রিনরিন করে কানে বাজে করুণ একটা প্রশ্ন, "না গেলেই কি নয় ?" প্রশ্নটা কেউ উচ্চারণ করেনি, শুধু জোড়া জোড়া ভাষাময় চোখ নীরবে চেয়ে আছে, নিরুচ্চার প্রশ্নের ভার এত বেশী! ছটফট করে উঠি ভিতরে ভিতরে, মনে মনে উত্তর দিই, না গেলেই নয়। মন না চাইলেও যেতেই হয়। নিয়তি।
স্রোতের টানে ফেনিয়ে ওঠা জল নিয়ে ধলেশ্বরী বয়ে চলে যেমন। যেমন রাখতে চাইলেও ধরে রাখা যায় না কাজলরেখাকে। কীর্তিনাশার দিকে তেমনি করেই চলে গেছে আমাদের চন্দ্রাবতী, ভাঙা দেউলে যেখানে তক্ষক আর শঙ্খচূড়ের বাসা, যেখানে কত শত বছরের পুরানো বটগাছ ঝুরি নামিয়ে আঁধার করে রেখেছে, সেইদিকে। চন্দ্রাবতীর ফেরা হয় না।
ভালোবাসার সব শব্দ পুরানো, জীর্ণ, ক্ষয়ে গেছে তারা। যে ভালোবাসা ঝড়ের দিনে পাশে দাঁড়াতে পারে না, অভয় হাত বাড়িয়ে বলতে পারে না "আমি আছি", তা মিথ্যা মিথ্যা মিথ্যা। মরে যাওয়া ভালোবাসার শব। অন্ধকারের পশুরা ছিঁড়ে খেয়ে ফেলেছে তার হৃৎপিন্ড। সোনাই মরে পুড়ে ছাই হয়ে যাবার পরে সোনাই উপাখ্যান লিখতে বসে ভুল কলমেরা, হা হা করে হাসে অদেখা বিদূষক।
হলদেটে হয়ে যাওয়া জীর্ণ পুঁথির পাতাগুলো দমকা বাতাসে দুর্বল বাঁধন খুলে উড়ে যায়। যাক, যাক ওরা। অতীত মুছে যাক নি:শেষে। সব পিছুডাক থেমে যাক, সব পিছুটান শেষ হয়ে যাক। সামনে সব নতুন হোক, সব অক্ষর সব শব্দেরা আনকোরা নতুন হোক, পুরানো রক্তের পুরানো অশ্রুর পুরানো ভুলবোঝাবুঝির কোনো চিহ্ন যেন কোথাও না থাকে।
শুধু একটুকরো শুকনো পাপড়ি পড়ে আছে জানালার সামনে, কবেকার বাগানে সে ফুল হয়ে ফুটেছিলো, কে তাকে তুলে এনেছিলো, একটি পাপড়ি ছিঁড়ে রেখেছিলো পুঁথির পাতার ফাঁকে। দিনে রাতে মাসে বছরে সে শুকিয়ে শুকিয়ে কত বদলে গেছে, কিন্তু ধক্ করে মনে পড়িয়ে দেয় কী যেন! সেই অদ্ভুত অসহায় ছিঁড়ে যাওয়া, সেইসব হায়েনা-নেকড়েদের ধারালো দাঁত, সেই আঁধার, সেই নিষ্পাপের রক্তপাতের ঋণ! সে ঋণ শোধ হবে না? শেষবিচার কি সত্য? নাকি নি:সহায়ের শেষ খড়কুটো? কেজানে!
সত্যি কি কোনোখানে সুবিচার হয় একদিন? যারা ভয়ানক কাজ করেও সগর্বে ঘুরে বেড়িয়েছে সংসারে, ক্ষমতা আর শক্তির দম্ভে অমানুষিক অত্যাচার করেছে, অপমান করেছে, দুর্বলকে ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করেছে, মানুষের সংসারের কোনো বিচারব্যবস্থাই যাদের কেশাগ্র স্পর্শ করতে পারেনি-কোনোদিন তারাও কি কোনো চরম বিচারকের কাছে দন্ডিত হয়? নাকি সেখানে দন্ড বা পুরস্কারের কোনো মানেই আর নেই? সবই সেখানে সত্যবিচারের পালকের মতন হালকা হয়ে ঘুরছে, অমৃত-অশ্রুতে ধুয়ে ধুয়ে সব দাগ মুছে গেছে ?
কিছুই জানা নেই, খন্ড খন্ড দেশেকালে সীমাবদ্ধ জীবন নিয়ে বসে থাকি শুকনো ছিন্ন পুষ্পদল হাতে তুলে নিয়ে। ঝাপসা চোখে মনে পড়ে ছিন্নডানা সেই প্রজাপতিটিকে, মনে পড়ে শীতের সকালের টলটলে শিশিরের মধ্যে পড়ে থাকা সেই মৃত মৌমাছিটিকে। মনে পড়ে বৃষ্টিথামা বিকেলের সেই জলফড়িংটাকে, অবুঝ বালকের হাতে যার ডানা ছিঁড়ে গেল!
"Little fly, thy summer's play
My thoughtless hand has brushed away......"
এমন কোনো করুণা কি আছে কোথাও যা ছিন্ন ডানাও নতুন করে গজিয়ে দিতে পারে? রাতজানালার বাইরে হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি তারার চোখ মেলে চেয়ে থাকে নীরব আকাশ। সে কোনো কথা বলে না, কোনোদিন বলেনি।
মুঠাভর দূরভাষ কেঁপে ওঠে, পরিচিত নামটা ফুটে ওঠে, মুহূর্তে আমার তর্জনী থামিয়ে দেয় কথাসঙ্কেত। কী হবে কথা বলে? খুদে খুদে মেসেজ বলে "রাণি, রাণি, ইন্দ্রানী, একটিবার কথা কইবি না?" মুছে দিই সব, সব কথা ধুয়ে গেছে জলে।
শ্রাবণের শেষ রাত সব নিয়ে গেছে নি:শেষে।
একদিন, কোনো অচেনা দেশেকালে, শরতের প্রথম সকালে দেখা হবে। নিদাগ, নির্মল, বৃষ্টিধোয়া আকাশের মতন সেই দেখা হওয়া। এখানে মিছে ডাকিস নে আমায়। সেখানে সেই জলফড়িংটা জলতরঙ্গ রোদ্দুরে খুশিখুশি ডানা মেলে উড়বে, ঐ যে ঐ শালুকফুলের উপরে। সেই মৌমাছিটা সেখানে নতুন হয়ে জেগে উঠবে শিশিরের ভিতর থেকে। সেখানেই কথা হবে আবার।
___
মন্তব্য
আমার ভাল লেগেছে।
লেখককে ধন্যবাদ
আপনাকেও ধন্যবাদ কুতুবি।
-----------------------------------------------
কোন্ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
কী অপূর্ব সব চিত্রকল্প আর বর্ননের ছন্দময়তা! আপনার লেখাগুলো কী যে ভালো লাগে!
-বাঁশি।
বাঁশি, আপনাকে ধন্যবাদ। আপনার নিকটি ভারি সুন্দর।
-----------------------------------------------
কোন্ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
তুলিরেখীয় ভাষাবুনন..
সবসময়ের মতই!
--------------------------------------------------
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
তিথীডোর,
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
-----------------------------------------------
কোন্ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
বহুদিন পর তুলি আপনার লেখা পড়ছি।
ভালো থাকবেন।
মধুবন্তী মেঘ
অনেকদিন পর আপনার কমেন্ট দেখে ভালো লাগলো।
ভালো থাকবেন।
-----------------------------------------------
কোন্ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
নতুন মন্তব্য করুন