সমুদ্রের তীর ধরে হেঁটে যাই, গভীর নীল ঢেউয়ে জ্বলজ্বল করে কীসের যেন দীপ্তি। আর আবহসঙ্গীতের মতন অবিরল ঢেউওঠা আর ঢেউপতনের শব্দ। আসে আর যায়, ওঠে আর পড়ে। স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের মত, বিরতি নেই, ক্লান্তি নেই, অনন্তকাল উঠছে আর পড়ছে।
বাতিঘরের আলো এসে চোখে পড়ে, দূরে বাঁকের কাছে মিনারের মতন বাতিঘর। নগ্ন নির্জন একটি উত্তোলিত হাতের মতন আকাশে উঁচিয়ে আছে,মুঠোতে আলো। আলো ঘুরে যায়, দূর সমুদ্রের জল আলোকিত হয়ে ওঠে,চকমকে আলো দূর থেকে আরো দূরে কুয়াশা হয়ে মিলিয়ে যায়। কাছের অর্ধেক ডুবো পাহাড়টা কালচে স্তূপের মতন দেখায় রাত্রির রহস্যভরা আলোয়। অথচ এই শিলাটি দিনের বেলায় কত অন্যরকম! সবুজ একটি পাহাড়, বর্ষার জলে সবুজতর। পায়ের কাছে ছোটো কুন্ডে খেলা করে রঙীন মাছেরা। কত লতাপল্লব, কত শঙ্খকঙ্কন।
বাতিঘরের আলো আরো ঘোরে, আরো দূরের দিকে আলো ফেলে। এইবারে এইদিকে শুধু নক্ষত্রের আলো। আবিল আলোর চেয়ে একদম অন্যরকম, শুদ্ধ পরমজ্যোতির মতন, তিরতিরে রহস্যময়। অগভীর জলে নেমে হেঁটে যাই সবুজে ঢাকা শিলাটির দিকে, ওখানে যেন কিছু আছে, কিছু আহ্বান, কিছু নির্দেশ!
খালি পা জলের ছোঁয়া পেয়ে খুশি হয়ে ওঠে, সেই খুশি উঠে আসে মেরুশিরা বেয়ে উপরে। সালোয়ারের পায়ের গোছের কাছটা ভিজে গেল। আহা, ও ও তো কত তৃষ্ণার্ত ছিলো এতক্ষণ! শিরশিরে শ্যাওলা আর জলের লতা পেরিয়ে সাবধানে উঠে আসি। এবারে চড়াই বেয়ে উপরে উঠতে হবে। একটু হাঁপ ধরে, নিঃশ্বাস ঘনতর হয়, ঢালে গা এলিয়ে বসে পড়ি। তাড়াহুড়োর তো কিছু নেই!
অদ্ভুত একটা অনুভূতি! গভীরে একটা তিরতিরে কম্পন! মনে পড়ে ওকে, আমাদের পুরানো বাড়ীর বাগানের ছয়কোণা সেই জলকুন্ডে সে থাকতো। লাল আর সোনালী রঙের নকশা ছিলো ওর গায়ে। আমার কল্পনায় ওর লেজের ছোট্টো ছোট্টো খুশি-খুশি ঝাপটা লাগে, আমায় নিয়ে যায় বহু বিস্মৃত পূর্বজন্মে।
তীক্ষ্ন শিসধ্বনির মতো সজোর শক্তিশালি শব্দতরঙ্গের আহ্বান এসে লাগতো মহাসমুদ্রের বিশাল বিস্তার পেরিয়ে। পৃথিবীজোড়া যোগাযোগব্যবস্থা ছিলো আমাদের, এইসব ছোট্টো ছোট্টো চিপভরা সেলফোন আর মস্ত মস্ত টাওয়ার তৈরীর বহু বহু যুগ আগেই। হাতডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে সাঁতরে যেতাম, ঠিক যেদিক থেকে ও আসতো তার উলটোদিকে। ও জল তোলপাড় করে এসে আমাকে ধরে ফেলতো! মাথা দিয়ে ঢুঁ মারতো পেটে। মুখের কাছে হাতডানার ঝাপটা দিতো, আমি লেজের ঝাপটায় একরাশ জল ছিটিয়ে পালিয়ে যেতাম! এই খেলাটা আমাদের দু'জনেরই খুব পছন্দের ছিলো। ওর মসৃণ সুন্দর গা আর মিটমিটে দু'খানা চোখ---
এই তো সেদিনও---যেদিন উপম আর আমি অন্ধকার সমুদ্রে নেমেছিলাম। ঢেউয়ে ঢেউয়ে দলিতমথিত হতে হতে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলাম, "মনে পড়ে উপম? সেই সাঁতার? উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরু?"
উপম অদ্ভুত গলায় বলেছিলো, "মনে পড়ে, মনে পড়ে, মনে পড়ে উর্বী। "
সঙ্গে সঙ্গে শুনতে পেলাম সেই তীক্ষ্ন শিসধ্বনি, সমুদ্র আলোড়িত করে আছড়ে পড়ছে কানের পর্দায়। চারিদিকে নীল, নীল আর নীল। ঘন থেকে ঘনতর নীল, আরো গভীর নীল। উপরে তীব্র নীল আকাশ, নিচে দিগন্ত থেকে দিগন্ত পর্যন্ত নীল জলরাশি।
আমরা সাঁতরাতে সাঁতরাতে পার হয়ে যাচ্ছিলাম ছায়াবৃত্ত, দিন থেকে রাত্রির মধ্যে ঢুকে পড়ছিলাম। সন্ধ্যার সমুদ্রজোড়া অগণিত তিমিদের গান। অদ্ভুত সংকেতধ্বনির মতন, প্রার্থনার মতন, গভীর সুরময়! সে কাছিয়ে এসেছিলো আরেকটু, ঘন হয়ে সাঁতরাতে সাঁতরাতে সহসা ঠোক্কর লাগিয়েছিলো হাতডানার নিচে। আরো ঘন রাতের মধ্যে ঢুকে যেতে যেতে সন্ধ্যাভ্রচ্ছটা মিলিয়ে গেলো, আকাশ জুড়ে অসংখ্য তারাদের জ্যোতি-আবেষ্টনীর মধ্যে আমরা অর্ধনিদ্রামগ্ন দুই জলচর জীব সাঁতরাচ্ছিলাম, ক্রমে আমাদের গতি ধীর থেকে ধীরতর হয়ে গেছিলো। ঘুমেলা রাত্রি সমুদ্র কিন্তু গান গেয়ে যাচ্ছিলো, অবিরাম!
একটা ডিসক্লেমার দেবার আছে। এটা আসলে একটা বড় গল্পের প্রথম পর্বটুকু। পর্বে পর্বে লেখা অনেকেই পড়তে চান না আর বেশী বড় লেখা পাঠককে ধৈর্যহীন করে দেয়। তাই এই কৌশল নিয়েছি। প্রথম পর্বটাকেই পরমানুগল্প হিসাবে দিয়ে দিয়েছি।
মন্তব্য
নাহ্ এই গল্পটা ভালো হয়নি একদম...
পড়েই যে আমার বাক্সপেঁটরা গুছিয়ে কক্সবাজার ছুটতে ইচ্ছে হচ্ছে, তার কি হবে শুনি ??
--------------------------------------------------
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
ইচ্ছে যখন হয়েছে, বেরিয়ে পড়ুন।
আহা, হু আ র শুভ্র সিরিজের গল্পগুলো পড়ে আমারও খুব ইচ্ছে করে দারুচিনি দ্বীপে যেতে।
-----------------------------------------------
কোন্ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
অনেক কটা লেখা মিস করে গেছি, এটা পড়া হয়ে গেলো, এবার দেখি তার আগে কি কি ছিল....
মধুবন্তী মেঘ
ধন্যবাদ মধুবন্তী মেঘ।
-----------------------------------------------
কোন্ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
আপনার লেখাটা পড়ে মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি হবার পর কঠিন শাসনের বেড়াজালে বেড়াতে যাওয়া কক্সবাজারের স্মৃতি মনে পড়ল। তখনও মোটেল রোডে (তাইতো নাম বোধহয়) এত হোটেল/মোটেল হয়নি, রাতে পাহাড়ের উপর বাতিঘরের আলো দেখা যেত। এখন আলো-ঝলমলে হোটেল গুলিতে রাতে বাতিঘরের আলো আর দেখা হয়ে উঠেনা। (সেই বাতিঘরটা রাতে এখন আর আলো দেয় কিনা তাও বলতে পারছিনা…)।
ভাল লাগল...।
ধন্যবাদ নৈষাদ।
ইস্কুল থেকে বেড়াতে যাবার স্মৃতিগুলো চমৎকার হয়। আমাদের দূরে কোথাও যাওয়া হয় নি, কেবল শহরবাজার পেরিয়ে গাঁয়ের মাঠে পিকনিক করতে যাওয়া হয়েছিলো। সে এক অসাধারণ স্মৃতি!
আমার প্রথম সমুদ্র দেখা নাকি পুরীতে, দেড় বছর বয়সে। সেই স্মৃতি নেই আমার। প্রথম সজ্ঞানে সমুদ্র দেখা ক্লাস থ্রীতে, দীঘা। সে এক আশ্চর্য স্মৃতি, যা সারা জীবন একটা ম্যাজিক দরজার মতন হয়ে আছে মনের মধ্যে।
ভালো থাকবেন।
-----------------------------------------------
কোন্ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
নতুন মন্তব্য করুন