পাশের ডালে একটা বাসা, সেখানে থাকে এক ভিনদেশী পাখি। সে কথা কয় না বিশেষ, কতটুকুই বা দেখা হয় আমাদের! আমি উড়ে বেড়াই, খাবার খুঁজে বেড়াই, ঝুপ করে জলে পড়ি মাছ ধরার জন্য-বেশ স্নানও হয়ে যায়! নয়তো পাহাড়ে যাই, সেই অলৌকিক গানের পাহাড়! শুধু ফিরে আসি রাত্রের ঘুমটুকুর জন্য।
পাশের বাসার পাখির সঙ্গেও তাই তেমন আলাপ-পরিচয় হয় নি। সেতো বেশী কথাও বলে না, নইলে হয়তো নিজেই এসে একফাঁকে বন্ধু হয়ে যেতো! অবশ্য আমি নিজেও যেতে পারতাম বৈকি! কিন্তু সে কিনা ভিনদেশী, হয়তো তার কথাও সহজে বুঝবো না! কী দরকার বাপু ঝামেলার! তারচেয়ে যেমন আছি, তেমনই থাকি! এইসব ভেবে ভেবে আর আলাপ-পরিচয় তেমন হয় নি! আজকের স্বপ্নভাঙা রাতে হঠাৎ মনে হলো বন্ধুত্ব থাকলে মন্দ হতো না!
নেশাধরানো জ্যোৎস্নায় ডুবে আছে সবদিক। আমি উপরে তাকাই, অফুরাণ আকাশে চাঁদের আলো ছাড়িয়ে আছে হাওয়াহাল্কা রূপোলী জরির ওড়নার মতন, ফুটকি ফুটকি কয়েকটা তারাও জ্বলছে। চাঁদনি রাতে বেশী তারা দেখা যায় না, যে রাতে চাঁদ থাকে না, সেই নেইচাঁদ রাতে আকাশে তারায় তারায় ঠাসাঠাসি লেগে যায়।
ভিনদেশী পাখি ডানা ঝাড়া দেয় ওর বাসায়, সেও জেগে গেছে। আমি ছোট্টো করে ডাক দিই। "এই যে শুনছেন, আপনি কি জেগে আছেন?"
ঘুমঘুম গলায় সে বলে, "জেগে গেলাম, আপনিও জেগে যে!"
- "আমি ঘুমিয়েছিলাম, ঘুম ভেঙে গেল। জেগে উঠে অবশ্য লাভই হলো। এমন জ্যোৎস্না!!! আপনি আগে দেখেছেন এমন আশ্চর্য জ্যোৎস্না?"
সে উদাসীন গলায় বলে, "কত দেখেছি। খোলা মাঠের ধারে গাছে বাসা বেঁধে থাকতাম। সে গাঁয়ের মাঠের দুধেল জ্যোৎস্না দিকদিগন্ত ভাসিয়ে দিতো। এ আর এমন কী বা জ্যোৎস্না!"
আমি একটু ক্ষুব্ধ হই, বলি,"তাই নাকি? কোথায় সে গাঁ?"
এবারে ওর উদাসীন স্বরে দু:খ মিশে যায়, দক্ষিণের দিকে ডানা ছড়িয়ে দিয়ে সে বলে, "ওওওও ই দিকে। অনেক পাহাড়,বন, নদী, মাঠ,ঘাট, ঝর্ণা পার হয়ে ছিলো আমাদের গাঁ।"
- "ছিলো? এখন আর নেই?"
"নাহ, সে গা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। বনে আগুন লাগলো তো! বিরাট দাবানল। সবাই পালিয়ে গেলো। আমরাও।"
_আস্তে করে বলি, "আমি জানতাম না, মাফ করে দিন। আপনার দু:খ হবে জানলে আমি কখনো জিগ্গেস করতাম না।"
"নাহ, মাফ চাইবার কী আছে? আর, এতদিন পরে আজ আর দু:খ কীসের? ছিলো সেদিন দু:খ, যেদিন আমাদের সদ্য ডিমফোটা চারটি অসহায় শিশু আগুনে পুড়ে গেলো। ওদের মা চাইছিলো না ওদের ছেড়ে আসতে, কিন্তু ওরাই বললো নিজের শক্তি থাকতে কেন পুড়ে মরবে মা? পালাও। আমরা পরের বছরেই আবার তোমাদের ঘরে ফিরে আসবো নতুন হয়ে।"
আমি স্তব্ধ হয়ে যাই, চুপ করে চেয়ে থাকি ওর দিকে। সে একটুক্ষণ থেমে থাকে, তারপরে আস্তে আস্তে বলে, "ওদের মা পালিয়ে এসেছিলো আমার সঙ্গে, কিন্তু সন্তানশোক সইতে পারলো না, অসুখ হয়ে মরে গেলো। আমি বেঁচে রইলাম, একা একা। ভুলতে চেষ্টা করি, খাই দাই বেড়িয়ে বেড়াই, কিন্তু ভুলতে পারিনা।"
আমি কী বলবো বুঝতে পারিনা, সুখপালকের পাখির দেশে এ কী ভয়ঙ্কর কাহিনী! আমার ইচ্ছে করে কিছু সান্ত্বনার কথা বলি ওকে, এমন কিছু যা ওই ভয়ানক দু:খের কিছুটা হলেও প্রশমন করে! কিন্তু কিছু বলতে পারিনা। বোবা হয়ে বসে থাকি। সব ভাষা যেন ভুলে গেছি, যেন কোনো বাক্য শব্দ কিছুই ছিলো না আমার কোনোদিন!
এমন সময়! ঠিক সেই মুহূর্তে! আকাশভরা জ্যোৎস্নাকে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতন কাঁপিয়ে দিয়ে বেজে উঠলো সেই অলৌকিক সঙ্গীত! সেই সব সুখদুখমন্থন করা গান! নিদ্রাহারা, কুলহারা গান! সুপ্রাচীন অলীক পাখির সেই গান!
আমি কানখাড়া করি, সেও করে। শুনতে পেয়েছে, সেও শুনতে পেয়েছে! মায়া নয়, মায়া নয়! সে আমার দিকে তাকায়, বলে," গান? কোথায় হচ্ছে? আপনি শুনতে পাচ্ছেন?"
আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতন মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলি। বলি, " আমার এখনই যেতে হবে, ওই পাহাড়ে, ওখান থেকে ভালো শোনা যায়।"
সে বলে," আমিও যেতে চাই, আমাকে সঙ্গে নিন।"
আমরা দুজনে উড়াল দেই, জ্যোৎস্নাভরা আকাশ দিয়ে ভেসে চলি গীতপাহাড়ের দিকে, দু:খজল শিশিরের মতন ঝরে যায় আমাদের ডানা থেকে। আমাদের চারিপাশে উপরে নীচে ছড়িয়ে যেতে থাকে অনন্ত রাত্রির পালক, সীমাসংখ্যা পেরোনো পালকেরা, তার নরম ওমের মধ্যে নিজেদের সমর্পণ করে দিয়ে বসি নীলকদমের ডালে।
আকাশ ভরে, বাতাস ভরে, জলস্থলের হৃদয় ভরে ছড়িয়ে পড়তে থাকে সেই অলৌকিক সুরের সুধা- "বহে নিরন্তর অনন্ত আনন্দধারা/ জাগে অসীম নভোমাঝে অনাদি সুর ......"
(শেষ)
মন্তব্য
হুমম...
অতপর তাহারা সুখে শান্তিতে বাস করিতে লাগিলো?
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
আরে নজরুল! কি কন! সব কি আর রূপকথা হয়?
বাস্তবে দেখা যায় ফার্দিনান্দের ফান্দে পড়ে মিরান্দা কান্দে। সরলসোজা ক্যানিবলই ভালো ছিলো-মনে মনে ভাবে। মিরান্দা তার "ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড" এর আসল মুখ দেখে পালাতে চায়, দূর দ্বীপে ক্যানিবল আখ খেতে খেতে হাসে।
মিশটেক মিশটেক।
ওটা ক্যালিবান হবে।
হ্যাঁ, চিন্তায়ই ছিলাম- সুখপালকের দেশে সুখ হবে কি না শেষে!
'অতঃপর তাহারা'র একটা কিউ তাহ'লে পাওয়া গ্যালো স্বস্তির সুরে।
সুন্দর লেখা, তুলিরেখা।
রূপকথা-যথার্থ রূপবতী লেখা।
ধন্যবাদ। ভালো থাকুন।
_ সাইফুল আকবর খান
ভীষন মিষ্টি করে স্বপ্ন মিশিয়ে লেখা।
শেষের পর্বটাই সবচে সবচে বেশি ভাল্লাগলো।
আপনার বর্ণণার ভঙ্গি খুবই চমৎকার।
...........................
সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
দারুন লিখেছেন...
আপনারা যারা কষ্ট করে এতদিন ধরে ধৈর্য রেখে পড়লেন ও কমেন্টালেন , সবাইকে যথার্থ ধন্যবাদ।
পরের ধারাবাহিক আসিতেছে।
- বাহ্ শেষ হলো তাইলে।
মাছরাঙার স্বপ্নভাঙাতে একটু নাড়া লেগেছিলো, পিষুয়ে গেছে জ্যোৎস্নার রূপকে অমন অপরূপভাবে দেখার ক্ষমতায়। একই সুরে বাধা যে সঙ্গীত-লয়, তার উৎসপানেই মূর্ছণা। পরের ঘটনা সপ্তসুরের শেষটার মতো! অনেক বাঁদাড়-ঠিকানা ঘুরে এসে পরিণতি ঘটে একই বিন্দুতে। সম্ভবতঃ প্রতিটা সম্পর্কের পরিণতিও তাই। তবে, সময়ের প্রয়োজনে বেশিরভাগ সম্পর্কই সপ্তসুরের নিয়তি পায় না।
সিরিজটা ভালো লাগছে। এইবার এইসব কঠিন কঠিন বাক্যবন্ধ থুইয়া আবার সোজা কিছু লেখা ধরেন দেখি।
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
অনেক ধন্যবাদ, ধূ গো।
নতুন মন্তব্য করুন