ঝাঁক ঝাঁক জোনাকি গাছের মাথায় মাথায় পাতায় পাতায় জ্বলছে আর নিভছে জ্বলছে আর নিভছে। আমরা কয়জন ছাদের উপরে মাদুরে, তখন নভেম্বর মাস, বেশ শীত পড়ে গেছে। কম্বল টম্বল ভালো করে গায়ে জড়িয়ে বসেছি আমরা গুছিয়ে, চায়ের ব্যবস্থাও আছে। আমরা অপেক্ষা করে আছি উল্কাবৃষ্টির। লিওনিড মিটিয়র শাওয়ার। সিংহরাশির উল্কাবৃষ্টি।
কতকাল হয়ে গেলো? বহু বহু কাল? যেন মনে হয় গতজন্ম! অথচ মাত্র বারোবার পৃথিবী সূর্যপ্রদক্ষিণ করলো তার পরে! তাতেই এমন গতজন্ম হয়ে গেলো সবকিছু?
মীরার উৎসাহ সবচেয়ে বেশী। অনুরোধ করে করে সন্ধ্যা থেকেই পথবাতি নেভাবার ব্যবস্থা করেছে, কিন্তু জোনাকিরা তো আর তা জানে না! তারা নিজেদের মতন জ্বলছে নিভছে জ্বলছে নিভছে। হঠাৎ মনের মধ্যেটা কেমন করে, কতকাল জোনাকি দেখিনা!
আর আকাশে অগণিত নক্ষত্রের অনির্বাণ দীপাবলি। আরে ঐ তো জ্বলে উঠলো নীলসবুজ আলো! দাগ টেনে মিলিয়ে গেল অন্ধকারে। উল্কা বুঝি? একেই বুঝি তারাখসা বলে? কারা যেন এমন দেখলে উইশ করে? যা ইচ্ছা করা যায় তাই পূরণ হয় বুঝি?
তারপরে আর বহুক্ষণ উল্কা জ্বলা দেখা হয় না, উল্কা তো আর পড়ে না আর পড়ে না, এফ এম রেডিও সেই রাতে জনসাধারণের জন্য এই উল্কা নিয়ে অনুষ্ঠান করেছিলো, টেলিফোনও সেখানে করছিলো লোকে। তো সেখানে শোনা যায় বাচ্চা একটা ছেলে বলছে, "কই উল্কা পড়ছে না তো!" সঞ্চালক সস্নেহে বলেন, "পড়বে পড়বে রাত দুটোর পরে পড়বে। " ছাদের উপরে আমরা তো হেসে গড়াগড়ি।
তারপরে আর উল্কাদের দেখা নাই, আমরা মাদুরে শুয়ে শুয়ে তারা চিনি শুভ্রলেখার কাছে। ওই যে তারা দিয়ে ভি এর মতন হয়েছে, ওটা বৃষরাশির বৃষের মাথা, ওর পিঠে ওই যে একসাথে অতগুলো তারা ঝাপসাটে মেঘের ভিতরে, ওটা কৃত্তিকা। আর কালপুরুষ তো চেনাই যায়, তিনটে তারা একলাইনে একটু বাঁকা হয়ে নেমেছে, ওটা কালপুরুষের কোমরবন্ধ! কালপুরুষের পায়ের কাছে বেশ কিছু নিচে ওই যে জ্বলজ্বল করছে, ওটা লুব্ধক, এখান থেকে খালিচোখে দেখা রাতের তারাদের মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল! আর কালপুরুষের কাঁধের কাছে ওই যে কমলা তারা, ওর নাম আর্দ্রা, ও হলো রেড জায়ান্ট তারা!
ঝলমলে রঙীন আলো জ্বালিয়ে আকাশ পার হয়ে চলে যায় একটা এরোপ্লেন, তার পরে আরো একটা। গাছে গাছে জোনাকি আরো বেশী বেশী জ্বলছে এখন। শুধু উল্কাই আর দেখা দেয় না। না, ঐ তো ওই তো! আরেকটা। সবাই সেদিকে মুখ ফেরাতে না ফেরাতেই শেষ, আবার অন্ধকার!
শুভ্রলেখার খবর আর পাই নি বহুদিন, শেষবার খবর পেয়েছিলাম চিকিৎসার জন্য ওকে ওর বাবামা বিদেশে নিয়ে যাচ্ছে। হয়তো একদিন আবার খবর পাবো সেদিনের সবার, আবার ছাদের উপরে হয়তো আসবে সেই অলৌকিক তারার রাত্রি, সেই আশ্চর্য জোনাকপ্রহর।
মন্তব্য
প্রথম প্রথম ভেবেছিলাম কানাডায় বুঝি জোনাকি নাই। ভুল ভেঙেছে যখন আবিস্কার করলাম কানাডা বোধহয় সবচেয়ে বড় শহুরে-গ্রাম।
কানাডিয়ান স্পেস এজেন্সীর সাইট দেখতে পারেন-- অরোরার লাইভ দৃশ্য। সন্ধ্যার পরে মনে হয় শুরু হয়। সাইট ওপেন করলে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শুরু হবে, একেবারে সেই রকম পরিবেশ।
http://www.asc-csa.gc.ca/eng/astronomy/auroramax/default.asp
খাসা সাইট। পিপিদা অরোরা দেখেছেন নাকি? ছবি দেন না!
না রে ভাই, দেখিনি। এই সাইটতো সারাক্ষণই কয় ক্যামেরা বন্ধ আছে। কখন যে খোলে? এখনো দেখতে পারিনি।
অনেক অনেক ধন্যবাদ।
আহা অরোরা দেখার আমার বহুকালের শখ, আকাশে আলোর ওড়না, আলোর পর্দা, সবুজ, নীল বিচিত্রবর্ণা।
সত্যি সত্যি দেখার ইচ্ছা, আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে, মেরুজ্যোতির ছবি দেখে সাধ মেটে না, তবু কিছুটা তো মেটে।
আপনাকে আরো ধন্যবাদ।
----------------------------------------------
কোন্ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
ছবি দেখাটাই আপাতত সিন্থেটিক সুখ হিসাবে ধরেন।
সিন্থেটিকে শানায় না, দেখি কোনো প্রোজেক্টে যদি আন্টার্কটিকা যাওয়া যায় তাইলে দক্ষিণমেরুজ্যোতি দেখবো।
আর সিন্থেটিকই যদি কন তাইলে তো ঘরে বইসাই বড় বড় গ্যালাক্সি চইষা ফেলা যায়!
-----------------------------------------------
কোন্ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
ভাল্লাগলো।
ধন্যবাদ কৌস্তূভ।
-----------------------------------------------
কোন্ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
তুলিরেখা, লেখাটা বেশ লাগল।
বহুদিন আমি তারা দেখেছি। আমার শ্যামলদা বাঁশি বাজাতেন। হাওয়ায় হাওয়ায় ছড়িয়ে দিতেন কান্না। আর তখনই আকাশটা দূরে সরে যেত। জেগে উঠত তারা।
তখন শ্যামলদা দেখিয়ে দেখিয়ে চেনাতেন--তারকামণ্ডরী। ওনার কাছে জেনেছি সপ্তর্ষি মণ্ডলের অষ্টম তারাটির নাম অরুন্ধতী। বশিষ্টর পাশে আছে। পতিব্রতা স্বামীর অনুগামিনী হয়েছেন।
আর ধ্রুব তারাটিকে কেন্দ্র করে ঘুরছে সপ্তর্ষি। লুদ্ধক তারাটির কথা আপনি বললেন--ওটির অর্থ খ্যাপা কুকুর। ইংরেজিতে বলে সিরিয়াস। কালপুরুষ একটি খ্যাপা কুকুরকে নিয়ে ছুটে চলেছে।
তুলিরেখা, জোনাকী থাকে বাঁশবনে--ঝোঁপে ঝাড়ে। ওদের আলোর রসায়নটির নাম--লুসিফেরন। ডাইনীর আলো। অথচ কী শান্ত।
গল্পটিতে এই যে জোনাকীর কথা বলা হল--কিন্তু গল্পটিতো সেই মেয়েটির গল্প--যে ছাদের উপরে তারা শেখাল। কোন তারা? ভালবাসার তারা। ভালবাসা দিয়ে সে কেন পাগল হয়ে গেল? নাকি মেয়েটিই জোনাকী ছিল? জোনাকী হতে হতে এক সময় তারাকে ছুতে চেয়েছে?
এইখানে এসে--গল্পটি হাহাকার করে ওঠে।
এরকম গল্প রাতে ছাতে বসে পড়ার গল্প। গল্প খুঁজে নেওয়ার গল্প। অনেক ভাল লাগল। অন্যরকম লেখা। ধন্যবাদ তুলিরেখা।
...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'
...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'
আমার হৃদয়ের কৃতজ্ঞতা জানবেন। এমন সব মন্তব্য পেলে সামান্য এ লেখনি ধন্য হয়।
আমরাও তারা দেখতাম ছাদ থেকে, গরম রাতে বিদ্যুৎ না থাকলে ঘরে তিষ্ঠানো যায় না, তখন ছাদে মাদুর বিছিয়ে শোয়ার ব্যবস্থা। আর অবিস্মরণীয় সেই তারারাত্রিগুলি! সপ্তর্ষি, কালপুরুষ, ক্যাসিওপিয়া, অ্যান্ড্রোমিডা, পোলাক্স্ ক্যাস্টর যাদের বাংলায় বলে পুনর্বসু, ধনুরাশির মধ্য দিয়ে ছায়াপথের ওড়না, বৃশ্চিকের বুকে জ্বলজ্বলে কমলা জ্যেষ্ঠা, কন্যারাশির ঝকমকে সুন্দর নীলতারা চিত্রা--- ওদের সবাইকে চেনা।
ভালো থাকবেন।
-----------------------------------------------
কোন্ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
নতুন মন্তব্য করুন