৩। পুতুলদের বাগানের লাউমাচায় বাসা করেছে এক ঘুঘু-মা। বেশী উঁচুতে না, একদম কাছে। লাউপাতার ছায়ায় বেশ অন্ধকার অন্ধকারমতন সেখানে যদিও। তুলি আর পুতুলের আগ্রহী চোখ সেই বাসায়, ভারী অস্বস্তির সঙ্গে বাসায় বসে ওদের দেখছে ঘুঘু, বাসা ছেড়ে একটুও যায় না, না-ফোটা ডিমগুলো রয়েছে তো! যাবে কিকরে?
ওরা চলে আসে, কিন্তু বারান্দা থেকে লক্ষ রাখে যদি একটু যায় মা ঘুঘুটা, তাহলে ডিমগুলো দেখবে, কখনো আগে ওরা ঘুঘুর ডিম দেখেনি! হাঁস আর মুরগীর ডিম ছাড়া আর কোন্ পাখির ডিমই বা দেখেছে?
অবশ্য এক বাড়ীতে পোষা পায়রা থাকতো অনেক, সেখানে দেখেছিলো পায়রার ডিম, কদিন পরে ছোট্টো ছোট্টো ছানাও, খড়ের আস্তরণের উপরে শুয়ে থাকতো ছানাগুলো, একটাও পালক নেই তখন তাদের ! কি অদ্ভুত হাল্কা গোলাপী রঙের অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পায়রাছানা! সে বাড়ীর পোষা পায়রার ঝাঁকে ছিলো অনেক সাদা পায়রা, কালচে পায়রা যাদের গলায় চিত্রগ্রীবের মতন রঙ, পাখিগুলো সব ছাড়াই থাকতো, শীতের সময় জমির মাটিতে পড়ে থাকা ধান খেতে আসতো দল বেঁধে।
কিন্তু ঘুঘু-মা যায় না বাসা থেকে, ওরা আশাহত হয়ে ছাদে খেলতে চলে যায়। পুতুল বলে, "দুপুরবেলা নজর রাখবো, হয়তো দুপুরে খেতে যায় ঘুঘু-মা টা।"
দুপুর বলতেই তুলির মনে পড়ে ঘুমেলা নির্জন একটা সময়, বড়রা সব ঘুমাচ্ছে, বাইরে আমগাছের ডালে বসে ঘুঘু ডাকছে, কেমন অদ্ভুত টানা ঘুঘ ঘু-উ-উ-উ-উ সুর, দুপুরের ঘুমেলা প্রকৃতির সঙ্গে কোথায় যেন যোগ! সেই দুপুরবেলা পুতুল দেখবে ঘুঘু-মায়ের বাসা! আহা! যদি তখন সেও থাকতে পারতো! কিন্তু তাতো হবে না, তখন তো সে বাড়ী ফিরে স্নান করে ভাত খেয়ে জেগে শুয়ে থাকবে! দুপুরবেলা কেন যে মা ঘুমাতে জোর করে! দুপুরে কী ঘুমাতে ইচ্ছে করে? তখন তো গুঁড়ো দুধ চুরি করতে ইচ্ছে করে। বড়রা কেন যে কিছু বোঝে না!
ছবিসুতো চলতে চলতে এসে থেমেছে তালবটের কাছে। তুলি-পুতুলদের পাড়ার পুবের দিকে যে বটগাছটা, সেটা একটা বড়ো পুকুরের উঁচু পাড়ির উপরে। গাছটা অদ্ভুত, একটা তালগাছকে একেবারে আষ্টেপৃষ্টে ঘিরে বটগাছ, অথচ তালগাছটা ও দিব্যি বেঁচে আছে, বটগাছের মোটা কান্ডের মধ্যখান থেকে মাথা উঁচিয়ে পাখার মতন সবুজ পাতা মেলে আছে। কী আশ্চর্য! এ কেমন করে হয়?
তুলিদের বাড়ীর উঠানে তুলি আর পুতুলকে দেখা যাচ্ছে, তুলির ঠাকুমা নারকোল পাতা থেকে বঁটিতে পাতা পাতা অংশটা কেটে মাঝখানের শক্ত লম্বা শলাগুলো একপাশে জড়ো করে রাখছে, এগুলো থেকে ঝাঁটা তৈরী হবে, উঠান ঝাড় দেবার নারকোল শলার ঝাঁটা। তুলিপুতুল অবাক হয়ে দেখছে, শলা তুলতে তুলতে ঠাকুমা ওদের বোঝান ঝাঁটার বৈচিত্র অনেক-ফুলঝাড়ু, ঘরের মেঝে ঝাড় দেবার জন্য, নারকোল শলার ঝাড়ু উঠান ঝাড় দেবার জন্য, খেজুরপাতার ঝাড়ন জানালাদরজার ধুলা ঝাড়তে, ময়ূরপালকের ঝাড়ন টেবিল বুককেস এসবের ধূলা ঝাড়তে---মানুষের কী বুদ্ধি! প্রত্যেক কাজের জন্য আলাদা আলাদা উপযুক্ত জিনিস তৈরী করেছে!
কথাবার্তা আরো এগোতে এগোতে এইবারে সেই তাল আর বট নিয়ে ওদের সেই প্রশ্ন, এমন কেমন করে হয় যে একটা গাছের মধ্যে আরেকটা গাছ? এমন তো না যে বটগাছ চলতে পারে, দৌড়ে এসে আষ্টেপৃষ্ঠে জাপ্টে ধরছে তালগাছকে?
ঠাকুমা বলেন যে বটের চারা আসলে পাখিতে ফেলে যাওয়া বীজ থেকে হয়েছিলো ঐ তালগাছের উপরেই, তারপরে আস্তে আস্তে বট বেড়ে বেড়ে নীচে শিকড় নামিয়ে উপরে ডালপালা পাতা মেলে মেলে এখন একেবারে মৌরুসীপাট্টা গেঁড়েছে! পুরানো বাড়ীর ছাদের কার্ণিশে কার্ণিশে কত বটচারা হয়, ছোটো থাকতে তুলে না ফেলে দিলে একদিন এরা বড়ো হয়ে গোটা বাড়ীই আষ্টেপৃষ্ঠে ঘিরে নেয়!
আরে সত্যিই তো! গাছও তাহলে জবরদখল করে!
অনেক পরে ঐ তাল ও বট দুই কাটা পড়ে যাবে আরো অনেক গাছেদের সঙ্গে, পুকুর চওড়া হবে। সেখানে সুইমিং পুল হবার কথা ছিলো, কিন্তু চারিপাশে এত বাড়ী এত বাড়ী, জলও কেমন ময়লা কালচে! আগে এমন ছিলো না,তখন জল টলটল করতো!
ছবিসুতো হাতড়াতে হাতড়াতে এক রবিবারের সকাল-সেদিন আপিসের ভাতের দৌড় নেই, বেশ ঢিলেঢালা, সকালে একপ্রস্থ জলখাবারের পরে বাবাকাকাজ্যেঠারা সব বাজারের দিকে গেছেন রবিবারের স্পেশালিটির জন্য, সাধারণতা রবিবারেই মাংস হয়, নয়তো স্পেশাল কোনো বড়মাছ, বেশ তেলমশলা দিয়ে তরিবত করে- অন্যদিন তো তাড়াহুড়ায় তাড়াতাড়ি করে ডাল, তরকারি আর সোজাসাপ্টা মাছের ঝোল-খেয়েদেয়েই সবাই পড়ি-কি-মরি করে স্টেশানের দিকে ছোটে, প্রায় সকলেরই তো আপিস কলকাতায়।
আহা, কলকাতা, তুলি-পুতুলের কাছে সে এক দূরের দেশ, বেড়ানোর জায়গা। শীতের সময় রঙবেরঙের সোয়েটার পরে সঙ্গে টিফিনবাক্সে লুচি আলুরদম নিয়ে ফ্লাস্কে গরম দুধ নিয়ে চিড়িয়াখানা, যাদুঘর, গড়ের মাঠ দেখতে যাবার কলকাতা। পরে সেই কলকাতাই হয়ে যাবে দুজনের দিনগত পাপক্ষয়ের কলকাতা, ভীড়ে ঠাসা গুদামের মতন ট্রেন থেকে নেমে হাওড়া স্টেশানের জনসমুদ্র ঠেলে লাফিয়ে বাসে উঠে ঝুলতে ঝুলতে হুহু করে গঙ্গা পেরিয়ে ঘামতে ঘামতে গিয়ে পৌঁছানো কলকাতা ...
তবে সেতো পরে অনেক পরে। তখনো মানুষের অত ভীড় নেই, ওদের ছোটোবেলার রবিবারগুলো বেশ উত্সব উত্সব। একটু পড়েশুনে তুলি চলে এসেছে পুতুলদের বাড়ী, ওদের বাগানে লাউমাচার ছায়ায় রান্নাবাটি খেলতে।
-" একটা জিনিস দেখবি তুলি?"
কি জিনিস?
-" চল না!"
তুলিকে পুতুল নিয়ে আসে ওদের পুবের দিকের একটা ঘরে, সে ঘরটা অনেকটা ওয়ার্কশপের মতন, আসলে সত্যিই তাই, পুতুলের বাবা ও জ্যেঠতুতো দাদা ইন্টেরিয়র ডেকরেটরের কাজ করতেন, তাদের কাজের ঘর।
তো সেই ঘরে পুতুল দেখায় একটা রেডিওর পেছনের দিকের ঢাকাটা খুলে ফেলার পরে ভেতরে কিসব আশ্চর্য জিনিস দেখা যাচ্ছে-তারকুন্ডলী, ছোট্টো ছোট্টো দাঁড়ানো দাঁড়ানো টিউব ... আরো কত কী! নিঁখাদ বিস্ময়ে হাঁ হয়ে যায় তুলি, এইসব থাকে রেডিওতে? এইগুলো এমন ম্যাজিক ঘটায়, এত গান-গল্প-নাটক-খবর সব শোনা যায় এইসবের কেরদানিতে?
উত্তেজনায় দু'জনের প্রায় চোখ ঠেলে বেরিয়ে এসেছে, নতুন মহাদেশ প্রথম দেখে ফেলার মতন অবস্থা! এইসব জিনিস থেকে অত গান অত কবিতা অত নাটক অত খবর কিকরে আসে? রোজ সকাল বেলায় ঐ যে "আকাশবানী: খবর পড়ছি ইভা নাগ" বলে? ঐ যে শনিবারের দুপুরে হয় শনিবারের বারবেলা! ঐ যে শুক্রবারের রাত্রিবেলা হয় নাটক যখন মা রান্না করে রাতের খাবার! এইসব বেরিয়ে আসে এই এত এত টুকরো টুকরো জিনিসপত্রের কেরামতিতে!
তুলি পুতুলের হাত চেপে ধরে, উত্তেজনায় নি:শ্বাস নিতে পারছে না সে। কিকরে এইসবের ভিতর থেকে এতকিছু শোনা যায়? হুমড়ি খেয়ে পড়ে তারা আরো ভালো করে দেখতে থাকে, কিন্তু কৌতূহল মেটে না, এদিকে বড়োদের কাউকে জিগ্গেস করে তো কোনো ফল নেই, ওরা বলবে বড়ো হলে বুঝবি। পুতুলের দাদা টোটো তাদের থেকে বছর পাঁচেকের বড়ো, বানের মুখে কুটোর মতন তাকেই ধরে পড়লো ওরা। কিন্তু সেও কিছু বলতে পারলো না, তবে বিজ্ঞের মতন ঘুরেফিরে দেখলো। তুলি-পুতুল ভাবে- নিশ্চয় কিছু আছে, কোনো একটা রহস্য, চোখে দেখতে পাওয়া জগতের বাইরের কোনো রহস্য, সেসব জানা অনেকদিনের কাজ।
(চা খাওয়া হলেই আবার হবে চলমান)
মন্তব্য
চা খাওয়ার পরে যেন ছবি থাকে।
ছবি?
তখন তো আমাদের ক্যামেরা ছিলো না! সবই যাকে বলে মন-ক্যামেরায় তোলা!
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
এই ঘটনার মতো করে বর্তমানের একটা ছবি দিতে হবে।
হায়, কোথায় অতীত কোথায় বর্তমান! কোথায় ফুটফুটে একমাথা চুলওলা কোমলমুখের ছিপছিপে কিশোর আর কোথায় নেয়াপাতি ভুঁড়ি আর টাকওলা এক বুড়ো!
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
তুলিপুতুল বড় না হোক
ছোট্ট থাকুক সারাজীবন
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
ধন্যবাদ রানা মেহের।
না, ওরা বড় হয় নি এ গল্পে। এ গল্প ওদের ছোটোবেলার গল্প।
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
সিরিজটা কি বোরিং হয়ে যাচ্ছে? অনুগ্রহ করে কেউ নি:সঙ্কোচে জানান। তাহলে সিরিজ থামিয়ে দেওয়া যাবে'খন, পরিবর্তে ছোটো গল্প বা অন্যকিছু দেওয়া যাবে ।
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
তখন তো গুঁড়ো দুধ চুরি করতে ইচ্ছে করে। বড়রা কেন যে কিছু বোঝে না!
আহা আমিও করতাম ছোটবেলায় দুধ চুরি। যদিও বেশী সুযোগ হতো না। কারন আমার মা আমাদের ঘুম পাড়িয়ে তারপর নিজে ঘুমুতে যেতেন। কিন্তু চুরি করতে পারলে তারসাথে ওভালটিন আর নইলে শুধু চিনি মিশিয়ে দুনিয়ার সবচাইতে সুস্বাদু খাবারের স্বাদ গ্রহন করিতাম।
তুলিপুতুলের সিরিজকে চলতেই হবে এএ এ এ এ এ এ এ
---------------------------------------------------------
রাত্রে যদি সূর্যশোকে ঝরে অশ্রুধারা
সূর্য নাহি ফেরে শুধু ব্যর্থ হয় তারা
*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়
একদম ঠিক বলেছ! চুরি করা গুঁড়াদুধের মতন এমন সুস্বাদু জিনিস দেখলাম না আর! তুলনা একমাত্র চুরি করা কাঁচামিঠে আম (সে আরেকটু বড় হয়ে, গরমকালের বিকালে )!
এত উঁচু তাকে তুলে রাখতো আমূলের কৌটা, যে পাড়ার জন্য নানা কৌশল উদ্ভাবন করতে হতো!
ধন্যবাদ তানবীরাদি, সিরিজটা পড়ছো বলে। দেখি আবার কবে পরের অংশ দেওয়া হয়ে ওঠে।
সেদিন নিবিড় এর লেখায় "সচলচারণ" এর উল্লেখ দেখে খুব স্মৃতিমেদুর হয়ে পড়লাম। সেই আমার অতিথিবেলার সিরিজ, ৮ পর্যন্ত গিয়ে থেমে গেছিলো।
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
নতুন মন্তব্য করুন