সমুদ্রতীরের ছোট্টো গ্রামে থাকতো সুজন। বাপদাদাদের আমল থেকে তারা দক্ষ জেলে, সমুদ্রে মাছ ধরাই তাদের প্রধান কাজ। সুজন কিশোর বয়স থেকেই বাবার সঙ্গে যেত মাছ ধরতে। এখন তার বাবা-মা দুজনেই পরলোকে, এখন সে একাই মাছ ধরতে যায় নিজের নৌকা, জাল আর লোকজন নিয়ে।
সুজন কাজেকর্মে যেমন দড় তেমনি দেখতেও ভারী চমৎকার। তার সতেজ সবল দীর্ঘ চেহারা দেখে সবাই খুব প্রীত হয়। গ্রামের কুমারী মেয়েরা তাকে বিবাহ করার জন্য পাগল। কত সম্বন্ধ আসে সুজনের কাছে। কিন্তু সুজন সব ফিরিয়ে দেয়। সে বিবাহ বন্ধনে বাধা পড়তে চায় না, সে বলে, "এই বেশ ভালো আছি। সংসার করা মানেই হাজার হ্যাপা, আজ বৌ বলবে "এনে দে রেশমী চুড়ি/ নইলে যাবো বাপের বাড়ী/ দিবি বলে কাল কাটালি/ জানি তোর জারিজুরি", কাল ঠোঁট ফুলিয়ে বলবে "বলেছিলি যে স্নোপাউডার পমেটম এনে দিবি, কই সেসব? " পরদিন বলবে, "সোনার সুতায় কাজকরা রেশমীশাড়ী চাই আমার, এখুনি এনে দে, নইলে এক থাপ্পড়ে তোর দাঁতের হালি ফেলে দিবো, হ্যাঁ"-- ওরে বাপ রে, সে যেন সেধে খাল কেটে কুমীর আনা। ভাবলেই গায়ে জ্বর আসে।
দিন যায়, সুজন সারাদিন কাজকর্ম করে আর দিনের শেষে মাছটাছ সব হাটে চালান হয়ে গেলে সেদিনের পারিশ্রমিক সহকারীদের ঠিকঠাকমতন গুণে দিয়ে গুণগুণ গান গাইতে গাইতে একা ঘরে ফিরে আসে নিজের উপার্জন নিয়ে। একদিন সে ফিরছিলো অমন, বেলাশেষের রাঙা আলোয় আকাশ ভরে আছে, সমুদ্র টলটল করছে পাত্রের কানায় কানায় ভরা রঙীন সুরার মতন। উতল বাতাস বইছে, ফাগুণ হাওয়া। সমুদ্রের দিকে চেয়ে সুজনের বুক হু হু করে উঠলো, " মনের জানালা ধরে উঁকি দিয়ে গেছে / যার চোখ তাকে আর মনে পড়ে না/ আর কোনো চোখ তবু মনে ধরে না।" কে সে? তাকে কি গত জন্মে সে দেখেছিলো কোনোদিন?
সমুদ্রে ছোটোবড়ো শিলা মাথা জাগিয়ে আছে, ওখানে সেল্কি মেয়েরা খেলছিলো। সেল্কি হলো জলমানুষ, ওরা সীলের চামড়া পরে থাকে। খেলার সময় চামড়া খুলে রেখেছে পাথরের উপরে, খুব আনন্দে সাঁতার কাটছে জলকন্যারা, একে অন্যের দিকে জল ছুঁড়ছে, হী হী হী হী করে হাসছে। সেই হাসিতে ভরে উঠছে ফাগুণ বাতাস, চরাচরে যেন স্বর্ণবৃষ্টি হচ্ছে। সুজন এত অবাক হয়েছে যে গতিশক্তি হারিয়ে ফেলেছে, একবার চোখের উপরে হাত বুলিয়ে নিয়ে বুঝে নিলো স্বপ্ন দেখছে কিনা। স্বপ্ন না, সত্যি! সেল্কিরা তাহলে গল্পকথা নয়, এরা তাহলে সত্যি আছে!
সম্বিত ফিরে পেয়ে চুপি চুপি গুঁড়ি মেরে সুজন এগোলো পাথরগুলোর দিকে, ওগুলো বেশী জলে না, সুজনের কোমরজল হবে ওখানে। একটা সীলচামড়া খুব কাছে, সেটা একটান মেরে নিয়েই সুজন জলছপছপ করে পাড়ের দিকে দৌড় দিলো। জলকন্যারা টের পেয়ে গেছে, সব্বোনাশ। ডাঙার মানুষ দেখে ফেলেছে ওদের। পড়ি কি মরি কে এসে সবাই ঝটাপট সীলচামড়া পরে ফেলেছে আর জলের উপরে মাথা জাগিয়ে দেখছে ডাঙার মানুষটাকে। পাড়ের দিকে যেতে যেতে সুজন ফিরে তাকিয়ে দেখে সেলকিরা তার দিকে চেয়ে আছে নীরবে।
সব মাথা সীলের শুধু একটা মাথা এক মেয়ের, সে মেয়ে কেঁদে কেঁদে বলে, "ওগো ডাঙার মানুষ, ডাঙার মানুষ, দয়া করো আমায়। সীলের চামড়াটা ফেরত দাও গো, ওটা ছাড়া আমি সমুদ্রে থাকতে পারবো না। ওগো ভালোমানুষের ছেলে, নিজের উপরেও তো দয়া আশা করো তুমি, তবে আমাকে কেন দয়া করবে না? "
সুজনের হৃদয় বিগলিত হয় করুণায়, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই সেখানে জলপ্রপাতের মতন নেমে আসে ভালোবাসার অনুভূতি। জীবনে সেই প্রথম। জলের মধ্যে কাঁদছে ঐ অপার্থিব সুন্দরী তরুণী, গভীর সমুদ্রের মতন তার চোখ, জলজ্যোৎস্নার মতন তার বরণ, ঝড়ের মেঘের মতন তার কেশরাশি, সেই তো তার স্বপ্নে দেখা মেয়ে, যার জন্য আজও সে কঠোর কৌমার্যব্রত ধারণ করে আছে!
সুজন বলে, "সাগর কন্যা, আমায় বিয়ে করবে? "
সাগরকন্যা অবাক হয়ে বলে, "তোমায় কেমন করে বিয়ে করবো? আমি যে সাগরের মানুষ!"
সুজন বলে, " তাতে কী? তুমি দিব্যি ডাঙায় থাকতে পারবে, এই এখন যেমন নি:শ্বাস নিচ্ছ তেমন নেবে। তোমার দু'খান পা ও তো আছে, হাঁটতেও পারবে চমৎকার! প্রথম প্রথম আমি না হয় ধরে ধরে তোমায় হাঁটাবো। ঐ পাহাড়ের চূড়ায় প্রার্থনাভবন, সেখানে আমাদের বিয়ে হবে। তুমি আমার সঙ্গে ডাঙায় থাকবে। এখানে কত কিছু আছে, পাহাড় আছে, নদী আছে, হাট আছে বাজার আছে সব তোমায় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাবো। তোমায় কিনে দেবো সোনার চুড়ি রেশমী শাড়ী স্নো পাউডার পমেটম আতর যা তুমি চাও। অমত করিস না কন্যে, পায়ে পড়ি তোর। আমি তাহলে বাঁচবো না।"
(আগামী পর্বে সমাপ্য )
মন্তব্য
অসাধারণ! চালিয়ে যান, সুযোগ পেলে আপনার সাথে যোগ দেয়ার চেষ্টা করবো।
অবশ্যই যোগ দিবেন। আসুন সব লোকেদের আচ্ছা করে উপকথার ঝাল ঝাল ঝোল খাওয়াই।
-----------------------------------------------
কোন্ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
আগামী পর্বে কেন??? এই পর্বে কি সমস্যা ছিল???
--- থাবা বাবা!
মিষ্টি একসাথে বেশি খাওয়া ভালো না তাই।
_________________________________________________
হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস
তবুও তো ভাই কারোরই নাই, একটুখানি হুঁশ।
------------------------------------------
হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস
তবুও তো ভাই কারোরই নাই, একটুখানি হুঁশ।
থাবাথাবা,
সবকিছু থাবাথাবা খাইতে নাই, যেমন ধরেন আচার। অল্প করে আস্তে আস্তে টাগরা দিয়ে দিয়ে চুষে খেতে হয়।
-----------------------------------------------
কোন্ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
দারুন!
পরের পর্ব তাড়াতাড়ি...
ভালো কিছুর জন্য আমার অপেক্ষা করতে খুব একটা খারাপ লাগে না নাহলে আপনার উপরে রাগ হতো কেন এপর্বেই সবটা দিলেন না।
_________________________________________________
হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস
তবুও তো ভাই কারোরই নাই, একটুখানি হুঁশ।
------------------------------------------
হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস
তবুও তো ভাই কারোরই নাই, একটুখানি হুঁশ।
পূনশ্চঃ মিষ্টি!
--- থাবা বাবা!
ভাগ্যিস।
-----------------------------------------------
কোন্ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
ভালোই তো এগোচ্ছিল
---আশফাক আহমেদ
তারপরে কী হলো?
-----------------------------------------------
কোন্ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
টুক করে থেমে গেলো!
_____________________
আমরা মানুষ, তোমরা মানুষ
তফাত শুধু শিরদাঁড়ায়।
থামেনি তো, একটু জিরিয়ে নিচ্ছে।
-----------------------------------------------
কোন্ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
পরের পর্ব কই?
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
আসছে।
-----------------------------------------------
কোন্ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
অনেকদিন পর আবার উপকথা পড়লাম। ইকথিয়ান্ডরের কথা মনে পড়লো। পর্বটা ছোট হয়ে গেছে।
আহ। ইকথিয়ান্ডর! মনে পড়িয়ে দিলেন! খুব ভালো ছিলো কাহিনিটা।
আমি নেটেও কিছুদিন আগে একটা ভালোমানের বাংলা অনুবাদ পেয়েছি।
-----------------------------------------------
কোন্ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
ইকথিয়ান্ডর মানে? সেই উভচর মানুষ? প্রগতি না রাদুগা প্রকাশনী থেকে বেরোনো একটা অনুবাদ পড়েছিলাম ছোটবেলায় - হারিয়েই গিয়েছিলো গল্পটা, এইমাত্র নামটা শুনে মনে পড়লো।
ঠিক এরকম একটা গল্প পড়েছিলাম, তবে সেখানে সিল ছিল না। রাজহাঁস ছিল। পরের পর্বের অপেক্ষায়। তবে একটা জিনিস কি, একবারে পড়লে মনোযোগ ধরে রাখা যায়। আলাদা করে দিলে পুরনো মনোযোগটাকে "রিস্টোর" করতে পারি না।
নতুন মন্তব্য করুন