পরিচিত মাঠ, বন, নদী, পাহাড়, ঝর্ণা সব কিছু ছেড়ে উড়াল দিয়েছিলাম, সুখপালকের পাখিরা যেদিকে থাকে, সেইদিকে। চেনাজলের শেষকণাও ঝেড়ে ফেলেছিলাম ডানা থেকে।
অনেকটা পথ ওড়া, নীচে কখনো ডাঙা কখনো জল। তারপরে পৌঁছাই, অচিনগাছে বাসা বাঁধি, ফল ঠোকরাই, খাই আর ভাবি কোথায় সেই সুখপালকের পাখিরা?
চেনা-চেনা পাখিদের দেখি মাঝে মাঝে, ছোটো ছোটো দলবাঁধা ছাতারে, ওরা সবসময় দলবেঁধে থাকে আর খুনসুটি কি ঝগড়াঝাঁটি করে, ওদের পালকে কেমন যেন দুঃখী ধূসর রঙ! আমি উড়ে পালাই অন্যদিকে।
তবু কেজানে কেন আর কিসের দায়ে বারে বারে ফিরে আসি উত্তরের পাহাড়ে! সব সুখদুখমন্থন করে সেই যে আমাদের প্রাচীন পাখি গেয়েছিলো নিদ্রাহারা গান, সেই গানের মায়াটানে। আমি সবকিছু এড়াই, তবু একে এড়াতে পারিনা কেন? দুঃখবালি মাখবো না বলে কত পথের আলাপ পথেই রেখে চলে গেছি, ভেতরের ওই অন্ধকার আমার চেনা বলে সেখানে যাই নি কখনো, সুকৌশলে এড়িয়ে গেছি আমন্ত্রণী হাসি। কিন্তু এই পাহাড় কেন ভুলতে পারিনা? কেন এখানে ফিরে আসি বারবার?
নিদ্রালু চোখে চুপ করে বসে থাকি নীলকদম্বের ডালে, বাতাসে ভেসে আসে সেই গান, প্রাচীন পাখি যে গান গেয়ে গিয়েছিলো কতযুগ আগে, কুলহারা সমুদ্রের মত সে গান, দিগন্তে নত হয়ে পড়া আকাশের হৃদয় থেকে ভেসে আসে সেই গান। আমি নড়তে চড়তে পারিনা, চুপ করে ঝিম হয়ে বসে থাকি যেন মহুয়াফুলের মধু পান করেছি আকন্ঠ।
বন্ধুরা বলে এই করেই নাকি আমি মরবো। ওই পাহাড় এক মস্ত ফাঁদ। ওই গানের মায়ায় ভুলিয়ে শিকারী বিঁধবে আমায় তীরে! আমি শুনি, বুঝি, কিন্তু কিছুই করতে পারিনা, যেই না সেই গানের রেশ শুনি বাতাসে, অমনি প্রাণপণে ডানা নাড়তে নাড়তে এসে পৌঁছাই পাহাড়ে, হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বসি নীলকদমের ডালে, তারপরে বুঁদ হয়ে যাই সেই গানে। কোথা দিয়ে যে প্রহরের পর প্রহর কেটে যায়, কোনো হুঁশ থাকে না আমার।
বন্ধুরা বলে, "ওসব মনের ভুল। আসলে কোনো গান নেই। ও মায়া, ও শুধুই মায়া। বাঁচতে চাস তো যাসনে আর ওখানে।"
আমি শুনিনা, আমি তবু যাই, আমি শুনতে পাই যে গান! অকুল সমুদ্রের মত সে গান, দিগন্তে নত হয়ে পড়া আকাশের হৃদয় থেকে ভেসে আসে সেই গান- কেমন করে বলি ও সত্য নয়,মায়া?
একদিন পাহাড় থেকে ফিরছি ঘরে, বেশ রাত, দখিনা হাওয়া ঝুরুঝুরু করছে জারুলের ডালে ডালে, রক্তকাঞ্চনের পাতায় পাতায়। আকাশে ফালি চাঁদ বেশ পুরুষ্টু হয়ে উঠেছে, নারিকেলের পাতায় পাতায় পিছলে পড়ছে রুপোগলা আলো। হঠাৎ দেখা হলো এক চেনা পাখির সঙ্গে, আমি অবাক হলাম- সে একা! ওরা তো কখনো একা থাকে না!
সে কুশল সংবাদ জিজ্ঞেস করে, আমিও করি। আমরা কথা বলি পাশাপাশি উড়ে চলতে চলতে, অনেকক্ষণ কথা বলি, অনেকটা পথ উড়ি পাশে পাশে, একসময় সে বিদায় চায়, অন্যপথে উড়ে যায় একা একা। আমি আবার ভাবি এ কেন একা ছিলো আজ? ওরা তো কখনো একা থাকে না!
তারপরে ভাবনাচিন্তা মুছে ফেলে টলটলে জলের দিঘির উপর দিয়ে উড়ে যেতে যেতে দেখি জলের ভিতরে চাঁদ! আমার মতন আরেক পাখিও উড়ে যাচ্ছে জলের ভিতর দিয়ে। জলের ভিতরে কি আরেক দেশ আছে? চেনাজানা সবকিছুই কি সেখানে আছে উল্টা হয়ে?
কনকনে একটা হাওয়া কোথা থেকে এসে আমায় ছুঁয়ে যায়! এখন তো এই হাওয়ার সময় নয়! এ তো সেই নিঠুর হাওয়া যা ধারালো ক্ষুরের মতন বনের সব পাতা ঝরিয়ে দেয়! এখন এ হাওয়া এলো কোথা থেকে?
সেই অদ্ভুত অকাল শীতবাতাসের ঝাপটা চোখেমুখে নিয়ে ফিরে আসি বাসায়, কোমল আস্তরণের মাঝে সঁপে দিই নিজেকে, উষ্ণ পালকের মধ্যে মুখ গুঁজে চোখ বুজি। আধোঘুমে আধোজাগরণে ভাবি কোথায় থাকে সেই সুখপালকের পাখিরা?
কিন্তু ঘুম আসে না চট করে। চোখ মেলি। হাওয়া শন্শন্ করে বয়ে যায় বনের ভিতর দিয়ে, চাঁদের রূপালী আলো চিকমিক করে ঝোরার জলে, ঝুঁকে থাকা ফার্ণের পাতায় জলের বিন্দু লেগেছে, তাতেও ঝিকমিক করে জোছনা। আমার মনে পড়ে বহুদূর উষ্ণ দেশের বনকুঞ্জের কথা, তাতেও এমন জ্যোৎস্না পিছলে পড়তো শুক্লপক্ষ রাতে। ভাবতে ভাবতে আমি ঘুমিয়ে যাই।
(চলবে)
মন্তব্য
ধূসর গোধূলি,
আর কারে বা সামনে পাই, আফনেরেই তাই জিগাই-এই লেখাটা কি বেশী "শক্ত" হইয়া গেলো?
আপনি তো আপনার ঝোলা থেকে একের পর এক ম্যাজিক বক্স বের করা শুরু করেছেন।
গল্পের বিচার সবটা পড়ে করব; কিন্তু এমন ঝিম ধরানো গদ্য খুব বেশি পড়িনি।
---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!
---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!
-
শক্তমত্ত নিয়া একটা কমেন্ট করতে আইসা দেখি আপনে নিজেই আমার নামে কমেন্ট কইরা বইসা আছেন!
বলি, আপনার সচলচারণ কি শেষ? (ইরাকসমুদ্র টাইপের লেখা যে শুরু করলেন!) কতো কষ্ট হৈছে যে পড়তে!
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
ইরাকে এতকাল সমুদ্রের অভাব ছিলো। এইবার তাও হয়ে গেলো। )
কিন্তু তাইগ্রিস ইউফ্রেতিসের কি হবে?
তাইগ্রিসের পারে ঘুরে বেড়ানো সবুজ বাঘেরই বা কি হবে?
চলুক...
চলা শেষ হলে বলবো।
এটুকুর জন্য বলি...
১. লেখক নিজে পাখি হলে বুঝি এতবার পাখি পাখি করে পাখি পরিচয় ব্যাখ্যা করতো না।
২. গল্পের ভাষাটার সাথে কয়েকটা শব্দ (যেমন জিগায়) একটু খাপছাড়া লাগলো, হয়তো আমার চোখেই...
আপনি দেখি সব্যসাচী লেখক, আর মুফতে বিজ্ঞানী... এর পরে আর কি কি পরিচয় যে বের করবেন আল্লা মালুম।
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
হে হে!
আসলে সোজা কইরা লিখতে গেছিলাম।
আবেশ মাখানো লেখা।
সুন্দর।
...........................
সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
সুন্দর, সবসময়কার মতোই।
তবে, তুলি, ওই যে- 'জিগায়' আর 'জিগাই'-এর বদলে 'শুধায়' আর 'শুধাই' হ'লে বুঝিবা আর একটু নিপাট নিটোল হ'তো।
চলুক। ভালো চলুক। পাঠক চাতক থাক্ প্রতীক্ষায়।
_ সাইফুল আকবর খান
অপূর্ব !
----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি
ধন্যবাদ আশালতা।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
আবেশ ছড়ানো লেখা এবং সেইসাথে খুব কোমল একটা ভাব। চমৎকার! তুলিরেখা, আপনার তুলিতে তুলিতে যেসব লেখা আসে তার প্রকাশ চলুক এবং আমাদের আবেশিত করতে থাকুক। শুভেচ্ছা, তানিম এহসান
আমি অবাক। এ যে সুপ্রাচীন এক পোস্ট!
এখনও সেগুলো বার করে কেউ পড়ছে জানলে এক অদ্ভুত আনন্দ হয়।
অনেক ধন্যবাদ নেবেন।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
নতুন মন্তব্য করুন