১
ঠান্ডা ধূসর আকাশ থেকে অদ্ভুত বিষন্ন বৃষ্টি পড়ছে, অবিচ্ছিন্ন অশ্রুর মতন, বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নেমে আসে, জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আমি দেখতে থাকি পথবাতিগুলির জ্বলে ওঠা, একের পর এক। এইখানে কয়েক মাস হলো এসেছি, এই দ্বীপরাজ্যের আবহাওয়া নাকি প্রায় সারাবছরই এমন ছিঁচকাদুনে বৃষ্টি আর বৃষ্টি। বন্ধুবান্ধব যারা থেকেছে সকলেই এই নিয়ে বিতৃষ্ণ। কী জানি আমার থাকতে হয় কতবছর।
মনে পড়ে রৌদ্রতপ্ত দিনের শেষে কালবৈশাখী, জটামেলা মেঘেভরা আশ্চর্য আকাশ, সেখান থেকে নেমে আসা ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি। আমি আর মোহর ... মোহর..... এখন কোথায় সে? কোনো খোঁজ আর রাখা হয় নি, দেশের বাড়ীতেই তো আর যাই নি সেই ক্লাস এইটের পরে।
তারপরে কোথা দিয়ে কেটে গেছে কত কত বছর-সময়ের ঘূর্ণীজল সরিয়ে দেখতে চাই, মোহরকে। দেখতে চাই সেই কবে যেন চিরকালের মতন হারিয়ে ফেলা আমার সেই আকাশপরীকে! ওর সেই দু'খানা আকাশীনীল রঙের নরম ডানা ... আর কি কোনোদিন সে আসবে না? কোনো রূপবতী বৃষ্টির বিকেলে আমি আর মোহর যদি একসঙ্গে ভিজতে পারি ...
চোখ বন্ধ করে ধূসর আকাশের বিষন্ন বৃষ্টি থেকে আলাদা হয়ে যাই, মনে পড়ে দীর্ঘ এক উড়ান। হাওয়াই জাহাজ রানওয়ে দিয়ে ছুটছে আর ছুটছে ... একসময় মাটি ছেড়ে উঠে পড়লো। পাশের সীটে মোহর, মোহরের নরম হাতখানা শ্বেতকপোতীর মতন আমার কোলে আশ্রয় নিলো ... চোখ মেলে দীর্ঘশ্বাস মুক্ত করে দিই। কোথায় বা মোহর ? হয়তো দূরে কোনো শান্ত জনপদে একটি সুলক্ষণ সুন্দর ঘরকন্যা পেতেছে-হয়তো উঠোনে খেলা করে বেড়ায় চুন্নিমণি শিশুরা।
ক্যারোলিন এসে কাঁধে টোকা দেয়, "রিখু, কী হলো, ডিনারে যাবে না? নাকি আজকে বাড়ী যাবে?"
ঘোর ভেঙে বেরিয়ে আসতে আসতে আমি বলি, " ডিনারের সময় হয়ে গেল? চলো তবে যাই। বাড়ীতে তো যাবো সেই মাঝরাতে।"
ক্যারোলিনের সঙ্গে বন্ধুত্ব হওয়াটাও বেশ আশ্চর্য। আমার মতন স্বল্পভাষী, অন্তর্মুখী, লাজুক মানুষের এত তাড়াতাড়ি বিদেশিনী বান্ধবী হয়ে যাবার কথা নয়, ক্যারোলিন নিজে উদ্যোগী হয়েই বলা যায় বন্ধুত্বটার সূচনা ও প্রস্ফুটন দুইই করে চলেছে।
একদিনের কথা মনে হয়। তখন আমি নতুনই বলতে গেলে। ক্যারোলিনের সঙ্গে ক্লাসে আলাপ হয়েছে, কিছুদিন কথাবার্তাও হয়েছে। একদিন ওকে দেখলাম বাইরে পাথরের বেদীতে বসে আছে। ওর কোমল তরুণীমুখের পাশে লতিয়ে আছে ভেলভেট ফুলের লতাটি, নরম সুখস্পর্শ ফুলগুলি ওর গালের ওপরে এসে পড়ছে হাওয়ায়। হাওয়ায় ওর সোনালী চুলের গোছাও উড়ছে আলতো আলতো করে।
ক্যারোলিনকে ছেঁড়া পুরানো পোশাকে এলোমেলো চুলে কল্পনা করতে চেষ্টা করি, কিন্তু তাতেও ওর রূপ এতটুকু কমে না। এমন সাদাতে গোলাপীতে মেশানো মুখের রঙ! এমন নিঁখুত করে গড়া নাক মুখ চোখ! নীল চোখের ভিতরে আলো জ্বলছে। ওকে ক্লান্ত ক্ষুধার্ত তৃষ্ঞার্ত কল্পনা করি, তাতেও রূপ কমে না ওর। ও বলেছিলো একসময় নাকি খুব কঠিন অবস্থা গেছে ওর, রোজ খেতে পেতো না, ছেঁড়া পোশাক পরতে হোতো। কিন্তু এই আকাশচ্যুত বিদ্যুতের মতন সুন্দরী কি তাতে ম্লান হয়? আমার দু:স্বপ্ন যত দূর যেতে পারে, চেষ্টা করি ততদূর খারাপ অবস্থায় ওকে কল্পনা করতে, কিন্তু সামনে ফুলে ছাওয়া শ্বেতপাথরের বেদীটিতে এলিয়ে বসা হাসিমুখ তরুণীটির চেয়ে কোনো মতেই বেশী ম্লান হয় না আমার কষ্টকল্পনার ক্যারোলিন। এত সৌন্দর্য দর্শকের বুকের ভিতরে একধরনের কষ্ট তৈরী করে। অচেনা কষ্ট। পৌষের ফিনিক ফোটা জ্যোৎস্নায় জেগে উঠে পূর্বজন্মের কথা মনে পড়ি পড়ি করেও যখন পড়ে না, তখনকার মতন কষ্ট।
আমরা চলতে থাকি, ক্যারোলিন কথা বলতে থাকে, আমি চুপ করে শুনতে থাকি। ক্যারোলিন ওর নিজের কত কথা আমাকে বলেছে, আমি নিজের কিছুই বলতে পারিনি। ক্যারোলিনের মা ওকে আর ওর ভাইকে একা-একা মানুষ করেছেন অমানুষিক পরিশ্রম করে। দিনেরবেলা একখানা কাজ আর সন্ধ্যাবেলা আরেকখানা কাজ করতেন উনি। ওদের বাবা নাকি ছিলেন খুব অদ্ভুত চরিত্রের লোক, আগে হাসিখুশী ছিলেন, ছেলেমেয়ে জন্মাতেই মেজাজ তিরিক্কি হয়ে গেল ভদ্রলোকের। ডিভোর্স করে ছেলেমেয়েকে ফেলে সবরকম দায়িত্ব এড়িয়ে একদিন চলে গেলেন দূরদেশে, আরেক মহিলাকে তার পূর্বতন সন্তানসমেত বিবাহ করে। সে বিয়েও টিঁকলো না অবশ্য বেশীদিন, পরে এক ধনী নি:সন্তান বিধবাকে বিবাহ করে এখন তাতেই নাকি সুখে আছেন।
অচেনা দূরের সংস্কৃতির গল্প সব, এদেরই মধ্যে থাকি কিন্তু বুঝতে পারি না, চিনতে পারি না। হয়তো সারাজীবন থাকলেও চিনতে পারবো না। ক্যারোলিন কত অনায়াসে বলে যায় তার মায়ের নতুন স্বামীর কথা, অনেক কষ্টের পরে এখন সুখে আছেন মা। "ডেভিড খুব চমৎকার লোক", সৎ বাবা সম্পর্কে বলে ক্যারোলিন।
আমি প্রথম শুনে আঁতকে উঠেছিলাম, "স্টেপড্যাডকে নাম ধরে বলছো?"
ক্যারোলিন বিশুদ্ধ অবাক হয়ে বলেছিল, "আরে নাম ধরে ছাড়া কিভাবে বলবো? নাম তো ডাকার জন্যই, তাই নয়? "
ওর ছোটোবেলার আর কৈশোরের গল্প শুনি, আমাকে মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করে আমার কথা, আমি একটা দুটো কথা বলে চুপ করে যাই, তেমন কিছু বলতে পারি না। একদিন হয়তো আমিও -- বুকের ভিতরের কষ্টপাথরটা নড়ি নড়ি করে ওঠে যেন।
ক্যারোলিন তার সতেরো বছর বয়সের কথা বলে, তখন তার বয়ফ্রেন্ড তাকে অন্ত:সত্ত্বা করে দায়িত্ব এড়িয়ে পালিয়ে যায়। ক্যারোলিনের একটা দুর্ঘটনা হয়, তার প্রাণ বাঁচে, অজাত সন্তানটি মারা যায়। কেমন এক নিরাসক্ত গল্পকথকের ভঙ্গীতে বলে যায় ক্যারোলিন, যেন অচেনা-অজানা কারুর জীবনের কথা বলছে। নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলার মতন করে সে বলে যায়, "একদিকে ভালোই হয়েছে, নইলে কী আর কলেজে-ইউনিভার্সিটিতে ফিরে আসা হতো? ঐ হাইস্কুল ডিপ্লোমা সম্বল করেই কোথাও না কোথাও কাজ করতে হতো আর বাচ্চা মানুষ করতে হতো!" আমার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে সেই বয়ফ্রেন্ড পরে কোনো খোঁজখবর নেবার চেষ্টা করেছে নাকি! কিন্তু শেষমেশ আর জিজ্ঞেস করি না, থাক, কী হবে ওর ব্যক্তিগত কথা জানতে চেয়ে?
২
ধূসর আকাশ থেকে একটানা তুষার ঝরছে, রাস্তাগুলো সাদা হয়ে গেছে। গাছগুলো সব ন্যাড়া, কঙ্কালের মতন দাঁড়িয়ে আছে। প্রাণহীন প্রত্নপ্রস্তর যেন। অদ্ভুত বিষন্নতা বর্ণহীন চাদরের মতন ছড়িয়ে আছে সবটুকু জুড়ে, বাইরে আর ভেতরে। সূর্যহীন ধূসর মেটে তুষারাচ্ছন্ন দিন যে কি প্রচন্ড বিষাদের! আহ, উষ্ণতা যে কি ভীষণ আকাঙ্ক্ষার, সে কি এই অবস্থায় না পড়লে কোনোদিন বুঝতে পারতাম?
প্রবল সূর্যের দাবদাহের দেশ থেকে আসা আমি, আগুন আবিষ্কার নিয়ে এদের এই আদিখ্যেতার অর্থ অস্পষ্টভাবে বুঝতে শুরু করি। মস্ত মস্ত গাম্বাট পোশাকে সর্বাঙ্গ আবৃত লোকেরা পথ চলেছে,আমি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে কিছুতেই ঠিক করতে পারছি না কখন বাসায় ফিরবো, এখন না আরো অনেক পরে?
হুতুমথুমের মতন দিন, ধোঁয়া ধোঁয়া সব কিছু। জোর করে পিছিয়ে যাই সময়ের মধ্যে, স্মৃতির সরণী ধরে অতীতের উদ্যানে ঢুকে পড়ি। মোহর, মোহর, মোহর। ওকে দেখবো, ওকে দেখতে চাই। থুতনি ঠেকাই মোহরের গালে, বলি," কীরে, কেন কাঁদছিস ছিঁচকাঁদুনির মতন?" মোহর দু'হাত দিয়ে গাল চোখ মুছতে মুছতে হাসে, বলে, "চোখে আঞ্জনি না খঞ্জনি কী হয়েছে কে জানে।"
প্রবল হাওয়ায় উড়ছে মোহরের চুল, সন্ধ্যার রঙ গড়িয়ে পড়ছে আকাশ বেয়ে, কাকেরা দল বেঁধে উড়ে চলে আসছে পুবের দিকে, ওরা সর্বদা বাসায় ফেরার সময় পুবে উড়ে আসে। সকালে বেরোবার সময় সূর্যের বিপরীতে ওড়ে আবার ফেরার সময়ও। আচ্ছা, ওরাও কি জানে জ্যামিতি, অংক, গোল জ্যামিতি? ওরা নিশ্চয় আমাদের থেকে অন্যরকম জানে, কত উপরে ওড়ে ওরা, জন্মকাল থেকে।
সারি বেঁধে ওড়া কাকের দল থেকে পিছিয়ে পড়েছে একটি কাক, তাছাড়া অন্য কাকেরা উড়ে যাচ্ছে নিঁখুত একটি গতিময় প্যাটার্নের মতন, ওদের ডানায় আলো থেকে ছায়া পড়ে আসছে। পিছিয়ে পড়া কাকটিকে মোহর বললো,"তাড়াতাড়ি যা, এই তাড়াতাড়ি যা। হারিয়ে যাবি নইলে।"
মোহরের মুখের দিকে চেয়ে হেসে উঠলাম আমি, "তুই একটা পাগলি রে মোহর।"
দুধসাদা ক্যারোলিনের মুখের পাশে লতিয়ে আছে ভেলভেট ফুলের লতাটি, নরম সুখস্পর্শ ফুলগুলি ওর গালের ওপরে এসে পড়ছে হাওয়ায়। আমাকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো ও, বললো, " রিখু, কোথায় চললে? "
" লাইব্রেরী। তুমি যাবে? " আমি ওর হাত ধরতে হাত বাড়িয়ে দিই। ক্যারোলিন ওঠে, একটি আলোর হিল্লোলের মতন এগিয়ে আসে। কোথা থেকে খিলখিল একটা হাসি শুনতে পাই, একদম মোহরের গলা।
আহ, যতবার ক্যারোলিনের দিকে তাকাই, কেন মোহরকেই শুধু মনে পড়ে? তবু কিছুতেই মন খুলতে পারিনা কেন? ত্রুটি কি তবে আমারই মধ্যে? আমারই ভুল অভিমানে হারিয়ে ফেলছি সব? আকাশপরীকে কি তাই আর দেখতে পাই না?
মাঝে মাঝে তীব্র অপরাধবোধে আচ্ছন্ন হয়ে যাই। মনে হয় কত দূরের দেশের কত অজানা সংস্কৃতির এই আমাকে নি:সঙ্কোচে এত আপন করে নিয়েছে এই মেয়েটা, আমি কি তার যোগ্য প্রতিদান দিতে পেরেছি? আমি তো আমার আপন অহং এর পাঁচিলের ভিতরেই আছি দিব্যি! অহং এর পাঁচিলই তো! মনের দরজা তো খুলে দিতে পারিনি কোনোদিন সেভাবে!
শীত শেষ হয়ে বসন্ত এসে গেল। বসন্ত ও চলে গেল, এখন গ্রীষ্ম। আমাদের কাজ পড়লো অনেক দূরে, ক্যারোলিনকে আর আমাকে পাড়ি দিতে হলো আরেকটা মহাসাগর। ক্যারোলিন আগেও বেশ কয়েকবার গেছে সে পথে, একটুও নার্ভাস না। আমার তো টেনশনে আধাসেঁকা অবস্থা। সে বারেবারে আমায় সাহস দেয়, খুব ভালো সময় কাটবে আমাদের।
এখন আমরা আবার এক গরম দেশে, ধোঁয়াটে আকাশ আবারও নীল। বদলে যেতে থাকা সবকিছু, এই যে আকাশ, স্ফটিকের মত স্বচ্ছ নীল, ঝকঝকে সূর্য বুকে নিয়ে-আবার জোরালো দক্ষিণের হাওয়ায় এই উড়ে এলো সাদা তুলো-তুলো মেঘেরা, ধূসর ভারী মেঘেরা এলো তার পরে। ছায়া পড়ে এলো, হয়তো বৃষ্টি নামবে।
বাড়ীতে ফোন করি, জিজ্ঞেস করি কেমন আছে ওরা। মা বলে যে ওরা ভালোই আছে, খুব গরম, লোডশেডিং চলছে লাগাতার, আকাশভরা মেঘ, গুমোট হয়ে আছে সকালবেলা, খুব বৃষ্টি হয়ে গেছে গত সন্ধ্যায়। আশ্চর্য, সেই সন্ধ্যাটা এখনো চলছে এখানে! দুনিয়া এত অবাক করা জায়গা! জন্মান্তরের মতন বিচ্ছিন্ন অথচ যুক্ত হয়ে আছি সবাই, লিখে কিছুই বোঝানো যায় না, শুধু একটা আকুলতা, একটা অস্থিরতা ধাক্কা দিতে থাকে! বিজ্ঞানীরা কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গলমেন্ট এর কথা বলেন, সেও কি অদ্ভুত অবিশ্বাস্য ব্যাপার! নিকট ও দূর সত্যিই কি জুড়ে আছে অমন নিবিড় হয়ে ?
মানুষের জীবনটা আসলে কিরকম? বিষাদের নাকি আনন্দের? নাকি যে যেভাবে চায় সেভাবেই পায় জীবনকে? এই যে ক্যারোলিন, সুখদু:খের স্রোতের ভিতর দিয়ে কেমন নতুন গড়া নৌকার মতন অনায়াস গতিতে অবলীলায় ভেসে যাচ্ছে, আমি তো তেমন পারি না! কেন পারি না? কীসে আমাকে টেনে ধরে পিছন থেকে? সকলের সঙ্গে কেন মন খুলে মিশতে পারি না? এ কি আমার জন্মগত কোনো অসহায়তা? নাকি পূর্ণবয়স্ক এই আমার ভিতরের মানুষটা আজো অভিমানী এক শিশুর মতন ঠোঁট ফুলিয়ে বসে আছে?
বারে বারে মনে পড়ে প্রবঞ্চিত শৈশবের দিনগুলো যখন বাবা-মা কেউ আমাকে বুঝতে চাইলো না, শুধু কঠোর শাসন করে গেল কারণে অকারণে। মনে পড়ে সেই কৈশোরের একাকীত্ব, যখন খুব কাছের বন্ধু কেউ ছিলো না, যখন বাবামায়ের সঙ্গে বন্ধুর মতন একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠা খুব প্রয়োজন ছিলো, কিন্তু তা হলো না। এইসব কথা মনে মনে তোলাপড়া করে নিজের সপক্ষে কিছু যুক্তি দাঁড় করাই আবার নিজেই ভেঙে ফেলি। আরও কত মানুষের শৈশব-কৈশোর আরো কত কঠিন অবস্থার মধ্য দিয়ে পার হয়েছে, কই তারা তো সবাই এরকম হয়ে যায় নি?
৩
ক্যারোলিন গুণ্ গুণ্ করে গান গাইতে গাইতে আসছে, দু'হাতে দু'খানা আইসক্রিম কোণ, আমাকে একটা দিলো। নিজে ঠোঁটে মুখে আইসক্রিম মাখামাখি করে খেতে খেতে বাচ্চাদের মতন হাসছে। বলছে, "চলো না বেড়িয়ে আসি, উইকেন্ডে ঘরে বসে থেকে কী হবে?"
আমার ওকে দেখে অবাক লাগে, এত প্রাণশক্তি এত আনন্দ এত মজা করার ক্ষমতা এই ক্ষীণকায়া মেয়েটির মধ্যে কেমন করে থাকে?
আইসক্রিমের ঠান্ডা শিরশিরে দুধালো মিষ্টতা মুখের ভিতরে গলে যায়, আমি ক্যারোলিনের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি। হঠাৎ করে মনে পড়ে আমার খয়েরী মলাটের ডাইরিটাকে, ডাইরিটার পাতাগুলো ঘিয়ে রঙের, কেমন একটা হালকা ধূপের গন্ধ ছিলো পাতাগুলোতে।
পাতাগুলো ভরে উঠছিলো এলোমেলো কবিতায়। একলা একজন মানুষের গভীর সঙ্গোপনের সাথী। কেউ কোনোদিন জানতে পারেনি আমার কলেজবেলার কবিতাদের, খুব সাবধানে লুকিয়ে রাখতাম ডাইরিটা। দেশ থেকে চলে আসার সময় সেটা আনা হয় নি সঙ্গে করে আর।সেই খুব যত্নে লুকিয়ে রাখা ডাইরিটা কি কেউ খুঁজে পেয়ে গেছে? মা অথবা বাবা? নাকি এখনো ওটা লুকানোই আছে? লুকিয়ে থেকে থেকেই হয়তো একদিন পুরানো, জীর্ণ হয়ে যাবে, লেখার কালি আবছা হয়ে হারিয়ে যাবে। আজ থেকে একশো বছর পরে কোথায় থাকবে আমাদের চেনা এই বর্তমানের জিনিসগুলো সব?
সন্ধ্যাবেলার কমলা পালকমেঘের মতন একটা কবেকার লেখা অনামিক কবিতা ভেসে এসে আমাকে ছুঁয়ে যায়, কেমন করে স্মৃতির মধ্যে লুকিয়ে চলে এসেছে সে?
" আঁকেবাঁকে পাথরের চুলগুছি আল্পনা-
ঘুরে ঘুরে এলোমেলো ঢেউকথা ছুঁয়ে ছুঁয়ে
নিজের মতন পথ চলে নদী।
মাঝে মাঝে ঘুরে দাঁড়ানোর ইচ্ছেফুল
ফেনায় ফেনায় ফুটে উঠে পাড়পাহাড়ে মিলিয়ে যায়।
গাঢ় যুবতী রোদ ঢেকে দিয়ে বিকেল আসে জলকল্যাণী।"
আমি জোর করে ঘোর থেকে বেরিয়ে আসার জন্য উঠে দাঁড়াই। বলি, " বেশ তো, চলো না কোথাও ঘুরেই আসি। সমুদ্র তো মাত্র দুইঘন্টার দূরত্বে। যাবে?"
ক্যারোলিনের আইসক্রীমমাখা মুখ খুশীতে আলো-আলো হয়ে ওঠে, বিশ্বাস করতে পারছে না যেন এমন গলায় বলে, " সত্যি যাবে ?"
" হ্যাঁ, সত্যিই তো। চলো বেরিয়ে পড়ি এখনই। কোনো গোছগাছের কিছু নেই, সন্ধ্যেবেলায় ফিরে আসবো। দুপুরে ওখানেই কোথাও খেয়ে নেওয়া যাবে। এসো, যাই। "
" আরে! পোষাকটা অন্তত পাল্টে আসতে দাও। আর সানস্ক্রীন লোশন, ক্যামেরা...." কথা বলতে বলতে ক্যারোলিন পাশের ঘরের দিকে চলে যায়, আমি হেসে জুতোমোজা পরতে শুরু করি। আমার সানস্ক্রীন লাগবে না। সূর্যক্ষুধায় আমার ভিতরটা আনচান করছে, পুড়ে কালচে হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে।
কোলের উপরে ম্যাপ খুলে বসে আছে ক্যারোলিন। সি-বীচে যাওয়ার পথে পড়বে এক সংরক্ষিত অরণ্য, সেখানে আবার নাকি বড় বড় দু'খানা লেক আছে। ক্যারোলিন আমাকে দিয়ে কড়ার করিয়েছে সেখানে আগে যেতে হবে, তারপরে সিবীচ। অল্প কষাকষিতেই আমি রাজি হয়েছি দেখে সে খুব খুশী।
সংরক্ষিত জঙ্গলের ভিতরে অগভীর এক হ্রদ। বছর চল্লিশ আগে নাকি খোঁড়া হয়েছিলো পুস্তিকায় দেখি। গাড়ী থামিয়ে নামলাম আমরা। বেশী কিছু আশা করিনি, কিন্তু কাছে গিয়ে আমি একেবারে চমকে যাই, অজস্র সাদা শালুক ফুটে আছে পাড়ের কাছে! জোড়ায় জোড়ায় ফড়িং উড়ছে ফুলগুলোর উপরে। মাঝে মাঝে বেশী অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় ফড়িংগুলো জল ছুঁয়ে ছুয়ে বিদ্যুৎগতিতে উড়ে যায় দূরে, আবার একটা জটিল পাক খেয়ে ফিরে আসে।
একটু দূরেই কচি কচি নরম সবুজ পাইন গাছ, বড় বড় পাইনের পায়ের কাছে নতুন গাছেরা জাগছে। ক্যারোলিন ক্যামেরা বার করে ছবির পর ছবি তুলছে, আমি লেকের পাড় থেকে ঝুঁকে একটা শালুক তুলে নিলাম। আহ, যদি মোহর আজকে সঙ্গে থাকতো! ক্যারোলিনকে কী এই ফুলের মাহাত্ম্য বোঝানো সম্ভব কোনোদিন?
জলের মধ্যে খুব ছোটো ছোটো মাছ সাঁতরে বেড়ায়। আমার মনে পড়ে যায় দেশের বর্ষাবাদলার দিন, রেনি ডে হয়ে স্কুল ছুটি হয়ে গেছে। কচিকাচাদের আনন্দ দ্যাখে কে! ছাঁকা দিয়ে মাছ ধরে কচুপাতায় জল নিয়ে তাতে করে মাছ নিয়ে ফিরছে তারা! চোখ বুজে আমি নিজেকে শাসন করি, " বর্তমানে বাঁচতে হয় রিখু, অতীত ভুলে যেতে হয়, নইলে মানুষ সামনে এগোতে পারে না।"
অন্ধ গুহার ভিতর থেকে গভীর গুমগুম শব্দে কে যেন বলে, "আমি চাই না চাই না চাই না সামনে এগোতে। আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে চলো, ফিরিয়ে নিয়ে চলো।" কে বলে? কেন বলে?
কচি পাইন গাছগুলোর কাছ থেকে উত্তেজিত রাঙা মুখে ছুটতে ছুটতে আসে ক্যারোলিন। একটা মস্তবড় নীল প্রজাপতি নাকি ওখানে দেখেছে সে! কিন্তু ছবি তুলতে পারে নি, তার আগেই উড়ে পালিয়ে গেছে প্রজাপতিটা।
ওর ছেলেমানুষী দেখে আমি হেসে ফেলি কিন্তু ক্যারোলিন রেগে ওঠে, বলে, "তুমি নিজের চোখে দেখলে একথা বলতে পারতে না রিখু। সেটা এমন আশ্চর্য সুন্দর!"
আমি বলি, " তাই পোজ দিতে রাজি হয় নি। ছবিতে যদি উঠেই গেল, তো সেই রূপের রহস্য আর রইলো কী? কিছু কিছু জিনিস অধরা থাকাই ভালো ক্যারোলিন। চলো, সিবীচে যদি যেতে হয় এইবেলা সেদিকে রওনা দেওয়াই ভালো।"
বিকেলের আলো সাদা বালির সমুদ্রসৈকতে লুটোপুটি খাচ্ছে। সীগালগুলোর একেবারে ভয়ডর কিচ্ছু নেই, মানুষের একেবারে কাছাকাছি এসে খাবার তুলে নিয়ে যাচ্ছে। সূর্যস্নানের জন্য তোয়ালে পেতে খালি গায়ে বালির উপরে পড়ে থাকা মানুষের দলের মাঝখানেই সাত-আটটা সীগালও দিব্যি বসে আছে, কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই! হয়তো ওদের হাজার হাজার বছরের বালি-উঠানে এই সেদিনের মানুষের জবরদখলে ওরা একটু বিরক্তও বা!
পালক-পালক তুলো-তুলো মেঘেরা উড়ে উড়ে সরে যাচ্ছে, আকাশটা সেই গল্পের দিব্যলোকের নীল শতদলের পাপড়ির মতন টলটল করছে। আমার আকাশপরীর ডানা দু'খানিও এমনই ছিলো!
আর কিছুক্ষণ পরেই সূর্যাস্ত হবে। ক্যারোলিন সূর্যাস্তের ছবি তোলার জন্য উপযুক্ত জায়গা খুঁজছে, পছন্দ হচ্ছে না কোনোটাই। আমি দূরে ব্যারিয়ার আইল্যান্ডটা দেখিয়ে বলি, "ওখানে চলো। ওখান থেকে ভালো দেখা যাবেই।"
ও লাফিয়ে ওঠে আইডিয়াটা পেয়ে, আমরা রওনা হই। এতক্ষণে মনে পড়ে আমাদের লাঞ্চ হয় নি। কাছের সীফুডের দোকান থেকে কড়া করে ভাজা মাছ কিনি আমরা। সঙ্গে অনিয়ন রিঙ। গোল গোল করে কাটা পেঁয়াজের টুকরো, বেসনের মতন কোনো জিনিসে ডুবিয়ে ছাঁকা তেলে ভাজা, আমার পেঁয়াজির কথা মনে হয়। আমরা একজায়গায় বসে টোমাটো সস দিয়ে মাছভাজা আর পেঁয়াজি খেয়ে নিতে থাকি, আমাদের লেট লাঞ্চ।
খাওয়া সেরেই হাঁটতে থাকি ব্যারিয়ার আইল্যান্ডের দিকে। পাথুরে পথের ধারে ধারে বালি, তাতে লতায় সাদা ফুল দুলছে, কাছে না গেলে ঠাহর হয় না সেগুলো ফুল, একেবারে সাদা বালির সঙ্গে রঙ মিলানো। ব্যারিয়ার আইল্যান্ডে পৌছে পছন্দমত জায়গা খুঁজে যখন দাঁড়ালাম তখন সমুদ্রে স্বর্ণসন্ধ্যা। জলে রঙ টলটল করছে। ক্যারোলিন মন দিয়ে ছবি তুলছে। সীগালেরা নিজেদের মতন ওড়াউড়ি আর মাছ ধরায় ব্যস্ত।
এইসব সুখদুঃখ আনন্দবেদনার ঘন করে বোনা নকশার মাঝখানে নিজেকে কেমন খাপছাড়া মনে হয়। কেন আমি কোথাও নিজেকে খুঁজে পাই না? কোথাও কেন নিজেকে ন্যস্ত করতে পারি না ?
ভালো ভালো ছবি তুলতে পেরে ক্যারোলিনের চোখ খুশীতে চকচক করছে। কাছে এসে সে আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে সন্তুষ্ট হলো না, আরো ঘনিষ্ঠ কিছু দিতে চাইলো। আমি শক্ত হয়ে গেছিলাম ভিতরে ভিতরে, ক্যারোলিন ডিজিটাল ক্যামেরার ছোট্টো স্ক্রীনে আমায় দেখালো কেন সে এত উত্তেজিত, কী অসাধারণ ছবি সে ক্যামেরাবন্দী করেছে!
সেই ছবিতে সূর্য ডুবে গেছে, সমুদ্র দিগন্তে আশ্চর্য রাঙা আভা তখনো মিলায় নি। সেই রাঙা জমিনের উপরে আশ্চর্য বেগুনীনীল প্রসারিত আভা, কোন্ অদেখা জগতের নীলপদ্মের পাপড়ি যেন, মুহূর্তের জন্য দেখা দিয়ে যা মিলিয়ে যায়! কেবল যে দেখতে চায় খুব মন খুলে, তার চোখেই কেবল যা ধরা পড়ে।
আমার ভিতরঘরের শক্ত করে খিলআঁটা দরজার সম্মুখ থেকে পাথরটা গুড়গুড় গুড়গুড় করে সরে যেতে থাকে। ক্যারোলিনের ঠোঁট দু'খানা এমন কোমল, এমন উষ্ণ, এমন আশ্চর্য ভাষাময়! বুকের জমাট মেঘ বৃষ্টি হয়ে ঝরে যাচ্ছে, দেখতে পাচ্ছি এক টুকরো নীল!
ক্যারোলিনের তারার ফুলের মতন দু'টি চোখে মোহরের চোখ দুটি হেসে উঠেছে ঝড়বৃষ্টির পরে প্রথম ওঠা রোদ্দুরের মতন। মোহরের মুখ আর ক্যারোলিনের মুখ মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। আমার মুখ ঝুঁকে পড়ে, স্বচ্ছ হ্রদের জলের উপরে যেমন ঝুঁকে পড়ে মরুপার হয়ে আসা তৃষ্ণার্ত। ফিসফিস করে বলতে বলতে থাকি কবিতার লাইনটা, "গাঢ় যুবতী রোদ ঢেকে দিয়ে বিকেল আসে জলকল্যাণী", ক্যারোলিন চোখ বুজে থেকেই হাসে, বলে, "আমাকে এর মানে বুঝিয়ে দেবে একদিন?"
মনে মনে বলি, "দেবো, দেবো, নিশ্চয় দেবো। ভালোবাসার নীল আলো একদিন আকাশভরে ফুটে উঠবে, আকাশপরীর ডানা দু'খানির মতন। ততদিন শুধু অপেক্ষা আর অপেক্ষা। আমরা অপেক্ষা করতে চাই না, তবু অপেক্ষা করতে হয় কেবলই অপেক্ষা করতে হয়। আরোগ্যের অপেক্ষা, শান্তির অপেক্ষা, ভালোবাসার অপেক্ষা ...”
( শেষ )
মন্তব্য
অনুভূতির বিভিন্ন মাত্রার উদাস করা মিশ্র আবহ তৈরি করেছে ভাললাগার এক অদ্ভুত জগাখিচুড়ী
উদ্ধৃতিঃ-
"কেন আমি কোথাও নিজেকে খুঁজে পাই না?"
-অতীত
ধন্যবাদ ভাই অতিথি অতীত। আপনার ভালোলাগা শুনে আমারও কিছুটা তৃপ্তি।
ভালো থাকবেন।
-----------------------------------------------
কোন্ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
গভীরতম অনুভূতির অনাবিল সুন্দর প্রকাশ।।
মন উদাস করা অসাধারন লিখনী।।
তুলিদি খুব বিভূতি পড়েন, তাইনা?
ধন্যবাদ ভাই।
বিভূতি এককালে সত্যিই খুব পড়তাম, ভালো লাগতো। পরে মাণিক বন্দ্যো আর প্রেমেন মিত্তির শুরু করে সেখান থেকে কত পথের জালে পড়ে কোথায় যে গেলাম। ভালো মনে করিয়েছেন, আবার পড়তে হবে বিভূতি।
ভালো থাকবেন।
-----------------------------------------------
কোন্ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
নতুন মন্তব্য করুন