১১
গিবান-ওরিয়ানার ভ্রমণের আনন্দে সেদিন নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। উল্কাবৃষ্টি হবার কথা রাতে, গিবান আর ওরিয়ানা সারা রাত আকাশের নীচে কাটাবে বলে সন্ধ্যেবেলা খেয়ে দেয়ে ঠিকমতন পোষাকপত্তর পরে রেডি হলো। মাদুর, টর্চ, রেডিও, ফ্লাস্কে চা, কিছু কাগজের কাপপ্লেট, ঠোঙায় চানাচুর, প্লাস্টিকের বাক্সে প্যাটিস, সামোসা, সসের প্যাকেট ইত্যাদি সাজসরঞ্জাম নিয়ে বেরোলো।
ওদের আতিথ্যদানকারী সরাইয়ের মালিক-মালকিন ওদের আইডিয়াতে চমত্কৃত হয়ে নিজেরাও একদিন ঐভাবে হোল নাইট প্রোগ্রাম করবেন বলে ফেললেন, বয়স হয়েছে তো কী হয়েছে! একদিন তাদেরও তো এমন দিন ছিলো। ওঁরা ভেবেছেন যে এরা নির্ঘাত হানিমুনে এসেছে। নইলে এমন ছেলেমানুষী করে নাকি কেউ এমনি বেড়াতে এলে? ওরিয়ানাকে ভদ্রমহিলা জিগ্গেসও করেছেন ঠারে ঠোরে, ওরিয়ানা ঠোঁট ছড়িয়ে হেসেছে খালি। ওতেই ভদ্রমহিলা এত সন্তুষ্ট হয়েছেন যে স্পেশাল একটা কি ঝালনিমকি তৈরী করে ওদের সঙ্গে দিয়ে দিয়েছেন রাত্রিব্যাপী পিকনিকে যাতে খেতে পারে কোনোসময়।
ওরিয়ানার সত্যি সত্যিই কিন্তু হানিমুনের কথা মনে হচ্ছিলো, ওর সত্যিকারের হানিমুনটা এত ভয়ানক দু:স্বপ্নের মতন যে ওটা ঘটেছিলো কখনো এটা সে মন থেকে মুছে ফেলতে চায়। গিবানের ব্যাপারে তাই সে ওদের ল্যাব কমপ্লেক্সেও কাউকে কিছু জিগ্গেস করেনি, গিবান কি কোথাও গেছিলো না ওখানেই ছিলো-এইধরনের কোনো প্রশ্নই সে কাউকে করেনি। হয়তো গিবান গেছিলো, হয়তো নয়। কী হবে সত্য জেনে? যে সত্য মিছিমিছি দু:খ দেবে তা জেনে লাভ কী?
অবিকল গিবানের মতন দেহমন ওরিয়ানার সেই দু:খী ক্ষণসঙ্গী হয়তো এই গিবান নয়, তাতে কী এলো গেলো? সে যদি এ নাও হয়, ওরিয়ানা তো তাকে এই গিবান হিসাবেই নিয়েছিলো!
নারিকেলবীথি যেখানে সমুদ্রতীরের সাদা বালুবেলার সঙ্গে মিশে গেছে সেইখানে ফাঁকা দেখে জায়গা বেছে গিবান মাদুর বিছিয়ে ফেলে হুড়হুড় করে সব জিনিসপত্র মাদুরে ফেলে ঝাড়া হাতপা হয়ে একটু দৌড় দিয়ে আসতে গেলো সমুদ্রের কাছ থেকে, শুকনো বালি থেকে ভেজা বালির দিকে যেতে যেতে ওর জুতোর ছাপ পড়ছিলো ক্রমশ বেশী বেশী গভীর হয়ে। ওর ভারী খারাপ লাগলো, জুতো যেন প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখছে ওকে, ফিরে এলো ও মাদুরের কাছে। জুতোমোজা খুলে রেখে এবারে খালিপায়ে দৌড়োতে দৌড়োতে সর্বাঙ্গে আনন্দের শিরশিরানি অনুভব করছিলো।
ওরিয়ানা এলোমেলো ভাবে ফেলা জিনিসপত্রগুলো গোছাতে গোছাতে বলছিলো "পাগল! এক্কেবারে পাগল!" দূর থেকে গিবানের ডাক এলো," ওরিয়ানা-আ-আ-আ, এসো, এসো। দেখো কী আশ্চর্য সুন্দর! "
ওরিয়ানাও জুতোটুতো খুলে রেখে শুকনো বালি পার হয়ে তরঙ্গধৌত ভেজাবালির উপর দিয়ে পরিচ্ছন্ন সুন্দর পদচিহ্ন রাখতে রাখতে দৌড়ে গেলো গিবানের কাছে, জলসীমায় পৌঁছে দুজনে ফিরে তাকালো পাহাড়ের দিকে, ঠিক তক্ষুণি পাহাড়ের শীর্ষের কাছে সবুজ আভা তুলে আকাশের কালো গায়ে উল্কা জ্বলে উঠলো।
প্রথম উল্কা দেখার আনন্দে হাই ফাইভ করে দু'জনে হাতে হাত জড়িয়ে ফিরে এলো মাদুরে। রেডিও অন করে দিলো, এফ এমে অনুষ্ঠান চলছিলো এই উল্কা দেখা নিয়েই, লোকে ফোনও করছিলো, জানাচ্ছিলো কে কোথায় কীরকম দেখছেন। তারা নিজেদের লিঙ্ক অফ করে রাখলো, এই আশ্চর্য রাতে কেউ যেন ডিসটার্ব না করে!
একটা দুটো করে উল্কা জ্বলে জ্বলে উঠে নিভে যায়, আকাশভরা তারা যেন ঝমঝম করছে, দূরে সমুদ্রতরঙ্গশীর্ষে অদ্ভুত আলো জ্বলজ্বল করছে।
"আচ্ছা গিব, সমুদ্রে যেসব জীব থাকে, সেইসব জীবেরা আকাশটাকে, ঐ তারাদের ঠিক কেমন ভাবে দ্যাখে বলো তো? এই উল্কাজ্বলা ওরা কীভাবে দ্যাখে? আদৌ ওরা কি জ্যোতিষ্ক ইত্যাদি দেখতে পায়?"
"ওরা আরো ভালো দ্যাখে। সারফেসের কাছে কাছে যারা থাকে, তারা দিব্যি দেখতে পায়, পুরো একশো আশি ডিগ্রী না বটে, কিন্তু অনেকটাই। জলের মধ্য দিয়ে আলো চলতে পারে দিব্যি। তুমি তো জানোই। জলের ভিতর মার্বেল ফেলে দ্যাখো নি? আরে আমরাও তো বাতাসের সমুদ্রের মধ্যে ডুবে আছি, আমাদের কাছেও তারার আলো তো রিফ্র্যাকটেড হয়েই আসে। মহাসমুদ্রের জীবেদের কাছে আকাশ দ্যাখা আমাদের তুলনায় সুবিধাজনক, কোনো গাছটাছের বা পাহাড়ের বাধা নেই, শহরের ধোঁয়া নেই, লাইট পলুশন নেই ... অবশ্য আমরা নিজেরা জাহাজ টাহাজ ওশেন লাইনার টাইনার পাঠিয়ে কিছুটা দূষিত করে দিয়েছি ... "
"একবার জলচর জীব হয়ে দেখতে ইচ্ছে করে গিব, কেমন লাগে দুনিয়াটা ... " ওরিয়ানার মুখ আকাশসমুদ্রের দূর মিলনস্থলের দিকে, দু'চোখে স্বপ্নলীন দৃষ্টি।
গিবানের মুখকানগলাহাত সহসা অস্থির হয়ে ওঠে, ও দুইহাতের কাপে ওরিয়ানার মুখ ধরে নিজের ঠোঁট ওরিয়ানার ঠোঁটের দিকে নামিয়ে আনে .... তারপরের আধাঘন্টা অদ্ভুত ঝড়ের মতন, দুজনের স্মৃতিতেই সময়ের পারম্পর্য্য হারিয়ে যায়, সময়হীন স্বপ্নলোকে চিরন্তন দয়িত-দয়িতার মতন অন্তহীন মিলনে মিলে যেতে যেতে ওদের বাকশ্রুতিময় পার্থিব অনুভূতি অন্যলোকে চলে যায়, ওদের চারধারে বালিতে ছড়িয়ে থাকে ওদের সমস্ত পরিত্যক্ত বসন, ওদের মাথার উপরে সমগ্র আকাশ জুড়ে তখন দ্যুলোকের অগ্নিক্রীড়ার মতন তখন শত শত উল্কা জ্বলে জ্বলে জ্বলে জ্বলে উঠছে নিমেষ নিমেষ জুড়ে। অজস্র অজস্র উল্কা, কখনো সবুজ আলোর দ্যুতি, কখনো কমলা আলো, কখনো লাল আলো। উপরে কোথায় যেন উত্সব, সেখানে ফুলঝুরি, চর্কিবাজি, তুবড়ি জ্বালিয়ে কারা উত্সব করছে। এই জ্বলানেভার আলোকোত্সবের উপরে জেগে থাকে চিরন্তন তারারা, স্নেহকোমল আলোর দৃষ্টি মেলে।
সেই রাত্রি তিহা আর তিশানেরও বিশেষ রাত্রি। বাদামী পাহাড়ের চূড়ার কাছে একটি গুহা আছে, সেই গুহার সম্মুখে একটি উন্মুক্ত চাতাল, সেই চাতালে ওরা ওদের বাসর রাত্রি কাটাচ্ছিলো।
সেদিন বিকালে বৃদ্ধ জ্ঞানী জ্যোতিষী ও ভিষক কিন্মল আগুনের ধুনির সামনে সমাজবৃদ্ধদের আশীর্বাদ নিয়ে এবং জ্যোতিষগণনার শুভলগ্ন মিলিয়ে তিহা ও তিশানের বিবাহ দিয়েছেন। অগ্নিপূত মন্ত্রশলাকা তন্তুতে গেঁথে ঝুলিয়ে দিয়েছেন ওদের দু'জনের গলায়, দু'জনের হাতে এঁকে দিয়েছেন উল্কি, কপালে দিয়েছেন ভেষজ ও ভস্মের মিশ্রণের ফোঁটা, দু'জনের প্রত্যেক হাতের মণিবন্ধে বেঁধে দিয়েছেন শুষ্ক একজাতীয় বিশেষ লতা।
তারপরে সকলে প্রীতিভোজে আপ্যায়িত হয়েছে, স্তিমিত আগুন ঘিরে বসে অন্যেরা যখন গল্প করছে, তখন তিশান আর তিহাকে বিদায় নিয়ে চলে আসতে হয়েছে পর্বতের গুহার কাছে,উপজাতির নিয়ম অনুযায়ী ওদের তিনদিন ও তিনরাত্রি বাস করতে হবে ওখানে।গুহার কাছটিতেই একটি ক্ষীণ জলধারা আছে, সেখান থেকে ওরা জলপান করতে পারবে আর সামান্য আহার করবে সঙ্গে নিয়ে আসা শুষ্ক ফলমূলাদি থেকে। এই তিনদিন ওদের ওখানে কাটাতে হবে আকাশের কাছাকাছি, উপজাতির বিশ্বাস অনুযায়ী নবদম্পতি কেবল এইভাবেই আকাশস্থ পূর্বজদের আশীর্বাদ পেতে পারে। এরা বিশ্বাস করে, বহু বহুকাল পূর্বে একদিন আকাশ থেকেই এদের আদিপিতা ও মাতা নেমে এসে মরুমধ্যস্থ দেশটুকুতে এই মানুষদের সৃষ্টি করেছিলেন।যখন সকলেই আত্মনির্ভর হয়ে ওঠে,তখন ওনারা নিজের স্থানে ফিরে যান, কিন্তু আজও যখন সৃষ্টির অমোঘ নিয়মে নরনারীর বিবাহ হয়, তখন তারা আশীর্বাদ করতে আসেন, তাদের আশীর্বাদ অনূভূত না হলে নরনারীর মিলন নিষেধ।
সন্ধ্যা থেকেই নবোঢ়া তিহা শান্ত হয়ে চোখ বন্ধ করে প্রার্থনার ভঙ্গীতে বসে ছিলো চাতালে, নি:শব্দে ওর ঠোঁট নড়ছিলো, হয়তো কোনো মন্ত্র বলছিলো। তিশান পাশে বসেছিলো, কিন্তু ও তো তিহার ভাষা তেমন ভালো করে জানেনা ভাসা-ভাসা কিছু কাজ চালাবার মতন নামশব্দ আর ক্রিয়াপদ ছাড়া, তাই মন্ত্র বা প্রার্থনা কিছুই না করে ও শুধু চুপ করে বসে তিহার মুখের দিকে চেয়ে ছিলো।
পশ্চিম আকাশের কমলা আলোয় মানুষের সন্ধ্যাবেলার মুখ এত মায়াবতী লাগে! নাকি তিহার মুখই শুধু এত মায়াকাড়া! আগে তো ঠিক এরকমটি মনে হয় নি! লোহিত সন্ধ্যারাগ ক্রমে মিলিয়ে গেলো, তারার আলোয় তাপসীর মতন সমাহিত মুখ তিহার। বন্ধ চোখের পাতা একসময় কেঁপে ওঠে, চোখ মেলে তিশানের দিকে তাকিয়ে তিহা অল্প হাসে, ইঙ্গিতে ওকে চোখ বুজে মন সংহত করতে বলে।
চোখ বুজতেই তিশানের মনে পড়ে সেই নৃত্যানুষ্ঠানের রাত্রির কথা, সেই রাতেই এই উপজাতির একজন হয়ে গেছিলো তিশান। কী যেন হয়েছিলো সেই রাত্রে, অদ্ভুত কিছু স্বপ্ন, অদ্ভুত কিছু ভাবনায় অর্ধচেতন তিশান ফিরে গিয়েছিলো বহু বহু জন্ম আগের কোনো উপকথায়, কী আশ্চর্য, সেখানেও ছিলো বাদামী রঙের একটা পাহাড়,কিন্তু সে এই জায়গা নয়,অন্য কোনো জায়গা, সেখানের গাছপালা পশুপক্ষী সব অন্যরকম, সেখানে একটি নদী ছিলো, সেই নদীতীরে তিশান বসে থাকতো যেন কার অপেক্ষায়, একটি বিরাট সোনালী পাখী ওকে নিয়ে গেছিলো যেন কোথায় ....
ঐ রাত্রির পর থেকে তিশানের আর স্মৃতিহীনতার অস্বস্তি ছিলো না, সে যেন প্রসারিত দীর্ঘ ড্রীমটাইমের মধ্যে ঢুকে পড়েছিলো, যেখানে নিকট অতীত আর দূর অতীত, ইহজন্ম পরজন্ম সব অদ্ভুতভাবে একটা বিরাট নক্সায় সুষমভাবে বুনে দেওয়া হয়েছে।
ঐ রাত্রিতে অর্ধচেতন ওকে বাড়ীতে হয়তো বয়ে এনেছিলো তিহা অন্যদের সাহায্য নিয়ে, পরদিন সকালে জেগে উঠেছিলো অন্য তিশান, যার মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দমেশানো অন্যজীবনের ছেঁড়া টুকরো উঁকি দিয়ে যেতো জাগিয়ে যেতো তীব্র বেদনা, সেই তিশান নয়। এক নতুন তিশান, অনেক অনেক বেশী শক্তিশালী, অনেক অনেক বেশী আত্মস্থ, অনেক বেশী জীবনীশক্তিসম্পন্ন। সেদিন থেকেই তিশান তিহার কাছে ভাষা শিখতে থাকে, ওদের পোশাক পরিধান করে আর আস্তে আস্তে সকলের সঙ্গে পরিচিত হতে থাকে। ও বুঝতে পেরেছিলো এই উপজাতির মানুষেরা ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের চেয়ে সমষ্টিগত জীবনের ভালোমন্দকে অনেক বেশী মূল্য দেয়।
উল্কাবৃষ্টি যখন শুরু হলো তখন তিহা ও তিশান গুহার সম্মুখে সেই চাতালে, ওরা উর্ধ্বমুখে ঐ ফুলঝুরিকাটা আকাশ দেখতে দেখতে মন্ত্রমুগ্ধ, বাক্যহত, চলত্শক্তিরহিত হয়ে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে ছিলো। তিহা কী যেন বলছিলো অস্ফুটে, শব্দগুলো থেকে তিশান বুঝতে পারছিলো ও বলছে সেই মাতৃকাদেবী ও আকাশহৃদয় আদিপিতার আশীর্বাদের কথা। তিহার মুখ উজল হয়ে উঠছিলো সেই অগ্নিআভায় হয়তো বা ওর ভিতরের আগুনের প্রভাবেও। তিশান অস্পষ্টভাবে অনুভবে বুঝতে পারছিলো অলক্ষ্য শক্তির ধারা আকাশ থেকে নেমে এসে তিহার মধ্য দিয়ে বয়ে এসে প্রবেশ করছে ওর মধ্যে।
তিহার আবিষ্ট মুখ দেখে ওর মনে হচ্ছিলো সে যেন ওদের বিশ্বাসের মধ্যে প্রোথিত সেই অগ্নিময়ী মাতৃকাদেবীকে দেখতে পাচ্ছে ওর স্বপ্নচোখে, তিহার দুইবাহু যা কিনা তিশানের চারিপাশে আলিঙ্গন করে ছিলো, সে উল্কাপাতের তুঙ্গমুহূর্তে সেই হাতের বেষ্টনী খুলে নিয়ে হাতজোড় করে ছিলো।
একসময় উল্কাপাত কমতে থাকলো, কমতে কমতে শেষ হয়ে গেলো প্রায়। পুব দিগন্তে একখানি জ্বলজ্বলে তারার দিকে চেয়ে ঝুঁকে প্রণত হয়ে তিহা তিশানকে বাহুবদ্ধ করে ওদের গুহাবাসরে প্রবেশ করলো। ওদের ব্রত সম্পূর্ণ হয়েছে, আশীর্বাদ ওরা পেয়েছে, সঞ্জীবনী সে মন্ত্র এবারে সংসারে প্রযুক্ত হবে। তিশানের মন আনন্দের সমুদ্রে বটপত্রের মতন ভাসছিলো, একখানি ক্ষুদ্র আনন্দকণিকার মতন সেই বটপত্রের উপরে সযতনে ধরা ছিলো তিহা।
পুবে যখন ভোরের মৃদু আলো দেখা দিলো, আস্তে আস্তে যখন নিবিড় রাত্রিনীল আর তার মধ্যে মণিকণার মতন জেগে থাকা নক্ষত্রনীহারিকা মিলিয়ে গিয়ে শুধু রইলো কটা গ্রহ আর কৃষ্ণা একাদশীর ক্ষীণ চাঁদের রেখা,তখন ওরিয়ানা আর গিবানকে দেখা যাচ্ছিলো বালির উপরে পাতা আস্তরণে গভীর নিদ্রাচ্ছন্ন---আলগাভাবে ওদের গায়ের উপরে জামাকাপড়গুলো টেনে নেওয়া, বেশ শীত শীত ভোরের হাওয়া, ভোরের সমুদ্র অদ্ভুত তাজা!
কোথা থেকে পাখির নরম ডাক ভেসে আসছিলো---রিকিউ রিকিউ রিকিউ, কেটিত্ কেটিত্ কেটিত্ .... রিকিউ রিকিউ রিকিউ .... । ওরা চোখ মেললো সূর্যোদয় হবার পরে, ওদের রাত্রিব্যাপী বাইরে থাকা সার্থক হয়েছে, অমন উল্কাবৃষ্টি বাড়ীর বারান্দা বা ব্যালকনি থেকে কখনোই ওভাবে অত অসাধারণভাবে ধরা পড়তো না।
সুখী ও পরিতৃপ্ত মানুষের মতন শান্তির হাসি নিয়ে গিবান ওরিয়ানা ফিরে চললো সরাইয়ের দিকে, হাতে হাত জড়িয়ে রইলো বাচ্চা বাচ্চা দুটো ছেলেমেয়ের মতন, ওদের মধুযামিনী সত্যই মধুময় হয়েছে,আর অন্তরে কোনো সংশয় নেই। আকাশের অগ্নিময় জ্যোতিরুত্সব ওদের মধ্য থেকে সমস্ত ভয় সংশয় ও অন্ধকার দূর করে দিয়েছে। আগামীকালই ওরা ফিরে যাবে গিবানের কাজের জায়গায়, ওরিয়ানা ফিরে যাবে নিজের শহরে, যদিও সেখানকার পাট চুকিয়ে কিছুদিনের মধ্যেই সে এসে গিবানের ওখানে কাজে যোগ দেবে।
১২
কেটে গেছে বহুদিন, বহু মাস, বহু বছর। ওরিয়ানা-গিবানের ছেলেমেয়েরা এখন বড়ো হয়ে গেছে, ওদের দিকে তাকিয়ে গিবান-ওরিয়ানার নিজের তরুণবেলার কথা মনে পড়ে। ছেলে আরুক আর মেয়ে মিয়ারা দূরের কলেজে চলে যাবার পরে ওরিয়ানা বেশ একা হয়ে পড়েছিলো। গিবান তো চিরকালই কাজপাগল, এখনো তেমনিই আছে। ও পরের দিকে ক্লোনের গবেষণাকে স্টেম সেল গবেষণার দিকে নিয়ে যায় যা কিনা বহু দুরারোগ্য পক্ষাঘাতগ্রস্ত মানুষকে নতুন জীবন দিয়েছে। বহু প্রায়-অনারোগ্য অসুখ ভালো করেছে। গিবান ও তার সহযোগীরা ক্রমে হয়ে উঠেছে মিরাকল ওয়ার্কারদের মতন বিখ্যাত, যাদের কাজের উপরে রহস্যের আবরণ, যাদের অসাধারণ অবদান মানুষেরা স্মরণ করতে বাধ্য হয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে।
ড: পেরিটান বৃদ্ধ হয়ে অবসর নিয়ে চলে গেছেন নিজের দেশে। হিমালয়ের পাদমূলে তাঁর জন্মগ্রামটিতে। সেখানে গরীব মানুষের জন্য স্বাস্থকেন্দ্র শিক্ষাকেন্দ্র এইসব গড়েছেন। সিমিয়ন শেয়ন দু'জনেই গিবানের মতনই কাজে ব্যস্ত। তারই মধ্যে ওরা সংসারী হয়েছে অনেক আগেই, ওদের ছেলেমেয়েরা গিবান-ওরিয়ানার ছেলেমেয়েদের প্রায় সমবয়সী, ছোটো থেকে একসঙ্গে খেলাধূলা পড়াশুনা হুটোপাটি করে বড়ো হয়েছে।
এতকাল সংসারের ব্যস্ততার মধ্যে যা মনে পড়েনি, এখন মাঝে মাঝে ওরিয়ানার মনে পড়ে সেই দু:খ-টলটল মুখ মানুষটাকে, মাত্র কয়েকটা দিন ওরিয়ানা তার সঙ্গে অনেক নিবিড় মুহূর্ত কাটিয়েছে, সে কি সত্যি অন্য কেউ ছিলো? নাকি গিবানেরই অল্টার-ইগো?
একদিন বিকেলে বাড়ী ফিরে গিবান বললো," কতকাল হয়ে গেলো আমরা অনেক বড়ো ছুটি নিয়ে কোথাও যাই নি। আমি কাল থেকে ছুটি নেবো ছয়মাসের। অনেক হলো, এবারে আমি তোমাকে নিয়ে বেড়াবো। তোমার মনে আছে ওরিয়ানা, সেই উল্কাবৃষ্টির রাত?"
ওরিয়ানা হাসে, খুব আনন্দের একটা স্মৃতি সেই রাত। ঐ জ্যোতির্ময় রাত্রি না এলে সে কিছুতেই জীবন বহন করতে পারতো না, দ্বিধাবিভক্ত স্মৃতির মধ্যে ছিন্ন হয়ে যেতো। ওরা দেশ বেড়াতে বের হলো পরের দিন। খুব হাল্কা লাগছিলো ওরিয়ানার, মনে হচ্ছিলো আবার সেই প্রথম যৌবনের দিনগুলো ফিরে এসেছে।
এদিক এদিক বেড়িয়ে বেড়ায় ওরা, ছোটো ছোটো সরাইয়ে থাকে কয়েকদিনের জন্য, তারপরে ফের নতুন জায়গার দিকে চলতে থাকে। টুকটাক এটা ওটা কেনে, ফিরে ছেলেমেয়েদের দেবে মনে করে।
অনেক দিনের ছুটি, প্রায় ছমাস, তাই তাড়া নেই। মাঝে মাঝে বাচ্চা ছেলেমেয়েদের মতন প্ল্যান করে কোনো সুন্দর জায়গায় ছোট্টো বাড়ী বানিয়ে বাকী জীবনটা সেখানেই শান্তিতে কাটাবে। একবার এক নির্জন সোনালী সমুদ্রসৈকত আর অসংখ্য নারিকেল গাছ দেখে ওদের এত ভালোলেগে গেলো ওদের যে সত্যি সত্যি বাড়ীটাড়ীর সন্ধান শুরু করলো। ওখানেই বাকী জীবন কাটাবে ভেবে। কিন্তু তিনদিনের দিন এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটলো, হঠাৎ ওদের সেজায়গা ছেড়ে চলতে শুরু করতে হলো সম্পূর্ণ অন্যদিকে।
ঘটনাটা এরকম, ওখানে সী বীচে বেশী লোক দেখা যায় না, ওটা ট্যুরিস্টের জায়গা না। সেদিন সকালে ওরিয়ানা আর গিবান সী বীচে ছিলো, একটু পরে সমুদ্রস্নান করবে বলে প্ল্যান ছিলো, একদল অল্পবয়সী ছেলেমেয়ে এসে একসময় সী বীচে হৈহল্লা শুরু করলো, ওরা বেড়াতে এসেছিলো। গিবান আর ওরিয়ানা ওদের সঙ্গে আলাপ পরিচয় করলো, ওরা বললো নাকি ওদের সকলেরই মেরিন বায়োলজি নিয়ে পড়ার খুব ইচ্ছে।
ওদের মধ্যে একটি মেয়ে, অপেক্ষাকৃত শান্ত, নাম বললো ইরিনা, সে যখন হেসে ওরিয়ানার সঙ্গে পরিচয় করলো, হঠাৎ ওরিয়ানার বুকের মধ্যে ধাক্কার মতন লাগলো, এ মুখ সে কোথায় দেখেছে আগে? না, পরিচিত কারুর সঙ্গে মিল নেই, কিন্তু কোথায় একটা যেন অদ্ভুত মিল ওরিয়ানার মনে হলো। অনেক দিনের ভুলে যাওয়া সুরযন্ত্রের ঢাকনা সরিয়ে কে যেন একটা তারে টান দিলো হঠাৎ। মেয়েটার হাসি, সুন্দর চোখের তাকানো যেন ওরিয়ানাকে কিছু মনে পড়িয়ে দিতে চাইছিলো। সী-বীচে সেদিনের আলাপের পর অনেকক্ষণ একসঙ্গে থাকা হলো, ওদের নেমন্তন্ন করলো দিশারা, ওরা ইউথ হোস্টেলে উঠেছে বলছিলো, বললো আসবে পরদিন।
ইরিনা ও তার বন্ধুরা কিন্তু পরদিন নিমন্ত্রণ রক্ষা আসতে পারলো না, ওদের মধ্যে একজন ফোন করে বিপন্ন গলায় পরদিন সকালে জানালো এক বন্ধু খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে, তাকে নিয়ে ওদের ফিরে যেতে হচ্ছে তক্ষুণি। বন্ধুটি বাড়ী ফিরতে চাইছে, ওর বাড়ী সেখান থেকে অনেক দূরে, মরুভূমির মাঝখানে এক গ্রামে। সকলে চিন্তিত, ট্রান্সপোর্টেশান নিয়ে। ওরা ট্রেনে এসেছিলো, নিজেদের ইস্কুল শহর থেকে। এই বন্ধুটির বাড়ী যেখানে সেখানে ট্রেনে পাঠানোর উপায় নেই।
গিবান আর ওরিয়ানা তক্ষুণি দিকনির্দেশ জেনে নিয়ে প্যাক ট্যাক করে সরাই থেকে চেক আউট করে ওদের ইউথ হোস্টেলে গেলো। সেখানে ভাঙা মেলার মতন অবস্থা। মাত্র একদিন আগেই প্রাণশক্তিতে ভরপুর যে ছেলেমেয়েগুলো নানা হৈহল্লা করছিলো, আজকে তারা দিশাহারা। শুকনা মুখে বসে আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। যে ঘরটিতে অসুস্থ বন্ধুটি ছিলো, সেখানে ওদের নিয়ে গেলো ওদের গ্রুপলীডার গোছের ছেলেটি।
ঘরে বিছানায় শুয়ে ছিলো অসুস্থ ছেলেটি, গলা পর্যন্ত চাদর দিয়ে ঢাকা, ছেলেটির শ্বাসকষ্ট হচ্ছিলো, চোখে বুজে ছাই ছাই রঙা মুখ নিয়ে পড়েছিলো, ইরিনা ওর পাশে বসে হাত ধরে ছিলো ওর, নিজেদের ভাষায় কী যেন বলছিলো। হয়তো সান্ত্বনাবাক্য, হয়তো আরোগ্যপ্রার্থনা। অসুস্থ ছেলেটি ইরিনার যমজ-ভাই, জুরান।
গিবান-ওরিয়ানা জানালো ওদের গাড়ীতে করে পৌঁছে দেবে ওদের বাড়ী, কিন্তু আগে কোনো ক্লিনিকে যাওয়া দরকার, সেখানে ভালোমতো চিকিত্সা হওয়া দরকার।
ইরিনাকে বুঝিয়ে বলে ওরিয়ানা। ইরিনা প্রথমে ক্লিনিকেই জুরানকে নিয়ে যেতে রাজী হয়, যদিও জুরান যত দ্রুত সম্ভব নিজের বাড়ীতে নিজের বাবামায়ের কাছে ফিরতে চাইছিলো। বারে বারে সে নিজের ভাষায় ইরিনার কাছে আশংকা ব্যক্ত করছিলো দেরি হলে হয়তো বাবামায়ের সঙ্গে আর ওর দেখা হবে না। ইরিনা ওকে প্রাণপণে বোঝানোর চেষ্টা করছিলো হতাশ না হতে, জীবনমৃত্যু ঈশ্বরের হাতে, কিন্তু চিকিত্সার একটা সুযোগ কি সে দেবে না? অনেক বোঝানোর পরে জুরান রাজী হলো।
গিবান আর ওরিয়ানা ওদের নিয়ে যাচ্ছিলো, ইরিনা অর্ধচেতন জুরানের মাথা কোলে নিয়ে পিছনের সীটে বসেছিলো, সে সংকুচিতভাবে বারে বারে ধন্যবাদ দিচ্ছিলো, ওদের বেড়ানো এইভাবে ভন্ডুল করে দেয়ার জন্য দু:খপ্রকাশ করছিলো---ওরিয়ানা ওকে বোঝালো কিছুই ভন্ডুল হয় নি, ওদের বেড়ানো প্ল্যান করা বেড়ানো না, সবটাই অজানা, ঘটনা যেদিকে নিয়ে যাবে ওরা সেদিকেই যাবে।
কাছের শহরের ক্লিনিকে পৌঁছে যতদ্রুত সম্ভব জুরানের চিকিত্সার বন্দোবস্ত হলো। জুরানকে ক্লিনিকে ভর্তি করে ওরা আর ইরিনা উঠলো এক হোটেলে। যতদিন না জুরান সুস্থ হয়, ওরা থাকবে সেখানে।ইরিনা ওরিয়ানাকে বলছিলো, ওদের নিজেদের সমাজ ও সংস্কৃতি চারিপাশের মতন নয়, উপজাতির নিজস্ব বিশ্বাস জ্ঞান কৃষি কুটিরশিল্প ভেষজবিদ্যা নিয়ে সে একেবারে ভিন্নরকম একটা জগৎ। সেখান থেকে এভাবে এতদূরে পড়তে আসাই ওদের পক্ষে সম্ভব ছিলো না,ওদের বাবামাও প্রথমে ভাবেই নি। ওদের ভাষা পর্যন্ত ভিন্ন। নানা ঘটনাচক্রে হয়ে গেছে, আসলে প্রধানত ইরিনার জেদেই। জুরান নিজে আসতে এত ইচ্ছুক ছিলো না, কিন্তু শেষ পর্যন্ত যমজ বোনকে সে অজানা পৃথিবীর হিংস্রতায় একা ছেড়ে দিতে পারলো না, সঙ্গে এলো পড়তে।
ইরিনা খুব ভেঙে পড়ছিলো, বলছিলো, " জেদ করে বাইরে বেরোতে চাইছিলাম, জানতে চাইছিলাম কী আছে বাইরে, কেমন সেসব, কারা থাকে সেখানে, তারা কীভাবে চিন্তা করে, কীভাবে জীবনযাপন করে। না, আমি এতে কোনো দোষ দেখিনি, জানতে চাওয়া কি অপরাধ? অথচ আজ আমার ভুলেই জুরানকে এতবড়ো খেসারত দিতে হচ্ছে। গ্রামে সেখানে আপন মানুষের মধ্যে থাকলে ওর হয়তো এইরকম অসুখ হোতো না, হয়তো হলেও সেরে উঠতো। এখন? ওর যদি কিছু হয়ে যায়, আমি কী করবো?"
ওরিয়ানা সান্ত্বনা দিচ্ছিলো, বলছিলো, " ইরিনা, আশা ছেড়ে দিও না। ভালোটা ভাবতে হয়, খারাপটা ভাবতে নেই। আমার কথা শোনো, কেঁদো না, জুরান ভালো হয়ে যাবে।"
কয়েকদিনের মধ্যে জুরান একটু ভালো হলো। কিন্তু অত্যন্ত দু:সংবাদের মতন একটি কঠিন অসুখ ধরা পড়লো ওর। বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট না করতে পারলে ওর জীবন সংক্ষিপ্ত হয়ে আসবে। গিবানকে এদের অভিভাবক ভেবে আলাদা ডেকে নিয়ে ওকে জানালেন ডাক্তার। গিবান ইরিনাকে জানানোর আগেই প্রথমে যেটা করলো সেটা হলো নিজের রিসার্চ সেন্টারে যোগাযোগ, তারপরে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপত্র আনানোর বন্দোবস্ত। গোটা টীম এসে পৌঁছলে ইরিনাকে সব বুঝিয়ে বললো সে। কিন্তু এতবড়ো সিদ্ধান্ত ইরিনা একা নিতে চাইলো না, জুরানকে তো জড়ানো অসম্ভবই, সে পুরোপুরি চেতনই নয়।
ঠিক হলো সকলে মিলে ওদের বাড়ীতে গিয়ে ইরিনা জুরানের বাবামাকে জিজ্ঞেস করে অনুমতি নিয়ে তারপরে যা করার করা হবে। সেই মতো ওদের গ্রামের দিকে চললো গোটা টীম, অনেকটা পথ, রাস্তাও খুব সুবিধার না। ইরিনা অনেক রিলিভড, সে বুঝতে পেরেছে এরা সত্যি সত্যি সাহায্য করতে পারবেন ও করবেন।
অবশেষে বাদামী পাহাড় ও ক্যাকটাস দেখা দিলো, শান্ত ছোটো মরুগ্রামটিতে গিয়ে পৌঁছবার পর দেখা গেলো সত্যি সত্যি বিরাট চিকিত্সাগত সাহায্যের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে গোটা গাঁয়ে। গোটা গ্রাম জুড়ে অনেক মানুষ অসুস্থ। অল্পবয়সীদের মধ্যে অদ্ভুত অসুখ দেখা দিয়েছে, শ্বাসকষ্ট, দুর্বলতা, জ্বর। গ্রামের ভিষকরা এর কোনো কারণ বুঝতে পারছেন না, প্রতিকারও করতে পারছেন না, এনাদের ভেষজে হয়তো কিছু প্রতিকার আছে, কিন্তু রোগের কারণ ধরা পড়লে তবে তো প্রতিষেধক দেবেন।
গিবানের টীম যাকে বলে এক্কেবারে সুতায় সুতায় ঠিক সময়ে এসে পৌঁছেছিলো, আর মাত্র ঘন্টাকয়েক দেরি হলেও হয়তো মৃত্যু শুরু হয়ে যেতো। সঠিক চিকিত্সার ব্যবস্থা হয়ে গেলো সময়মত, অবস্থা ভালোর দিকে গেলে এইবারে টীমের কয়েকজন জুরানের বাবামায়ের কাছে অনুমতি চাইলো জুরানের বিশেষ চিকিত্সার জন্য। ইরিনা ওর বাবামাকে বোঝাচ্ছিলো।
ইরিনার বাবা ও মা, চিনুক আর তিতি, এই ঘটনাপুঞ্জের দ্রুতগতি দেখে সেই অভিঘাতে হতভম্ব। হঠাৎ গাঁয়ের ছেলেমেয়েরা এরকম অদ্ভুত অসুখে আক্রান্ত হওয়ায় অনেকে এনাদের দায়ী করছিলেন কারণ এদেরই ঘরের ছেলেমেয়েদুটি দূর শহরসভ্যতার সংস্পর্শে এসে কোনো না কোনোভাবে হয়তো সব অপবিত্র করে দিয়েছে, এই ধারণা অনেকের হয়েছিলো। গ্রামবৃদ্ধেরা অনেক কষ্টে জনরোষের হাত থেকে চিনুক আর তিতিকে বাঁচিয়েছে। এই ছেলেমেয়েদুটির এরা পালক পিতামাতা।
ইরিনা আর জুরানের প্রকৃত বাবামা তো পুত্রকন্যাকে দত্তক দিয়ে পর্বতশৃঙ্গের কাছে কঠিন সাধনায় রত রয়েছেন, জাতির কল্যাণের জন্য। কঠিন পরীক্ষায় বারে বারে উত্তীর্ণ সেই মানুষ দুটির সন্তানদ্বয় অবশ্যই সমাজে কল্যাণ আনবে, এই সকলে সুনিশ্চিত বিশ্বাস করে। অথচ এই অদ্ভুত অসুখের হঠাৎ আক্রমণে অনেকের বিশ্বাস টলে গিয়েছিলো। এখন অবস্থা ভালোর দিকে যাওয়ায় সকলে শান্ত। তিতি আর চিনুক জুরানের চিকিত্সার অনুমতি দেবার আগে গ্রামবৃদ্ধদের সঙ্গে আলোচনায় বসলেন। ওদের প্রকৃত পিতামাতার অনুমতি প্রয়োজন চিকিত্সার আগে।
এদিকে সময় গড়িয়ে যাচ্ছে, গিবান আর তার পুরো টীম অধৈর্য্য এসব ননসেন্সে, দিশা আর ইরিনা বোঝাবার চেষ্টা করে যাচ্ছে এসব ওদের কাছে ননসেন্স না, এসব খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। গিবান অনেকক্ষণ এসব বাগবিতন্ডা শুনতে শুনতে ধৈর্য্যের শেষ সীমায়, এরা বুঝতে পারছে না প্রত্যেকটা মুহূর্ত একটু একটু করে কিশোর ছেলেটির সুস্থ হয়ে ওঠার সম্ভাবনাকে কমিয়ে দিচ্ছে। সময় মূল্যবান, খুব মূল্যবান, চিকিত্সা প্রস্তুত, এই সময়ে এভাবে বিতন্ডার কোনো অর্থ হয়?
ইরিনার মাধ্যমে গ্রামবৃদ্ধদের সঙ্গে গিবান নিজেই আলোচনার বসলো। সে বললো,"আমাদের বিশ্বাস করুন, আমাদের বিশ্বাস করুন, এই যে এত অল্পবয়সী ছেলেমেয়েকে আমরা সাহায্য করতে পেরেছি, সেতো আপনাদের সহযোগিতা ছাড়া হতো না, এখন এই জুরানের ব্যাপারেও আমাদের বিশ্বাস করুন। আপনাদের ক্ষতি করতে চাইলে তো ইতিমধ্যেই করতে পারতাম। এই যে ইরিনা আমাদের সঙ্গে বেশ কিছুদিনের পরিচিত, সে বলবে আমরা সত্যি সত্যি সাধু উদ্দেশ্যেই এসেছি। আমাদের কি প্রয়োজন ছিলো নইলে এতখানি পথ এইভাবে এত সব জিনিসপত্র লোকজন নিয়ে আসার?"
বুড়ো ভিষক কিল্মল মাথা নেড়ে কইছেন," অচেনা অতিথি, তোমরা সত্যই আমাদের সন্তানদের সাহায্য করেছ, তারা মরে যাচ্ছিলো, তাদের বাঁচিয়ে তুলছো। কিন্তু এই জুরান আমাদের সাধক-সাধিকার সন্তান, তাঁদের সম্মতি ছাড়া কিকরে অচেনা চিকিত্সার অনুমতি দেওয়া যায়?"
গিবান অধৈর্য্যে ঠোঁট কামড়ে চিন্তা করছিলো, তারপরে হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে বললো,"আমি নিজে দায়ী থাকছি, চিকিত্সা শুরু হোক, আমি আর আমার স্ত্রী নিজেরা দুজন গিয়ে জুরানের মা ও বাবার কাছে সম্মতি প্রার্থনা করবো। আপনারা শুধু একবার আমাদের বিশ্বাস করুন।"
জুরানের জটিল দীর্ঘমেয়াদী চিকিত্সা শুরু হয়ে গেলো, মা তিতি বাবা চিনুক জুরানের শিয়রের কাছে রইলেন অতন্দ্র, বৃদ্ধ ভিষক কিল্মল রইলেন কাছেই, দৃঢ়-ওষ্ঠ চিকিত্সক গবেষকেরা সুচ্যগ্র মনোযোগে জুরানের চিকিত্সা করতে থাকলেন। ইরিনা পাশের ঘরে একাকী নি:শব্দ প্রার্থনায় রত, কিন্তু সে কীপ্রার্থনা করছে সহজেই অনুমানযোগ্য।
দুই গ্রামবৃদ্ধ তাদের দু'জনকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চললেন বাদামী পাহাড়ের দিকে, ঐ পাহাড়ের চূড়ার কাছে নির্জন গিরিগুহায় সাধনরত ইরিনা-জুরানের বাবামায়ের কাছে। যেতে যেতে ওরিয়ানার বুক কাঁপছিলো,সে অনুমাণ করছিলো এক সাংঘাতিক উন্মোচনের, এক অদ্ভুত রহস্য, এক অসহ্য সত্য, যার থেকে সে এতদিন পালিয়ে থাকতে পেরেছিলো সাফল্যের সঙ্গে। গিবান কিন্তু চিন্তিত নয়, জুরানের চিকিত্সা যে মুহূর্তে শুরু হলো, সেই মুহূর্ত থেকেই সে অনেক হাল্কা।
ওরিয়ানা প্রত্যেক পদক্ষেপে ভাবছিলো বলে সে আর পারছে না, সে যেতে চায় না, কিন্তু কিছুতেই বলতে পারলো না। মৌন অনুচরীর মতন চললো বিশ্লথ পদে, একসময় সমতল ছাড়িয়ে পাহাড়ী বন্ধুরতায় এসে পড়লো ওরা, অল্পসল্প হোঁচট খেতে খেতে পর্বতারোহণ করছিলো কপালের ঘাম হাতে মুছতে মুছতে।
একসময়ে দূরে গুহাটি দেখা গেলো, ওরিয়ানার ভয়ে দমবন্ধ হয়ে এলো, সে কাকে দেখবে? বহুযুগের ওপার হতে সেই দু:খী উদাস মুখটি দেখা দেবে আবার? এতদিনের পরে ছিঁড়ে পড়বে সব কিছু? অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কুটি কুটি হয়ে ছড়িয়ে পড়বে চতুর্দিকে?
বিকেল শেষ হয়ে আসছিলো,আকাশে রঙীন মেঘেরা অতি সুন্দর দৃষ্টিসুখ দৃশ্য তৈরী করছিলো। দক্ষিণ থেকে স্নিগ্ধ ঠান্ডা হাওয়া আসছিলো, কোন্ মহাসমুদ্রের আদর জড়িয়েছিলো হাওয়ার ডানায় ডানায়। হাল্কা কমলা ওড়নার মতন মেঘের ফাঁক দিয়ে জ্বলজ্বলে সন্ধ্যাতারাকে সবুজ লাগছিলো। এরকম আগে কবে যেন দেখেছে ওরিয়ানা? এমন সন্ধ্যা হয়ে আসা?
"সন্ধ্যা হলো সন্ধ্যা হলো দেখছি চেয়ে প্রথম তারা/সেই যেন চায় আমার চোখে তার দুখানি নয়নতারা।" এই গান কবে যেন গাইছিলো সে, কোনো এক খোলা ব্যালকনিতে মাদুর বিছিয়ে বসে, সেখানে গিবান এসেছিলো। সে তখন সদ্যস্নাত, পাটভাঙা নতুন হাল্কা রঙের পোষাক ছিলো ওর, ওরিয়ানা ওকে দেখে গান থামিয়ে হেসে ফেলেছিলো।
ঘর থেকে ধূপের হাল্কা ধোঁয়া এসে ওদের দু'জনের চারপশে ছড়িয়ে যাচ্ছিলো। ধূপের গন্ধটা অবধি স্পষ্ট মনে পড়লো ওরিয়ানার। ঠিক মনে পড়াও যেন নয়, যেন সে অনুভবও করতে পারছে সেই সব? এটা কী হচ্ছে? কোনো ম্যাজিক? সময় ঘুরে যাচ্ছে? পিছনে চলে যাওয়া সময় সামনে ফিরে আসছে বিশাল বৃত্তচাপ এঁকে? সন্ধ্যা আরো মায়াবতী হয়ে এসেছে। একঝাঁক পাখি উড়ে গেলো পুবের দিকে।
গ্রামবৃদ্ধদ্বয় এগিয়ে গেলেন গুহাটির দিকে, গুহার সম্মুখে একটি সমতল চাতাল, সেখানে দাঁড়িয়ে অতি সুরেলা প্রার্থনাসঙ্গীতের মতন ভাষায় ডাকলেন সাধক ও সাধিকাকে। প্রথমে গুহামুখে দেখা দিলো তিহার মুখ, সে বের হয়ে এলো চাতালে, শান্ত সমাহিত মুখ তাপসী, উজল দুই কালো চোখ, একটুও অবাক না, যেন সে জানতোই এই দিনের এই সময়ে এই লোকেরা ওদের কাছে আসবেন।
তিহার বয়স হয়েছে, মুখে অল্প অল্প সেই চিহ্ন পড়েছে, কিন্তু অন্তরের অনির্বাণ আলো তাকে সময়হীন করে রেখেছে। উপজাতির সাধকদের আলগা লম্বা পোষাক তার পরনে, সে পোষাক স্কন্ধ থেকে জানু পর্যন্ত লম্বিত, হাত দুটি আর চরণ দুটি উন্মুক্ত, হাতে বাহুতে আর পায়ে লালনীলসবুজ রঙ দিয়ে নানা রহস্যময় নকশা, একখানি তন্তুময় লম্বা সরু ফালি কপালের উপর দিয়ে তেকোনা করে বেঁধে চুলগুলোকে সামলানো হয়েছে, ওর চুল এখনো অপর্যাপ্ত, কিন্তু ঘন কালো চুলের মধ্যে মাঝে মাঝে সাদা সাদা কিছু রেখা। চাতালের প্রান্তে দাঁড়িয়ে স্তম্ভিত হয়ে তিহাকে দেখছিলো গিবান আর ওরিয়ানা। ওরিয়ানা হঠাৎ হাত বাড়িয়ে গিবানের হাত চেপে ধরলো। এমনি সময় হলে গিবান অবাক হতো, কিন্তু এখন অবাক হলো না।
তিহার পরে বেরিয়ে এলো তিশান, তারও পোষাক পরিচ্ছদ একেবারে তিহার মতই, তারও বয়স হয়েছে, তারও মুখ তিহার মতন সমাহিত। ওরিয়ানা বা অর্চিষ্মান বুঝতে পারলো না, পোষাক নানারঙের উলকি, মাথার ফেট্টির মধ্যে সেই মানুষটি যে কিনা গিবানের প্রতিলিপি। তিশান যখন বেরিয়ে আসছিলো তখন ওরিয়ানার বুকের মধ্যেটা ধড়াস ধড়াস করছিলো, কিন্তু ও বেরিয়ে এসে চাতালে তিহার পাশে দাঁড়াতে তার অস্থিরতা শান্ত হয়ে গেলো।
গ্রামবৃদ্ধেরা তিশান ও তিহার সঙ্গে গিবান আর ওরিয়ানার পরিচয় করিয়ে দিলেন। তারপরে অনেকক্ষণ ধরে অনেক কথা বলে যেতে লাগলেন তিশান তিহাকে, এর কিছুই গিবান বা ওরিয়ানা বুঝতে পারলো না, চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো হতভম্বের মতন।
ওরিয়ানা তিহাকে লক্ষ্য করছিলো, কথা শুনতে শুনতে তিহার মুখ কখনো উদ্বিঘ্ন কখনো হাস্যোজ্জল হচ্ছিলো, কখনো ছায়ায় ঢেকে যাচ্ছিলো কখনো রোদ্দুরে চিকমিকিয়ে উঠছিলো, কথাবার্তা শেষ হলে তিশান তিহা এগিয়ে এসে সাদরে আহ্বান করে চাতালের উপরে ঠিক গুহার সম্মুখে নিয়ে বসালো গিবান আর ওরিয়ানাকে। গ্রামবৃদ্ধেরা দুজনেই নত হয়ে সম্মান প্রদর্শন করে বিদায় নিলেন। কী গেরো! এবারে কী হবে? এই দু'জনের ভাষার বিন্দুবিসর্গ যে তাদের জানা নেই!
কিন্তু আতিথ্যের ভাষা দুনিয়ার সকলেই বুঝতে পারে। তিহা ওদের জন্য এনে দিলো মিষ্টি ফল, শুকনো নোনতা খাবার আর ঝর্ণার মিষ্টস্বাদ জল। প্রথমেই জলে চুমুক দিয়ে ওরিয়ানা অবাক হয়ে গেলো, এমন মিঠা স্নিগ্ধস্বাদ জল জীবনে এর আগে কখনো খায় নি সে।
আকাশে নক্ষত্ররাজি ভরে উঠছিলো, নীহারিকার সূক্ষ্ম ওড়নারাও। সব মেঘ চলে গেছে, এখন শুধু শান্ত রাত্রি ভরে নক্ষত্রমালা। ওরা জানতো না, আকাশ কী খবর গোপণ করে রেখেছে ওদের জন্য। একেবারেই কি জানতো না? প্রথম বসন্তের স্বপ্নে কি কোনোদিন ওরা দেখেনি সেই সোনালী পাখিকে? জানতো, ভুলে গেছিলো। হয়তো ভোলেও নি, স্বপ্ন বলে তাকে উড়িয়ে দিয়েছিলো।
মধ্যরাত্রে শান্ত নক্ষত্রালোককে তুমুল তোলপাড়ে ডুবিয়ে দিয়ে উল্কাবৃষ্টি শুরু হলো। কুড়িবছর আগের সেই উল্কাবৃষ্টির চেয়ে দশগুণ মারাত্মক। বিরাট সোনালী ধাতব পক্ষীটি অগ্নিপক্ষ বিস্তার করে উড়ে এলো। চাতালে নামার পরে গুটিয়ে নিলো আগুনের ডানা, খুলে গেলো ওর একটি পাশে ছোট্টো একটু জানালা।
বিকট শব্দে ছোটো মাঝারি উল্কাখন্ড তখন আকাশ থেকে এসে পড়ছে চারিপাশে, একটি গুহামুখে পড়ে প্রবেশপথ আটকে দিলো। আকাশ ভরে যেন অসংখ্য আলোর তুবড়ি দোদমা সাপবাজি চর্কিবাজি ফেটে পড়ছে নীলসবুজলাল আলোর অঞ্জলি হয়ে, অন্ধকার আর নেই, এই অদ্ভুত অপার্থিব দ্যুতিতে রাত্রি উজল হয়ে উঠছে।
সোনালী পক্ষীটির মাথায় আলো জ্বলে উঠলো, তীব্র অথচ স্নিগ্ধ দ্যুতি, তার রঙের বর্ণনা করা যায় না, সে রঙ বদলাতে থাকে অবিরাম। ঝিমঝিমে নেশাধরানো সেই আলোর মধ্যে অসংখ্য উল্কার অবিরাম আভায় ক্রমাগত বিভাময় হতে থাকা রাত্রির মধ্য দিয়ে ঐ ক্ষুদ্র গবাক্ষটির দিকে এগিয়ে যায় চারজন।
জানালা থেকে আলোর সিঁড়ি নেমে এসেছে, কমলা-গোলাপী আলোর সিঁড়ি, সেই সিঁড়ির ধাপে ধাপে পা রেখে প্রথমে তিহা, তারপরে ওরিয়ানা, তারপরে তিশান, তারপরে গিবান উঠে যায়। আলোর সিঁড়ি অদৃশ্য হয়, জানালা বন্ধ হয়, সোনালী পাখির মাথার আলো নিভে যায় ও ডানার আগুন ফের দেখা দেয়।
সহস্র সহস্র উল্কার মধ্য দিয়ে অসংখ্য নক্ষত্রের দিকে উড়ে যেতে যেতে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে আসে সোনালী পাখি। চঞ্চল দেশকালের মধ্য দিয়ে ভিন্নপথে নৌকা বাইতে বাইতে জীবন ও প্রতিলিপিজীবন মিলে গেছিলো একবিন্দুতে, এবারে তারা চেনা দেশকাল ছেড়ে পাড়ি দিয়েছে অন্য কোনো দেশেকালে। কীজানি সেখানে হয়তো সকলেরই একটি একটি করে প্রতিলিপি রয়ে গেছে।
(শেষ)
১২ পর্বে শেষ হলো প্রতিলিপি, আসলে একাদশ পর্বেই মূল গল্প শেষ, দ্বাদশ পর্বটি পরিশিষ্ট। যারা ধৈর্য ধরে পড়লেন এতদিন ও নানা গঠনমূলক কমেন্ট করলেন সকলকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। শেষটুকু পড়া হলে অনুগ্রহ করে বলবেন কাহিনিটা সব মিলিয়ে কেমন দাঁড়ালো। সকলকে শুভেচ্ছা।
মন্তব্য
লেখা নিয়ে কোনরকম সমালোচনার প্রশ্নই আমার কাছে নেই। অসম্ভব রকম ভালো লেগেছে, একেবারে শেষ অংশেই সব মিলিয়ে মন্তব্য করলাম তুলিরেখা।
মধুবন্তী
অনেক ধন্যবাদ মধুবন্তী।
প্রত্যেকটা পর্বেই যদি কমেন্ট করতেন, আরো ভালো লাগতো। আসলে আমি দেখতে চাইছিলাম কোনো লেখা জায়মান অবস্থায় পাঠকের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ায় বদলে যেতে পারে কিনা।
ভালো থাকবেন।
-----------------------------------------------
কোন্ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
শেষটা একটু অন্যরকম হবে ভেবেছিলাম। তবে যা ভেবে রেখেছিলাম তা পুরোপুরি মিললো না দেখেই খুশি হলাম !
সব মিলিয়ে বেশ ভালো লেগেছে, তবে কোথাও কোথাও ঠিক সন্তুষ্ট হতে পারিনি, যেমন - ক্লোন গিবান কীভাবে বুঝতে পারলো যে সে প্রতিলিপি বা ক্লোন গিবান হারিয়ে যাওয়ার পর এ নিয়ে কাউকে তেমন ব্যস্ত দেখা গেল না বা কাহিনী কোথাও কোথাও হাঁটতে হাঁটতে দৌড়ে নিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করলো..এইসব। তবে সব মিলিয়ে এই সায়েন্স ফিকশন বেশ ভালো লেগেছে। এবার আরেকটা লিখুন !
তাই নাকি? আপনি শেষটা কিরকম হবে ভেবেছিলেন?
লেখাটি ধৈর্য ধরে পড়ার জন্য ধন্যবাদ। এই গল্পে আপনার আর ধূসর গোধূলির কমেন্টগুলো খুব মূল্যবান। পরে যদি কখনো লেখাটা মাজাঘষা করে নতুন চেহারা দেবার কথা ভাবি, তখন আপনাদের কমেন্টগুলো খুব কাজে লাগবে।
ভালো থাকবেন।
-----------------------------------------------
কোন্ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
এপিলগটা ভালো হয়েছে। এখন পুরোটা আরোএকবার পড়তে হবে।
______________________________________
যুদ্ধ শেষ হয়নি, যুদ্ধ শেষ হয় না
______________________________________
যুদ্ধ শেষ হয়নি, যুদ্ধ শেষ হয় না
পুরোটা পড়া হলে বলবেন কিন্তু আবার যে সব মিলিয়ে কেমন লাগলো।
ভালো থাকবেন।
-----------------------------------------------
কোন্ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
সহস্র সহস্র উল্কার মধ্য দিয়ে অসংখ্য নক্ষত্রের দিকে উড়ে যেতে যেতে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে আসে সোনালী পাখি। চঞ্চল দেশকালের মধ্য দিয়ে ভিন্নপথে নৌকা বাইতে বাইতে জীবন ও প্রতিলিপিজীবন মিলে গেছিলো একবিন্দুতে, এবারে তারা চেনা দেশকাল ছেড়ে পাড়ি দিয়েছে অন্য কোনো দেশেকালে। কীজানি সেখানে হয়তো সকলেরই একটি একটি করে প্রতিলিপি রয়ে গেছে।
সুন্দর পরিসমাপ্তি। শেষ লাইনগুলো চিরন্তন কালের জন্যই সত্যি। ভালো লাগা রেখে গেলাম। শুভ কামনা রইল ভাই।
শেখ আমিনুল ইসলাম
আপনার ভালো লেগেছে জেনে খুশী হলাম। আরেকটু বিস্তারিত পাঠপ্রতিক্রিয়া দিলে আরো খুশী হতাম।
আপনার জন্যও শুভকামনা রইলো। ভালো থাকবেন ভাই।
-----------------------------------------------
কোন্ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
- শেষে এসে প্রশ্ন জাগলো, তিহা কি তাহলে ওরিয়ানার প্রতিলিপি?
এ প্রবেও গিবানের রহস্যময় উধাও হওয়া নিয়ে বেশ অস্বাভাবিক রকমের নিরস্ত থেকেছে। এটা কি একজন সাধারণ মানুষের সাথে যায়!
শেষের দিকে কেমন নাটকীয় মনে হচ্ছিলো যেখানে গল্পের অন্যান্য অংশের সঙ্গে বের ভালোভাবেই সম্পর্কায়িত করা যাচ্ছিলো নিজেকে। উল্কাপিণ্ডের পতন হলে তো সেই মরুময় গ্রামটাও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা।
তবে, পরিশেষে প্রতিলিপি গল্পটা বেশ ভালো লেগেছে।
এইপর্বে সবচেয়ে ভালো লেগেছে গিবান ওরিয়ানার রাত্রিরকালের পিকনিকের সময়টা। আমার নিজেরও এমন একটা চিন্তাভাবনা আছে কিনা! আমি সেখানে ঢোলাঢালা হাফপ্যান্ট পরে খালি পায়ে সাগরতটে দৌঁড়ে বেড়াই... পেছন পেছন পরিবার। কখনো পরিবার আগে, আমি পিছনে। আবার কখনো আমি আর পরিবার একই সাথে।
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
আপনার পরিকল্পিত রাত-পিকনিক বেশ চমৎকার মনে হলো। কপিরাইট যেহেতু আমার, রয়ালটি পাঠিয়ে দিতে ভুলবেন না।
গল্পটা শেষে এসে নাটকীয় একটু ঠিকই, তবে কিনা সেটা এপিলোগে। আর মানুষের গদ্যময় ধূলিবালিসংসার তো আছেই চিরকাল, যেখানে ঝগড়া লাগে, মারামারি হয়, একঘেয়ে লাগে, স্বপ্নগুলোয় শ্যাওলা ধরে যায়, সব অর্থহীন মনে হয়, আবার কামড়াকামড়ি করে জেগে উঠতে হয়-সেসব তো আছেই। কিন্তু তার মধ্যে ও কি অমর্ত্যলোকের ছায়া এসে পড়ে না মুহূর্তের ভগ্নাংশের জন্য? ছবি গান গল্প কবিতা আসলে সেই অধরা ছায়াকেই ধরার চেষ্টা মাত্র। "দেবে না ধরা অধরা ছায়া/ রচি গেল মনে মোহিনি মায়া...."
পার্থিবজীবনের শেষে তেমনই এক আশ্চর্য রহস্য। কী হবে এই জীবনসঞ্চিত স্মৃতির? ক্ষিতি অপ তেজ মরুৎ ব্যোম এ তো মিশে যাবে যা নশ্বর সবই। সেগুলি রিসাইকলড হয়ে আবার নতুন করে ব্যবহৃত হতে পারে। কিন্তু যা অবিনশ্বর, তার কী হবে? কনজারভেশন অব ইনফরমেশন, তার কী হবে? সেইসব চিররহস্য কেই একটু প্রতীকি করে দেখানোর চেষ্টা আরকি!
ভালো থাকবেন।
-----------------------------------------------
কোন্ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
শেষ হইছে! এলা পড়তে বসি!
------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
বসেন, পড়েন।
পইড়া কেমুন লাগলো কইবেন কিন্তু পন্ডিতমশয়।
-----------------------------------------------
কোন্ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
নতুন মন্তব্য করুন