প্রতিলিপি(৪)

তুলিরেখা এর ছবি
লিখেছেন তুলিরেখা (তারিখ: রবি, ১০/০১/২০১০ - ১১:৪২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

এখানে ৩য়

ওরিয়ানা দাঁড়িয়ে ছিলো ওদের বড়ো ফটকের সামনে। অল্প অধৈর্য আর অল্প রাগ আর অনেকটা খুশী মিলে ওর মুখখানা অবর্ণনীয়। প্রথম দেখা হবার উচ্ছ্বাস কেটে যেতে লাগলো বেশ কিছুক্ষণ! আরো কিছুক্ষণ পারস্পরিক অনুযোগ-অভিযোগ, তারপরে জলযোগের ব্যবস্থা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো ওরিয়ানা।

সারারাতের ক্লান্তি কাটাতে স্নানঘরে ধারাজলের নীচে আবরণহীন একলা দাঁড়িয়ে একটা অদ্ভুত অনুভূতি হলো গিবানের। মনে হলো এই ওরিয়ানা, এত এত চেনা সেই কৈশোর থেকে একসঙ্গে পথচলা ওরিয়ানাকে যেন সে চিনতে পারছে না! এ কি এতদিনের বিচ্ছেদ এর ফল নাকি অন্য কিছু?

ঘনিষ্ঠ মুহূর্তগুলো মনে পড়তে লাগলো, জলের ধারার মধ্যে লালচে হয়ে উঠতে লাগলো গিবানের মুখ, আবার পরক্ষণেই মুছে যেতে লাগলো সেই রক্তাভ প্রসন্নতা। কেন এই বিষাদ, এই দু:খ? সাময়িক বিচ্ছেদ তো হয়ই মানুষের তার প্রিয়জনের সঙ্গে, তাহলে তার এমন কেন লাগছে?

এই ওরিয়ানা, সেই শেষ দেখা হবার সময় প্লেনে ওঠার আগে যাকে নিবিড় জড়িয়ে ও বলেছিলো,"কেউ আমাদের আলাদা করতে পারবে না কোনোদিন। আমরা সব সময় মিলে থাকবো যেখানেই থাকি যতদূরেই থাকি। আমাদের মধ্যে কোনো ব্যবধান কেউ ঘটাতে পারবে না।"

ধারালো একটা ভয়ের ফলা গিবানের বুকের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। খুব খুব দূরের আর সিনেমায় দেখা কথার মতো মনে হচ্ছে ঐ স্মৃতিসমূহ। কিন্তু ওসব তো সত্যি সত্যি ঘটেছিলো! ঘটেনি কি? হঠাৎ কেন তার তবে মনে হচ্ছে ওটা অন্য কোনো মানুষের জীবন, ওর নিজের জীবন নয়। সেই স্মৃতির অবিচ্ছিন্ন প্রবাহের মধ্যে একটা অন্ধকার ভয়াবহ খাঁজ, একটা ধারালো ছুরি দিয়ে আলাদা করে দেয়া অতীত ও বর্তমান, সেইটার রহস্য ভেদ করা মাত্র বোঝা যাবে সে আসলে কে, আসলে কি, কোন্‌টা সত্যি কোন্‌টা বানানো। কিন্তু ভীষণ ভয় করছে তার, শীত করছে, উষ্ণতার জন্য কাতর হয়ে উঠছে প্রতিটি অণুপরমাণু।

দীর্ঘ ধারাস্নানে ক্লান্তি ধুয়ে ফেলে গামাথা মুছে বাথরোব জড়িয়ে বেরিয়ে এলো গিবান, ওরিয়ানা ব্যস্ত ছিলো ব্রেকফাস্ট টেবিল সাজাতে। পিছনে না ঘুরেই বললো," গিব, তোমার শুকনো জামাকাপড় পাশের ঘরে চেয়ারে রাখা আছে। প্লীজ তাড়াতাড়ি করো। খাবার ঠান্ডা হয়ে গেলে খুব বিশ্রী লাগবে খেতে।"

ব্যস্ত ওরিয়ানার দিকে একপলক তাকিয়ে পাশের ঘরে ঢুকে পড়লো গিবান। পোশাক পরতে পরতে আবার সেই ভয়টা ফিরে এলো, কেন এমন মনে হচ্ছে তার? এই বাড়ী, ঐ যে গাড়ীটা দীর্ঘপথ দীর্ঘরাত পার করে সে চালিয়ে আনলো, এই হাসিমুখ মেয়েটা যে কিনা এতদিন পরে প্রিয়সান্নিধ্যে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে, সব এমন স্বপ্নের মতন কেন মনে হচ্ছে? মনে হচ্ছে এক যাদুকর জাদুকাঠি ঘুরিয়ে এই বলবে "যা:",অমনি সব মিলিয়ে যাবে, চমকে উঠে সে দেখবে সে দাঁড়িয়ে আছে অদিগন্ত নগ্ন বালুর মধ্যে, একটি মরুচর তরুণী কাঁখে কলসী হাতে দড়িবালতি নিয়ে দূর থেকে দূরে চলে যাচ্ছে।

এইসব কি বলা যায় ওরিয়ানাকে? বলা যায়? নাহ, ও ভয় পাবে, উদ্বিগ্ন হবে।কিন্তু কাউকে তো বলতে হবে, কাকে বলবে গিবান?

ব্রেকফাস্টের পরে দুজনে মিলে ঘুরতে গেলো শহরের সবুজ নির্জন পার্কে। এটি একটি বন্যপ্রাণী সংগ্রহশালাও। স্বাভাবিক গাছপালার পরিবেশে রাখা হয়েছে হরিণ,নীলগাই, শিম্পাঞ্জী, গোরিলা, অস্ট্রিচ, হেজহগ ইত্যাদি। বড়ো বড়ো গাছের ছায়ায় ভারী মনোরম সে জায়গা। বড়ো বড়ো ময়ূর মুক্ত অবস্থায় ঘুরে বেড়াচ্ছে দর্শকের কাছে কাছে। দুপুর রোদে ক্লান্ত হয়ে ছায়াঘন ঝোপের আড়ালে চলে গেলো মস্ত পেখমওলা পুরুষ ময়ূরটি।

মেরি গো রাউন্ডে বাচ্চাদের চড়িয়ে দিয়ে বাইরে থেকে দেখছে তরুণ হাসিমুখ বাবামায়েরা, ওরিয়ানার মুখ খুশী হয়ে উঠছে। ও খুব ভালোবাসে ছোটোদের। একবার বললো, "আমাদের ছেলেমেয়েদের এখানে যখন নিয়ে আসবো, ওরা খুব খুশী হবে গিব।" অমনি ভয় লাফিয়ে উঠছে গিবানের মনের মধ্যে, ভবিষ্যৎ ভাবতে গেলেই শীত করছে ওর। ও শক্ত করে ধরছে ওরিয়ানার হাত, ওরিয়ানা অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলছে "কী হলো গিব?"

গিবানের মুখ ঘামে টসটস করছে, খসখসে দুর্বল গলায় সে কোনোরকমে বললো,"কেন জানি মাথায় ব্যথা করছে, একটু বসতে পারলে হতো। হয়তো গরমে এরকম লাগছে।"

গাছের ছায়ায় সিমেন্টের বেঞ্চিতে গিবানকে বসিয়ে দিয়ে কোল্ড ড্রিংকের স্টলের দিকে দৌড়ে গেলো ওরিয়ানা। পাঁচ মিনিটের মধ্যে ঠান্ডা পানীয় নিয়ে এলো। গিবান কয়েক চুমুক দিয়েই একটু হাসলো। ওরিয়ানা খুব অপ্রস্তুতমুখে ক্ষমা চাইছে, সারারাত ড্রাইভ করে আসা গিবানকে একটুও বিশ্রাম করতে না দিয়ে পার্কে নিয়ে এসেছে বলে।

গিবান ওকে আশ্বস্ত করে " না না ক্ষমা চাওয়ার কী আছে? আমি নিজেই তো বললাম যে এখানে আসবো।"

দুইজনে হাত ধরাধরি করে এবারে ফিরে যাচ্ছে বাড়ীর দিকে। ওরিয়ানা বললো,"বাড়ী গিয়ে ভালো করে বিশ্রাম নেবে আগে। ছি ছি,আমার আগেই খেয়াল থাকা উচিত ছিলো। তুমি তো চিরকালই ছেলেমানুষ, কিছুই খেয়াল থাকে না, কিন্তু আমারও কেন ভুল হলো?"

(চলবে)


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

খুব ভালো লাগলো ভাই। পঞ্চম পর্বের প্রত্যশায় থাকলাম।
ভালো থাকুন।

শেখ আমিনুল ইসলাম,

তুলিরেখা এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ ভাই শেখ আমিনুল ইসলাম। আপনাদের ভালো লাগলেই এ "আঙুল-কীবোর্ড-মন লেখে তিন জন" ধন্য হয়। হাসি
ভালো থাকবেন। আগামীকালই ৫ম পর্ব আসবে।
-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- নীল গাই জিনিষটা কী বলুন তো! নাইনে একটা গল্প ছিলো 'নীল গাইয়ের সন্ধানে' (বোর্ডে পাঠ্য ছিলো না অবশ্য)। গল্পটা পুরো মনে নেই। কিন্তু নীল গাই জিনিষটা বোধহয় বুঝিনি। এখন সেই নীল গাই আবার মাথায় গুঁতাগুঁতি শুরু করে দিয়েছে।
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক

তুলিরেখা এর ছবি

নীলগাই একরকমের অ্যান্টিলোপ।
আরে গুগুলকাকুকে কন না! কইয়া দিবো। আমি একটা লিংক পাইছি, অল্প কিছু পাইবেন তাতে।
http://www.nsrl.ttu.edu/tmot1/bosetrag.htm

-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

তিথীডোর এর ছবি

আবারো জানিয়ে দি, আপনার লেখার আমি বেজায় ভক্ত!
পরের পর্বের অপেক্ষায়...

--------------------------------------------------
"সুন্দরের হাত থেকে ভিক্ষা নিতে বসেছে হৃদয়/
নদীতীরে, বৃক্ষমূলে, হেমন্তের পাতাঝরা ঘাসে..."

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

তুলিরেখা এর ছবি

শুনে ভালো লাগলো।
ভালো থাকবেন তিথীডোর।
-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

অতিথি লেখক এর ছবি

"সোপ অপেরা"র মত!! হাসি :)
তবে, প্রথম প্যারায়

অনুযোগ-অভিযোগ, তারপরে জলযোগের
এত যোগের ব্যবস্থা দেখে মজা পাইছি। হাসি
পঞ্চম পর্বের অপেক্ষায়।

- মুক্ত বয়ান।

তুলিরেখা এর ছবি

সোপ অপেরা? আরে নজরুল ইসলাম! নজরুল ইসলাম!!! শুনতাছেন? আপনে করেন কী? প্রোডিউসার খুঁইজা বাইর করেন নাই এখনো? হাসি

আর যোগ? আরে ভাই, জগতে আছে কী যোগ আর বিয়োগ ছাড়া? তাও তো দার্শনিকেরা থুতনি চুলকাইয়া খালি কন ধ্রুবক ধ্রুবক! চিন্তিত

-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।