প্রথমাংশ এখানে
রাজোদ্যানে পুষ্পপরিচর্যা করে দিন যায় মারিয়ার, বৃদ্ধা পুরানো মালিনী চাঁদের কণার মতন মেয়েটিকে নিজের নাতনীর মতন মনে করে খুব যত্নে কাজ শেখান। মাঝে মাঝেই আবার কেন জানি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, "আহা, এমন চাঁদপানা মুখ, এ কি রোদের তাতে পোড়ার জন্য? সাত সমুদ্দুর পার থেকে রাজপুত্রেরা নৌবহর সাজিয়ে কি আসে না এই মুখেরই জন্য? আর এ মুখপোড়া আমাদের রাজপুত্তুরের কেন চোখে পড়ে না এই আশমানি ফুল?"
মারিয়া রেগে যায়, বলে, "দাদীমা, কেন তুমি এসব কথা কও? স্বাধীনভাবে খেটেখুটে উপার্জন করে জীবন কাটাচ্ছি, ঐ সোনার খাঁচার পাখি হওয়ার চেয়ে এ কি অনেক ভালো না?"
বুড়ী মালিনী হেসে বলে, "সেতো ভালো রে নাতনি কিন্তু ভালোবাসার বাসাও যে বড়ো ভালো। প্রার্থনা করি শীগগীর সুখের ঘর হোক তোর, সেখানে চাঁদের হাট বসুক।"
মারিয়া অন্যদিকে সরে যায় কাজ করতে করতে, দাদীমা তার সব কথা জানলে বিস্ময়ে অজ্ঞান হয়ে যাবে। সে যে রাজকন্যে ছিলো, সেই সোনার শিকল ছিঁড়তে গিয়েই যে স্বেচ্ছায় সংসারসমুদ্রে ঝাঁপ দিয়েছে একা। ও যে কী বিষ, সে নিজে ছাড়া কে জানে আর!
মাঝে মাঝে মাবাবার কথা মনে পড়ে মারিয়ার, তারা না জানি কত চিন্তা করছে মারিয়ার কথা ভেবে। কিন্তু তারপরেই সে শক্ত করে নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরে। সে যখন পায়ে পড়ে বলেছিলো ও ধনী বুড়ো রাজার সঙ্গে বিয়ের কথা ভেঙে দিতে তখন তো তারা কান দেয় নি। তাহলে হয়তো এভাবে ঘর ছেড়ে অকূলে ভাসতে হতো না তার। এখন আর চিন্তা করে কী হবে।
দিন যায়, রাত কাটে। একসময় উৎসবের সময় আসে সে রাজ্যে। বছরের সবচেয়ে বড়ো উৎসব, তিনদিন তিনরাত ব্যাপী চলবে নাচগান খানাপিনা। গরীব বড়লোক রাজাপ্রজা ছেলেবুড়ো সকলেই আনন্দে উদ্বেল, চারিদিকে সাজোসাজো পড়ে গেছে। এসময় ধনীগরীব সকলেই নূতন পোশাক কেনে।
মারিয়া বাগানের কাজ করছিলো, বুড়ী মালিনী এসে তাকে একখানা পোশাক উপহার দিয়ে বলে রাত্তিরে উৎসবের জোশ বেশী, তখনই তো নাচগান হবে ভালো ভালো। মারিয়া যেন সুন্দর সেজে এই নতুন পোশাক পরে অবশ্যই নাচে যোগ দেয়।
মারিয়া ভাবে সে বিদেশে বিভুঁইয়ে একা, আজ কোন্ আপনজনের হাত ধরে সে কীসের আনন্দের উৎসবে যাবে? আবার মনে হয় এই যে আত্মীয় না স্বজন না এই বৃদ্ধা তাকে নিজে থেকে আদর করে উপহার দেয়, এই বা কী কম পাওয়া?
উৎসবদিনের সন্ধ্যায় চারিদিকে সমারোহ, আলোয় চারিদিক ঝলমল, বাজি পুড়ছে, ফানুস উড়ছে। অজস্র লোক সেজেগুজে যাচ্ছে নাচের জায়গায়। রাজারাণী চলেছেন লোকলশকর নিয়ে, রাজপুত্র চলেছেন সঙ্গীসাথী নিয়ে। উৎসবের দিনগুলিতে রাজাপ্রজা সমান।
মারিয়া স্নানটান করে ঘরে গিয়ে পেটরা থেকে বার করলো সেই বনসবুজ পোশাকটি। সেটি পরে নিয়ে আয়নায় নিজেকে দেখলো। আবার সে রাজকুমারী মারিয়া, উদ্যানপরিচারিকা মালিনীকে আর দেখা যাচ্ছে না। পোশাক আশাক গয়নাগাঁটিই কি তবে পরিচয়?
এবারে মারিয়া চললো নৃত্যস্থলীতে, সেখানে মারিয়াকে দেখে তো সবাই স্তম্ভিত। মেঘবরণ কেশ, চম্পাবরণ কন্যা যাকে ঘিরে বনভূমির উদার নববসন্তসৌন্দর্য ঝলকে উঠছে। কে এই মেয়ে? এ কী পৃথিবীর কেউ নাকি অপ্সরোলোকের কেউ?
রাতভোর নাচ চললো, মারিয়া নাচলো রাজপুত্তুরের সঙ্গে। রাজপুত্র ততক্ষণে যাকে বলে একেবারে পুরাই কুপোকাৎ। এমন নিরূপমা পরমাসুন্দরী মেয়ে কোথায় লুকিয়ে ছিলো? এ কি স্বপ্ন? এ কি মায়া?
শেষরাতে নাচশেষে সবাই ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লে মারিয়া চুপি চুপি ফিরে গেল বাগানে তার ঘরখানিতে। পোশাক পালটে সাজ ধুয়ে কেশবিন্যাস খুলে আবার বাগানের মালিনী হয়ে গেল সে।
রাজপুত্র পরদিন সকালে বাগানে এসে কেন জানি তার মুখের দিকে চেয়ে বলে," শোনো তুমি কি গেছিলে কাল রাতের নৃত্যসভায়?"
নতমুখিনী মারিয়া বলে, " না, আমি উৎসবে যাই নি রাজপুত্র।"
রাজপুত্র বলে, " কিছু মনে কোরো না, তোমার মুখের সঙ্গে কোথায় জানি মিল আছে তার, যে কাল রাতে নাচলো আমার সাথে।"
হাতজোড় করে মারিয়া বলে, "আমি গরীব মানুষ রাজপুত্তুর, কী হবে আমার সঙ্গে রাজকীয় রসিকতা করে?
বিষন্ন রাজপুত্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, "না না রসিকতা নয়, সে যে কোথায় চলে গেল! হয়তো আজ রাতে ---থাক, আশা করে কী হবে? " তারপরে হাত বাড়িয়ে দিয়ে সেই রাজভিখারী কাহিনির মতন সে বলে, "আমাকে একটা ফুল দেবে মালিনী?"
মারিয়া শশব্যস্ত হয়ে ফুল এগিয়ে দেয়, রাজপুত্র ফুল নিয়ে নত হয়ে ধন্যবাদ দিয়ে চলে যায়। মারিয়া সেইখানেই দাঁড়িয়ে থাকে, নড়তে পারে না, যেন বাগানের পাথরের নারীমুর্তি।
পরের রাতে আবার। এবারে মারিয়া পরেছে সাগরনীল পোশাকখানি। তাকে অলৌকিক রূপবতী দেখাচ্ছে। রাজপুত্র তার সাথে নাচতে নাচতে নিজের পোশাক থেকে একখানি রত্ন ছিঁড়ে গোপণে গুঁজে দিলো মারিয়ার বেণীতে।
সবাই ঘুমালে মারিয়া চুপিসাড়ে চলে গেল নিজের ঘরে, রাজকুমারী থেকে আবার সে সাধারণ মালিনীতে পরিবর্তিত হলো।
পরদিন সকালে খবর পেলো রাজপুত্রের খুব জ্বর, উঠতে পারে না। সে একতোড়া ফুল চাইছে কেবল। মারিয়া নিজেই গেল ফুলের তোড়া নিয়ে। রেশমীকম্বল চাপা দিয়ে কুকড়েমুকড়ে বিছানায় শুয়ে ছিলো রাজপুত্র। মারিয়া গেলে সে জ্বরে রাঙা চোখ মেলে হাত বাড়িয়ে ফুলের তোড়া নিলো, আর দেখলো তোড়ার একেবারে মাঝের ফুলগুলোর মাঝখানে সেই গোপণে দেওয়া রত্নটি জ্বলজ্বল করছে!
একমুহূর্তে কম্বলটম্বল সরিয়ে সে উঠে বিছানা থেকে নেমে পড়লো, কোথায় গেল তার জ্বর, কোথায় গেল তার অসুখ! আনন্দে পাগলের মতন হয়ে গিয়ে উদ্দাম নাচতে নাচতে সে বললো, "আমি জানতাম, আমি জানতাম, আমি জানতাম তুমিই সেই।"
সেই সন্ধ্যায় মারিয়ার বিয়ে হলো রাজপুত্রের সাথে। মারিয়া পরেছিলো আকাশনীল সেই পোশাক যাতে সব তারা জ্বলজ্বল করছে। তার চেয়েও বেশী জ্বলজ্বল করছিলো নবদম্পতির চোখমুখ।
কিন্তু হায়, সুখের সাগরে ভাসতে ভাসতে মারিয়া ভুলে গেল দুখের সাথী সাপবোনটির কথা। ডোনা লাবিস্মিনার নাম ধরে তিনবার আর তার ডাকা হলো না সাগরের তীরে এসে। শাপমুক্তি হলো না সাপবোনের। তাই আজো সমুদ্র কেঁদে কেঁদে আছড়ে পড়ে বালুকাবেলায়।
(শেষ)
মন্তব্য
হায় হায়! একী হলো?
গল্প , বাস্তব সবখানে এমন প্যাঁচ লেগে যায় কেন?
হায় অনিন্দিতা, এই তো হয়। এক সন্তানকে দুধে মুখ ডুবিয়ে মেরে আরেক সন্তানকে মধুমাখন খাইয়ে নির্বিকারে মানুষ করে এই আমাদের বাস্তব সংসারেই তো! গল্পে তো তবু কেউ সত্যি করে কষ্ট পেলো না, এই ভেবে সান্ত্বনা পাওয়া যায়।
ভালো থাকবেন।
-----------------------------------------------
কোন্ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
বাঃ, সুন্দর গল্প। কিন্তু এর মাঝে কত গ্যালন চা খেয়ে এলেন বলুন দিকি?
আর বলেন কেন! চা আর চা, সে চায়ের সমুদ্দুর।
-----------------------------------------------
কোন্ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
শেষে এসে এমন করে কষ্ট দিলেন?
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
দুনিয়াটাই এই।
সে যাই হোক, এ তো গল্প।
ভালো আছো তো?
-----------------------------------------------
কোন্ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
আহারে! শেষে এসে মন খারাপ হয়ে গেলো...
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
দুনিয়াটাই যে এমন! কী আর করা!
ভালো থাকবেন।
-----------------------------------------------
কোন্ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
আমি আগেই বুঝতে পারসিলাম (চিন্তার ইমো)
ঠানদি, গল্পের মাঝে,
একটা গুরুগম্ভীর চিন্তা ঢুকিয়ে দিলেন
সময়ের আগেই নিষিদ্ধ আপেলে কামড়ের পর থেকেই সর্বনাশ! সিদ্ধ হওয়া আর হলো না, একেবারে নিসিদ্ধই কচমচ করে খেয়ে পোশাক আশাকই কেবল বেড়ে উঠে পোশাকী সভ্যতা হয়ে গেল!
-----------------------------------------------
কোন্ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
দারুণ
কত নম্বর হলো?
ধন্যবাদ।
কেজানে কত নম্বর হলো। নম্বরের খেই হারিয়ে ফেলেছি সেই মাউইয়ের সময়ে।
----------------------------------------------
কোন্ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
শেষটা বদলানো যায় না, তাই না?
শেষটা বদলে গেলে খুব ভালো হতো।
লিখতে লিখতে কেবল মাইকেল মধুসূদনের কথা মনে পড়ছিলো, মেঘনাদবধের শেষটুকু লেখার আগে উনি রাতের পর রাত জেগে ভেবেছেন আহা মেঘনাদের মতন ভালো রাজপুত্র কেন মরবে ওভাবে? ওরকমভাবে লড়ার পর্যন্ত সুযোগ না পেয়ে? ওভাবে দেখলো নিজের কাকা গুপ্তচর হয়ে শত্রুকে এনে ঢুকিয়েছে পূজার ঘরে আর সে কিছু করতে না পেরে ওভাবে অসহায় হয়ে মরবে?
বদলানো কি যায় না? কিন্তু রামায়ণের কাহিনি উনি বদলাবেন কী করে? শেষে উনি চোখের জলে কাহিনি শেষ করলেন, "সপ্তদিবানিশি লঙ্কা কাঁদিলা বিষাদে।"
-----------------------------------------------
কোন্ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
দারুণ
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
ধন্যবাদ।
সিন্ডারেলা কাহিনির সাথে মিলটা দেখেছেন? আসলে মেইনস্ট্রীম মিডিয়া সে এককালে ছিলো উপকথা লোককথা আর আজকাল হয়েছে সিনেমা আর টিভি সিরিজ --এরা সবসময় কায়দা করে নিজেদের মনোমতো সুন্দরী বিউটি বানিয়ে নেয় আর তাকে উদ্ধারের জন্য অবশ্যই রাজপুত্রের আগমণ ঘটে।
-----------------------------------------------
কোন্ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
শেষটায় আইসা গেল মেজাজ খারাপ হয়ে। বেচারি!
==========================
আবার তোরা মানুষ হ!
==========================
আবার তোরা মানুষ হ!
নতুন মন্তব্য করুন