আর পারা গেল না,নেমে আসতেই হলো। গেছিলাম ইচ্ছাপাহাড়ে নিরুদ্দেশে, ভেবেছিলাম ফিরব যখন ইচ্ছা হবে তখন। অনেকদিন পরে, যখন আমাকে ভুলে যাবে সবাই, তখন এসে জানালায় টুকি দিয়ে বলবো, এই এই শোনো, মনে আছে সেই নীল পাখিটাকে?
কিন্তু কোথায় কি? ঝড় ঝর্ণা বিজলী বাদল পার হয়ে ডানায় জড়িয়ে যায় কিসের জানি টান। বুঝি কি বুঝি না করতে করতে দেখি সচল খুলে ফেলেছি। খুলে খুলে দেখছি আর আমার ভুলে যাওয়া গতজন্মবাড়ীর বিষাদ জড়িয়ে যাচ্ছে চোখেমুখেহাতে। নাহ, তবে গল্পই বলি আসুন, আকাশের গল্প। আকাশের নীচের মানুষের গল্প। নক্ষত্রপ্রিয় এক মানুষের গল্প।
তারায় তারায় ছাওয়া রাত্রি ছিলো আমাদের একদিন,দিনও ছিলো সূর্য,মেঘ আর বৃষ্টির ছন্দে ভরা। আকাশ ছিলো আমাদের ঘড়ি, আমাদের ক্যালেন্ডার, আমাদের দিকনির্দেশক কম্পাস, আমাদের সমস্ত শুভ উত্সব শুরু হতো আকাশের পঞ্জী দেখে, শেষও হতো সেই দেখেই। সূর্যচন্দ্রতারা সাজানো সেই দিবারাত্রিজুড়ে অনন্ত অনিশ্চয়তার মধ্যে নিশ্চয় হয়ে জেগে থাকতো আকাশের নক্ষত্ররা, ওদের দিয়ে তৈরী সব আকার আকৃতিগুলো-সূর্যের চলার পথের রাশি গুলি, চন্দ্রের চলার পথের নক্ষত্ররা, আর উত্তরে দক্ষিণে দুই ধ্রুবতারা স্থির হয়ে রইতো দিনেরাতে-ঘুরে যেতো পৃথিবী, দিন থেকে রাতে রাত থেকে দিনে আবার। মহাসাগরীয় স্রোত আমাদের ক্ষুদ্র মাঝারি জেলেডিঙিগুলোকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতো দ্বীপ থেকে দ্বীপান্তরে, এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে।
তারপর একদিন সেই জীবন আমরা হারিয়ে ফেললাম,আমাদের ঘড়ি এসে গেলো, ক্যালেন্ডার এসে গেলো, কম্পাস এসে গেলো। শুধু আকাশ হারিয়ে গেলো ধূলা আর ধোঁয়া আর কটকটে বৈদ্যুতিক আলোর আবিলতায়।
নতুন যুগে নতুন করে আবার আকাশের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধছি আমরা,কারণ আমরা যে একদিন মধ্যদিনের ধূলার ঝড়ে আক্রান্ত হয়ে তাঁর প্রসারিত হস্ত চুম্বন করে বলেছিলাম,"তারাহীন হয়ে আমি বাঁচতে পারবো না।" আমরা যে সত্যিই নক্ষত্রধূলি!
ধোঁয়াধূলাবারুদগন্ধী আলোকদূষণে ভরা বাতাবরণ পার করে টেলিস্কোপ তুলে দিয়েছি মহাকাশে, সে বিশ্বাসী বন্ধুর মতন আমাদের ছবি পাঠিয়ে যায়--হাজার হাজার ছবি, গভীর মহাকাশের গ্যালাক্সিপুঞ্জ,অপরূপ সে সুষমা! "বহে নিরন্তর অনন্ত আনন্দধারা/বাজে অসীম নভোমাঝে অনাদি সুর/ জাগে অগণ্য রবিচন্দ্রতারা ... "
আমাদের এক শিক্ষক বলছিলেন এই নক্ষত্রপ্রিয় সুলতানের গল্প। তিনি অত্যন্ত অবাক হতেন যে সেই মধ্যযুগের ভয়ানক রক্তপিপাসু যোদ্ধাদের মধ্যে কিকরে এমন আকাশনক্ষত্র আর অংক-ভালোবাসা মানুষের জন্ম হলো? কিন্তু কেউ কেউ তো থাকে অমন জন্ম বাউল, অমন সুফী, অমন জন্ম ফকীর। থাকে না? মোগল প্রাসাদের সোনার খাঁচার জালের মধ্যেও তো দারাশুকো জন্মেছিলেন দুই মহাসমুদ্রের মিলনের স্বপ্ন নিয়ে।
তো, হচ্ছিলো উলুগ বেগের কথা। এই নাতি তখনো জন্মায় নি, ঠাকুদ্দা তৈমুর ছিলেন এক যুদ্ধে। শুভ জয়সংবাদ আর নাতির জন্মের সংবাদ প্রায় একই সঙ্গে এসে পৌঁছালো তার শিবিরে। আনন্দে উদ্বেল হয়ে তৈমুর ঘোষণা করলেন যে যুদ্ধবন্দীদের তিনি মারবেন না, তাদের তিনি নি:শর্তে মুক্তি দিলেন। তাদের আজকের আনন্দে যেন সদ্যোজাত নাতিটির ভালো হয়।
এই নাতিকে সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে ঘুরতেন তৈমুর, মধ্য-এশিয়ার বিরাট অংশ উলুগ বেগ যে অল্পবয়সেই ঘুরে ফেলেছিলেন তা এই দিগ্বিজয়ী ঠাকুদ্দার কল্যাণে। যদিও এতসব যুদ্ধের মধ্যে এত কচিবয়সে ঘোরা নিরাপদ নয়, এ হলো তৈমুরী বংশের সন্তান! শক্তপোক্ত করার জন্য এনারা ছোটো থেকেই ঐভাবে মানুষ।
উলুগ অল্প বয়স থেকেই গণিত আর জ্যোতির্বিদ্যায় আগ্রহী। আর অসাধারণ স্মৃতিশক্তিও। কোরাণ মুখস্থ করে ফেললেন অল্পদিনেই! নিশ্চয় নাতির কৃতিত্বে তৈমুর অত্যন্ত খুশী ছিলেন।
তৈমুরের মৃত্যুর পরে তার পুত্র শাহরুখ দায়িত্ব পেলেন তার সাম্রাজ্যের। তৈমুরের রাজধানী ছিলো সমরখন্দ, শাহরুখ নিজের রাজধানী করলেন হীরাটে। ছেড়ে যাওয়া সমরখন্দ দেখভালের দায়িত্ব দিলেন পুত্র উলুগের হাতে, তার তখন ১৬ বছর বয়স। এই টিনেজার শাসক সমরখন্দকে বিদ্যাশিক্ষার পীঠস্থান করে তুলতে ব্রতী হলেন। তৈরী করলেন বিরাট মাদ্রাসা---সেখানে সেযুগের বড়ো বড়ো স্কলারদের সমাদরে ডেকে এনে, তাদের মধ্যে গণিতবিদ আর জ্যোতির্বিদই বেশী ডাকলেন- ডেকে এনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিলেন।
এরপরের অংশই উলুগের সবচেয়ে গৌরবময় অধ্যায়। ১৪২৮ সালে তিনি সমরখন্দে এক বিরাট তিনতলা অবজার্ভেটরি তৈরী করলেন। সেখানে সেই দূরবীনপূর্ব যুগের সবচেয়ে ভালো ভালো পর্যবেক্ষণ যন্ত্রপাতি বসালেন। টলেমির পরে আর টাইকোব্রাহের আগে এনার অবজার্ভেটরির কাজই সবচেয়ে বিস্তৃত ও সূক্ষ্ম। সেযুগের দুনিয়ার সবচেয়ে নামকরা জ্যোতির্বিদ আলি কাদ্শী কে এই অবজার্ভেটরির ডিরেকটর পদে বৃত করলেন সম্রাট উলুগ বেগ।
এর কয়েক বছর পরেই প্রকাশিত হলো সেযুগের সবচেয়ে বিস্তৃত স্টার ক্যাটালগ ৯৯৪ টি তারার কো-অর্ডিনেট সূক্ষ্ম ও নির্ভুল হিসেব করে দেখিয়ে। আগের টলেমির ক্যাটালগ এত তারা দেখায় নি আর তাতে হিসাবের কিছু অল্প ভুলচুক ছিলো, সমস্ত ঠিকঠাক করে এই অবজার্ভেটরি থেকে প্রকাশিত হলো। পরবর্তীকালে উরোপের রেনেসাঁর সময় এসব কাজ খুব কাজে লেগেছিলো।
এই নক্ষত্রপ্রিয় গণিতজ্ঞ সম্রাটের মৃত্যু অত্যন্ত দু:খজনক। নানারকম যুদ্ধ হত্যামৃত্যু বিদ্রোহের চক্করে একসময় ইনি ফেঁসে গেলেন। একসময় ধর্মান্ধেরা তাকে ধর্মদ্রোহী ইত্যাদিও বললো, এদিকে তিনি একজন হাফিজ, সেই কোন্ কিশোরকাল থেকে তিনি কোরাণ আবৃত্তি করতে পারেন না দেখে, মন থেকে। ধর্মদ্রোহী ইত্যাদি অভিযোগের প্রতিবাদ করে কোনো লাভ হলো না, এসবের মধ্যে গভীর ষড়যন্ত্র ছিলো।
শেষপর্যন্ত একটা পথ পাওয়া গেলো, পায়ে হেঁটে মক্কা যেতে হবে প্রায়শ্চিত্ত করতে। উনি রাজী হলেন এবং যাত্রা শুরুও করে দিলেন প্রাথমিক চিত্তশুদ্ধির পরে। শহরসীমা ছাড়ানোর পরেই ওনার ছেলের পাঠানো গুপ্তঘাতক এসে তার মুন্ডটি ধড় থেকে আলাদা করে ফেললো।
সম্রাটের নশ্বর দেহ পৃথিবীতে পড়ে রইলো, অবিনশ্বর যা, তা চলে গেলো আকাশে, ঐ যে লক্ষ তারার মণিরত্ন জড়ানো ঐ তার প্রিয় আকাশে।
মন্তব্য
ফুল মার্কস।
----------------------
বিড়ালে ইঁদুরে হলে মিল, মুদির কিন্তু মুশকিল ।
----------------------
বিড়ালে ইঁদুরে হলে মিল, মুদির কিন্তু মুশকিল ।
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
অসাধারণ ব'লে ব'লে ক্লান্ত হয়ে গেছি, কিন্তু এটা পড়ে সত্যিই রোমহর্ষণ হয়, আরো জানার ইচ্ছে হয় উলুগ বেগের কথা। আছে কিছু লিঙ্ক?
হাতের কাছে উইকিপিসি খুলে সামনে পেলাম এইটা-
http://en.wikipedia.org/wiki/Ulugh_Beg
আরো আছে, গুগুলকাকুকে জিগান না!
লেখাটা ভালো লাগলো কইলেন শুনে বড় ভালা লাগিল। সচলে এত ভালোবাসা পাইলাম যে সচলের এই সময়ে আর চুপ রইতে মন মানলো না। ক্যাচ কট কট হয়ে ফের এখানে। চিন্তার কথা।
----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
প্রিয় তুলিরেখা, একটি প্রচন্ড করুণ আবেদন - আপনি এতো ঠাস করে লিখে ফেলেন কী করে, আমাকে শেখাবেন??!!
লেখা ভাল্লাগ্লো, কিন্তু কথা সেটা না! কথা হলো এই যে মন চাইলো আর লিখে ফেললেন এটা কিভাবে হয় আমাকে শিখিয়ে দিইইইইইন
আমার কাজকর্মের বিরাট অংশ লেখালেখি বিষয়ক, কিন্তু আমার যে ইচ্ছেটাই হয় না - কী করবোওওওওও ????
আর, উলুগটা তো বেশ ছিলো! আপনার কল্যাণে জানা হচ্ছে অনেক কিছু
ইয়াল্লা!!! কন কি? এই লেখা এখন এখন লেখা নাকি? এতো ফিরিজে ছিলো, বাইর কইরা গরমে দিয়া প্লেটে দিলাম খালি!
আর আপনের লেখা যা ধারালো, টনকনড়াইয়া দেওয়া,সমাজের ঝুঁটি ধইরা ঝাঁকানি দেওয়া! অমন লেখা রইয়াসইয়াই লিখতে হয়।
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
আমি এখন অবাক হওয়া ছেড়ে দিয়েছি। তুলির লেখা পড়ে আর অবাক হইনা।
কন কি?
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
নতুন মন্তব্য করুন