১
হাল্কা নীল ভোর, খুব মৃদু একটা আভা শুধু দেখা দিয়েছে। এখনও সূর্য উঠতে অনেক দেরি, পুবের আকাশে এখনো লাল রঙই লাগে নি। হাওয়ায় হাল্কা শীত-শীত ভাব। একটা ভোরজাগা পাখি সুরেলা গলায় ডেকে উঠলো, গানের প্রথম আখরটির মতন বাধো-বাধো ডাক।
সুজাতা জেগে গেছিল আগেই, অনেককাল ধরেই শেষরাতে ঘুম ভেঙে যায় তার। সেই স্কুলে থাকার সময় সে রাত জাগতে পারতো না বলে শেষরাতে মা ডেকে দিতো, সে উঠে পড়তে বসতো, সেই অভ্যাস রয়ে গেছে। এখন যদিও আর দরকার নেই অত তাড়াতাড়ি ওঠার, কিন্তু সুজাতার ভালোই লাগে। মনে হয় এই শেষরাত বা প্রথম ভোর, যখন বেশীরভাগ মানুষই ঘুমিয়ে আছে, চারিদিক খুব নির্জন আর শান্তিময়, এই সময়টা তার কাছে একটা গোপণ উপহারের মতো, সেই ছোটোবেলার জন্মদিনের সময়কার বালিকা সুজাতা হয়ে সে মোড়ক একটুখানি খুলে চুপিচুপি দেখে নেয় কি আশ্চর্য জিনিস আছে ভিতরে। আরেকটু বেলা বাড়লে যখন একে একে সবাই উঠে পড়ে, আওয়াজ আর তাপ বাড়তে থাকে, তখন সেই লুকিয়ে উপহার দেখে নেবার নিষিদ্ধ রোমাঞ্চকর আনন্দ সে আর পায় না।
এখন ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সুজাতা চুপ করে দেখছে একটু একটু করে আকাশের গায়ে আলোর তুলি বুলিয়ে যাচ্ছে অদৃশ্য শিল্পী, ঐ অনেক উপরের মেঘগুলোয় কেমন আশ্চর্য রঙ! সেই পাখিটা এখন কেমন ছন্দবাঁধা ধ্বনিতে সুরেলা গান গেয়ে যাচ্ছে-সুজাতা কান পেতে শোনার চেষ্টা করে। হঠাৎ আরেকটা পাখি সাড়া দিয়ে ডাক দেয়। দু'জনে মিলে এখন যুগলবন্দী গাইছে তারা। নিজের অজান্তে একটা ছোট্টো শ্বাস পড়ে সুজাতার। আর একেবারে হঠাৎ করেই মনে পড়ে যায় সুপ্রতীকের মুখ।
শেষবার দেখা তার সেই খরগ্রীষ্মের রোদেপোড়া, ভাঙাচোরা, আহত, যাতনাবিদ্ধ মুখ নয়- প্রথম দেখা অমল কিশোরমুখ, অপরিচয়ের লজ্জা আর দ্বিধার সঙ্গে সেখানে প্রথম ভোরের আলোর মতন দীপ্তি তিরতির করে কাঁপছে। সুপ্রতীক প্রথমে খুব লাজুক ছিল, আস্তে আস্তে তাদের পরিচয় গাঢ় হলো, সুপ্রতীকের সঙ্কোচ কাটতে লাগলো।
প্রথমে সে পড়াতে আসতো সপ্তাহে দু'দিন, তারপরে তিনদিন। বন্ধুত্ব পেরিয়ে সম্পর্কটা যখন আরো গভীর কিছুর দিকে মোড় নিচ্ছে, তখনই সুজাতা বুঝতে পেরেছিল এইবারে শেষ হয়ে আসছে সব। সুজাতার আজ মনে হয় সুপ্রতীক যদি আরেকটু বয়সে বড় হতো, যদি ওর একটা স্থায়ী জীবিকা থাকতো বা অন্য কোনো সঙ্গতি থাকতো, ও ওভাবে হাল ছেড়ে দিত না। ও সুজাতাকে কষ্টে ফেলতে চায় নি, ও চেয়েছিলো সুজাতা সুখে থাক, আর্থিক সাচ্ছল্যের মধ্যে বড় হওয়া সুজাতাকে সে অভাব-অনটনের অনিশ্চয়তার মধ্যে টেনে নিয়ে যেতে চায় নি।
সুখ ? হাহ। সুখেই তো আছে সুজাতা, ধনী স্বামী, ছেলেমেয়েরা নামীদামী আবাসিক স্কুলে মানুষ হচ্ছে, সে এখানে ঝাড়া হাতপা, শুধু সাজগোজ আর শপিং করা আর স্বামীর সঙ্গে পার্টিতে যাওয়া বা বাড়ীতে পার্টি হলে সেজেগুজে ঘুরে বেড়ানো আর খেজুরে আলাপ করা ছাড়া আর কাজই তো বলতে গেলে নেই! মাঝে মাঝে বিদেশ যায় তারা, সেখানেও তো সেই শপিং! এই সুখের জীবনই কি সে চেয়েছিলো? হয়তো চেয়েছিলো। নইলে আঠেরো বছর হলো তাদের বিয়ে হয়েছে, স্বামীর সম্পর্কে বিশ্বাসভঙ্গের গুজবই শুধু না, প্রমাণও সে পেয়েছিলো। কিছুই সে বলেনি। কেন?
কেন যেন মনের মাঝখান থেকে কোনো তাগিদ আসে নি। স্বামী তাকে ঠকাচ্ছে জেনেও সে এমন ঠান্ডা হয়ে রইলো কেন? তরুণী বয়সে যে তীব্র আত্মমর্যাদাবোধ তার ছিলো, তার শতাংশের একাংশ অবশিষ্ট থাকলেও তার ভীষণভাবে জ্বলে ওঠার কথা। একেকবার মাঝে মাঝে যে ইচ্ছে যে করেনি জ্বলে উঠতে, সাজানো সংসার ভেঙে চুরমার করে পথে বেরিয়ে পড়তে, তা নয়। কিন্তু শেষ অবধি অদ্ভুত এক অবসাদ জড়িয়ে ধরেছে তার সমস্ত অস্তিত্ব।
কখনো খুব মগ্ন একলা দুপুরে উত্তরের ব্যালকনিতে বসে উল বুনতে বুনতে তার মনে হয়েছে স্বামীই কি শুধু ঠকাচ্ছে তাকে? সমস্ত সমাজ কি তাকে ঠকায় নি ? রীতিনীতিই কি তাকে আত্মমর্যাদা বিসর্জন দিতে বাধ্য করেনি? সে নিজে কি নিজেকে ঠকাচ্ছে না? মনের খুব গভীরের তন্তুগুলি খুলেমেলে দেখলে সেখানে কি স্বামীকে খুঁজে পাবে সে কোথাও? সেই হিসাবে তারই বা কি অধিকার আছে স্বামীর কৈফিয়ত দাবীর?
মাঝে মাঝে মনে হয় এই যে ঘড়ির টিক টিক টিক টিক এর মতন নিয়মিত ছন্দে তার জীবনটা চলে যাচ্ছে, অবসন্ন নদীধারার মতন, এরকমই কি যাবে চিরকাল? এইভাবেই একসময় বয়স বাড়তে বাড়তে জরাজীর্ণ বার্ধক্য ও মৃত্যু? পছন্দের মানুষকে হারিয়ে ফেলার তীব্র বেদনা বুকের ভিতরে কবর দিয়ে অন্য মানুষের সঙ্গে মানিয়ে চলতে চলতে জীবন পরিক্রমা? কিন্তু ...কিন্তু সেই হারানোর বেদনা? সেইসব অন্ধকার দিনরাত? কোনো মূল্যই কি ছিলো না সেই দুঃখদহনের? সেটা শুধুই এক অবুঝ বালিকার ভুল ?
সুজাতার মনে হয় তার জীবনটা কুয়াশায় ঘিরে আছে, নজর চলে না বেশী দূরে। শুধু মাঝে মাঝে নিমপাতা স্বাদ জিভে জড়িয়ে যায়, ভিতর থেকে একটা কী যেন ঝমঝম করে ওঠে বন্ধ ঘরের ভিতরের রহস্যময় শব্দের মতন। অর্ধেক রাতে জেগে উঠে তার শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসে যেন, ছুটে সে ব্যালকনিতে বেরিয়ে আসে খোলা বাতাসের জন্য। জ্বলজ্বলে তারাগুলোর দিকে চেয়ে তার মনে হয় কী যেন তার করার ছিলো?
ব্যালকনি থেকে শোবার ঘরে ফিরে আসে সুজাতা। বিছানায় শেখর, তার স্বামী, ঘোর নিদ্রাভিভূত। শেখর বোধ হয় কোনোদিন ভোর হওয়া দেখেনি। সবসময়েই সে বেশী রাত করে ফেরে আধা মাতাল হয়ে, তারপরে সুজাতাকে জাগিয়ে তার উপরে স্বামীত্বের অধিকার ফলিয়ে ঘুমাতে ঘুমাতে আরো দেরি। অত দেরি করে ঘুমালে ভোরে জাগবেই বা কেমন করে?
ঘুমন্ত স্বামীর দিকে তাকিয়ে হালকা একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে সুজাতার। ঘুমের মধ্যে মানুষকে কত সরল কত নরম লাগে! কে বলবে এই একই মানুষ অত হিংস্র হয়ে ওঠে তার কাজে বাধা পড়লে? এই মানুষটাকেও তো মাঝে মাঝে ভালোবাসতে ইচ্ছে করে সুজাতার! মনে হয় হয়তো এর ভিতরের আসল মানুষটাকে একদিন সে দেখতে পাবে! কিন্তু প্রতিবারেই চূর্ণ হয়ে ভেঙে যায় আশা, দানবটাই শুধু দেখা দেয়, মানুষটা কোথায় লুকিয়ে থাকে কোন গহন গোপণে!
হালকা পায়ে ঘর পরে হয়ে সুজাতা চলে যায় তার সাজগোজ করার ঘরে। এ ঘরের পুবে পশ্চিমে বড় বড় জানালা, দুটো জানালাই খুলে দেয় সুজাতা। আহ, কত আলো কত হাওয়া! দেওয়ালের পাশে বড় আলমারি, আচলের চাবি নিয়ে সে খোলে আলমারি। মাঝের তাকের এককোণের চন্দনকাঠের বাক্সটা থেকে সে জীর্ণ, হলদে হয়ে যাওয়া চিঠিটা সাবধানে তুলে নেয় হাতে। সুপ্রতীকের দেওয়া এইটাই একমাত্র জিনিস যা আজও তার সঙ্গে আছে। তার শেষ চিঠি। কিকরে যে এটা রয়ে গেল সেকথা ভাবলে সুজাতার কেমন একটা অদ্ভুত অনুভূতি হয়। এতকাল পরে তার মনে হয় এটা সুপ্রতীকের চিঠিই শুধু নয়, এই জীর্ণ হয়ে যাওয়া পাতায় ঝাপসা হয়ে যাওয়া কালির আঁচড়ে যেন আটকে আছে সুজাতার নিজেরই পবিত্র কৈশোর ও তরুণীবেলা, মানুষের প্রতি তার সরল বিশ্বাস, তার অপরাজেয় ভালোবাসা। জীবনের আঘাত ও দুঃখ সব পেয়ে যাবার পরেও, জীবনের অন্ধকার দিক গুলো দেখার পরেও, মানুষের বিশ্বাসভঙ্গ ও নিষ্ঠুরতা দেখার পরেও, বাতিঘরের মতন জেগে আছে সেই ভালোবাসা। এ সুপ্রতীকের থেকে পাওয়া নয়, ওর জন্যও নয়, এ কোন্ আশ্চর্য রহস্যময় জগৎ থেকে সঙ্গে করে সুজাতাই নিয়ে এসেছিলো একদিন, জীর্ণ হয়ে জীবনশেষে ফিরে যাবার সময় আবার সঙ্গে করেই নিয়ে যাবে। কাউকে দেওয়া গেল না, সে তো তার ত্রুটী নয়!
কেউ বোঝে নি, মা না, বাবা না, কেউ না। তারা ভেবেছিলো তারা মেয়ের ভালোর জন্যই করেছে। সুপ্রতীকও বোঝে নি, সে একটু শক্ত হয়ে সুজাতার পাশে দাঁড়ালে কী সে বাঁচাতে পারতো, কোন্ অমূল্য রত্ন, সে বোঝে নি। সুজাতাই কি বুঝেছিলো তখন? সতেরো বছরের বোকা, ভীতু মেয়েটা সেদিন নিজের অভিমানেই নিজের ভিতরে নিজেকে বন্ধ করেছিলো।
সুপ্রতীকের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক জানতে পেরে রেগে আগুন হয়ে গেছিলো সুজাতার বাবা। একটা প্রাইভেট টুইশনি করে বেড়ানো কলেজ পাশ ছেলে যার কিনা কোনো স্থায়ী চাকরি নেই, পারিবারিক বিষয়সম্পত্তি ও কিছু নেই, বাড়ীতে যার অবসরপ্রাপ্ত নিরীহ বৃদ্ধ বাবা আর রুগ্ন মা আর আশ্রিত এক পিসতুতো ভাই ছাড়া আর কেউ নেই, সেই ছেলে কোন সাহসে বড়লোক বাড়ীর মেয়ের সঙ্গে প্রেম করে! আর মেয়েরই বা কী আক্কেল! আরে তুই কত ধনীমানী বাড়ীর বৌ হয়ে যাবি কত সমাদরে, সেই ভবিষ্যৎ তুই পায়ে ঠেলবি এভাবে!
বাবা রাগে হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলো নইলে সতেরো বছরের মেয়েকে ওভাবে চড় দিয়ে গালে দাগ ফেলতো না, কঞ্চি দিয়ে মেরে পিঠে কালশিটে ফেলতো না। চড় খেয়ে ঘুরে পড়ে গেছিলো সুজাতা, কিন্তু মুখে কোনো শব্দ করে নি। যখন শপাশপ্ কঞ্চি পড়ছিলো পিঠে, সে দাঁতে দাঁত চেপে ছিলো অচেতন হয়ে যাবার আগে অবধি। মা বাবাকে থামাতে চেষ্টা করছিলো, কিন্তু সুজাতার মনে হচ্ছিলো সে মরে যাওয়া অবধি মারুক তাকে, মরে গেলেই তার ভালো হয়। রাতে জ্বরের ঘোরে মায়ের হাতের ছোঁয়া পাচ্ছিলো সে, মা কপালে বরফ দিতে দিতে বিনবিন করে কাঁদছিলো। তার মনে হচ্ছিলো বলে, "মা কেন তুমি বাবাকে আটকালে? আমাকে মেরে ফেলতে কেন দিলে না?”
সুজাতা জানে না সুপ্রতীককে কী বলেছিলো বাবা। সুজাতা তখন উপরের ঘর থেকে নামতে পারে না, বাবার কঠিন নির্দেশে সে তখন দোতলাতেই থাকে। হঠাৎ যেন ছোঁয়াচে রুগী হয়ে গেছে সুজাতা। উপরের স্নানঘরে স্নান করে, নিচের রান্নাঘর থেকে মা ওর ঘরে খাবার দিয়ে যায়। বিস্বাদ ঘাসের মতন লাগে তার সব খাবার। বাবার অনুমতি নিয়ে ঘরের সামনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গেছিলো সুপ্রতীক।
সুজাতা পাথরের মতন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো দরজার চৌকাঠে, তার চোখ ছিলো নিরশ্রু, তার ঠোঁট নড়ে নি একতিল। তার মনে হচ্ছিলো সে বুঝি পাথরের মূর্তি হয়ে গেছে, নিষ্প্রাণ পাথর, যার মায়া নেই মমতা নেই শোক নেই দুঃখ নেই কিছু হারাবার নেই কিছু পাবার নেই। সুপ্রতীক মাথা ঝুঁকিয়ে বিদায় নিয়ে চলে গেল হোঁচট খেতে খেতে, সুজাতা একটা কথাও বলতে পারলো না। বলবে কি করে, তার গলা জিভ ঠোঁট সব যে পাথর!
সেই শেষ দেখা। সুজাতা কখনো ভাবে নি ওটাই শেষ দেখা হবে। তখন তার একটা দিন থেকে জীবনটা টেনে পরেরদিনে নিয়ে যাওয়াটা ছিলো একটা লড়াই, লড়াইটা সে করছিলো সুপ্রতীককে পাবার কথা ভেবেই। সে ভাবে নি, কখনোই ভাবে নি সব শেষ।
২
শেষ চিঠিতে সুপ্রতীক তাকে লিখেছিলো, " সুজাতা, তুমি ভালো থেকো। আমাদের জীবনে অনেক জিনিসই আমরা পেতে চাই, বেশীরভাগ সময়েই পাই না। কিন্তু সুখশান্তি যারা চায় তারা না পাওয়া জিনিসটার জন্য হাহুতাশ করে না, তার বদলে অন্য একটা কিছু নিয়ে ঠিকই সুখশান্তি রচনা করে নেয়। ভালো থাকা আসলে ভালো যে থাকতে চায় তার উপরেই নির্ভর করে। তুমি একদিন ঠিক বুঝতে পারবে। "
সুজাতা তখন সতেরো বছরের বাচ্চা মেয়ে, সে এসব শুনে সান্ত্বনা পায় নি। তার তখন শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসছে, তার দিন রাত্রি জুড়ে তখন আগুন জ্বলছে। মাঝে মাঝে মনে হতো দোতলার ঐ ঘর আর সামনের বারান্দাটুকুর জেলখানায় সে আটকে গেছে চিরকালের জন্য, মাঝে মাঝে মনে হতো ছাদে উঠে লাফিয়ে পড়লে কেমন হয়? মৃত্যু কি আসলে একধরনের মুক্তি নয়? একটা জিতে যাওয়া নয়? তবু পারে নি শেষ পর্যন্ত, প্রত্যেকটা সকালে উঠে মনে হতো এটা একটা নতুন দিন, একটা ভালো কিছু কি ঘটতে পারে না যা তার ভালো লাগবে ? একটা ঠান্ডা হাওয়া কি আসতে পারে না যা বুকের জ্বালাটা নিভিয়ে দেবে?
সামনে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা, টেস্ট হয়ে গেছে বলে তখন স্কুলেও যেতে হচ্ছিলো না। মাঝে মাঝে তার মনে হতো স্কুলে যেতে পারলেও একটু যেন খোলা হাওয়ায় নি:শ্বাস নিতে পারতো। ফর্ম ফিলাপের জন্য একদিন যেতে হলো, সেদিন সুপ্রতীকের এক বন্ধুর বোন শ্রীলা, সেও পড়তো সুজাতার সঙ্গে, সে এই চিঠিটা দিয়েছিলো। সুজাতার ভয় ছিলো বাড়ী ফিরলে মা যদি ব্যাগ ঘেঁটে দেখতে চায়, যদি চিঠিটা পেয়ে যায়! কী হবে তাহলে? নিজের উপরে রাগ হচ্ছিলো তার, সামান্য সাহস তার নেই বলে। এতটুকু সাহস যার নেই তার ভালোবাসার অধিকার কোথায়, সব চুকেবুকে গেছে ভালোই হয়েছে। শেষপর্যন্ত চিঠিটা সে নিজের পোশাকের ভিতরে এমন জায়গায় গুঁজে রেখেছিলো যেখানে সেটা নিরাপদ।
মা অবশ্য ব্যাগ ঘাঁটে নি, ফর্ম ফিলাপের কথা নিয়েই বরং কথা বলছিলো, আসন্ন পরীক্ষা নিয়ে নানা কথা জিজ্ঞেস করছিলো। তার পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে মা খানিকটা চিন্তিত ছিলো, এমন একটা ঘটনা পরীক্ষার আগে আগে ঘটলো বলে মায়ের চিন্তা ছিলো হয়তো সেটা সুজাতার পরীক্ষাটা খারাপ করিয়ে দেবে। মা চিন্তায় ছিলো তার কলেজে ঢোকা নিয়ে, অন্তত ব্যাচেলার ডিগ্রীটা না করতে পারলে ভালো জায়গায় বিয়ে দেওয়া মুশকিল সেসব নিয়েও চিন্তায় ছিলো মা। সুজাতার শুধু ক্লান্তি লাগছিলো, কথাগুলোর কিছু কানে যাচ্ছিলো কিছু যাচ্ছিলো না, এসবের কোনো মানেই সে বুঝতে পারছিলো না। বিয়ের কথা ভাবছে মা? বাবাই নিশ্চয় বলেছে! মা তো বাবার কথাগুলোরই প্রতিধ্বনি করে গেলো চিরকাল! নিজের কোনো মতামতই নেই। অচেনা একটা লোকের সঙ্গে সম্বন্ধ করে তার বিয়ে দিয়ে দেবে এরা?
স্নান করতে ঢোকার সময় চিঠিটা পোশাকের ভিতর থেকে থেকে বার করে ব্যাগে রেখেছিলো সে। একবার তার মনে হয়েছিলো যদি মা এখন ব্যাগ খুলে দ্যাখে? সে কি অন্য কোথাও সরিয়ে রাখবে চিঠিটা? তারপরে আবার অবসাদ ঘিরে ধরলো তাকে, মনে হলো চিঠিতে আপত্তিকর তো কিছু নেই! সুপ্রতীক নিজেই তো তাকে লক্ষ্মীমেয়ে হয়ে বাপমায়ের সব কথা মেনে নিয়ে সুখী হতে বললো! ভালোবাসার দাবীতে তাকে কেড়ে নিতে আসবে সেকথা বলতে পারলো না! কাপুরুষ!
হঠাৎ একটা গরম রাগ মুখ-মাথা-কান ভরিয়ে ফেললো সুজাতার, স্নানঘরে ঢুকে জলধারার নিচে শরীর মেলে দিয়ে সে শান্ত হবার চেষ্টা করলো। রাগ নিভে যেতেই সজল বেদনা নেমে এলো বৃষ্টির মতন, জলের শব্দের মধ্যে কান্নার শব্দ ঢেকে সে প্রাণভরে কাঁদতে কাঁদতে সমস্ত বিষাদ নামিয়ে দিতে থাকলো জলস্রোতে। জল, জল, সর্বতাপহর জল! একমাত্র দু:খসঙ্গী তার। গোটা দুনিয়ায় তাকে বুঝবার মতন আর কেউ যে তখন ছিলো না!
স্নান সেরে অনেক সময় নিয়ে সে মাথার চুল মুছেছিলো, নরম সুতির ম্যাক্সি পরে ড্রায়ারে চুল শুকাচ্ছিলো। মা ঘরে এসে খাবার আর জল দিয়ে গিয়েছিলো। গরম গরম পাতলা ক'খানা ঘীমাখানো রুটী, সব্জিভাজি আর ছোট্টো বাটিতে ছোলার ডাল। দু'খানা কাঁচালঙ্কাও ছিলো, ভাত রুটী যাই খাক, সঙ্গে কাঁচালঙ্কা সবসময় লাগতো সুজাতার। কতদিন পরে আবার সে লক্ষ করলো সেটা। সে আস্তে আস্তে খাচ্ছিলো, মা পাশে বসেছিলো, তাকে আগ্রহ করে খেতে দেখে মা খুশীই হচ্ছিলো মনে হয়। সুপ্রতীকের সঙ্গে প্রেম জানাজানি হয়ে যাওয়া আর সুজাতার বাবার তীব্র শাসনের ঘটনার পর থেকে সুজাতার খাবারদাবাড়ের দিকে কোনো মনোযোগই ছিলো না, জন্ডিসের রুগীর মতন নিরাবেগভাবে কিছু খেতো, কোনো স্বাদ পেতো না কিছুতে। এতদিন পরে মেয়ে তারিয়ে তারিয়ে খাচ্ছে আর স্বাদ ভালো হয়েছে বলছে, আরেক হাতা ডাল চাইছে--মায়ের খুশী হবার কথাই তো!
খাওয়াদাওয়ার পরে সে শুয়ে পড়লো, মা চুলে বিলি দিয়ে দিলো। সে ঘুমিয়েছে মনে করে মা যখন ঘর থেকে চলে গেল তখন সুজাতা উঠে চিঠিটা বের করে ভরে রাখলো চন্দনকাঠের বাক্সে। বাক্সটায় তার পুরানো কিছু খেলনা আর নিজের করা সূচীশিল্প ফুলপাতার নকশাওলা রুমাল আর হরিণ নকশার টেবিলক্লথ এইসব ছিলো। টেবিলক্লথের ভাঁজের মধ্যে চিঠিটা রেখে সে বাক্স তুলে রাখলো উপরের তাকে। খুব নিশ্চিন্ত যে হয়েছিলো তা না, হয়তো ক'দিন পরেই মেয়ে দেখাবার সময় ঐ রুমাল টেবিলক্লথের উপরে টান পড়বে। একটাই আশা ছিলো আজকালের দিনে পুরানো ওসব রীতিনীতি হয়তো উবে গেছে। হয়তো ও বাক্সে আর হাত দেওয়া হবে না।
দিনের পরে দিন এসেছিলো, চলে গেছিলো। বুকের ভিতরের সেই তীব্র জ্বালার উপরে যখন নামলো অশ্রুজল, তখন আস্তে আস্তে জুড়িয়ে আসতে থাকলো জ্বালাটা। মনে হলো সে যদি আত্মহত্যা করে, কারও তো কিছু আসবে যাবে না! তার বাবামা প্রাথমিক অসুবিধা কাটিয়ে উঠে নিজেদের মতন জীবনটা কাটিয়ে দেবে, সুপ্রতীক হয়তো এসব অপ্রীতিকর স্মৃতি ভুলে গিয়ে একদিন নতুন কাউকে জীবনে গ্রহণ করে সুখে সংসার করবে, পৃথিবীর কোথাও সুজাতা বলে এই মেয়েটার চিহ্ন থাকবে না, এর সতেরো বছরের জীবনের সুখদুঃখচাওয়াপাওয়ার কোনো চিহ্ন থাকবে না, এই বহ্নিময় দিনগুলোর দহনজ্বালার কোনো স্মৃতি, কোনো বেদনা কোথাও থাকবে না। ওভাবে অস্তিত্বহীন হয়ে গিয়ে লাভ কী?
অন্ধকার মৃত্যুপিয়াসী সেই জগতে বাতিঘরের মতন জ্বলে উঠলো তার অহং, বাঁচতে হবে তাকে নিজের জন্যই, চিহ্ন না রেখে মৃত্যু মানে হেরে যাওয়া। বেঁচেছিলো সুজাতা, মৃত্যুর অন্ধকার গুহা থেকে বেরিয়ে এসেছিলো আলোভরা দুনিয়ায়। এ কিছুতেই সম্ভব হতো না তখন যদি ছোটোমাসী না আসতো।
৩
ছোটোমাসীকে আগে খুব ছোটোবেলা হয়তো দেখেছিলো, কিন্তু সেসব মনে ছিলো না সুজাতার। সে শুধু জানতো ছোটোমাসীর নাম প্রিয়দর্শিনী, বিয়ে করেনি, হিমালয়ের কাছে এক পাহাড়ী শহরের আবাসিক স্কুলে পড়ায় ছোটোমাসী।
সোনালী ফ্রেমের চশমার ভিতর থেকে চেয়ে আছে দু'খানা উজ্জ্বল চোখ, ঘাড় পর্যন্ত ছাঁটা চুল, মুখে আশ্চর্য দৃঢ়তা আর কোমলতা একই সঙ্গে মিশে আছে। এই তার ছোটোমাসী। প্রথম দেখার স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে এই চেহারা। কমলা পাড়ের সাদা সিল্ক শাড়ী পরা ছিলো, কাঁধে একটা ঝোলা ব্যাগ। কোথাও কোনো গয়না ছিলো না হাতে কানে বা গলায়, শুধু বাঁহাতের কব্জিতে ছোট্টো সোনালি ঘড়ি, সেটাকেই মনে হচ্ছিলো রূপউজানী এক অলঙ্কার! সন্তাপে প্রাণ পুড়তে থাকা কিশোরী সুজাতা মুগ্ধ হয়ে গেল, মনে হলো স্বর্গ থেকে এক দেবদূতী এসেছে তাকে উদ্ধার করতে।
পরে অনেক ভেবেছে সুজাতা, কেন সেদিন ছোটোমাসীকে দেখে সে অমন অবাক আর মুগ্ধ হয়ে গেছিলো? আসলে বাড়ীঘর তার কাছে তখন জেলখানা, পুরুষজাতি তখন তার কাছে নিষ্ঠুর ও স্বার্থপর, আশেপাশের সব মহিলারাই তখন পরের বশে বশে চলা নিরীহ ব্যক্তিত্বহীন পরমুখাপেক্ষী। এর মধ্যে এই স্বাধীন স্বাবলম্বী ব্যক্তিত্বময়ীকে দেখে তার মনে হলো আরে, এমনও তো হওয়া সম্ভব!
মা হয়তো অনেক কথা জানিয়েছিলো ছোটোমাসীকে। সেইসব রাতগুলো, যখন জেগে জেগে শুয়ে ছোটোমাসী তাকে পাহাড়ের দেশের সেই স্কুলের গল্প করতো, সুজাতার মনে হতো পরীক্ষাটরীক্ষা সব পড়ে থাক, সে যদি সারাজীবনের জন্য চলে যেতে পারতো সেখানে! ছোটোমাসী কিন্তু বারে বারে সুজাতার মাথার চুলে হাত বোলাতে বোলাতে শান্ত হতে বলতো, ধৈর্য ধরতে বলতো। জীবনে কত ঝড়ঝাপ্টা আসবে, ধৈর্য না থাকলে সেসব সামলাবে কেমন করে সুজাতা?
পরীক্ষা হয়ে গেলে ছোটোমাসীর সঙ্গে সুজাতা সেখানে বেড়াতে যাবে এরকম ঠিক হয়েছিলো। সুজাতা শান্ত হয়ে পরীক্ষা দিলো, কিন্তু সেই পাহাড়ের দেশে বেড়াতে যাওয়া আর তার হলো না পরীক্ষার পরে। ছোটোমাসী তখন ক্লিনিকে, তার তখন হার্ট অপারেশনের দিন ঠিক হয়েছে। ছোটোমাসীর যে এত অসুখ তা জানতো না সুজাতা, এমনকি তার মা ও জানতো না।
সে দেখতে গেছিলো মায়ের সঙ্গে, চুপ করে মাসীর হাত ধরে বসেছিলো, কেন জানি তার মনে হচ্ছিলো আর দেখা হবে না। জীবনে যা কিছু সে গভীর আগ্রহে গভীর ভালোবাসায় আঁকড়ে ধরতে চায়, তা কেন বারে বারে তার হাত থেকে জোর করে কেড়ে নেওয়া হয়, সেই অভিমানে তার চোখে জল আসছিলো। মাসী হাসতে হাসতে বলছিলো, "পাগলি মেয়ে, মন খারাপ করে আছিস কেন? পরীক্ষা তো ভালো হয়েছে তোর। এবারে আমি ভালো হয়ে গেলেই তোকে আমার পাহাড়ের স্কুল দেখাতে নিয়ে যাবো।"
অপারেশন ঠিকঠাকই হয়েছিলো, কিন্তু তার তিনদিন পরে ছোটোমাসী মারা গেল। সবচেয়ে দূরের পাহাড় পার হয়ে ঐ দূরের তারাদের থেকেও আরো দূরে চলে গেল। শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে থাকার মতন বিছানায় পড়ে আছে ছোটোমাসীর দেহ, যেন এখুনি একবার ডাকলেই উঠে বসবে। সুজাতা চুপ করে চেয়ে ছিলো শুধু, সেই তার প্রথম মৃত্যু দেখা। মৃত্যু এমন? এইখানেই সব শেষ? সব সুখ সব দুঃখ সব সম্ভাবনা সব আশঙ্কা ইতি হয়ে যায় এভাবে?
অনেক পরে মায়ের কাছে সে শুনেছিলো ছোটোমাসীর জীবনের গল্প, ভিন্নধর্মের এক ছেলেকে ভালোবেসে পরিবারের সকলের বিরোধীতার মুখোমুখি হয়েছিলো প্রিয়দর্শিনী। সবাইকে দু:খ থেকে বাঁচাতে সে নিজে একা সব দু:খ তুলে নিয়েছিলো বুকে। পরিবার-পরিজন বন্ধুবান্ধব সব ছেড়ে ঐ মিশনারি স্কুলে গিয়ে কাজ নিলো। যে ছেলেটিকে সে ভালোবাসতো সে পরে তার নিজের বাপমায়ের মনোমতো পাত্রীকে বিয়ে করেছিলো, কিন্তু প্রিয়দর্শিনী সকলের শত অনুরোধেও কাউকে বিয়ে করলো না।
ততদিনে সুজাতা কলেজে ভর্তি হয়ে গেছে, তার কিশোরীবেলার তীব্র আবেগ ততদিনে বাস্তবতার প্রলেপে ঢেকে গেছে। কলেজ পাশ করার পরে পরেই বড়লোক পাত্রের সঙ্গে সম্বন্ধ করে বিয়ে হয়ে গেল তার। সুজাতা প্রায় বিনা প্রতিবাদে সব মেনে নিয়েছিলো। এমন কি পণ যৌতুক এসব নিয়েও সে কিছু বলে নি। ঐতিহ্যই যদি এত বড়ো হয়, তাহলে প্রতিবাদ করেই বা লাভ কী? সুপ্রতীককে তখন মনে পড়তো না, সেইসব দিনে ঘুরে ঘুরে মনের মধ্যে ভেসে উঠতো ছোটোমাসীর মুখ!
হানিমুনে তারা গেছিলো গোয়ার সমুদ্র দেখতে, শেখর বলেছিলো পাহাড়েই চাকরি বলে সেখানেই তো থাকতে হবে বেশীরভাগ সময়, বেড়াতে সমুদ্রের তীরে যাওয়াই ভালো। সুজাতা রাজি হয়েছিলো, সে তখন বাড়ীর খপ্পর থেকে মুক্তি পাবার আনন্দেই কেমন যেন একটু টালমাটাল। শেখরও তখন একটু অন্যরকম ছিলো সত্যিই, কিংবা হয়তো নতুন সম্পর্ক বলেই সুজাতার ভালো মনে হয়েছিলো। কিজানি হয়তো সুজাতার মন কোনো একটা অবলম্বন খুঁজছিলো, সে তখন জানতো না অবলম্বন বাইরে পাওয়া যায় না, নিজের ভিতরেই খুঁজতে হয়।
হানিমুন থেকে ফিরে ক'দিন শ্বশুরবাড়ীতে থাকা, সেবাড়ীতে শ্বশুর শাশুড়ী ননদ দেওর সবাই থাকলেও সবাই নিজের নিজের মতন থাকে, বাড়ীভর্তি কাজের লোক। তারাই সদাসর্বদা ছোটাছুটি করে কাজ করছে। নিজেদের বাড়ীতে বা আত্মীয়স্বজনের বাড়ীতেও এরকম দেখেনি সুজাতা। মনে হচ্ছিলো যেন সিনেমায় দেখা কোনো কাহিনির ভিতরে পড়ে গেছে সে।
স্বামীর সঙ্গে তার কাজের জায়গায় চলে যাবার আগে বাবামায়ের সঙ্গে একদিনের জন্য দেখা করে আসার অনুমতি পেয়েছিলো সুজাতা। তারপরেই তারা চলে গেল উত্তরে, স্টেশানে বিদায় জানাতে দুই পরিবারের লোকেরাই গেছিলো। সত্যি বলতে কী, সুজাতার কোনো বিদায়জনিত কষ্টের অনুভূতিই ছিলো না, প্রতি পদক্ষেপে কেবল মুক্তির কথাই মনে হচ্ছিলো। আহ, জেলখানাটা তাহলে ভাঙলো এতদিনে!
বয়সে বড় সকলকে প্রণাম করতে করতেই ট্রেন ছেড়ে দেবার সময় হয়ে গেলো। চলন্ত ট্রেনের জানালায় সুজাতা, জানালা থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে মা হাত নাড়ছে, মায়ের চোখ ছলছল। সুজাতা হাত নাড়তে নাড়তে অস্ফুটে বললো, ভালো থেকো মা। একে একে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো ঝাপসা হয়ে এলো, ট্রেন পূর্ণগতি পেয়েছে তখন।
সুজাতার মনে হলো আহ, কী হাওয়া, কী মুক্তি। শেখর আলতো করে তার কাঁধে হাত রেখে বলেছিলো, "কী গো, মনখারাপ লাগছে?" সুজাতা শুধু আলতো মাথা নেড়েছিলো, সে মাথা নাড়ায় বোঝা যায় না হ্যাঁ কি না! আসলে তখন সে নিজেকেই বুঝতে পারছিলো না, কাছের মানুষদের ছেড়ে দূরে চলে যাবার সময় এই বেদনাহীনতা কি ভালো? কাছের মানুষ? মা-বাবা? তারা কি কাছের মানুষ ছিলো সুজাতার? শেষ কয়েকটা বছর তারা এক ছাদের তলায় কাটিয়েছে মাত্র, নিজের নিজের বৃত্তে নিজেদের আটকে রেখে।
তারপর ছবির মত সুন্দর পাহাড়ী শহরে। রেলস্টেশন থেকে গাড়ীতে যেতে হলো আরো ঘন্টা দুইয়ের মতন। গাছপালা লতাপাতা আর ঝরঝর করে ঝরতে থাকা পাহাড়ী ঝর্ণার পাশ দিয়ে অপূর্ব সেই যাওয়া। খুব ভালো লাগছিলো সুজাতার। আশ্চর্য, তখনও বারে বারে মনে পড়ছিলো ছোটোমাসীর মুখ। কী যেন গভীর একটা রহস্য ও মুখে।
প্রথম কয়মাস সুজাতার কেটে গেল যেন স্বপ্নে, শেখর উত্তরোত্তর অধৈর্য হয়ে উঠছিলো। নিজের শহর থেকে এতদূরে এরকম বনবাসে মানুষ কেমন করে থাকতে পারে, এই নিয়ে কেন সুজাতার তাপউত্তাপ নেই-এইসব নিয়ে নিত্য অভিযোগ ছিলো শেখরের। সুজাতা তাকে মাঝে মাঝে মনে করিয়ে দিতো যে শেখরেরই চাকরির জন্য এখানে থাকা। শুনে আরো চটে যেত শেখর।
আস্তে আস্তে সয়ে এলো সব। শেখর বোধহয় সুলুকসন্ধান পেয়ে গেল বাইরের নানাবিধ বিনোদনের। আর সুজাতা রইলো নিজের মধ্যে নিজে মগ্ন। অবশ্য বেশীদিন না। বিয়ের একবছরের মাথায় সুজাতার কোলে এলো তিতলি।
তিতলি হবার আগে সুজাতার মা আসতে চেয়েছিলো দেখাশোনার জন্য, সুজাতা উৎসাহ দেখায় নি। শেখরেরও বিশেষ ইচ্ছা ছিলো না। সুজাতার কাছে বাপের বাড়ীর আর কোনো টান ছিলো না। সে জানতো ওরা আইনত তার মাবাপ তখনো, কিন্তু মনের দিক থেকে কোনো যোগাযোগ আর তার ছিলো না। প্রথমদিকে মা আর বাবা দুজনেই চিঠি লিখতো, সুজাতা বেশীরভাগ চিঠিই পড়ে রেখে দিতো, মাঝে মাঝে তিনচার লাইনের আনুষ্ঠানিক উত্তর দিতো। ব্যস। আস্তে আস্তে ওদের চিঠির ফ্রিকোয়েন্সিও কমে গেল।
তিতলি হবার পরে ছোট্টো তিতলিকে নিয়ে কোথা দিয়ে যে দিনরাত তার কেটে যেতো সুজাতার খেয়াল থাকতো না। তিতলির তিন বছর পরে জন্মালো ছোটন, ভালো নাম তড়িৎ। ওদের নিয়ে বছর কয়েক ভরপুর হয়ে ছিলো সুজাতা। তখন দীর্ঘশ্বাস আর অতীতচারণার মতন ফাঁকা সময় তার থাকতো না। শেখর যে কোনোদিনই তার কাছের হয় নি সেই সময়ে সেই অভাব সুজাতার মনে থাকতো না। সে নিজেও মনের দিক থেকে কোনোদিন শেখরের কাছের ছিলো না কোনোদিনই। দুজনের মনের গড়ন আলাদা যে! সুজাতা জানতো শেখর বাইরে বেশ কিছু ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরী করেছে, অপরপক্ষের সম্মতিও আছে স্বার্থের কথা ভেবে, শেখর যে আপিসে প্রভাবশালী অফিসার। যতটা খারাপ লাগার কথা ছিলো ততটা লাগেনি সুজাতার, কেমন যেন একটা হাঁফছাড়া ভাবও ছিলো বরং। বাড়ীতে মনোমালিন্য সুকৌশলে এড়িয়ে চলতো তারা দু'জনেই।
সুজাতার মনে প্রথম আঘাত এসেছিলো যখন শেখরের ব্যবস্থাপনায় তিতলি চলে গেল নামী আবাসিক স্কুলে, তার কয়েক বছর পরে তড়িৎ ও। সুজাতার মতামতের কোনো মূল্য ছিলো না। শেখর তার সন্তানদের যেভাবে মানুষ করতে চায় তার বাইরে যে মা হিসাবে সুজাতার কিছু বলার থাকতে পারে তা শেখর ভাবতেও পারে নি। নিজের মত জানাতে গিয়ে যে তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখিন হতে হলো তা ভাবতে গেলে আজও মুখের ভিতরে তেতো তেতো লাগে সুজাতার।
শেষ পর্যন্ত কিন্তু সেটাও সয়ে গেল সুজাতার। ঘুম না আসা রাতে চুপচাপ যখন সে উপরের বারান্দায় বসে চেয়ে থাকতো নীরব তারাগুলোর দিকে, ঐ পুরানো পুরাকালের তারাগুলোর দিকে, তখন মনে হতো এই সংসার সন্তান স্বামী কেউ তার নয় আসলে, অভ্যাসের বশে সে শুধু জড়িয়ে আছে এদের সঙ্গে। নইলে তিতলি তড়িৎ চলে গেলে যে শূন্যতা এসে জেঁকে বসবে তার জীবন জুড়ে সে ভেবেছিলো, তাতো আসে নি! ঠিকই তো সুজাতার দিনরাত ভরে গেছে কাজে বা অকাজে! যে শেখরকে সে মাঝে মাঝে তীব্র ঘৃণায় পুড়িয়ে ছাই করে দিতে চায়, তার সঙ্গেই তো হেসে গেয়ে নিয়মমাফিক দাম্পত্যজীবন চালিয়ে যাচ্ছে সে!
৪
সকালে খাবার টেবিলে শেখর বললো সামনে এক সপ্তাহের ছুটিতে তিতলি আসছে। সুজাতা খুশি হবার ভান করলো। তিতলি এখন সতেরো, এখনকার এই তিতলিকে সেভাবে সে চেনেই না। সেই ছোট্টো তিতলির শিশুবয়সের নির্মল হাসিটুকুই সে যত্ন করে রেখেছে স্মৃতিতে।
শেখর অফিসে বেরিয়ে গেলে সুজাতার অখন্ড অবসর। পুরানো অ্যালবাম খুলে সে ছবি দেখতে থাকে। ছোট্টো তিতলি ছোট্টো ছোটন ছবিতে। আগেকার শেখর, যুবতী বয়সের সে। তিতলির দুধে দাঁতের হাসি। কত বছর কেটে গেল। আজকের সতেরো বছরের তিতলি কেমন? এই বয়সটাতেই সুজাতা প্রথম প্রেম চিনেছিলো আর চিনেছিলো সংসারের ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুরতা, চিনেছিলো মৃত্যু। তবু সে অভিজ্ঞতা তার লুকানো স্বর্ণ, কাউকে সেকথা জানানো হলো না।
বেলা পড়ে এলে সে উঠে পড়ে, মুখহাত ধুয়ে সাজগোজ করে চা টোস্ট খায়, তিতলি এলে কী করবে প্ল্যান করতে চেষ্টা করে, কিন্তু পরক্ষণেই ভাবে কী হবে?
তিতলি এলো ক'দিন পরেই, আগের থেকে একটু রোগা একটু শুকনো লাগে যেন ওকে। কিন্তু মাকে তিতলি সেভাবে কিছু বলে না তো কোনোদিন, সুজাতারও কেমন যেন ইচ্ছে করে না। মনে হয় এই তিতলি ছোটন এরা শেখরের ইচ্ছার ভাবমূর্তি মাত্র, শত কষ্ট সয়ে তাদের জন্ম দিলো সে, হাঁটতে শিখে তারা দূরে সরে গেল। সেও তো চায় নি কাছে টানতে, তার ভালোবাসার সন্তান নয় এরা, অভ্যাসের সৃষ্টি শুধু।
শেখর বললো তিতলির ব্লাড ক্যানসার, আর মাত্র কয়েকটা মাস সে আছে, তাই নিজের কাছে নিয়ে আসা। সুজাতার ভেতরটা কেমন স্তব্ধ হয়ে গেল, এখনো সে কেন কোনো দু:খ কোনো বেদনা অনুভব করছে না? এত পাষাণী সে কবে হয়ে গেল?
অসুস্থ মানুষকে দেখতে আসা আত্মীয়স্বজনের ভীড় পছন্দ করে না শেখর, খুব ঘনিষ্ঠ জনেরা ছাড়া আর কেউ তাই আসে না। তিতলি বিশ্রামে আছে, দু'বেলা ডাক্তার আসেন দেখতে। দেখাশোনার জন্য নার্স আয়া সবই আছে, সুজাতা তবু মাঝে মাঝে গিয়ে মেয়ের শিয়রের কাছে চুপটি করে বসে থাকে।
তিতলি মাঝে মাঝে চোখ মেলে মাকে দেখে আর অল্প হাসে। একদিন আর কেউ ছিলো না, সে সুজাতাকে বললো " মা, জানো আমি চেয়েছিলাম একলা একলা দূর দেশে চলে যেতে। সেখানে গিয়ে চাকরি করতাম, নিজের মতন থাকতাম। এখন দ্যাখো, সত্যি অনেক অনেক দূরের দেশে একা একা চলে যেতে হবে আমায়। " তিতলির গলায় বিষাদ নেই, ঠিক যেন বালিকার মতন খুশি।
সে বললো, "মা, আমি তোমার কথা জানি। তোমার লুকানো চিঠির কথা জানি। তুমি সারাজীবন যেকথা কাউকে বলো নি, সেই সব কথা আমি শুনেছি কেয়ামাসীদের ওখানে গিয়ে। কিন্তু মা, আমি হলে তোমার মতন মেনে নিতাম না, নিজের পায়ে দাঁড়াতাম, প্রিয়দর্শিনী দিদার মতন নিজের কাজ নিয়ে চলে যেতাম। ভালো যাকে বাসি না, তার ঘরে কিছুতেই বৌ সেজে থাকতাম না।"
সুজাতা টের পেল ঝরণার মতন জল ঝরে পড়ছে তার দু'চোখ থেকে। কতদিনের জমানো জল এ? এই তার আত্মজা, এই তার জগতের কাছ থেকে পাওয়া সবচেয়ে দামী উপহার, একে সে চিনতে পারে নি কেন? চিনলো যখন তখন আর কাছে রাখার উপায় নেই।
তিতলি মায়ের চোখ মুছিয়ে দিয়ে বলে, " আমি থাকবো না বলে দুঃখ পাচ্ছ? আরো কত ছেলেমেয়ে আছে আমার মতন, তাদের বাবা নেই মা নেই, তুমি তাদের জন্য কাজ করো মা, তুমি আমাদের মিশনের অনাথ আশ্রমে যোগ দাও। নিজেকে বন্ধ করে রেখো না মা, আমি বলছি তুমি দেখো তুমি যা খুঁজেছিলে তাই পাবে।"
তিতলির অন্তেষ্ঠির পরে পরেই যোগ দিয়েছে সুজাতা। এবারে শেখর এতটুকু আপত্তি করে নি।
সুজাতা পড়ায় খুব যত্নে। স্কুলছুটির মাঠে খেলে বেড়ায় শিশুরা। সুজাতা বসে বসে দেখে। সুজাতা আন্টি ওদের খুব প্রিয়।
সুজাতার মনে হয় দূরে কোথাও কে যেন কেবল হেঁটে হেঁটে ওর দিকেই আসছে, আসছে, আসছে। সে কে? সে কি সুপ্রতীক? সে কি তিতলি? সে কি ছোটোমাসী? সুজাতা জানে যখন ও এসে পৌঁছবে তখনই ওর সঙ্গে চলে যাবার জন্য সে তৈরী হয়ে আছে। ওরই জন্য অজস্র মৃতু পার হয়ে অমৃতের হরিণী সে, একা অপেক্ষা করে আছে।
(শেষ)
মন্তব্য
আপনার অদ্ভুত বর্ণন ক্ষমতা দেখে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই...
বিপ্লবী স্বপ্ন।
পড়ার জন্য ধন্যবাদ বিপ্লবী স্বপ্ন।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
অন্তত আমাদের দেশে কতশত সুজাতা যে এমন কষ্ট পেয়ে যায়, যাচ্ছে এবং যাবে সারাজীবন!
হ্যাঁ, আমাদের দেশে তো বটেই, মনে হয় সারা পৃথিবীতেই। ভালোবাসতে যাদের ভালো লাগে, বিশ্বাস করতে আর নির্ভর করতে যারা চায়, সবচেয়ে বেশী বেদনা হয়তো তাদেরই। কারণগুলো হয়তো আলাদা আলাদা, জোর খাটানোর কৌশলগুলো হয়তো ভিন্ন, কিন্তু দু:খ সেই একই। মানুষের জীবনে এত রকমের জটিলতা!
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
আমার সন্দেহ একটা ছিলো, পোস্টটা হাতী পোস্ট হয়ে গেছে। এখন দেখি ঠিক তাই। লোকে পালাচ্ছে।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
আমি কিন্তু পালাইনি!
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
না পালানোর জন্য ডবল ধন্যবাদ।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
অসম্ভব সুন্দর একটা গল্প
-অতীত
ধন্যবাদ অতীত।
হাতী পোস্ট দেখে ভয় না পেয়ে পড়েছেন বলে আরো বেশী করে ধন্যবাদ।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
নতুন মন্তব্য করুন