প্রতিলিপি(৮)

তুলিরেখা এর ছবি
লিখেছেন তুলিরেখা (তারিখ: বিষ্যুদ, ১৪/০১/২০১০ - ৮:৫৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

এখানে ৭ম


তিনদিন পরে ল্যাব কমপ্লেক্সে ওরিয়ানা এসে পৌঁছালো দুপুরবেলা। ওকে রিসিভ করতে গেটের কাছে ছিলো গিবান নিজে। ক্লিয়ারেন্স না থাকলে তো কেউ এখানে বাইরে থেকে ঢুকতে পারে না, তাই গিবান নিজেই নিরাপত্তারক্ষীদের পোস্ট পার হয়ে বাইরে এসে ওরিয়ানাকে রিসিভ করে ভেতরে নিয়ে যায়।

ঝলমল রোদ্দুরে ভরা নীল আকাশওয়ালা একটা সুন্দর দিন, চারিপাশে বড়ো বড়ো সবুজ গাছে ভরা বীথি দিয়ে যখন গিবানের পাশে পাশে হেঁটে ওর অ্যাপার্টমেন্ট বাড়ীর দিকে ওরিয়ানা যাচ্ছিলো, তখন দীর্ঘ ভ্রমণের ক্লান্তি মুছে যাচ্ছিলো হাল্কা বাতাসের ছোঁয়ায়, দূরে সবুজের আড়ালে আড়ালে লুকিয়ে থাকা পাখিদের ডাকে আর গিবানের সুখ-উজল মুখের দিকে চেয়ে।

এই তো তার গিব, চেনা সেই আপন মানুষটি, নাহ, এ তাকে ঠকাতে পারে বলে ওরিয়ানা আর বিশ্বাস হয় না। কিন্তু তাহলে ঐ হানিমুন? ঐ বিভ্রান্ত গিবান ? ঐ আবিষ্টমুহূর্তে সহসা উদাস ও দু:খী হয়ে পড়া মানুষটা কে ছিলো? এই গিবান বলছে সে কোথাও যায় নি, অন্যেরা কী বলে জানলেই সত্যিটা বোঝা যাবে, কিন্তু ওর জানতে ইচ্ছে করছে না। এক অভূতপূর্ব সুখে সে ভরে উঠছে, খুঁড়ে খুঁড়ে সত্যমিথ্যা জানতে চেয়ে সে এই দুর্লভ আনন্দ ভেঙে দিতে চায় না। কিন্তু সত্য? সত্য জানতে চাইবে না সে? ওরিয়ানা দ্বিধা করছে, সে এই মানুষটিকে হারাতে চায় না আবার মিথ্যার কাঁটাও বুকে পুষে রাখতে চায় না। চলতে চলতে সে ভাবছে আর ভাবছে।

এসে গেলো গিবানের বাড়ী। দোতলায় সুন্দর সাজানো ঘরে ওরিয়ানাকে নিয়ে গিয়ে গিবান বললো, "শোনো ওরিয়ানা, এই ঘর তোমার জন্য। এতটা পথ এসে তুমি ক্লান্ত। আগে স্নান করে নাও, ক্লোজেটে তোমার কিছু পোশাকও আছে, কালেভদ্রে শপিং এ গেলে তোমায় গিফট দেবার জন্য কিনি, প্রত্যেকবারই ভাবি তোমায় পাঠিয়ে দেবো, কিন্তু রয়েই গেছে। ভালোই হলো, এখন ব্যবহার করতে পারবে।"

সঙ্গে সঙ্গে ক্লোজেটের দরজা খুলে ওরিয়ানা অবাক! ক্লোজেট ভর্তি নানারকম পোশাক, সাধারণ প্রত্যেকদিনের পোশাক থেকে একেবারে উৎসবের পোশাক পর্যন্ত সবরকম। সে গিবানের দিকে চেয়ে হাসলো, বললো,"পাগল, একেবারে পাগলই আছো। কোনোদিন যদি না আসতাম, এগুলো এইরকম পড়ে থাকতো? এই ঘর, ঐ আয়না, ড্রেসিং-টেবল, আরে একটা বেহালা! আবার একটা গিটার আর একটা তানপুরা! এসবও রেখেছ? " ওরিয়ানা টেবিলটার দিকে এগিয়ে যায়, সেখানে সুন্দর ঢাকনা পরানো বাদ্যযন্ত্রগুলো রাখা।

গিবান মৃদু হাসে বলে," তুমি ফ্রেশ হয়ে নীচে এসো, আমরা একসঙ্গে কাফেটেরিয়ায় গিয়ে লাঞ্চ করবো।"

স্নান করে হাল্কা কচি কলাপাতা রঙের পোশাক পরে হাল্কা রজনীগন্ধাসৌরভের পারফিউম দিয়ে বেশ সাজলোগুজলো ওরিয়ানা, এমনকি পোশাকের সঙ্গে ম্যাচ করে সবুজ পাথর বসানো কানের দুল পরলো পর্যন্ত! আগের ক'দিন টেনশনে সে একেবারে সাজগোজ করতে পারে নি।

কাফেটেরিয়া বেশ নির্জন, বারোটা থেকে একটা অবধি ভীড় থাকে, তখন লাঞ্চের ছুটি, তারপরে খাওয়া দাওয়া শেষ করে সবাই চলে যায়। গিবান আর ওরিয়ানা একটা গোল টেবিলে মুখোমুখি বসে খাচ্ছিলো। খাবারগুলো চমৎকার স্বাদের। ওরিয়ানা হাসছিলো, দেশী খাবার এই বিভুঁইয়ে! গিবান বললো রোজ এরকম হয় না, আজকে ওরিয়ানা আসবে বলে সকালে স্পেশাল অর্ডার দিয়ে রেখেছিলো সে।

তৃপ্তি করে খাওয়া শেষ করে ওরিয়ানা ফিরলো গিবানের অ্যাপার্টমেন্টে আর গিবান চলে গেলো ল্যাবে, বাকী দিনটুকু কাজ করেই সাড়ে পাঁচটায় ফিরবে বললো। এমনিতে গিবান ল্যাবে অনেক বেশী রাত অবধি থাকে, কোনোদিন দুটো বা আড়াইটেতে ফিরে ঘন্টা তিনেক ঘুমিয়েই উঠে পড়ে স্নানটান ইত্যাদি সব সেরে আবার ল্যাবে ছোটে। কাজপাগল লোক সে, কোনোদিন ক্লান্তি অনুভব করে না, ঘন্টাতিনেক বা ঘন্টাচারেক ঘুম ওর অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া শরীরে যথেষ্ট মনে হয়।

আজকে কিন্তু ল্যাবে জটিল ক্যালকুলেশানের মাঝে মাঝেই অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিলো সে। মাঝে মাঝে ঘুমঘুম পাচ্ছিলো ওর, এ কি এত পেট ভরে দুপুরে ভালোমন্দ খাওয়ার ফল নাকি ওরিয়ানার জন্য মন ছটফট করছে?

বেলা তিনটের সময় কড়া কফি আনিয়ে খেতে খেতে কাজ করতে থাকলো, ওর অ্যাসিস্টেন্ট তরুণ দুজন-কলেজ থেকে সদ্য পাস করা দুটো ছেলে সিমিয়ন আর শেয়ন- একটু অবাক, কারণ এই সময়ে এমনিতে কফি টফি কিছু খায় না গিবান। মাঝে একবার সিমিয়ন কী একটা যেন ভুল করায় গিবান এমন ধমক দিলো যে সিমিয়ন শেয়ন দু'জনেই এত অবাক হয়ে গেলো যে বলার না। আসলে ওদের সঙ্গে গিবানের ঠিক সুপারভাইজার অ্যাসিস্টেন্ট রকম সম্পর্ক না, বরং বন্ধুর মতই সম্পর্ক বলা যায়। কোনোদিন ওদের সঙ্গে মেজাজ গরম করে না গিবান, আজকে হঠাৎ ...

সিমিয়ন মুখ কালো করে ফের কাজটা নিয়ে বসলো, আর গিবান নিজের টেবিলে ফিরে কপাল টিপে ধরে চোখ বুজে বসে রইলো,ওর সামনে ধূমায়িত কফির কাপে দুধচিনি ছাড়া কালো কফি ক্রমে ক্রমে ঠান্ডা হয়ে আসতে লাগলো। শেয়ন গোছানো ছেলে, সে এসে গিবানকে বললো,"স্যর, একটা কথা বলি যদি কিছু মনে না করেন। আপনাকে অত্যন্ত ক্লান্ত দেখাচ্ছে,আপনি বাড়ী গিয়ে বিশ্রাম নিন। আমরা দু'জনে মিলে সিমুলেশান মিলিয়ে সব ঠিক করে রাখবো, কাল সকালে এসে দেখবেন।"

গিবান কপাল থেকে হাত সরিয়ে চোখ মেলে রেগে চেঁচিয়ে উঠতে গিয়েও সামলে নিলো, ওর মনে হচ্ছিলো ওরিয়ানা কোথায় যেন দাঁড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে। অল্প একটু হেসে অত্যন্ত দীন গলায় গিবান বললো,"ঠিক আছে, তোমাদের আমি ভরসা করি, তাতো জানোই। একটা কথা শুনবে শেয়ন? সিমিয়নকে বলবে আমি মাফ চেয়েছি? আসলে আমি ওভাবে বলতে চাই নি, আজকে হঠাৎ কী যে ... খুব ক্লান্ত ... ওকে বলবে মাফ চেয়েছি?"

শেয়ন হেসে ফেললো," আপনি নিজে গিয়ে বলুন না, ও গোমড়ামুখে বসে আছে, চলুন।"

গিবান কুঁকড়ে গেলো ভেতরে ভেতরে, তবু উঠলো, যা করে ফেলেছে তা তো করেই ফেলেছে, এবারে তার প্রতিকার করার সময় অন্যের ঘাড়ে চাপালে তো চলবে না!

সিমিয়ন চুপ করে বসেছিলো সংখ্যামালা সামনে নিয়ে, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হাতের লেখায় খুব সুন্দর করে সাজানো সমীকরণ আর সংখ্যারাশি। গিবান কাছে যেতে উঠে দাঁড়ালো সে। অন্য এক দূরের দেশ থেকে এসে যোগ দিয়েছে সিমিয়ন, সেই দেশের কালচার অনুযায়ী উর্ধ্বতনদের মর্যাদা এত বেশী যে সর্বদাই অধস্তনদের কেঁচো হয়ে থাকতে হয়। এখানে যদিও কালচার অনেকটাই আলাদা, অনেকটাই সমব্যবহারের নীতি, তবু এখনো সিমিয়ন অভ্যস্ত হয় নি। ওর মুখ দেখে গিবানের কেমন কষ্ট হলো। তার নিজের তো স্বপ্নের প্রোজেক্ট, আপনজনেদের ছেড়ে পড়ে থাকার যুক্তি আছে কিন্তু এরা তো দুটো পয়সার জন্য এই গডফরসেকন জায়গায় পড়ে আছে বছরের পর বছর। কী আছে এখানে? না এদের পরিবার পরিজন না কোনো সেরকম উত্সব আয়োজন, না তেমন নামকরা বেড়াবার জায়গা।

সিমিয়নের কাঁধে হাত রেখে গিবান ভাঙা গলায় কোনোরকমে বললো, "মাফ চাইছি সিমিয়ন। আমার অত্যন্ত অন্যায় হয়েছে ওভাবে বলা। আমায় ... আমায় ক্ষমা করো।"

সিমিয়ন কিছুক্ষণ শক্ত কাঠের মতন হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো, তারপরে হঠাৎ একেবারে কেঁদেই ফেললো দু'হাতে মুখ ঢেকে। গিবান চরম অপ্রস্তুত। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা গিবানের সামনে সিমিয়ন যে কতক্ষণ ওরকম কাঁদতো কেজানে। প্রত্যুৎপন্নমতি শেয়ন এসে পরিস্থিতি সামাল দিলো।

সব মিটিয়ে টিটিয়ে ফিরতে গিয়ে গিবান দেখলো তার ঝিমধরা ভাব আর মাথাধরা পুরো কেটে গেছে, আরো কিছুক্ষণ কাজ করাই যায়। তাই এখন না ফিরে কাজ খানিক এগিয়ে ফেরাই ভালো, ভাবলো ও।

টানা ঘন্টা আড়াই কাজ করে একটু পায়চারী করার জন্যে বাইরে আসতেই দেখলো অপূর্ব সন্ধ্যা নেমে আসছে, পশ্চিম আকাশে আবীর ঢালা, মাথার উপরে নীল আকাশে গোলাপী ওড়নামেঘ, পাখিরা দলে দলে পশ্চিমের ঐ রঙীন আকাশের উপর দিয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিন্দুর মতন ফিরছে। প্রায়ই তো সন্ধ্যা হওয়া দেখে গিবান, আজকে এতটা অসাধারণ লাগছে কেন?

কাগজপত্র গুটিয়ে ফাইলে গুছিয়ে রেখে, কম্পু আর সিমুলেটার বন্ধ করে সিমিয়ন শেয়নকে ডেকে সব বুঝিয়ে বাড়ীর দিকে রওনা দিলো। কাছাকাছি পৌঁছে ওরিয়ানার গলার সুরেলা শব্দ ভেসে এলো, সুরযন্ত্র বাজাতে বাজাতে সে গাইছিলো," দেখছি চেয়ে প্রথম তারা / সেই যেন চায় আমার চোখে / তার দু'খানি নয়নতারা।"

গিবানেরও খুব প্রিয় এই গান, সে পশ্চিমের আকাশে তাকিয়ে দেখলো সন্ধ্যার তরল অন্ধকারে আকাশে জ্বলজ্বল করছে একটা তারা, সন্ধ্যাতারা, সে জানে ওটা গ্রহ আসলে।

কলিং বেলে হাত রাখতে গিয়েও রাখলো না গিবান, নিজের চাবি বের করে প্রায় নি:শব্দে দরজা খুলে ঢুকলো। সাবধানে ঘরে ঢুকে গিবান উঁকি দিয়ে দেখলো ওরিয়ানা দোতলায় ব্যালকলিতে মাদুর বিছিয়ে বসেছে, পরণে চন্দনীরঙের পোশাক, পাশে চন্দনগন্ধের ধূপ জ্বলছে, দক্ষিণা বাতাসে ওর চুল উড়ছে। ওরিয়ানার মুখ আকাশের দিকে, দেখেনি গিবানকে। গিবান পা টিপে টিপে নি:শব্দে নিচে নেমে এলো। সে স্নান করে নতুন পোশাক পরে তবেই কাছে যাবে, সারাদিনের ঘষটানিওলা মানুষ হিসাবে সে ওরিয়ানার কাছে যেতে চায় না।

(চা-কড়াইশুঁটীর কচুরি ব্রেক হাসি )


মন্তব্য

ধুসর গোধূলি এর ছবি

দোতলায় সুন্দর সাজানো ঘরে ওরিয়ানাকে নিয়ে গিয়ে গিবান বললো, "শোনো ওরিয়ানা, এই ঘর তোমার জন্য।
গিবান যাই জানুক অন্তত ওরিয়ানা তো জানে তাদের বিয়ে হয়েছে। তারপরেও ওরিয়ানাকে তার আলাদা ঘর দেখিয়ে দেয়ার পর ওরিয়ানা'র কোনো অভিব্যক্তি চোখে পড়লো না! এখানে একটু খটকা লেগেছে।

হাল্কা কচি কলাপাতা রঙের পোশাক পরে হাল্কা রজনীগন্ধাসৌরভের পারফিউম দিয়ে বেশ সাজলোগুজলো ওরিয়ানা
ওরিয়ানা দেখি আমার মনমতো সাজে। তায় ঠায়ঠিকানা দিয়েন তো, ইট্টু যোগাযোগ টোগাযোগ করে দেখি, কী বলে! হাসি
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক

তুলিরেখা এর ছবি

ওরিয়ানা কোনোভাবে ঠিকই বুঝতে পারছে এ গিবান আর সে গিবান আলাদা। কিন্তু সে সেটাকে খুঁড়ে তুলে শান্তি নষ্ট করতে চাইছে না। লক্ষ্য করলে দেখবেন, সে কাউকে জিজ্ঞেস ও করে নি কিছু।

ওরিয়ানার ঠাঁইঠিকানা? আপনার সাহস আছে! এক ডজন গিবানের মহড়া নিতে পারবেন? চোখ টিপি (এর পরে আর কত ক্লোন বানাবে তার কি কোনো ঠিক আছে? )

আপনার কমেন্টগুলো বেশ ভালো লাগে, সুন্দর ডিটেলগুলো উঠে আসে। ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।
-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

শেখ নজরুল এর ছবি

চমতকার লিখেছেন। ধন্যবাদ আপনাকে।
শেখ নজরুল

শেখ নজরুল

তুলিরেখা এর ছবি

পড়ার জন্য আপনাকেও ধন্যবাদ।
-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।