ধূলাবালিভরা পথে চলে যায় খালিপায়ে বাদামী রঙের মানুষরা। তাদের রোদপোড়া জলেভেজা মুখ, তাদের পা শক্ত পাথুরে অভ্যাসে, তাদের রুখু হাতে-মুখে-চুলে লেগে থাকে ধূলামাটি আর খড়কুটা। পথের পাশে জামরুল গাছের নীচে বসা ভিখু ওদের মুখের দিকে চেয়ে থাকে, কখনো কিছু বলে না। তার সামনে রাখা তোবড়ানো অ্যালুমিনিয়ামের বাটিটাতে পড়তে থাকে সিকি আধুলি কখনো বা গোটা টাকা।
এই রাস্তায় আরো চলে বিচিত্র বাহন, অদ্ভুত শব্দে এগিয়ে যায়, আরোহীরা কেমন তা বোঝা যায় না বাইরে থেকে। ছায়ায় ঢাকা থাকে তাদের মুখচোখ। মাঝে মাঝে ওদের খুব দেখতে ইচ্ছে করে ভিখুর। একদিন একটা গাড়ী থেকে পরীর মতন সুন্দর একটা মেয়ে নেমে ভিখুর বাটিতে দিয়েছিলো দু'দু'খানা চকচকে কয়েন। ভিখু অবাক হয়ে একবার মেয়েটার মুখের দিকে আরেকবার বাটির দিকে তাকাচ্ছিলো, মেয়েটার মুখের হাসিটা কেমন সুন্দর ছিলো, কোথা থেকে হাওয়া বইছিলো, মেয়েটার লম্বা চুলগুলো উড়ছিলো, সেই কয়েকটা মুহূর্ত যেন ভিখুর জীবনে অলৌকিক মুহূর্ত! সে নিঃশ্বাস ফেলতে পারছিলো না। তারপরেই মেয়েটা হাত নেড়ে গাড়ীতে উঠে পড়লো, হুশ করে গাড়ী চলে গেল। ভিখু আজও ভাবে সেই মেয়েটা সত্যিই হয়তো পরী ছিলো, ভিখুর জন্য মানুষ সেজে এসেছিলো। সত্যি সত্যি পরীরা কেমন দেখতে হয়?
কখনো কোনো দোতলার জানালার কাঁচ থেকে ছলকে পথ ভুলে গলিতে পড়ে টুকরো বিকেলের আলো, ভিখু মুখ তুলে দেখতে পায় পাশের বাড়ীর ছাদে কিশোরী মেয়েটির ঘুরতে ঘুরতে চুল বাঁধা, শুনতে চায় ওর গুণ গুণ গান। বুঝতে পারে এখন শেখরের আসার সময় হলো।
শেখর বড় রাস্তার ধারে প্যাকেটে মোড়া বাদাম ছোলা এসব বিক্রি করে। ভিখুর মতন ওর পা খোঁড়া না, শেখর ছুটতে পারে চমৎকার। শেখর এসে পড়ে, ওর রোদেপোড়া কালো মুখে কেমন একটা আশ্চর্য হাসি। সব বাদাম ছোলা বিক্রি হয়ে গেছে, ঝোলা খালি। খালি ঝোলাটা কাঁধ থেকে নামিয়ে ভিখুর হাতে দেয় শেখর, ভিখুর একহাতে পয়সার বাটি, আরেক হাতে ঝোলা। সে বাটির পয়সাগুলো ঝমঝম করে ঝোলাতে ঢেলে ফেলে হাসে। শেখর হাসতে হাসতে ভিখুকে কাঁধে তুলে নেয়। শেখরের কাঁধে চড়ে ভিখু ভাবে এমন একটা মানুষ সাথে থাকলে আর কখনো কোনো কষ্ট থাকে না। পরী টরীদের চাই না তার, শেখর থাকলেই হবে।
শেখর তার কে ভিখু জানে না। হয়তো কোনো দূরসম্পর্কের আত্মীয়, হয়তো বা কেউ না। ভিখু জানতে চায় না। ভিখু নিজের বাবামাকেও জানে না। খুব ছোটোবেলার স্মৃতিতে শুধু এক উস্কোখুস্কো চুলের ময়লা কাপড়ের নারীকে মনে পড়ে, ওর কোলের মধ্যে আঁকড়ে আছে সে, লোকে পাগলি পাগলি বলে ঢিল ছুঁড়ছে সেই নারীকে। সে কে? সেই কি তার মা? তারপরে কি হলো? শেখর কি তারপরেই এসে তাদের উদ্ধার করলো? মনে নেই, কিছু মনে নেই ভিখুর। মনে থেকেই বা কী লাভ হোতো?
শেখর হাসছে, বলছে, "কী রে ব্যাটা, আজকে এসেছিলো তোর পরী?"
ভিখু তখন দেখছে আকাশে ঘুড়ি আর ঘুড়ি, পেটকাটি চাঁদিয়াল ঘুড়ি, ইয়া লম্বা ফরফর করে ওড়া লেজওয়ালা একটা লাল ঘুড়ি, একটা নীল ঘুড়ি উপরে উঠে যাচ্ছে, মস্ত একটা সাদা টিপ ওর নীল বুকের মাঝখানে।
(চলবে)
মন্তব্য
জমতে শুরু করেছে!!!!!!!!!!!!!!!!
এস হোসাইন
---------------------------------
"মোর মনো মাঝে মায়ের মুখ।"
চলুক...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
নতুন মন্তব্য করুন