নক্ষত্রসরণী বেয়ে

তুলিরেখা এর ছবি
লিখেছেন তুলিরেখা (তারিখ: সোম, ১৭/০৫/২০১০ - ৯:৫৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মনে পড়ছে অনেকদিন আগের এককুচি নরম গোলাপ-পাপড়ির মতন স্মৃতি, এক সাদা বালির সমুদ্রবেলা, ঘন নীল সমুদ্র, দুধের মতন সাদা ফেনার মুকুট পরে অন্তহীন ঢেউ আসে, ঢেউ ভাঙে! আর কী প্রবল বাতাস, কী পরাক্রান্ত বাতাস! ছোট্টো মেয়েটার মাথাভর্তি কোমল চুলের রাশি এলোমেলো থেকে আরো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। ওর বালিমাখা গোলাপি ফ্রকের প্রান্ত, গলার লালফুল আঁকা আকাশীনীল রেশমীস্কার্ফ হাওয়ায় ওড়ে, ওড়ে, ওড়ে! কে ঐ মেয়েটা? ওকে কোথায় দেখেছিলাম?

হাল্কা রিন্‌ রিনে একটা কচি গলার ডাক, " দিদি ই ই ই " সেই স্মৃতিহাওয়ায় ভেসে আসে একমুহূর্তের জন্য, পরমুহূর্তেই হাওয়া ঘুরে যায়, শব্দ হারিয়ে যায়। কোথায় শুনেছিলাম ঐ ডাক? কোথাও শুনেছিলাম কি? কবে? কার ছিলো ঐ কচি শিশুকন্ঠ?

সাদা নরম বালির উপরে ছোটো ছোটো একজোড়া পায়ের ছাপ! জলের কাছ থেকে ডাঙার দিকে চলে এসেছে আর তারপরে আবার আল্পনার মতন বাঁক খেয়ে জলের দিকে চলে গেছে। কার পায়ের ছাপ? কেন মনে পড়ছে?

মনে পড়ছে পিটুলিগোলা দিয়ে আল্পনা দেওয়া একটা বারান্দা, ফুললতাপাতার আল্পনা, ধানের ছড়ার আল্পনা, S এর মতন প্যাঁচ দিয়ে আঁকা জোড়া জোড়া ছোট্টো ছোট্টো পায়ের ছাপ। কেন একসাথে এই দুখানা ছবি মনে পড়ছে? কেন?

ছবি দু'টো মিলিয়ে গেল। এবারে দেখছি পাখি, শত শত পাখির এক বিরাট দল। বাবা পাখি মা পাখির ডানার কাছ ঘেষে নতুন শিশু পাখিরাও। ওরা ঘরে ফিরে যাচ্ছে। ওদের দিক ভুল হয় না কখনো। তালে তালে ওদের ডানা উঠছে আর পড়ছে। কখনো বাতাসে ডানা ছড়িয়ে ওরা শুধু ভেসে যাচ্ছে, নিচে ঘন নীল মহাসমুদ্র। ওরা টানা উড়ে আসছে, টানা উড়ে আসছে। সাতদিন ওরা বাতাসে, অবিরাম উড়ে চলেছে। এইবারে ওদের ডানা ক্লান্ত হয়ে আসে, ক্লান্ত হয়ে আসে, এমন সময় দলের প্রথম পাখিটি কীকীকীক্‌ করে খুশীর ডাক দিয়ে ওঠে, তাদের দ্বীপের প্রথম পাহাড়টি দেখা গেছে দেখা গেছে। খুশীর তরঙ্গ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে গোটা দলে, এসে গেছে, এসে গেছে, ঘর কাছিয়ে এসেছে। আহ, কেন দেখছি এই ছবি? এ কি আমার জাগ্রত স্মৃতিতে কোথাও ছিলো? নাকি সব কল্পনা ?

আমার অচেনা সঙ্গী হাসলো। না, ওর মুখ দেখতে পাইনি, হাসির শব্দও শুনি নি, মাথার মধ্যে ধাক্কা মারলো অনুভূতিটা সরাসরি৷ সে বললো, "ফিরে তাকাও, দ্যাখো ৷" এখানেও একই ভাবে সরাসরি মন থেকে মনে কথা, কোনো শব্দ নেই৷ সে নিজেই আমাকে ধরে ফিরিয়ে দিলো৷ আমি ফিরেই নিস্পন্দ হয়ে গেলাম, স্তম্ভিত হয়ে গেলাম৷

আকাশের ভেলভেট কালো পটভূমিতে আমাদের পৃথিবী, টলটলে নীল একখানা উজ্জ্বল রত্নখন্ডের মতন, নিঁখুত নিটোল একটি গোলক, নীলজলের মহাসমুদ্রে বেষ্টিত, মাঝে মাঝে মহাদেশ জলে মাথা জাগিয়ে আছে৷ আধখানা আলোয় আলো, সেদিকে দিন, অন্য অর্ধেকে কালো রাত৷ মহাদেশগুলোতে বুটি বুটি সূক্ষ্ম আলো, রাতের বাতিরা৷ মহাসমুদ্রেও রাত্রিচর বায়োলুমিন্যান্ট প্রাণীরা কোনো কোনো জলখন্ড আলো করেছে৷ স্পন্দহীন আমার বাহু ধরে আবার অন্য দিকে ঘুরিয়ে সে ঐভাবেই বললো, "এবারে যেতে হবে৷"

"যেতে হবে, কোথায়?" মাথার ভেতরে জলবুটির মতন প্রশ্ন ওঠে৷ শুভ্রপোশাক আগন্তুক নি:শব্দে আমার মাথায় উত্তর ফুটিয়ে দিতে থাকে৷

আমার পায়ের নীচে, মাথার উপরে, সামনে পিছনে, ডাইনে বাঁয়ে কী বিপুল মুক্ত মহাকাশ! কী গভীর নীল! কত কত তারা টলটল করছে, যে তারাদের আমি কোনোদিন দেখতে পাইনি পৃথিবীর ধোঁয়াধূলা আর বিদ্যুত-আলোর আবিলতার মধ্য থেকে! এই ঝকঝকে পরিষ্কার আকাশের গহীন নীল অন্ধকারে ডুবতে ডুবতে ভাসতে ভাসতে চেয়ে চেয়ে দেখি। চেনা নক্ষত্রমন্ডলগুলোকেও অচেনা লাগে! চেনা চেনা উজল তারাগুলির ফাঁকে ফাঁকে এত যে তারা লুকিয়ে ছিলো, তা তো দেখিনি আগে!‍ আর শেষ পর্যন্ত তো আমার জ্যোতির্বিদ্যা পড়া হয় নি!

সব দীর্ঘশ্বাস, বেদনা, সুখ, দু:খ ভাসিয়ে দিয়ে বয়ে যায় কিসের এক অপূর্ব প্রবাহ! তারায় তারায় ঠাসাঠাসি আকাশের দিকে চেয়ে আমি হঠাৎ করে চিনে ফেলি উজ্জ্বল জ্বলজ্বলে নীল চিত্রা তারাকে! এই তারাটির নামে আমার জন্মমাসের নাম। কতকাল আগের এক চৈত্রের সন্ধ্যায় জন্মেছিলাম আমি, মাতৃগর্ভের জলময় অন্ধকার থেকে বার হয়ে চোখ মেলেছিলাম ওই আলোবাতাস ভরা সুন্দর পৃথিবীতে, তখন যারা ঘিরে ছিলো আমাকে, তারা কেউ কি আর আছে আজ?

চিত্রা চেনা মাত্রই চিনে ফেলি স্বাতীকেও। তারপরে এমনকি বৃশ্চিক রাশিকেও খুঁজে পাই, তার হৃদয়ের কাছে জ্বলজ্বলে কমলা জ্যেষ্ঠ্যা তারাকে দেখে অদ্ভুত চিনচিনে ব্যথা হয় বুকের মধ্যে। এমনই তো হতো মাটির জীবনেও! হতো না কি? আহ, কত তারা, কত তারা! ধনুরাশির তারাগুলির ভিতর দিয়ে দেখা যায় ছায়াপথের কেন্দ্রাঞ্চল, সেদিকে অজস্র তারা, তারায় তারায় একেবারে ঠাসাঠাসি,যেন সমুদ্রতীরে বালির মতন ছড়িয়ে পড়ে আছে! বালিকাবেলায় প্রথম ছায়াপথ চিনে যে ঝিনঝিনে রোমাঞ্চ হয়েছিল, সেই রোমাঞ্চ ফিরে আসে আবার, তারও অনেক অনেক গুণ বেশী হয়ে।

"পৃথিবীর সমস্ত ধূসর প্রিয় মৃতদের মুখও সেই নক্ষত্রের ভিতরে দেখেছি আমি;
অন্ধকার রাতে অশ্বত্থের চূড়ায় প্রেমিক চিলপুরুষের শিশিরভেজা চোখের মতো
ঝলমল করছিলো সমস্ত নক্ষত্রেরা;"
কোথায় পড়েছিলাম এই কবিতার লাইনগুলো? কার লেখা কবিতা ছিলো সেটা? মনে পড়ে না! আহ, মনে পড়ে না কেন?
শুধু আরো সব কবিতার লাইন মনে পড়ে, আশ্চর্য সব লাইন-
"তবু অক্লান্ত ডানা
ভেদ করে যায় অবিনাশী শূন্যমন্ডল,
দেশকালের জটিল বুনন, অন্ধকারের ষড়যন্ত্র।
অফুরান অগ্নিপক্ষ ধেয়ে যায়
অনির্বাণ আলোর দিকে। "

কার লেখা ছিলো এইসব কবিতা? কারা পড়েছিলো এইসব? কারা ভালোবেসেছিল? কারা ভালোবাসেনি? মনে পড়ে প্রিয় ও আরো গভীর প্রিয় মানুষদের মুখ, কখনো আবছা, কখনো স্পষ্ট। শিশুর মতন অবুঝ অভিমানে চোখ ভিজে যায়, কেন ওরা আমাকে ধরে রাখছে না? আমি মুখে বলতে পারি না ভালোবাসার কথা, কিন্তু কেন ওরা ও বলে না ভালোবাসি ভালোবাসি? তাহলেই তো অভিমান ভুলে গিয়ে বলতে পারতাম, " আমি চলে যেতে চাই না, চাই না, চাই না। আমি ভালোবাসি, খুব ভালোবাসি এই ধূলামাটি, এই সবুজ, এই তিরতিরে জলরেখা, ঐ তুলোতুলো মেঘ, ঐ কালো চোখে খুশীর বিদ্যুৎ আর ভালোবাসার বৃষ্টি। "

আহা, চাইতাম ঐ যাদুভরা দু'হাতে দু'হাত রেখে টলটলে চোখে চোখ রেখে আস্তে আস্তে নিভে যাক আমার জীবনতাপ, আবার আসবো আবার আসবো আবার দেখা হবে নিরুচ্চারে এইকথা বলে ঢলে পড়ি শান্তিময়ী মৃত্তিকার কোলের নীল অন্ধকারে।

কিন্তু যেতে হবে, উপায় নেই। অচেনা সঙ্গী আবার আবার মনের মধ্যে কথা পৌঁছিয়ে দেয়, " কেন এত দুর্বল হয়ে পড়ছো? এই দিনের কথা কি তুমি জানতে না? তুমি নিজেই কী প্রস্তুত হচ্ছিলে না এই দিনের জন্য?"

" হ্যাঁ, দূত, আমি জানতাম, আমি জানতাম। তবু মায়া কেন ছাড়ে না!" মনে মনে বলে দিয়ে চোখ বুজি।

বহুদূর শরতের ভোর থেকে নরম এক গান ভেসে আসে, সেই গানের মধ্য দিয়ে শিউলিফুলে ভরা উঠান পার হয়ে প্রায়-অচেতন আমাকে কোলে নিয়ে ফটকের দিকে যাচ্ছে কে যেন, সে কী মা? মায়ের চুলের সুগন্ধ আমাকে ঘিরে ফেলছে, ছবিতে আঁকা অন্ধকারের মতন সেই দীর্ঘদেহ মানুষটা, শেষরাতে যাকে দেখেছিলাম বিছানার পাশে-তাকেও দেখতে পাচ্ছি, তার হাতে লম্বা একটা দন্ড, ডগায় চকচকে তিনটে ধাতব ফলা। সকালের আলো ঝকঝক করে উঠছে তাতে। ফটকের বাইরে রিকশা দাঁড়িয়ে আছে, আমাকে নিয়ে উঠে বসে মা, পাশে কে? বাবা?

মনে মনে বলি, " আমি তাকে চিনি দূত, এবারে দেখা হওয়া মাত্র আমি চিনতে পারবো ঠিক। আঁধাররূপে এসেছিল বলে কি আলো হয়ে দেখা দিলে চিনতে পারবো না?"

(একটি বড় লেখার সূচনাপর্বের অংশ )


মন্তব্য

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

ভাষাটা শিখতে হবে আপনার কাছ থেকে। কী বলব ... ৫ দিয়ে যাই।
_________________________________________
Any day now, any day now,
I shall be released.


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

তুলিরেখা এর ছবি

ধন্যবাদ অনিন্দ্য, ভালো থাকবেন।

-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

তিথীডোর এর ছবি

আপনার লেখা সবসময়ই ভাল্লাগে!হাসি

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

তুলিরেখা এর ছবি

ধন্যবাদ তিথীডোর হাসি
-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

রানা মেহের এর ছবি

আপনার লেখা পড়া আসলে পড়া না।
লেখা দেখা।
ভালো লাগলো দৃশ্যকল্প।
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

তুলিরেখা এর ছবি

আপনার ভালো লেগেছে জেনে ভালো লাগলো। ভালো থাকবেন।
-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

কেমনে যে লিখেন এইসব...

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

তুলিরেখা এর ছবি

হাসি

আর আফা, আফনে কেমবে লিখেন অমুন মনের তার ধইরা টান দেওনের লিখাগুলান ????

-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

হরফ এর ছবি

আমি ঠিক ভিশুয়াল থিঙ্কার নই কিন্তু আপনার লেখা পড়ে সত্যি-ই দেখলাম। স্মিথসোনিয়ান মিউজিয়ামে দেখা অনেক মহাজগতিক ছবি ভেসে গেল দৃষ্টিপটে।
-----------------------------------------
"ছুটলে কথা থামায় কে/আজকে ঠেকায় আমায় কে"

ছুটলে কথা থামায় কে/আজকে ঠেকায় আমায় কে

তুলিরেখা এর ছবি

ধন্যবাদ আপনাকে, লেখা পড়ে মনে মনে দেখতে পেয়েছেন জেনে খুব ভালো লাগলো।
ভালো থাকবেন, হরফ।

-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- সরছে, সব দেখি সচলারা এইখানে কমেন্ট দিছে। আমি কিছু কইয়া দৌড়ানি খামু নাকি আবার! চিন্তিত
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক

তুলিরেখা এর ছবি

বলি, অনিন্দ্য রহমান কি সচলা?
ঝাইড়া দৌড় দ্যান জনাব, বাঁচতে যদি চান। হাসি
-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।