৬
গিবানের ভালো হয়ে উঠে বসতে সপ্তাহখানেক লাগলো। ততদিনে সবই ছন্দে ফিরে এসেছে প্রায়। কাজকর্ম চলছে পুরো ল্যাব কমপ্লেক্সে, হার্ডকোর টেকনিকাল লোকেদের কাছে ঝড়বৃষ্টির রাতের ভাঙচুর চুরি পলায়নের দুর্ঘটনা ল্যাবে একপেরিমেন্টের গন্ডগোলের মতন, একটা এক্সপেরিমেন্ট ভন্ডুল তো কী হয়েছে, ফের নতুন গোটা দশেক এক্সপেরিমেন্টের ডিজাইন করে সেগুলো করার কাজে লেগে গেলেই হয়! এই ধরনের সব মনোভাব।
বৃদ্ধ বৈজ্ঞানিক ডক্টর পেরিটানও ও দিব্যি ঠিক হয়ে গেছেন তরুণতরদের এই উত্সাহে উদ্যমে ভেঙে না পড়া মনোভাবে। সদ্য অসুখ থেকে ওঠা গিবানকে কেমন করে খবরটা দেওয়া হবে এটাই শুধু এখনো কেউ ঠিক করে উঠতে পারছে না। অবশেষে ভেনা এগিয়ে এলো, সেই ঠিক ঠাক করে খবরটা দেবে। গিবান জানতো ভেনা হিউম্যানয়েড রোবট, বস্তুত ভেনার ডিজাইন গিবান আর ওর এক রোবোটিক্স বিশেষজ্ঞা বান্ধবীর।
ধীরে ধীরে সইয়ে সইয়ে ভেনা খবরটা দিলো কিন্তু দেখা গেলো এত সতর্কতার কোনো প্রয়োজন ছিলো না। গিবান বেশ শক্ত গোছের লোক। নিরাসক্ত গবেষকের মতন সে বললো " আরে, তাতে কী হয়েছে? ফার্স্ট ট্রায়াল কি আর সবসময় ঠিকঠাক হয়? আমরা আবার সব নতুন করে করবো।"
দিন যায়, রাত যায়, নতুন দিন আসে। রাউলের স্যাবোট্যাজ ধরা পড়ে যায় একদিন। ভেনাই জানিয়ে দেয়, নইলে ব্যাপারটা আরেকটু হলেই ল্যাব কমপ্লেক্সে বিষ্ফোরণ ঘটার মতন বিপজ্জনক হয়ে যাচ্ছিলো।
রাউলকে কিন্তু পুলিশে দেওয়া গেলো না, না সে বর্ডার পার হয়ে পালায় নি অন্যদেশে, সে পৃথিবী পার হয়ে চলে গেছিলো। প্রচন্ড শকে হার্টফেল করে মারা গেছিলো রাউল, যখন সে চোখের সামনে ভেনাকে রোবট হিসাবে দেখলো! ওর অতিবড়ো দু:স্বপ্নেও বোধহয় বেচারা এই ভয়ংকর অবস্থা কল্পনা করতে পারেনি। যাকে দিনের পর দিন ভালোবেসে ধন্য হয়েছে, তাকে ইনঅ্যানিমেট যন্ত্র হিসাবে দেখা যে কী সাংঘাতিক জিনিস সে আমরা বুঝবো কেমন করে?
ভেনাকে ফিরিয়ে দেওয়া হলো রোবট ওয়ার্কশপে, সেখানে ওর ব্যবহারে ব্যবহারে ক্ষয়ে যাওয়া পার্টসগুলো বদলে নতুন করে দেওয়া হলে সে ফের ফিরে এলো নবোদ্যমে। কিন্তু কোথায় যেন সেই আগের ভেনা মিসিং !
সেই জ্বলজ্বলানো তরুণী আর নেই! ভেনা কি শুধুই যন্ত্র নাকি অন্যকিছু? ভালোবাসার যন্ত্রণা টের পেয়ে সে কি মানুষ-মানুষ হয়ে গেছিলো? তাই একদিন নিজেকে কড়া অ্যাসিড দিয়ে গলিয়ে ফেলে চলে গেলো অস্তিত্বের থেকে মুক্তি নিয়ে?
নতুন ক্লোন এক্সপেরিমেন্টসমূহ ভালোই এগিয়ে চলেছিলো পরিকল্পনা অনুযায়ী। মাস তিনেক কেটে গেছে এমন সময় একদিন গভীর রাতে এলো একটি টেলিফোন, ওরিয়ানার ফোন, গিবানকে চাইছে।
গিবান ল্যাবে ছিলো, সে লিঙ্ক অন করলো। ওরিয়ানা খুব আপসেট গলায় বলছিলো, কিছু না বলে গিবান কেন এইভাবে চলে গেছে! ওরিয়ানা কি কোনো ভুল করলো যে রেগে গিয়ে এভাবে বাড়ী থেকে চলে গেলো গিবান!
এ প্রান্তে গিবান এইসব কথার মাথামুন্ডু কিছুই ধরতে পারলো না! সে কোথা থেকে চলে গেছে! কবে সে রাগ করলো? দিশা কি মানসিক ভারসাম্য হারালো নাকি?
কিন্তু এইসব কিছুই বোঝা গেলো না, কান্নাভেজা উদ্বেগে জরজর গলায় ওরিয়ানা , "গিব, আমি আসবো তোমার ওখানে। আমার পাসপোর্টটোর্ট সব করা আছে, আসবো আমি গিব?"
"এসো, কিন্তু আমি কিছুই বুঝছি না। আমি তোমার উপরে রাগ তো করিনি! তোমার সঙ্গে তো তিনবছরের উপর দেখা হয়নি প্রায়, তাই কি তুমি আমার উপরে রাগ করেছ?"
খুব রেগে গেলো ওরিয়ানা, বললো,"ইয়ার্কি ভালো লাগছে না গিব, হানিমুনের থেকে ফিরেই আমি তোমাকে কেমন কেমন ছাড়া ছাড়া উদাস উদাস দু:খী দু:খী দেখেছি। হয়তো আমি কোনোভাবে তোমার মনের মতন হইনি, এতদিন পরে বুঝেছ। কিন্তু তবু একটা দায়িত্বশীল মানুষের মতন আচরণ করবে তুমি এইটুকু তো আমার এক্সপেক্টেশনের মধ্যে ছিলো! হঠাৎ কাউকে না বলে এভাবে নিরুদ্দেশ হয়ে যাবে!" ওরিয়ানা ফুঁপিয়ে ওঠে, কথা বলতে পারে না আর।
গিবানের কানের উপর দিয়ে হানিমুন, উদাস দু:খী, মনের মতন না হওয়া, নিরুদ্দেশ---কথাগুলো এলোমেলো ঘূর্ণির মতন ঘুরছিলো, কোনো অর্থবোধ হচ্ছিলো না। এসব কি বলছে ওরিয়ানা? হানিমুন কেন? কার সঙ্গে? ওর মাথাটাথা ঠিক আছে তো!
"ওরিয়ানা, ওরিয়ানা, শোনো, মন দিয়ে শোনো। একটু মাথাটা ঠান্ডা করো। মন দিয়ে শুনে উত্তর দাও। তোমার কি বিয়ে হয়ে গেছে? হানিমুনের কথা বলছিলে যে!"
এইবারে ওরিয়ানা এত রেগে গেলো যে গিবানকে কানের কাছ থেকে লিঙ্কটা কয়েক ইঞ্চি দূরে সরাতে হলো ওরিয়ানার চিত্কার যাতে কান না ফাটিয়ে দেয়! ওদিকে ওরিয়ানার চিত্কার দিয়ে গলা ভেঙে গেলো, সে ভাঙা গলায় কাঁদতে কাঁদতে বলছিলো," তোমাদের সবাই সমান। এখন বিয়েও অস্বীকার করছো! তোমাকে আমি বিশ্বাস করেছিলাম গিবি, ভেবেছিলাম তুমি একটা প্রকৃত মানুষ। কিন্তু এখন দেখছি তুমিও আর কিছু না, একটা দানব। মনস্কামনা পূর্ণ হয়ে যাবার পরে ছেঁড়া ফুলের মত সব ফেলে মাড়িয়ে চলে যেতে পারো। তোমরা সবাই সমান।"
গিবান একেই বিশেষ গুছিয়ে কথা বলতে পারেনা, তার উপরে এখন এত রেগে যাওয়া বান্ধবীকে সামলাবে কী করে, ঠান্ডা করবে কী করে তা একেবারেই ভেবে পেলো না। তবু শেষ চেষ্টা হিসাবে বললো," দ্যাখো ওরিয়ানা, তুমি যা খুশী ভাবতে পারো, কিন্তু সত্য হলো এই যে গত তিনবছর ধরে আমি এখানেই আছি, রাতদিন কাজ চলছে ল্যাবে, মাসতিনেক আগে একটা দুর্ঘটনা ঘটেছিলো, আমার নিজেরও খুব গন্ডগোল গেছে। অত্যন্ত অসুস্থ ছিলাম কিছুদিনের জন্য। তারপরে ও অনেক ঝামেলা চলছে রোজই, কিন্তু আমি একটা কথা বলতে পারি নিশ্চিত, যে আমি তোমাকে কখনো ঠকাই নি। তুমি এসো এখানে, যত তাড়াতাড়ি পারো এসো, তোমার সব ভুল বোঝাবুঝি দূর হয়ে যাবে আশা করি।"
(চলবে)
মন্তব্য
- চলুক তবে...
হানিমুনের অংশটুকু একটু ডিটেইলে বললে ভালো হতো না!
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
আরে জানেন তো, ডেভিল ইজ ইন দ্য ডিটেইলস!
আর আপনে কুমার ব্রহ্মচারী, আপনে এইসব হানিমুনফুন কী কন!
শালিকারা জানলে তখন ব্যাপার গুরুতর হইয়া যাইবো না?
-----------------------------------------------
কোন্ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
********************************************************
আমার লেখায় বানান এবং বিরাম চিহ্নের সন্নিবেশনের ভুল থাকলে দয়া করে ধরিয়ে দিন।
********************************************************
আমার লেখায় বানান এবং বিরাম চিহ্নের সন্নিবেশনের ভুল থাকলে দয়া করে ধরিয়ে দিন।
ধন্যবাদ বর্ষা।
-----------------------------------------------
কোন্ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
মানুষের কল্পনা যে কী পরিমাণ অমানুষিক হইতে পারে, এটা আপনার লেখা পড়ে বুঝলাম!! একটা রোবটকে ভালোবাইসা ফেলছে!! আবার, সেই রোবটও ভালোবাসা বুঝতে পেরে নিজেকে নষ্টও করে ফেললো!!!
গল্পের টুইস্ট শুরু হইল মনে হচ্ছে!! :)
পরের পর্বের অপেক্ষায়।
- মুক্ত বয়ান।
আরে বাউলি কি সাধে কইছে "গোলেমালে গোলেমালে পীরিত কইরো না / করলে পীরিত ছাইড়ো না/ গোলে মালে গোলে মালে পীরিত কইরো না/ পীরিতি কাঁঠালের আঠা লাগলে ছাড়ে না "
আরে এই যে আমরা মানুষ, আমরাই যে কারুর বানানো হাইলি অ্যাডভান্সড রেপ্লিকেটিং ইমোরোবট না, সেটা বা কেমন করে জানেন? হয়তো তারা আমাদের অবজার্ভ করে করে অবাক হয়ে বলছে- আরে, আরে এরা এমুন করে ক্যান?
একজন মানুষ যখন আরেকজনকে ভালোবাসে, কেন যে ভালোবাসে সেটা কি কখনো ব্যাখা করা যায়?
ভালো থাকবেন।
-----------------------------------------------
কোন্ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
মন্তব্যে জাঝাঁ!!
- মুক্ত বয়ান
আপনার কী মনে হয়?
-----------------------------------------------
কোন্ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
কল্পবিজ্ঞান আমার পছন্দের বিষয়। খুব আগ্রহ নিয়ে পড়ছি সবগুলো পর্ব একত্রে, বেশ ভালো লাগছে তুলি'দি।
তবে এই পর্বে এসে একটা খটকা লাগলো, তাই প্রশ্ন। প্রকৃত গিবান যেহেতু আড়াইবছর ধরে ক্লোন নিয়ে গবেষনা করছিলো, তারপর হঠাৎ করে তার ক্লোন উধাও হয়ে গেলো, তাতে তাকে তেমন বিচলিত হতে দেখছিনা বা সেই ক্লোন এর হদিস বের করার কোন তৎপরতা দেখছিনা কেনো? হুবহু তারই মত এক গবেষকের এক কপি ঘোরাফেরা করবে....এটা তো রীতিমত ভয়ংকর ব্যাপার।
তারপর সে অসুস্থ হবার পর ৩ মাস কেটে গেলো, এর মাঝে ওরিয়ানাকে এ ব্যাপারে কিছু জানালো না কেন?
আমার প্রশ্নঝড়ে মাইন্ড খেয়েননা যেনো আবার তুলি'দি পরেরগুলো পড়ি......
পড়ছেন বলে ধন্যবাদ। পরেরগুলো পড়া হলে বলবেন কিন্তু কেমন এগোচ্ছে।
আর গবেষকের তিনচারটে কপি তো ভালো ব্যাপার! একজন যায় পাবলিক লেকচার দিতে যারে কয় আউটরীচ, একজন রেডিও শো তে গিয়ে বাকতাল্লা দেয় যারে কয় এন্টারটেনমেন্ট, একজন কনফারেন্সে গিয়ে ফাটিয়ে প্রেজেন্টেশান দেয় আর অন্য গবেষকদের সঙ্গে বেশ যারে কয় কমুনিকেশন তাই করে-সেই ফাঁকে আসল লোক গবেষণা চালিয়ে যায়!
ফান্ডিং এর জন্য কত না ভেজাল করতে হয়, কয়েকটা কাপি থাকা তো ভালো।
জোকস অ্যপার্ট, আসলে ঐ রাতের দুর্ঘটনার পরে আসল গিবান নিজেও তো অসুস্থ ছিলো কিছুদিন। সেরে উঠে সে তো আবার অন্যান্যদের সাথে কাজে লেগে পড়েছে। দুর্ঘটনা যা হবার হয়ে গেছে, সে সেটাকে পাত্তা দিতে চাইছে না। অবশ্য নিখোঁজ গাড়ী আর সম্ভবত নিখোঁজ ক্লোনের জন্য ফরমাল খোঁজাখুঁজি চালিয়ে যাচ্ছে সন্ধানীবাহিনি, কিন্তু মূল কাহিনিতে তা গৌণ।
লক্ষ্য করে দেখবেন ওরিয়ানা নিজেও সেই ব্যাপারে তেমন কিছু জানতে চায় নি গিবানের কাছে, সে আসল গিবানকে পেয়েই সুখী। সে চালাক মেয়ে, অহেতুক জটিলতা বাড়িয়ে তুলতে চায় না।
ভালো থাকবেন, এরকম প্রশ্নওয়ালা কমেন্ট দেবেন যাতে বেশ আলোচনা করা যায়। না হলে একলাইনের কমেন্ট পেলে তো তেমন কিছু কথা কওয়ার থাকে না উত্তরে, মিথস্ক্রিয়া হয় না তেমন।
শুভেচ্ছা রইলো।
-----------------------------------------------
কোন্ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
নতুন মন্তব্য করুন