৬।
পাশাপাশি ঘুমিয়ে যাই আমরা, আমাদের দুটো হাত পরস্পরকে ধরে থাকে, একে অপরকে সাহস দেয় স্পর্শের বৈদ্যুতি-ভাষায়, আস্তে আস্তে হাত দুখানাও ঘুমিয়ে পড়ে৷ ঘুমের মধ্যেও কিন্তু আমার সেই তীক্ষ্ণ অস্বস্তিটা থেকে যায়, যেন কেউ লক্ষ্য করছে আমাকে৷ যেন আমার হৃদয় মস্তিষ্ক মন বুদ্ধি সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কারা দেখছে, আঁতিপাতি করে কিছু খুঁজছে, যেন কিছু লুকিয়ে রেখেছি আমি কারুর কাছ থেকে৷ ধোঁয়া ধোঁয়া সব ছায়া ছায়া মূর্তি হাল্কা পায়ে ঘুরছে, চারিদিকে চৈত্র-রাত্রির বাতাসের মতন ফিসফিস, আস্তে আস্তে ঘননীল হয়ে ওঠে সব, তারমধ্যে ফুটে ওঠে হাল্কা হাল্কা নীল ঘূর্ণী নকশা৷ সেই নক্শা ক্রমে সোনালীরূপালী হয়ে তীব্র হয়ে ওঠে৷ আমার ঘুম ভেঙে যায়৷
সাবধানে উঠে বসি, অতি সন্তর্পণে হাতখানা বার করে নিই আরেনুশের হাতের নীচ থেকে, চেয়ে থাকি আরেনুশের গভীর নিদ্রামগ্ন মুখখানার দিকে, ঘুমালে ওর মুখ কী কোমল! অকলুষ, অমলীন কিশোরের মতন মুখ! ও ও কি আমার মতন ঐ রহস্যময়দের স্বপ্ন দেখছে? আমি যা দেখলাম, তা কি স্বপ্ন?
ভয় পাবার কথা ছিলো, কিন্তু ভয় নয়, সত্যি ভয় না, অন্যরকম একটা অনুভূতি হচ্ছে স্বপ্নটা দেখে৷ ঠিক যেন ব্যাখাহীন কোনো অস্বস্তির একটু একটু কিছু ধরতাই পাওয়া যাচ্ছে৷ এতদিন যেটা ছিলো কল্পনা মাত্র, সেটার প্রথম উড়ে আসা রেণুধূলি যেন এসে লেগেছে চোখমুখেগালে৷ আমাদের জীবনের মধ্য দিয়েই হয়তো জানতে পারা যাবে, জীবন দিয়ে হয়তো রহস্যকে সমাধান করতে হবে৷
তাতে ভয় করে কি হবে? জীবন আমাদের এমন কিই বা যে মরণকে ভয় করতে হবে? অধৈর্য হয়েও তো লাভ নেই৷ একটু একটু করে গ্রন্থি খুলবে এর, আমাদের শুধু বেঁচে চলতে হবে ঠিক সময়ের অপেক্ষায়৷ আবার ঘুমিয়ে পড়ার আগে হঠাৎ মনে হলো, এইসব ভাবনা কি আমার? এও মনে হলো কেউ যেন আমাকে সাহস দিচ্ছে৷ এতটা ভয়হীন ভাবনা কে দুর্বলচিত্ত আমার মধ্যে ভরে দিচ্ছে?
ঘরটা এখন হাল্কা নীল রঙের, দরজা-জানালাগুলো অপরাজিতাফুলের পাপড়ির মতন ঘননীল৷ ঘরটার আকৃতি ভারী অদ্ভুত, চৌকো না গোল না পিরামিডের মতন কিছুতেই বোঝা গেলো না৷ মাঝেই মাঝেই আকৃতি বদল হচ্ছিলো, দেওয়াল কখনো সিলিন্ডারের ঘোরানো তলের মতন হয়ে যাচ্ছে, কখনো সোজা সমতল কখনো এবড়োখেবড়ো, কখনো বোঝাই যাচ্ছে না দেওয়াল আছে৷ ছাদও বদলাচ্ছে, দরজাজানালা আকৃতি বদল করছে৷ এগুলোর রঙও বদলে যায়, কিন্তু এখন অনেকক্ষণ ধরে একই রঙ ধরে রেখেছে৷ কেন কেজানে!
ঘরটা বিরাট বড়ো, এর মাঝখানে কতগুলো আশ্চর্য আকৃতির বসবার আসনে বসে আছে কিছু জীব, খুব ব্যস্ত হয়ে কাজ করছে সবাই৷ বুদ্ধিমান জীব সন্দেহ নেই৷ আকৃতি অনেকটা মানুষের মতনই, আশ্চর্য সর্বাঙ্গ ঢাকা পোশাক ওদের৷ পোশাকগুলোর রঙ বদলায়, কিন্তু এখন বদলাচ্ছে না৷ এরা মানুষ কিনা বোঝা যাচ্ছে না, মানুষও হতে পারে, যন্ত্রমানবও হতে পারে, আবার সম্পূর্ণ ভিন্ন জীবও হতে পারে৷
এরা মুখে বিশেষ কথাবার্তা বলে না, হাতের আঙুলে চিকমিক করা আংটির মতন বহু যন্ত্র বসানো, তারই মাধ্যমে এরা কমুনিকেট করছে৷ এদের সামনে বিশাল দেওয়াল জুড়ে ফুটে উঠেছে দুজন পার্থিব মানুষের স্নায়ুতন্ত্রের চিত্র, একদম সমস্ত সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম তরঙ্গ ইত্যাদি দেখানো,আরো বহুকিছু আছে আমাদের চেনা নয় সেসব, এদের প্রযুক্তি আমাদের থেকে বহুগুণ উন্নত৷ মাঝে মাঝেই বিশেষ বিশেষ অংশে গিয়ে এরা আরো ভালো করে বিশ্লেষণ করে৷
প্রথম প্রথম স্বপ্নে এদের যখন দেখতাম তখন এত স্পষ্ট হতো না, নীলঘূর্ণি এসে সোনালীরূপালী আলোর চর্কিবাজির মতন কিসব এনে ফেলে ছবি মুছে দিতো৷ কিন্তু এখন আর অমন হয় না, স্পষ্ট দেখি ওদের ঘর, দেওয়াল, আসবাবপত্র আর ওদের সবাইকে৷ বহুরকমের যন্ত্রপাতি আছে ঘরটিতে, কিছুই আমার চেনা নয়, ওরা আমার আর আরেনুশের স্নায়ুতন্ত্র পরীক্ষা করে৷ এতদূর থেকে কিভাবে এইসব ছবি ওরা নেয়, কেজানে!
"এতদূর থেকে" বলেই মনে হলো সত্যি কতদূর থেকে? ওদের ঐ গবেষণার ঘর কোথায় তার সম্পর্কে কিছুই জানি না আমরা৷ দুজনেই আমরা স্বপ্ন দেখি, ঘুম থেকে উঠে আস্তে আস্তে বলাবলি করি সেসব৷ এর বাইরে কিছুই আর করতে পারিনা অপেক্ষা করে থাকা ছাড়া৷
প্রথমে বুঝতেই পারতাম না ঐ ছবিগুলো কি? পরে আস্তে আস্তে অনুসন্ধান করে বুঝি মানুষের স্নায়ুতন্ত্রের ছবি৷ তারও আরো অনেক পরে অনেক অনেক পালা স্বপ্ন দেখার পরে বুঝতে শুরু করি ওদুটো আমাদের দুজনের৷ মাঝে মাঝে ওরা আমাদের পুরো চেহারা ও দেওয়ালে প্রজেক্ট করে দ্যাখে৷ বহুদিন থেকে দেখছে, ব্যস্ত হয়ে অংক করছে, ওদের কথাবার্তা বিশেষ নেই, বললেও কি আমরা কিছু বুঝতাম? কিন্তু দুজনেই বুঝতে পারি কিছু একটা নিয়ে ওরা ভারী উদ্বিঘ্ন৷ কি হতে পারে? নিরীহ আমাদের স্নায়ুতন্ত্রে এমন কি থাকতে পারে যা ঐ উন্নত জীবেদের এত উদ্বিঘ্ন করে তুলেছে?
(চলবে)
মন্তব্য
আপনার এইরকম অসামান্য লেখায় মন্তব্যের সংখ্যা দেখে অবাক হয়ে ভাবি, আমরা পাঠকেরা তাহলে ঠিক কী জাতীয় লেখা পড়তে চাই! লেখা আর কতো কতো ভালো হলে আমরা মুগ্ধ হবো!
পড়ার জন্য ধন্যবাদ পাঠক।
আসলে আমি বোধহয় মানুষটা বেহায়া, এত স্বল্প পাঠসংখ্যা আর স্বল্পতর কমেন্টসংখ্যা দেখে আগেই আমার লেখা পোস্ট করা থামিয়ে দেওয়া উচিত ছিল। তবু কেন যে লেখা দিয়ে পাতা আটকে রাখি কেজানে!
এবারে বরং দীর্ঘ ছুটিতে যাওয়াই ভালো।
ভালো থাকবেন, সকলের জন্যই শুভেচ্ছা রইলো।
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
পানিবন্দী হয়ে আছি সারাদিন, অফিসে যেতে পারিনি, কালও বোধহয় এই অবস্থা থাকবে। একটা ছুটি ছুটি আমেজ ছিলো তাই রাত জেগে খেলা দেখার ফাঁকে সচলায়তনে কী কী লেখা এসেছে দেখছিলাম। আপনার ’সাংগ্রিলা - ৬’ দেখেই খুশি হয়ে গেলাম কারণ আমি এই সিরিজের একজন আগ্রহী এবং মুগ্ধ পাঠক। আগের পর্ব যেটা মিস হয়েছে সেটাও পড়লাম।
প্লিজ, বেশি দিনের ছুটিতে যাবেন না। পরবর্তী পর্ব তাড়াতাড়ি আসুক। খুবই চমৎকার লিখছেন আপনি। খুব চমৎকার লিখেন আপনি।
নতুন মন্তব্য করুন