৩
বেল বাজছে, অনুরাধা আস্তে পায়ে এগিয়ে যায় দরজার দিকে। দরজা খোলে, অনন্তজীবন। রিটায়ারের পরে মানুষটা নানা কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখে। আত্মীয়স্বজনের মধ্যে যারা কাছাকাছি থাকে আর বন্ধুবান্ধব যাদের সাথে এখনো যোগাযোগ আছে, তাদের সঙ্গে দেখা করতে যায় প্রায়ই। আজ গেছিলো বন্ধুর বাড়ীতে। বেশ কয়েকবার অনুরাধাকেও নিয়ে গেছে,কিন্তু এখন আর অনুরাধা বিশেষ যায় না, বয়সের দোহাই দেয়, টেলিফোন আসে যদি ওরা না থাকাকালীন এইসব দোহাই দেয়।
অনুরাধা নিজের মনের তল খুঁজে দেখেছে কোথায় যেন স্বামীর সঙ্গে পছন্দের অমিল রয়ে গেছে তার। শুরু থেকেই অমিল আছে, এ অমিল যাবার নয়। তাদের সংসারে কোনোদিন বেসুর বাজে নি, অনুরাধা নিজের পছন্দ-অপছন্দ উচ্চকিত করে বলেনি কোনোদিন। ওভাবে যে বলা যায় তাই তো সে ভাবে নি। তাকে মেনে নিতে হবে মানিয়ে নিতে হবে চিরদিন, নিজের পছন্দ-অপছন্দ প্রচ্ছন্ন করে রাখতে হবে খুব সাবধানে, এই সে জানতো চিরকাল। মামার বাড়ীতে বিধবা মায়ের সঙ্গে থাকা আর বড় হয়ে ওঠার হবার সময় এই তো তাকে শিখতে হয়েছিলো পদে পদে! তারপরে বিয়ে হয়ে এই বাড়ীতে এসে সে অবাক হয়ে গেলো, শাশুড়ীকে দেখে সে আশ্চর্য হয়ে গেলো,অতি সামান্য শিক্ষাদীক্ষাসম্বল বুড়ীমানুষটার সতেজ স্বাধীনতা দেখে।
অঝোরা যখন জন্মালো তখন অনুরাধা বিমর্ষ, সে ছেলে চেয়েছিলো। কিন্তু শাশুড়ী আনন্দে উদ্বেল! কতকাল পরে তাদের ঘরে নতুন শিশু! যত বড় হয় মেয়ে তত তার জেদ বাড়ে, মেয়ের তীব্র জেদ অনুরাধাকে দুশ্চিন্তায় ফেলতো,মেয়ে হয়ে জন্মে এত জেদ! কোথায় কার ঘরে যাবে, সেখানে কি হবে তার ভাগ্য? এইসব নিয়ে অনেক চিন্তা ছিলো তার! হয়তো ভুলই ছিলো, মেয়ে তো নিজের পথ নিজেই গড়ে নিলো, চলেও গেলো সময় হলেই! সূক্ষ্ম একটা খোঁচার মতন লাগে কোথায় যেন, তারও জীবন কি তেমন হতে পারতো না? লঘুভার মেঘের মতন জীবন! মেয়ের জীবন কি তেমন? কিজানি! বাইরে থেকে কতটুকু বোঝা যায়?
মেয়ের কোনো বয়ফ্রেন্ড ছিলো না, স্কুলে থাকতে তো নয়ই, কলেজ জীবনেও না। তার পরেও না।অঝোরা কখনো প্রেম বা বিয়ে এইসবের কথা ভাবতেই পারতো না। অথচ ওর সমবয়সী মেয়েরা বিয়ে টিয়ে করে পুরুদস্তুর সংসারী। তাদের কারুর কারুর প্রেমে পড়ে বিয়ে, বেশীরভাগেরই সম্বন্ধ করে বিয়ে দিয়েছে তাদের বাবামা। কিন্তু অঝোরার কাছে বিষয়টা উত্থাপনই করা যায় না।
বিবাহ বা সংসার বিষয়ে অঝোরার এই তীব্র বিরক্তি কেন? সে কী সংসারের আলোঅন্ধকার চেনে না বলে তাতে প্রবেশ করতে ভয় পায়? নাকি এ তার সুগভীর অভিমান যে অভিমানের কারণ আসলে অনুরাধাই? নাচগান শিখিয়ে, সাজগোজ করিয়ে আর পাঁচটা বাঙালী মেয়ের মতন বড় করলে হয়তো অঝোরা এত দূরে সরে যেতো না, এত অচেনা হয়ে যেতো না। অথচ এ বাড়ীর কর্তা নাচগান শেখানোর পক্ষপাতী ছিলো না, সাজগোজ ও না। অনুরাধা একসময় চেয়েছিলো মেয়ে গান শিখুক, কিন্তু ওর বাবা রাজী হলো না।
বুদ্ধিমতী অঝোরাও একসময় বুঝে ফেললো কি কি জিনিস গ্রহণযোগ্য আর কি কি জিনিস এড়িয়ে যেতে হবে। সাজগোজ তো সব বাদ দিলোই, কানের দুল পর্যন্ত খুলে ফেললো একসময়। পড়া নিয়ে পড়ে রইলো রাতদিন, হয়তো তখন থেকেই সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করেছে, এখন হঠাত্ "মেয়েকে বিয়েতে রাজী করাও বিয়েতে রাজী করাও" বললে কিকরে চলবে? মাঝে মাঝে অনুরাধার খুব অসহায় লাগে, মনে হয় কোথাও কোথাও সঙ্গত কারণেই তার নিজের মতামত খাটনো উচিত ছিলো। এতদিন পরে এখন আর এসব ভেবেই না লাভ কি?
ফোনটা বাজছে, অনুরাধা ধীর পায়ে এগোয়। ফোন তুলে বলে, "হ্যালো।"
ওপাশ থেকে দ্বিধাজড়িত একটি পুরুষকন্ঠ,"এটা কি অঝোরা রায়চৌধুরীর নাম্বার?"
অনুরাধা বলে,"হ্যাঁ, এটা তাদের বাড়ীর ফোন নাম্বার ঠিকই কিন্তু অঝোরা তো এখানে থাকে না এখন।"
"এখানে থাকে না? অঝোরা কোথায় থাকে এখন?" কেমন যেন নিরাশা ধরা পড়ে ওপাশের গলাটায়।
অনুরাধা বলে,"অঝোরা গত কয়েকবছর ধরে ক্যালিফোর্নিয়ায়। আপনি কি অঝোরার কোনো পুরনো বন্ধু? যদি ওর ইমেল আইডি জানেন তবে ওকে ইমেল করেই জেনে নিতে পারবেন এর এখনের ফোন নাম্বার । "
ওপাশের গলাটি আস্তে আস্তে বলে,"আমি রুদ্রনীল। অঝোরার কলেজের বন্ধু, আমরা একসাথে পড়তাম বিএসসির সময়। গত ছয় বছর ধরে আমি অনেক দূরে থাকি,রিজার্ভ ফরেস্টে কাজ করি কিনা। পুরানো বন্ধু কারুর সাথেই আর তেমন যোগাযোগ নেই।"
অনুরাধার মনের ভিতরটা কেমন কোমল হয়ে আসে, "অঝোরার ইমেল আইডি কি জানতে চান? জানতে চাইলে দিতে পারি। ও এবারে ফোন করলে ওকে বলেও রাখবো যে আপনি ফোন করেছিলেন।"
রুদ্রনীল কিন্তু ইমেল আইডি জানতে চায় না, বলে,"আপনাকে অনেক ধন্যবাদ মাসীমা। ইমেল আইডি চাই না, অঝোরা যখন ফোন করবে ওকে আমার ফোন নাম্বারটাও বলবেন?"
"ঠিক আছে, বলবো। অঝোরা নিজে যদি ফোন করতে চায়, করবে। আপনি এখন কি এখানেই থাকছেন? রিজার্ভ ফরেস্টের কাজ কি ছেড়ে দিয়েছেন?"
ওপাশ থেকে রুদ্রনীল হাসে, বলে,"না না, সে চাকরি ছাড়লে খাবো কি? ছুটিতে বেড়াতে এসেছি দুইমাসের জন্য। ছুটি ফুরালেই আবার সেইখানে। তবে খুব সুন্দর জায়গা মাসীমা, আপনি যদি আগে সিমলা কি মিরিক গিয়ে থাকেন, বুঝতে পারবেন। আমার ফরেস্ট আরো অনেক দূরে, রেলের শেষ সীমা ছাড়িয়ে বাসে যেতে হয় আরো অনেকদূর। "
"বা:, খুব সুন্দর জায়গায় থাকেন তো! এমন জায়গায় চাকরি পাওয়াও ভাগ্যের ব্যাপার! কিছু মনে করবেন না, আজ রাখি ফোন? আমার এক জায়গায় যাবার আছে।"
"ইশ, দেখুন তো আপনার দেরি করিয়ে দিলাম। আমি খুব লজ্জিত। রাখি মাসীমা, পরে আবার কথা হবে।"
ফোন রেখে দিয়েছে রুদ্রনীল, অনুরাধা মনে মনে দেখে নাদেখা যুবকের অপ্রস্তুত মুখ, হেসে ক্রেডলে নামায় ফোন।
মন্তব্য
এবারের পর্বে লেখা শেষে আর যে সন্দেহ রাখেন নি চলবে কি না তাই নিয়ে, দেখে আশ্বস্ত হলাম। অবশ্যই চলবে, পাব্লিকের এই দাবী।
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
লেখাটি পড়লাম, আগে- পরের লেখা গুলো খুঁজে নেবো...।
....................................
বোধহয় কারও জন্ম হয় না, জন্ম হয় মৃত্যুর !
....................................
বোধহয় কারও জন্ম হয় না, জন্ম হয় মৃত্যুর !
ধন্যবাদ শাহীন, এর আগে মাত্র দুই পর্ব লেখা হয়েছিলো।
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
নতুন মন্তব্য করুন