এটা নেটিভ আমেরিকান উপকথা। শাইয়্যান (Cheyenne) গোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত গল্প। নামগুলোর ব্যাপারে কিছুটা স্বাধীনতা নেওয়া হয়েছে বাংলায় তাল রাখতে।
এক সুন্দর সন্ধ্যায় খেলাধূলার শেষে ক্লান্ত শরীরে খোলা মাঠে শুয়ে শুয়ে ঝিরিঝিরি হাওয়ায় ক্লান্তি দূর করছিলো দুটি কিশোরী মেয়ে। কল্পনা আর রঙ্গনা। একে একে উজল তারাগুলি ফুটে উঠছিলো আকাশে, সে ভারী সুন্দর সময়।
এক দুই তিন ... না না ঐ তো আরেকটা, ঐ যে আরো একটা, ওরা তারা গোণার খেলা খেলছিলো। তারপরে শত শত তারা ফুটে গেল, ওরা তারা গোণায় ক্ষান্তি দিয়ে চুপ করে দেখতে লাগলো। কল্পনা বললো, "ঐ যে ঐ তারাটা, ওটা সবচেয়ে উজল। আহা, ওর সাথে যদি দেখা হতো আমার!" রঙ্গনা হেসে উঠলো, "তারার সঙ্গে দেখা হবে, কী কল্পনা! সাধে কি তোর নাম কল্পনা?”
কল্পনা কিন্তু তার স্বপ্নাচ্ছন্ন চোখ মেলে দপদপ করে জ্বলা সেই উজল তারাটির দিকে চেয়েই রইলো, সে চোখ ফেরাতে পারছিলো না। তার মনে হচ্ছিলো উজল তারাটির মধ্য থেকে কার যেন হাসিমুখ তার দিকে চেয়ে আছে।
রাত বাড়ে, কল্পনা রঙ্গনা ঘরে যায়। রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়ার আগে আবার একবার আকাশভরা তারার নিচে বেরিয়ে আসে কল্পনা, সেই উজল তারাটি এখন অনেক পশ্চিমে নেমে গেছে, দপদপ করে জ্বলছে দিগন্তের কাছে। কল্পনা ফিসফিস করে বলে, "তারার মানুষ, তোমায় দেখতে ইচ্ছে করে খুব। আসবে আমার রাতের স্বপ্নে?" তারপরে ঘরে ফিরে সে ঘুমিয়ে যায়, তার স্বপ্নে আশ্চর্য সব দৃশ্যাবলি ভেসে আসে, অচেনা নদীতীর, একটা বিরাট মাঠ, অজস্র পাখি, সে যেন কত উঁচু থেকে, একেবারে যেন মেঘের কাছ থেকে পড়ে যাচ্ছে পৃথিবীর দিকে, তার কোলে এক উজল শিশু, দুরন্ত বেগে কাছিয়ে আসছে শক্ত মাটি, এবারে সে চূর্ণ হয়ে যাবে বুঝি, সে কার কাছে যেন প্রার্থনা করছে আমাকে বাঁচানোর দরকার নেই, আমার ছেলেটাকে বাঁচাও। সকালে ঘুমে ভেঙে অবাক হয়ে থাকে কল্পনা, এরকম অদ্ভুত স্বপ্ন সে কেন দেখলো?
সকাল সকালই কাজে বেরোয় তারা গোষ্ঠীর লোকেদের সঙ্গেই। সকলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে, কেউ কন্দমূল সংগ্রহ করে, কেউ নদী থেকে জল আনে, কেউ কেউ মাছ ধরতে যায়, কেউ যায় শিকারে। সকলেই গোষ্ঠীর সকলের জন্য কাজ করে, সাধারণ ভোজনশালায় সবাই এনে দেবে সব কিছু, সেখানে একসাথে রান্না খাওয়া হবে।
কল্পনা আর রঙ্গনা একসাথে জঙ্গলে খানিকটা এগিয়েই দেখে একটা মস্ত সজারু। কল্পনা তাড়া করে সেটাকে ধরবার জন্য, সজারুর মাংস চমৎকার খেতে। সজারুটা তরতর করে একটা লম্বা পাইন গাছ বেয়ে উঠতে থাকে, কল্পনা তার পিছন পিছন উঠতে থাকে। উঠতে উঠতে সে কতটা উঠে গেছে বুঝতে পারে নি, নিচের থেকে রঙ্গনা তাকে ডাকছিলো নেমে আসার জন্য, সে শুনতেই পায় নি। সেই পাইন গাছ যে সাধারণ কোনো পাইন গাছ নয়, তাও সে বুঝতে পারে নি। ওটা ছিলো যাদু গাছ, গাছের মাথা মেঘ ভেদ করে পৌঁছে গেছে আকাশরাজ্যে। অনেক উপরে পৌঁছে তার হুঁশ হলো, নিচে তাকিয়ে মাথা ঘুরে গেল, কিছুই দেখা যায় না। সে অজানা ভয়ে কাঁদতে শুরু করে।
সেই সজারু ছিলো সেই উজল তারা, সজারুবেশে সে কল্পনাকে ভুলিয়ে এনেছিলো। গত রাতে সে যে সব শুনেছিলো, শুনে যে তার কল্পনাকে খুব ভালো লেগেছিলো! উজল তারা নিজের রূপে দেখা দিয়ে কল্পনাকে হাত ধরে যত্ন করে নিয়ে গেল আকাশরাজ্যে, বললো কোনো ভয় নেই। সেখানে খুব আনন্দ, খুব সুখ।
তারপরে দিন যায়, কল্পনার সাথে বিয়ে হয়েছে উজল তারার মানুষের। সুখে-আনন্দে দিন যায় তাদের। বছর ঘুরে গেলে তাদের একটি ছেলে জন্মালো, ফুটফুটে সুন্দর। তখনও তার নামকরণ হয় নি।
কল্পনাকে উজল তারার মানুষ বলেছিলো সে বাগান থেকে সব ফুল তুলতে পারবে, সব ফল পাড়তে পারবে, সব কন্দমূল তুলতে পারবে, কিন্তু ভুলেও যেন শালগম না তোলে, তুললে তার জীবনে দু:খ দেখা দেবে।
কৌতূহলে ফেটে পড়ে একদিন কল্পনা তুলে ফেললো একটা শালগম, অমনি আকাশরাজ্যের মাটিতে একটা ফাঁক, সেই ফাঁকটুকু দিয়ে সে দেখতে পেলো কতদিন আগে ফেলে আসা তার ভূমি, সেই মাঠজঙ্গল, সেই নদী, সেইসব মানুষেরা। দীর্ঘশ্বাস পড়লো তার, আর কোনোদিন কি ওখানে তার যাওয়া হবে না আপনজনেদের মধ্যে?
স্বামীকে না জানিয়ে তন্তু পাকিয়ে পাকিয়ে কল্পনা একটা লম্বা দড়ি বানালো, তারপরে সেই দড়ির একমাথা একটা মোটা গাছের গুড়িতে বেঁধে অন্য মাথা নামিয়ে দিলো সেই ফাঁকাটুকু দিয়ে। ছেলেকে কোলে নিয়ে সে দড়ি বেয়ে নামতে লাগলো, নিচে নিচে আরও নিচে। কিন্তু দড়ির শেষমাথাতে এসেও দেখলো মাটি তখনো অনেক নিচে। খানিকক্ষণ ঝুলে থেকে আর পারলো না সে, হাত ছেড়ে দিলো। পড়তে পড়তে তার শুধু মনে হচ্ছিলো সে তো মরবেই, কিন্তু আহা ছেলেটা যদি কোনোক্রমে বেঁচে যেতো!
মাটিতে আছড়ে পড়লো মা আর ছেলে। মা সঙ্গে সঙ্গে মরে গেল, কিন্তু ছেলে কিনা উজল তারার মানুষের সন্তান, মাটির পৃথিবীর মানুষের চেয়ে অনেক শক্ত। ছেলেটা বেঁচে রইলো, পাখিরা সারারাত তাকে ডানা দিয়ে ঢেকে রক্ষা করলো শীত থেকে।
সেই প্রান্তরে থাকতো যাযাবর মানুষেরা। তারা ছেলেটাকে কুড়িয়ে পেল পরদিন। তাকে নিয়ে লালন পালন করলো ওরা, নাম দিলো সুনক্ষত্র।দিন যায়, মাস যায়, বছর ঘোরে। দেখতে দেখতে বড় হয়ে ওঠে সুনক্ষত্র। খুব সতেজ সবল সে, খুব ভালো তীর ছুঁড়তে পারে, বর্শা দিয়ে শিকারেও দক্ষ। একসময় যাযাবরেদের চলে যাবার সময় হলো, ওরা সুনক্ষত্রকে তীরধনুক বর্শা সবকিছু দিয়ে তার মায়ের গোষ্ঠী যেখানে থাকে সেখানে যাবার পথ বলে দিলো। সেখানে নাকি ভয়ানক এক নদীদৈত্যের উৎপাতে মানুষ খুব কষ্টে আছে।
সুনক্ষত্র সেখানে গিয়ে দেখে সত্যিই খুব ভয়ানক অবস্থা। নদীতে কেউ জল আনতে গেলেই সেই দানব কপাৎ করে গিলে ফেলে তাকে। সুনক্ষত্র একটা জলপাত্র নিয়ে গেল জল আনতে, তার সাড়া পেয়েই জল তোলপাড় করে ছুটে এলো সেই জলদানব। সুনক্ষত্রকে গিলে ফেললো।
কিন্তু সুনক্ষত্র হলো গিয়ে নক্ষত্রের সন্তান, সে কি যে সে? সে দানবের পেটের ভিতরে গিয়ে ঘুষি মেরে পেট ফাটিয়ে বেরিয়ে এলো, দানো আগে যাদের পেটে পুরেছিলো তারাও বেরিয়ে এলো। এইভাবে দানবের ধ্বংস হলো, সকলে সুনক্ষত্রকে ধন্য ধন্য করতে লাগলো।
কিছুকালের মধ্যেই সুনক্ষত্রকে দলপতি বানিয়ে দেওয়া হলো, গোষ্ঠীর সবচেয়ে সুন্দরীর সঙ্গে তার বিয়ে হলো। খুব সুন্দর একখানি কুটির তাদের দেওয়া হলো। সকলে তার নেতৃত্বে সুখে শান্তিতে থাকতে লাগলো।
আকাশ থেকে তার পিতা উজল নক্ষত্রের মানুষ আর তার মা যে কিনা মরে গিয়ে তারা হয়ে গেছে, দুজনেই তাকে ও তার গোষ্ঠীর সকল মানুষকে আশীর্বাদ করে চললো নিরন্তর।
মন্তব্য
একটানে পড়ে ফেল্লাম।
খুব ভাল লাগল।
ধন্যবাদ অনিন্দিতা।
-----------------------------------------------
কোন্ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
ভালো লাগলো। নামটা শাইয়্যান হবে, চেয়েন্নে নয়।
.........
আমাদের দূর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা
সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখণ্ড বস্ত্র মানবিক;
আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা
.........
আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা
সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখণ্ড বস্ত্র মানবিক;
আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা
ধন্যবাদ সংশপ্তক।
গোষ্ঠীর নাম ঠিক করে দিলাম।
-----------------------------------------------
কোন্ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
বাঃ। ভাল গল্প। এটা আপনার সিরিজেতে কত নম্বর হল?
ধন্যবাদ ভাই।
সিরিয়াল নম্বর কত কেজানে।
-----------------------------------------------
কোন্ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
এই উপকথার শেষটা তেমন পছন্দ হলো না। কেমন হুটহাট শেষ হয়ে গেল। তবে প্রথম অংশটা খুব ভাল। সত্যি সত্যি তারার সাথে দেখা হলে কী ভালই না হতো!
ধন্যবাদ বইখাতা।
তারার সঙ্গে দেখা হবার ঘুমন্ত বাসনা আমাদের বেশীরভাগেরই, আমাদের জিনে করে বয়ে আনা কোনো সুপ্রাচীন রহস্য হয়তো।
-----------------------------------------------
কোন্ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
দারুন!
বই চাই। সবগুলো গল্প একসাথে সংগ্রহ করার জন্য।
-শিশিরকণা-
(আমিহিমি@gmail.com)
ধন্যবাদ শিশিরকণা।
এসব বই করা একটু জটিল ব্যাপার। এইধরনের বইয়ে পাতাগুলো চমৎকার, ছাপা বেশ ভালো, অক্ষর বড়, বানান সব ঠিক, ভালো ভালো রঙীন বা সাদাকালো ছবি থাকলে ভালো হয় ( ছোটোরা পড়বে কিনা! )। অত যত্নে সবকিছু দিয়ে বই বার করা একটু ব্যয়সাধ্য ব্যাপার। ভালো প্রকাশনাভবনের সাহায্য দরকার।
ভালো থাকবেন।
-----------------------------------------------
কোন্ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
গল্পটার একটা জায়গার সাথে কি অ্যাডাম-ইভের পৃথিবীতে আসার কাহিনীর একটু মিল আছে? একইরকম ব্যাপার, একটা নির্দিষ্ট ফল নিষিদ্ধ, কিন্তু ঠিকই ঐটা তুলে ফেলল মানুষ, তুলে স্বর্গ/ তারার দেশ থেকে মানুষ পৃথিবীতে এসে পড়ল। এই একই কাহিনী ঘুরেফিরে কত জায়গায় পাইলাম। অবাক লাগে।
==========================
আবার তোরা মানুষ হ!
==========================
আবার তোরা মানুষ হ!
দেশ বিদেশের উপকথায় চমকে ওঠার মতো মিল।
সেই যে সাত ভাই রাজকুমার টিয়াপাখি হয়ে গেল আর বোন তাদের শাপমুক্তির জন্য জামা বুনতে লাগলো নীরবতার ব্রত নিয়ে, এইটা তো ছোটোবেলা মায়ের মুখে শুনে মনে হয়েছিলো বাংলার উপকথা, এখন দেখি কোস্টারিকাতে ও প্রায় একইরকম গল্প!!! সাত ভাই সাত ম্যাকাও হয়ে উড়ে চলে গেল।
ভালো থাকবেন।
-----------------------------------------------
কোন্ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
আমি পড়সিলাম, সাত ভাই রাজহাঁস হয়ে যায়, বোনকে চুপ থেকে বিছুটি পাতা থেকে সুতা বুনে জামা বানাইতে হয়।
==========================
আবার তোরা মানুষ হ!
==========================
আবার তোরা মানুষ হ!
আরেক গল্পে সেই যে দুষ্টু ডাইনি ভালো রানীকে কবুতর বানিয়ে দিলো মাথায় পিন ফুটিয়ে, পরে একদিন রাজা পাখির মাথায় হাত বুলিয়ে পিনটা দেখে যেই না তুলে ফেললো, রাণী ফের রাণী হয়ে গেল। এটাকেও বাংলার উপকথা বলে মনে হতো। সেই গল্পও দেখলাম বিদেশের একটা উপকথায়।
-----------------------------------------------
কোন্ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
নতুন মন্তব্য করুন