিভ? মামদোবাজি নাকি? এ কি মামারবাড়ী যে যাখুশী বলে দিলেই হলো অংক করতে জানে বলে?
লোকে চেপে ধরলো, বলো এর ফিজিকাল ব্যাখা কি? আচ্ছা নাহয় তর্কের খাতিরে ধরি নেগেটিভ এনার্জী হতে পারে, কিন্তু তাহলে পজিটিভ এনার্জী স্টেট থেকে লাফ দিয়ে তোমার পার্টিকল নেগেটিভে নামে না কেন? তোমাদের এত সাধের কোয়ান্টাম থিওরি যে বলে সবসময় সিস্টেম সর্বনিম্ন শক্তিস্তরে নামতে চায়?
ডিরাক কি আর করবেন কোনোরকমে একটা কারণ দিতে চেষ্টা করেন, তিনি কন," নেগেটিভে নামতে পারে না কারণ সব নেগেটিভ স্তর একদম ঠাসাঠাসি ভর্তি। সমুদ্রের মতন। মাঝে মাঝে ওই ভরাভর্তি সমুদ্র থেকে উঠে আসে কণা পজিটিভ স্টেটে, সমুদ্রে তখন যে "হোল" হয়, সেই "হোল" দেখা দেয় আরেক কণারূপে, সে হলো বিপরীত কণা বা anti-particle."
লোকে মেনে নিতে রাজী ছিলো না, ঠাসাঠাসি ভর্তি নেগেটিভ এনার্জীর সমুদ্রের নাম দিলো "ডিরাক সী"- ডিরাকের সমুদ্র। খানিকটা ঠাট্টার ছলেই। এরকম একটা অদ্ভুত জিনিস মানতে কষ্ট হয় বৈকি!
কিন্তু মেনে না নিয়ে করে কি? কয়েক বছরের মধ্যেই যে ইলেকট্রনের বিপরীত কণা পজিট্রন আবিষ্কার হলো!
ক্রমে জানা গেলো সব এলিমেন্টারি কণারই বিপরীত কণা আছে! পাওয়া ও যেতে লাগলো!
সেই শত শত মেসন ব্যারিয়ন তো আছেই, আবার তার সংগে বিপরীত কণারাও! একা রামে রক্ষা নাই, সুগ্রীব দোসর!
মন্তব্য
খাইছে, এত প্যাঁচ!!!
কঠিন বিষয় সহজ ভাষায় প্রকাশের বিরল ক্ষমতা আপনার!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
তীরুদা'র সাথে একমত।
দুর্দান্ত লিখছেন।
কিন্তু আমাদের ক্লাশে যে কণা পড়তো... সেই কণার কথা কখন বলবেন?
আর
আমি জানি না...
আর ডিরাকের সমুদ্রটা কই? কোন মুল্লুকে?
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
নজরুল ভাই, আপনাদের ক্লাশের কণা তো ঠিক জায়গায়ই আছে। আপনারে সে নেগেটিভ এপ্রোচ দেখালেও আরেক জায়গায় ঠিকই পজিটিভ এপ্রোচ দেখিয়েছে ! একই কণার দুই অবস্থা ! ডিরাক সমীকরণ।
আর তাই আপনি এখন ডিরাকের সমুদ্রেই সাঁতরাচ্ছেন !
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
তীরন্দাজ, অনিকেত,ভাঙা মানুষ, রণদীপম আর নজরুল-আপনাদের বহু ধন্যবাদ। পরের পর্ব কিছুদিন পরে।
নজরুল, ডিরাকের সমুদ্রেই তো আছেন ভাই!
প্রত্যুষা!!
তাই তো বলি!!
----------------
...অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা...
------------
...অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা...
)
সামরানদি,বহুদিন ধরেই তোমার লেখা পড়ি এখানে!
যে স্বল্প কয়েকজন বিজ্ঞানীর প্রতিভা আমাকে আজীবন চমৎকৃত রেখেছে তাঁদের একজন পল আদ্রিয়েঁ মরিস ডিরাক, যার অবসরগ্রহণ ও যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে ইংল্যান্ড ত্যাগের আগে শেষ কোয়ান্টাম মেকানিক্স ক্লাসগুলিতে উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। মিতভাষী এই মানুষটি সম্বন্ধে একটা গল্প জানা ছিল । বৃস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ে তড়িৎপ্রকৌশল অধ্যয়নরত অবস্থায় সহপাঠীরা তাঁকে সেই ধ্রুপদী ধাঁধাঁটা দিয়েছিল ঃ তিন জেলে কিছু মাছ ধরেছিল। রাতে একজন ঘুম থেকে উঠে দেখল, তিনজনকে সমান ভাগ দিতে গেলে একটা ফেলে দিতে হয়। তাই করে নিজের ভাগ সে রেঁধে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। দ্বিতীয়জনও কিছুক্ষন পরে উঠে এক-ই অবস্থা দেখে একটা ফেলে দিয়ে নিজের ভাগ খেয়ে নিল। তৃতীয় জনও তাই। সবচেয়ে কম কত মাছ ধরা হয়ে থাকতে পারে? ডিরাকের উত্তর ছিল ঃ মাইনাস ২।
লোকে বলে ডিরাক এই মাইনাস মাছের ধারনাটা তাঁর সমীকরণের সমাধানেও ব্যবহার করেছেন, যেখানে ঋনাত্মক শক্তির এন্টি-কণা থাকতে পারে। সম্ভবত গল্পই।
একবার ফাইন্ ম্যান এক সম্মেলনে ডিরাকের কাছে গিয়ে বললেন ঃ আমার নাম ফাইনম্যান; ডিরাক উত্তরে বললেন, আমার নাম ডিরাক। এর পরে পাঁচ মিনিট সামনে দাঁড়িয়ে থেকেও আর কোন কথা বার না করতে পেরে ফাইনম্যানকে বিদায় নিতে হল।
ফাইনম্যান ও অন্যান্যরা অবশ্য কোয়ান্টাম মেকানিক্সের পরবর্তী পর্যায়ের, অর্থাৎ কোয়ান্টাম ক্ষেত্রতত্বের, জন্ম দিয়েছেন, যেখানে তরংগ-অপেক্ষককে কণা সৃষ্টি ও ধ্বংস অপারেটরের সাহায্যে লেখা হয়। সেখানে ডিরাকের ঋণাত্মক শক্তির সমুদ্রের দরকার নেই।
আমি তাঁর বক্তৃতা থেকে খুব উপকৃত হয়েছি বলতে পারিনা, কারণ সেগুলো ছিল হুবহু তাঁর বিখ্যাত বইয়ের ভাষ্য, যা আমার আগেই পড়া ছিল। পরে শুনেছি একজন এ বিষয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কেন তিনি পরিবর্তন করেন না। উত্তর ছিল , কারণ আমার বইটা পার্ফেক্ট।
বইয়ের বিষয়ে অনেকের দ্বিমত থাকতে পারে, কিন্তু ডিরাকের সমীকরণের চেয়ে সুন্দর সমীকরণ বিজ্ঞানের আর কোথাও আমি দেখি নি। এছাড়াও ফার্মি-ডিরাক স্ট্যাটিস্টিক্স, মনোপোল, ইন্টার-একশন চিত্র ইত্যাদি অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এই অসাধারণ মানুষটির অবদান আছে।
আরে!!!!আপনি ডিরাকের কাছে পড়েছেন?
দারুণ ব্যাপার!
সেইসব নিয়ে আপনার স্মৃতিচারণ পড়ার অপেক্ষা রইল।
নতুন মন্তব্য করুন