১
প্রায়ান্ধকার ঘরে চুপ করে বসে আছি সেই দুপুরের পর থেকে। একদম চুপ। দূরের টেবিলের উপরে হালকা ডোমপরানো লাল আলোটা জ্বলছে, থ্রী-ডি মুভি ক্যামেরা যুক্ত আলট্রা-মাইক্রোস্কোপ সিস্টেমও সেই একইরকম সেট করা আছে। মাইক্রোস্কোপ-স্টেজের উপরে সেই স্লাইড, তাতেই সেই ভয়ানক স্যাম্পেল। সবচেয়ে আধুনিক অ্যানালাইজার যুক্ত আছে সিস্টেমে, স্ক্রীণে ত্রিমাত্রিক প্রোজেকশন করে করে সংখ্যাতালিকা দিয়ে দিয়ে নির্ভুলভাবে দেখিয়ে দিয়েছে সেই অ্যালিয়েন স্ট্রাকচার, সেই অদ্ভুত রেপ্লিকেশন, তার ভয়ানক প্রক্রিয়া। কী ভয়ানক সেই সত্য!
আমার শেষ আশা, অন্য আরো যে তিনজন স্যাম্পেল পরীক্ষা করতে নিয়েছে তারা অন্যরকম ফলাফল পাক, তাদের নিরীক্ষা বলুক এ সত্য নয়! কিন্তু মনের ভিতরে জানি তা হবে না, এ শুধু আমার কুটো আঁকড়ে ধরার চেষ্টা।
বাইরে নিশ্চয় এখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে আসছে। পাখপাখালিরা ঘরে ফিরছে, রাতের আশ্রয়ে শান্ত হয়ে যাবার আগে পাখিরা খুব কিচিরমিচির করে। আমার ইচ্ছে করছে সব সুইচ অফ করে বেরিয়ে যাই ঘরটা থেকে, তারা ফুটতে থাকা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে বুক ভরে শ্বাস নিয়ে বলি, আ:। কিন্তু পারছি না, আমার শরীরমন অবশ হয়ে গেছে যেন।
গলায় ঝোলানো স্ট্রিং এ লকেটের মতন ঝুলে থাকা কমুনিরিংটা টুং টুং করে উঠলো, রওশন কথা বলতে চায়। আমি তাকে সামনের থ্রীডি স্ক্রীনে প্রোজেক্ট করে বললাম," হ্যালো রওশন।" রওশন-আরা সবচেয়ে জুনিয়র ইনভেস্টিগেটর আমাদের গ্রুপে, কিশোরীর মতন নরম মুখচোখের মেয়েটি কাজেকর্মে দারুণ চটপটে। ভালো বলিয়ে-কইয়েও, গ্রুপ মীটিং এর সময় বেশীরভাগ প্রেজেনটেশানই ও দেয়।
আজকে রওশনের চোখমুখ শুকনো, চুল এলোমেলো, চোখের নিচে কালো ছায়া। আমার ভেতরে কোথায় যেন মোচড় লাগে, দ্রুত নিজেকে সামলাতে সামলাতে অল্প হাসির একটা চেষ্টা করে বলি, "বলো রওশন, কী খবর তোমার অ্যানালিসিসের?"
রওশনের ঠোঁট কেঁপে ওঠে, চোখ বড় বড় হয়ে যায়, যেন দুঃস্বপ্নের মধ্য থেকে প্রাণপণে বেরোতে চেষ্টা করছে। দু'বারের চেষ্টায় ওর কথা ফোটে, আমি শুনতে পাই, "পাভেল, পাভেল, আমার ...আমার অ্যনালাইজার খুব অদ্ভুত তথ্য দিচ্ছে। আমি বারে বারে চেক করে দেখলাম একই জিনিস কিন্তু আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।" ওর গলার স্বর শুধু না, সারা শরীর কাঁপছে।
আমার ভিতরে ঝড়, তবু আমি ওকে শান্ত হতে বলি, বলি,"রওশন, তুমি শান্ত হয়ে বসো তো চেয়ারে। তারপরে আস্তে আস্তে আমাকে বলো কী দেখেছ। উত্তেজিত হয়ো না, কোনোরকম দুশ্চিন্তা কোরো না, একেবারে নির্মোহ বিজ্ঞানীর মত বলো কী দেখেছ।"
রওশনের ত্রিমাত্রিক চেহারা আস্তে আস্তে বসে পড়লো তার চেয়ারে। গভীর শ্বাস টেনে সে বললো,"পাভেল, তুমিও কি ওরকমই কিছু পেয়েছ?" ওর আশা-আশঙ্কা মেশানো কাঁপা কাপা স্বর শুনে আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হলো,"না, না, আমি অদ্ভুত কিছু পাই নি, পাই নি, পাই নি।"
দীর্ঘশ্বাস গোপণ করে আমি রওশনকে বলি, "তুমি একটু অপেক্ষা করো, আমি কয়েক মিনিটের মধ্যেই তোমার ল্যাবে আসছি। আমার অ্যানালিসিসের রিপোর্ট আমি ডক্টর জীমানকে ট্রান্সমিট করে দেবো আর কিছুক্ষণ পরে। এতক্ষণ আমি দোটানায় ছিলাম।"
রওশনের চোখ জলে ভরে গেছে, অশ্রুরুদ্ধ গলায় সে বললো, " পাভেল, তুমিও একই তথ্য পেয়েছ, না? আমি ভাবছিলাম...আমি আশা করছিলাম...হয়তো যা দেখেছি ভুল, হয়তো সবটাই দু:স্বপ্ন একটা।"
"রওশন, শান্ত হও। আমি মিনিট দুয়েকের মধ্যে এসে পড়ছি।"
রওশনের ল্যাবে তার থ্রীডি ভিউয়ারে দেখলাম সেই একই দৃশ্য। মানসিকভাবে তৈরীই ছিলাম, তবু মনটা নতুন করে অস্থির হলো। ল্যাব লক করে দু'জনে ক্লান্ত বিধ্বস্তের মতন বেরিয়ে আসি। বাইরে ঝিরিঝিরি হাওয়া, গাছের পাতায় মর্মর, সন্ধ্যার আকাশ ভরে ফুটে উঠছে অগণিত তারা। বুক ভরে শ্বাস নিই, আর কতদিন নিতে পারবো? এই সুন্দর সবুজ জগৎ, এই ফুলপাতাপাখি--সবই ইতিহাস হয়ে যাবে?
কফিশপ থেকে দু'কাপ কফি কিনে দুজনে পার্কের বেঞ্চে গিয়ে গিয়ে বসি। কিছু কথা হয় না, দু'জনের একজনও কথা বলতে পারি না। কিম জিলুং তার কয়েক মাস বয়সের ছেলেকে প্যারামবুলেটরে বসিয়ে প্র্যাম ঠেলতে ঠেলতে ধীর পায়ে ফিরে যাচ্ছে। আমাদের কাছে এসে হাসলো, জিজ্ঞেস করলো আমরা কেমন আছি। আমরা হেসে বললাম ভালো। কিমের ছেলেটা ভারী মিষ্টি দেখতে। খলবল করে হাসে।
কিম জিলুং চলে গেল ছেলে নিয়ে। ও সারাবছর পুরোহাতা পোশাক পরে। যুদ্ধের সময়ে ও ছিলো বাচ্চা মেয়ে, বোমায় ও খুব মারাত্মকভাবে পুড়ে গেছিলো, বাঁচার আশাও ছিলোনা। শত্রুপক্ষীয় ডাক্তারদের যত্নে ও চেষ্টায় সে বাঁচলো, এখন অবশ্য আর তারা শত্রুপক্ষীয় নয়। এখন কিমের সুন্দর সংসার, নতুন মা হয়ে সে পরমানন্দে আছে।
এইসব যুদ্ধ হত্যা মৃত্যু-এত এত ভুল মানবজাতি করেছে, তবু তারও পরে মানুষের ভালোত্ব বেঁচে থেকেছে। তারও পরে আছে ভুল স্বীকার অনুতাপ ক্ষমা চাওয়া ও ক্ষমা করতে পারা, আছে বলেই সংসার সহনীয় আজও। কী হবে এর পরে?
ডক্টর জীমান ফোন করে জানান কাল সকালে জরুরী মীটিং। রওশন নিজের ঘরের দিকে চলে যায়, আমি টলতে টলতে যাই নিজের বাড়ীর দিকে। রাতটুকু বিশ্রাম করে নিতে হবে, নাহলে কালকে সকালে আরো গন্ডগোল করে ফেলবো।
এক গেলাস দুধ আর আধখানা পাউরুটি খেয়ে ঢকঢক করে আধবোতল জল পান করে শুয়ে পড়লাম। ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুমের মধ্যে সারারাত অদ্ভুত অদ্ভুত সব স্বপ্ন দেখলাম। দেখলাম ঝলমলে পাথরের গাছপালা লতাপাতা পশুপাখি সব চুপ করে আছে, সেই পাথরপুরীর মধ্যে একা একা ঘুরতে ঘুরতে অপার্থিব এক ভয়ঙ্কর হাসি শুনছি আমি। কাউকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না, হঠাৎ হঠাৎ কোথা থেকে আর্ত চিৎকার ভেসে আসছে শুধু।
শুকনো গলা ভরা তৃষ্ণা নিয়ে জেগে উঠে জল খাই, বাইরে তখন সুন্দর ভোর ফুটেছে।
( চলবে? )
মন্তব্য
সবেতো শুরু। কৌতূহল হচ্ছে কাহিনি জানার। চলুক।
একটা মজার ব্যাপার হলো আপনি বিসর্গের জায়গায় কোলন ব্যবহার করছেন (আ:, দু:স্বপ্ন)। মজার বলছি এই কারণে যে একসময় আমি কোলনের জায়গায় বিসর্গ দিতাম। পরে অন্যরা ধরিয়ে দিয়েছেন।
_____________________
আমরা মানুষ, তোমরা মানুষ
তফাত শুধু শিরদাঁড়ায়।
মনোযোগ টেনে এনে গল্পের অর্ধেক পথে 'চলবে?' ঝোলানোয় তীব্র নিন্দা!
অতি অবশ্যি চলবে, ঝটপট আসুক পরের পর্ব।
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
নতুন মন্তব্য করুন