রণজয়

তুলিরেখা এর ছবি
লিখেছেন তুলিরেখা (তারিখ: বুধ, ২৬/১১/২০০৮ - ৬:৪৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আকাশটা কী তীব্র নীল! সাদা কাপড় ঘষা দিলে যেন নীল রঙ উঠে আসবে! একটুকরো মেঘ কোথাও নেই। হেমন্তের আকাশে শিরশিরে শীত, পুরানো পাতারা ঝরে যাচ্ছে। এমনই অভিমানী হেমন্তের দিন ছিলো সেদিন। রণোর চলে যাবার দিন।

প্রিয়তোষ চুপ করে বসে থাকে বারান্দায়, সে এরকমই বসে থাকতো ও দেরি করে এলে যাতে হাতে নাতে ধরতে পারে। পশ্চিমের আকাশে ঢলে পড়েছে সূর্য, বেলা ফুরিয়ে এলো। চশমাটা ঝাপসা হয়ে গেছে, সে চশমা খুলে মুছতে থাকে। নির্মলা চা নিয়ে আসে, প্রিয়তোষ চেয়ে থাকে ফাঁকা চোখে। আরো কার যেন আসার কথা ছিল?

"চলো ভিতরে চলো, এখানে ঠান্ডায় আর থেকো না। চলো।" কে বলছে? নির্মলা? হ্যাঁ নির্মলাই তো! প্রিয়তোষ আর কার গলা শোনার জন্য কান খাড়া করে ছিলো?সে কি পাগল হয়ে যাচ্ছে? মাঝে মাঝে সে কেন তার গলা শুনতে পায়?

রণো কুন্ঠিত গলায় আস্তে আস্তে বলছে,"ফিরতে দেরি হয়ে গেলো বাবা। মাফ করে দাও। সারাদিন কিছু খাই নি, খুব ক্লান্ত। আজকে কিছু বোলো না।"

ঠোঁট নড়ে প্রিয়তোষের, "আয় খোকা, তোর জন্য মিষ্টি এনেছি। কিছু বলবো নারে, আয়। তোর মা মিষ্টি বেড়ে দেবে আমাদের, একসাথে খাবো,আয়।"
রণজয় ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে, একপাও এগিয়ে আসে না। প্রিয়তোষ এগিয়ে যায়, বলে,"কীরে কী হল? সত্যি সত্যি দিচ্ছি। আর তোকে কখনো কিছু বলবো না খোকা। তুই কাছে আয়।ভয় পাস না। কিছু বলবো না তোকে।"

রণজয় অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে,বলে,"আমি চলে যাচ্ছি বাবা, মাকে বোলো আমি তোমাদের সবাইকে ভালোবাসতাম। ভাইকে আর বোনকেও বোলো। তোমাদের সাথে থাকতে আমার অনেক ইচ্ছে ছিল। যদি আমায় ওরকম না করতে! তোমরা তো আমায় দেখতে পারোনা, ভাইবোনদের সাথে আমায় খেলতে দাও না। ঠিক আছে, আমি চলে যাচ্ছি। তোমরা ভালো থেকো।"

মিলিয়ে গেল রণজয়, প্রিয়তোষ চিত্‌কার করে উঠতে চায়, কিনতু গলা দিয়ে শব্দ বেরোয় না। তারপরে শোনে,"কী হল তোমার? স্বপ্ন দেখেছ? বোবায় ধরেছে? উঠে বসো, উঠে বসো।" নির্মলার গলা। ও:, স্বপ্ন! সব স্বপ্ন! স্বপ্ন এত স্পষ্ট হয়?

প্রিয়তোষ উঠে বসে, গলা শুকিয়ে কাঠ। জল চায়। জল এনে দেয় নির্মলা। জল খেয়ে সে বলে,"স্পষ্ট দেখলাম খোকাকে। আমি মিষ্টি খাওয়াতে চাই, ও আসে না, ভয় পায়। তারপরে চলে গেল।" প্রিয়তোষের চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ে, সে বলে,"আমাকে এত স্বপ্নে দেখা দেয় কেন বলোতো? আমি কত কষ্ট দিয়েছি বেচারাকে। তোমার ওকে মনে পড়ে না? তুমি ওকে স্বপ্নে দেখোনা? তুমি যদি ছোটো দুটোর মত ওকেও একটু আগলে রাখতে .....তাহলে হয়তো আমি ওকে বোকার মতন ওভাবে.... তুমি ওর নামে কত নালিশ করতে, আর আমিও ওকে কিভাবে....আহ, কিছু বলতো না শেষদিকে, আমার সামনে কাঁদতো ও না। ওর ভাইবোনে কত আবদার করতো পুজোর সময় জামাটামার জন্য, ও কিছু চাইতো না। একবার জিগ্গেস করেছিলাম কিছু বিশেষ জামাটামা ওর চাই কিনা, কেমন আস্তে আস্তে বলেছিলো -"তোমার যা ইচ্ছা তাই দিও।" কেমন করে প্রণাম করতো দশমীর দিন, পায়ের পাতায় মাথা ছুঁয়ে। আমরা ওকে বুঝতে পারিনি নির্মলা...."

নির্মলা কেঁদে বলে, "তুমি এমন কোরোনা।কেন শুধু নিজের উপরে সব নিচ্ছ? আমার দোষও তো কিছু কম না। মা হয়ে ওকে কষ্টের দিকে ঠেলে দিতাম। ছোটন আর মিতিনকে একবার নাকি বলেছিলো ওর কেউ নেই। আমরা নাকি ওকে অনাথ আশ্রম থেকে এনেছিলাম। তুমি বারণ করতে বলে কত রাতে ওকে খেতে দেই নি। কিছু বলতো না, চাইতো ও না খেতে। মিতিন নাকি একবার লুকিয়ে খাবার নিয়ে দিয়েছিলো, ও নেয় নি, বলেছিল, বাবা তোকে বকবে বোন।" নির্মলা চোখে আঁচল দেয়।

প্রিয়তোষ বলে,"মনটা শান্তি পায় ন। চলো রণোর নামে কোথাও কিছু দিয়ে আসি আমরা।"

নির্মলা বলে,"দিও। এখন ঘুমাও। যদি ছোটন মিতিন শোনে তুমি ঘুমাতে পারোনা, ওরা দু:খ পাবে। মিতিন বলছিলো রণো ওকে ছবি এঁকে দিতো আর ছোটনকেও দিতো। তুমি ওদের সঙ্গে খেলতে বারণ করেছিলে বলে খেলতো না ও। তারপরে তো ..... মিতিন বলছিলো, ওর সঙ্গে খেলা করতে ওদের খুব ইচ্ছে করতো। বলছিলো দাদা একা বলেই তো আমরা এসেছিলাম মা, ওর খেলার সাথী কেউ ছিলো না কিনা! এবারে আমরাও চলে যাই তাহলে?"

প্রিয়তোষ চমকে ওঠে, "এইসব বলে ওরা? তুমি ওদের বুঝিয়ে বোলো। ওদের তো কোনোদিন আমরা কিছু কষ্ট দেই নি! কোনোদিন ওদের কিছু বলবো না। চলো সবাই মিলে দূরে কোথাও বেড়াতে যাই, রণোর নামে কোথাও কিছু দিয়ে আসি।"

"আচ্ছা, তাই হবে। এখন তুমি ঘুমাও তো দেখি।"

প্রিয়তোষ শুয়ে পড়ে, চোখ বন্ধ করতেই নীল আকাশভরা সোনালী আলো, তারমধ্যে রণজয়ের অভিমানী মুখ ফুটে ওঠে,কি যেন সে বলে। প্রিয়তোষ বিড়বিড় করে,"আহা তুই আলোর ছেলে, ভালোবেসে এসেছিলি আমার ঘরে, রাখতে পারলাম না হতভাগ্য আমি। কষ্ট পেয়ে ফিরে গেলি। মাফও চাইতে সময় পেলাম না। একদিন তো দেখা হবে, সেদিন মাফ চাইবো। মাফ করে দিস খোকা সেদিন। করবি না? "

আকাশভরা আলোয় বিশাল থেকে বিশালতর হয়ে ওঠে দুটি অভিমানী চোখ, তাতে শিশিরে মতন অশ্রু, টপটপ করে ঝরে পড়তে থাকে প্রিয়তোষের বন্ধ চোখের পাতার উপরে। কানে আসে সেই শেষমন্ত্র, "মধুবাতা ঋতায়তে/ মধুক্ষরন্তি সিন্ধব:/ মাধ্বীর্ণ সন্তোষধী...." ওই মধুময় বাতাসের সঙ্গে সে মিশে গেছে। সে আলোর ঘরে ফিরে গেছে।

(শেষ)


মন্তব্য

ধুসর গোধূলি এর ছবি
কীর্তিনাশা এর ছবি

আবারো বলে যাই -
আপনার লেখার হাত খুব ভালো।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

নিবিড় এর ছবি

গদ্যে আপনার ভাষার ব্যবহার আমার সবসময় ভাল লাগে আজও লাগল ।

অনিন্দিতা এর ছবি

পড়তে গিয়ে কেন জানি বার বার চোখ ঝাপসা হয়ে গেল!

তুলিরেখা এর ছবি

ধূসর গোধূলি,
অনেক ধন্যবাদ। আসলে লেখাটা উঠে যাবার পর দেখলাম যা বলতে চাওয়া হয়েছিলো
তার শতাংশের একাংশ ও বলা হয় নি। এইধরনের সব লেখাতেই এরকম হয়েছে আমার। চেষ্টা করেও আমি তীব্র রঙ দিতে পারিনা। জানি তাহলে ঘেঁটে যাবে। অথচ আসল বক্তব্য বলতে গেলে গাঢ় লাল রঙ চাই। আরো অনেক বেশী শক্তিশালী কলম দরকার, যে কিনা বিপরীত রঙ গুলো মেশাতে পারে অনায়াস দক্ষতায়। এই ধরনের লেখার পরে প্রতিবারেই একটা নিমপাতা-অতৃপ্তি জড়িয়ে যায় আমার জিভে।
ভালো থাকবেন।
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

ধুসর গোধূলি এর ছবি

... তথাপি লেখাটা আগুনের কাছাকাছি হয়েছে। আপনার ভাষায় 'লাল রঙ'-এ রাঙা হলে কেমন হতো সেটা অনুভব করতেই শিহরিত হচ্ছি।
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক

তুলিরেখা এর ছবি

কীর্তিনাশা,
আপনাকে ধন্যবাদ। পাঠকের ভালোলাগাই সবচেয়ে বড় পুরস্কার।
ভালো থাকবেন।
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

তুলিরেখা এর ছবি

নিবিড়,
আপনার ভালো লেগেছে জেনে আমার খুব ভালো লাগলো।
আনন্দে থাকবেন।
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

তুলিরেখা এর ছবি

অনিন্দিতা,
আমারও। লিখতে গিয়ে চোখ ঝাপসা হয়েছে বারে বারে, লেখার অনেক জায়গা মুছে দিয়েছি।
আপনাকে ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

তানবীরা এর ছবি

কেনো ছেলেটাকে এতো কষ্ট দিলো বাবা - মা, সেটা জানাবেন কি?

তানবীরা
---------------------------------------------------------
চাই না কিছুই কিন্তু পেলে ভালো লাগে

*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়

তুলিরেখা এর ছবি

তানবীরা,
মানুষের কোনো কোনো কাজের যুক্তি থাকে না, বহু দু:খ তো সেইজন্যই! একই ভুল, পরিণামে একই হাহাকার। অথচ মানুষের জীবন এইরকমই।
মানুষ যদি জানতো সে যখন অন্যকে আঘাত করে, তখন নিজেকেই আসলে আঘাত করে, তাহলে কি সে করতো? সময়ের হাত থেকে সে পালাতে পারবে না সে কি মানুষ জানে না? তবু করে, পরিণামে সেই একই দুঃখ।
একবার এক ক্লাস থ্রীর ছেলে পত্রিকার ছোটোদের পাতায় "শিক্ষিকাকে সমস্যা জানাও" অংশে লিখেছিলো- বাবা মা তাকে বলে তার পড়াশোনার পিছনে এত খরচ! পড়শুনা থেকে তার মন একটু অন্যদিকে গেলে বাবা তাকে বেল্ট দিয়ে মারে। চিঠির শেষ লাইন ছিলো-"আমার মনে হয় আমার মরে গেলেই ভালো।"
শিক্ষিকা নানাবিধ সান্ত্বনা দিয়ে উত্তর দিয়েছিলেন,বলেছিলেন বিদেশে হলে তার বাবার শাস্তি হতো।(আমাদের দেশে তো কোনো প্রতিকার নেই!)
বেশ কবছর হয়ে গেছে। এতদিন পরেও আমার কেবল মনে হয় কি হলো সেই ছেলের? ওই অল্পবয়সে সে আত্মহত্যার কথা ভাবছিলো!
ভালো থাকবেন, ভালো রাখবেন।
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

সাইফুল আকবর খান এর ছবি

যথেষ্ট গাঢ়লাল হয়েছে। আপনার 'নিমপাতা-অতৃপ্তি'কেও সত্য স্বীকার ক'রেই বলছি, যতোবার পশম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গ্যাছে, প্রতি শিহরণের কসম দিয়ে বলছি- ছুঁয়ে গ্যাছে, অন্যান্যবারের চেয়েও আরো একটু বেশিই যেন! লেখার মনস্তাত্ত্বিক জমিন-টা অনেক বেশি তীক্ষ্ন আর ঋদ্ধ ব'লেই বুঝি-বা!
ধন্যবাদ। হাসি

-----------------------------------
"আমার চতুর্পাশে সবকিছু যায় আসে-
আমি শুধু তুষারিত গতিহীন ধারা!"

___________
সবকিছু নিয়ে এখন সত্যিই বেশ ত্রিধা'য় আছি

তুলিরেখা [অতিথি] এর ছবি

ধন্যবাদ আমার পক্ষ থেকেও।

তুলিরেখা [অতিথি] এর ছবি

পুরানো পাতায় ঘুরতে ঘুরতে দেখি জবাব দেওয়া হয় নি। তাই দেরিতে হলেও জবাব দেওয়া হলো আজ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।