অশেষ আকাশ

তুলিরেখা এর ছবি
লিখেছেন তুলিরেখা (তারিখ: শুক্র, ১৫/০৪/২০১১ - ৭:২৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

হালকা নীল আলোর মধ্য দিয়ে উড়ে যাচ্ছি, সঙ্গে সাদা পালকের মতন জিনিসের পোশাক পরা এক অদ্ভুত মানুষ, ওর মুখ দেখতে পাই না, ওর ডান হাত দিয়ে আমার বাঁহাত চেপে ধরে আছে, আমি সম্পূর্ণ ভারশূন্য! অথচ সেই দিশাহারা পড়ে যাবার মতন অনুভূতি কিন্তু এখন হচ্ছে না, প্রথম কৃত্রিম ভারশূন্যতায় যেমন হয়েছিলো৷ এখন বরং ভালো লাগছে, উড়ে যাওয়ার মতন একটা তীব্র আনন্দের অনুভূতি হচ্ছে, কোনো হাওয়া নেই, তবু মনে হচ্ছে দক্ষিণ সমুদ্রের হাওয়া এসে চুলগুলি ওড়াবে এখনই৷

মনে পড়ছে অনেকদিন আগের এককুচি নরম গোলাপ-পাপড়ির মতন স্মৃতি, এক সাদা বালির সমুদ্রবেলা, ঘন নীল সমুদ্র, দুধের মতন সাদা ফেনার মুকুট পরে অন্তহীন ঢেউ আসে, ঢেউ ভাঙে! আর কী প্রবল বাতাস, কী পরাক্রান্ত বাতাস! ছোট্টো মেয়েটার মাথাভর্তি কোমল চুলের রাশি এলোমেলো থেকে আরো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। ওর বালিমাখা গোলাপি ফ্রকের প্রান্ত, গলার লালফুল আঁকা আকাশীনীল রেশমীস্কার্ফ হাওয়ায় ওড়ে, ওড়ে, ওড়ে! কে ঐ মেয়েটা? ওকে কোথায় দেখেছিলাম?

হাল্কা রিন্‌ রিনে একটা কচি গলার ডাক, " দিদি ই ই ই " সেই স্মৃতিহাওয়ায় ভেসে আসে একমুহূর্তের জন্য, পরমুহূর্তেই হাওয়া ঘুরে যায়, শব্দ হারিয়ে যায়। কোথায় শুনেছিলাম ঐ ডাক? কোথাও শুনেছিলাম কি? কবে? কার ছিলো ঐ কচি শিশুকন্ঠ?

সাদা নরম বালির উপরে ছোটো ছোটো একজোড়া পায়ের ছাপ! জলের কাছ থেকে ডাঙার দিকে চলে এসেছে আর তারপরে আবার আল্পনার মতন বাঁক খেয়ে জলের দিকে চলে গেছে। কার পায়ের ছাপ? কেন মনে পড়ছে?

মনে পড়ছে পিটুলিগোলা দিয়ে আল্পনা দেওয়া একটা বারান্দা, ফুললতাপাতার আল্পনা, ধানের ছড়ার আল্পনা, S এর মতন প্যাঁচ দিয়ে আঁকা জোড়া জোড়া ছোট্টো ছোট্টো পায়ের ছাপ। ছোট্টো ছোট্টো দুটো হাত ওগুলো আঁকছে। বুড়োমতন দু'খানা হাত যত্ন করে দেখিয়ে দিচ্ছে। কারা ওরা?

এই সমুদ্রের তীরের বালিতে দৌড়পায়ের ছাপ, আবার এই আলপনায় চিকন চিকন S এর মতন পা। একটা ভেসে আসে আরেকটা মিলিয়ে যায়। আবার ফিরে আসে আগেরটা। জুম ইন জুম আউটের মতন। কেন একসাথে এই দু'খানা ছবি মনে পড়ছে? কেন?

ছবি দু'টো মিলিয়ে গেল। এবারে দেখছি পাখি, শত শত পাখির এক বিরাট দল। বাবা মা আর ডানার কাছ ঘেঁষে নতুন শিশু পাখিরাও। ওরা ঘরে ফিরে যাচ্ছে। ওদের দিক ভুল হয় না কখনো। তালে তালে ওদের ডানা উঠছে আর পড়ছে। কখনো বাতাসে ডানা ছড়িয়ে ওরা শুধু ভেসে যাচ্ছে, নিচে ঘন নীল মহাসমুদ্র। ওরা টানা উড়ে আসছে, টানা উড়ে আসছে। সাতদিন ওরা বাতাসে, অবিরাম উড়ে চলেছে। এইবারে ওদের ডানা ক্লান্ত হয়ে আসে, ক্লান্ত হয়ে আসে, এমন সময় দলের প্রথম পাখিটি কীকীকীক্‌ করে খুশীর ডাক দিয়ে ওঠে, তাদের দ্বীপের প্রথম পাহাড়টি দেখা গেছে দেখা গেছে। খুশীর তরঙ্গ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে গোটা দলে, এসে গেছে, এসে গেছে, ঘর কাছিয়ে এসেছে। আহ, কেন দেখছি এই ছবি? এ কি আমার জাগ্রত স্মৃতিতে কোথাও ছিলো? নাকি সব কল্পনা ?

শুভ্রপোশাক সঙ্গী হাসলো। না, ওর মুখ দেখতে পাইনি, হাসির শব্দও শুনি নি, মাথার মধ্যে ধাক্কা মারলো অনুভূতিটা সরাসরি৷ সে বললো, "ফিরে তাকাও, দ্যাখো ৷" এখানেও একই ভাবে সরাসরি মন থেকে মনে কথা, কোনো শব্দ নেই৷ সে নিজেই আমাকে ধরে ফিরিয়ে দিলো৷ আমি ফিরেই নিস্পন্দ হয়ে গেলাম, স্তম্ভিত হয়ে গেলাম৷

আকাশের ভেলভেট কালো পটভূমিতে আমাদের পৃথিবী, টলটলে নীল একখানা উজ্জ্বল রত্নখন্ডের মতন, নিঁখুত নিটোল একটি গোলক, নীলজলের মহাসমুদ্রে বেষ্টিত, মাঝে মাঝে মহাদেশ জলে মাথা জাগিয়ে আছে৷ আধখানা আলোয় আলো, সেদিকে দিন, অন্য অর্ধেকে কালো রাত৷ মহাদেশগুলোতে বুটি বুটি সূক্ষ্ম আলো, রাতের বাতিরা৷ মহাসমুদ্রেও রাত্রিচর বায়োলুমিন্যান্ট প্রাণীরা কোনো কোনো জলখন্ড আলো করেছে৷ স্পন্দহীন আমার বাহু ধরে আবার অন্য দিকে ঘুরিয়ে সে ঐভাবেই বললো, "এবারে যেতে হবে৷"

"যেতে হবে, কোথায়?" মাথার ভেতরে জলবুটির মতন প্রশ্ন ওঠে৷ শুভ্রপোশাক আগন্তুক নি:শব্দে আমার মাথায় উত্তর ফুটিয়ে দিতে থাকে৷

ঝিমঝিমে লাগে আমার, মনে পড়ে মাত্র কদিন আগের সেই সাংঘাতিক উদ্বেগের দিনরাত্রি, আমাদের অ্যাটমিক ক্লকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দৌড়, পালা করে রাত জেগে কাজ৷ সিকিওর পথে টানেল থেকে খবর আসে, সে খবর ডিসাইফার করে সেইমতো কাজ৷ ডার্ক রুমে নীলসবুজ লেজারের তীর আমাদের ঘুমহারা চোখে জ্বালা ধরায়, অথচ অন্য পথ নেই, নান্যপন্থা৷ জন্মের ঋণশোধ মৃত্যু দিয়ে৷

চার্লস, উইলিয়াম, ভিজয়ন, ইমন, আকিমদের গ্রুপ কোড লেখে আর ডিবাগ করে সারাদিন, হাজার হাজার লাইন কোড, মাঝে মাঝে ভালোমতন চলে, মাঝে মাঝে এত এত ভুল লুকিয়ে থাকে যে ওরা কেমন দিশাহারা হয়ে যায়, তখন আরেক গ্রুপ ওদের সাহায্য করতে আসে। ভিজল্যাবের থ্রী-ডি স্ক্রীণে আমাদের সামনে ফুটে ওঠে কলিশনের সিমুলেশান, নানা অ্যাঙ্গেলে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে দেখতে আর প্রোগ্রামে কারেকশান করতে করতে আমাদের মন আর শরীর ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে পড়ে, কিন্তু উপায় নেই বিশ্রামের। সময় ফুরিয়ে আসছে, সময় খুব কম।

পালা করে আমরা কাজ করতে থাকি আর কফি খেতে থাকি ঘুম তাড়াতে। ক্লান্তিতে একেবারে নি:শেষিত হয়ে গেলে অপেক্ষাকৃত তাজা সঙ্গীকে কাজের জরুরি অংশ বুঝিয়ে দিয়ে ঘরে যাই দুই কি তিন ঘন্টা ঘুমিয়ে আসতে।

সব মনে পড়ে যায়। ভোলা যায় না। এখন তো আর সেই উদ্বেগ নেই, এখন তো জীবনের ঋণশোধ আর বাকী নেই। তবু কেঁপে কেঁপে ওঠে ভিতর বাহির, রয়ে গেছে স্মৃতি, কী প্রবল তার শক্তি! প্রতি মুহূর্তের অনিশ্চয়তাভরা সেই তীব্র অশান্ত দিনরাত্রির উত্তপ্ত ঝাপ্টা সময়ের সমুদ্র পেরিয়ে ধাক্কা মারে আমার এ ভঙ্গুর মৃত্তিকাহৃদয়ে।

ওম শান্তি, ওম শান্তি, ওম শান্তি! আর ভয় নেই রণি! শান্ত হও, শান্ত হও অনরণ্যা, শান্ত হও। জপমন্ত্রের মতন নিজেকে বলতে থাকি, বলতে থাকি, বলতে থাকি মনে মনে। উষ্ণ লবণজল আমার দু'চোখ ছাপিয়ে গাল বেয়ে ঝরে পড়তে থাকে, পড়তে থাকে আর পড়তে থাকে! কোন্‌ অসীম শূন্যতায় হারিয়ে যাচ্ছে ওরা?

আমার পায়ের নীচে, মাথার উপরে, সামনে পিছনে, ডাইনে বাঁয়ে কী বিপুল মুক্ত মহাকাশ! কী গভীর নীল! কত কত তারা টলটল করছে, যে তারাদের আমি কোনোদিন দেখতে পাইনি পৃথিবীর ধোঁয়াধূলা আর বিদ্যুত-আলোর আবিলতার মধ্য থেকে! এই ঝকঝকে পরিষ্কার আকাশের গহীন নীল অন্ধকারে ডুবতে ডুবতে ভাসতে ভাসতে চেয়ে চেয়ে দেখি। চেনা নক্ষত্রমন্ডলগুলোকেও অচেনা লাগে! চেনা চেনা উজল তারাগুলির ফাঁকে ফাঁকে এত যে তারা লুকিয়ে ছিলো, তা তো দেখিনি আগে!‍ আর শেষ পর্যন্ত তো আমার জ্যোতির্বিদ্যা নিয়ে এগোনো হয় নি!

সব দীর্ঘশ্বাস, বেদনা, সুখ, দু:খ ভাসিয়ে দিয়ে বয়ে যায় কিসের এক অপূর্ব প্রবাহ! তারায় তারায় ঠাসাঠাসি আকাশের দিকে চেয়ে আমি হঠাৎ করে চিনে ফেলি উজ্জ্বল জ্বলজ্বলে নীল চিত্রা তারাকে! এই তারাটির নামে আমার জন্মমাসের নাম। কতকাল আগের এক চৈত্রের সন্ধ্যায় জন্মেছিলাম আমি, মাতৃগর্ভের জলময় অন্ধকার থেকে বার হয়ে চোখ মেলেছিলাম ওই আলোবাতাস ভরা সুন্দর পৃথিবীতে, তখন যারা ঘিরে ছিলো আমাকে, তারা কেউ কি আর আছে আজ?

চিত্রা চেনা মাত্রই চিনে ফেলি স্বাতীকেও। তারপরে এমনকি বৃশ্চিক রাশিকেও খুঁজে পাই, তার হৃদয়ের কাছে জ্বলজ্বলে কমলা জ্যেষ্ঠ্যা তারাকে দেখে অদ্ভুত চিনচিনে ব্যথা হয় বুকের মধ্যে। এমনই তো হতো মাটির জীবনেও! হতো না কি?

আহ, কত তারা, কত তারা! ধনুরাশির তারাগুলির ভিতর দিয়ে দেখা যায় ছায়াপথের কেন্দ্রাঞ্চল, সেদিকে অজস্র তারা, তারায় তারায় একেবারে ঠাসাঠাসি,যেন সমুদ্রতীরে বালির মতন ছড়িয়ে পড়ে আছে! বালিকাবেলায় প্রথম ছায়াপথ চিনে যে ঝিনঝিনে রোমাঞ্চ হয়েছিল, সেই রোমাঞ্চ ফিরে আসে আবার, তারও অনেক অনেক গুণ বেশী হয়ে।

কবিতার লাইন মনে পড়ে, আশ্চর্য সব লাইন।

"তবু অক্লান্ত ডানা
ভেদ করে যায় অবিনাশী শূন্যমন্ডল,
দেশকালের জটিল বুনন, অন্ধকারের ষড়যন্ত্র।
অফুরান অগ্নিপক্ষ ধেয়ে যায়
অনির্বাণ আলোর দিকে। "

কার লেখা ছিলো এইসব কবিতা? কারা পড়েছিলো এইসব? কারা ভালোবেসেছিল? কারা ভালোবাসেনি? মনে পড়ে প্রিয় ও আরো গভীর প্রিয় মানুষদের মুখ, কখনো আবছা, কখনো স্পষ্ট। শিশুর মতন অবুঝ অভিমানে চোখ ভিজে যায়, কেন ওরা আমাকে ধরে রাখছে না? আমি মুখে বলতে পারি না ভালোবাসার কথা, কিন্তু কেন ওরা ও বলে না ভালোবাসি ভালোবাসি? তাহলেই তো অভিমান ভুলে গিয়ে বলতে পারতাম, " আমি চলে যেতে চাই না, চাই না, চাই না। আমি ভালোবাসি, খুব ভালোবাসি এই ধূলামাটি, এই সবুজ, এই তিরতিরে জলরেখা, ঐ তুলোতুলো মেঘ, ঐ কালো চোখে খুশীর বিদ্যুৎ আর ভালোবাসার বৃষ্টি। "

আহা, চাইতাম ঐ যাদুময় দু'হাতে দু'হাত রেখে আস্তে আস্তে নিভে যাক আমার জীবনতাপ, আবার আসবো আবার আসবো আবার দেখা হবে বলে ঢলে পড়ি শান্তিময়ী মৃত্তিকার কোলের নীল অন্ধকারে।

কিন্তু যেতে হবে, উপায় নেই। শুভ্রপোশাক সঙ্গী আবার আবার মনের মধ্যে কথা পৌঁছিয়ে দেয়, " কেন এত দুর্বল হয়ে পড়ছো? এই দিনের কথা কি তুমি জানতে না? তুমি নিজেই কী প্রস্তুত হচ্ছিলে না এই দিনের জন্য?"

" হ্যাঁ, দূত, আমি জানতাম, আমি জানতাম। তবু মায়া কেন ছাড়ে না!" মনে মনে বলে দিয়ে চোখ বুজি।

বহুদূর শরতের ভোর থেকে নরম এক গান ভেসে আসে, সেই গানের মধ্য দিয়ে শিউলিফুলে ভরা উঠান পার হয়ে প্রায়-অচেতন আমাকে কোলে নিয়ে ফটকের দিকে যাচ্ছে কে যেন, সে কী মা? মায়ের চুলের সুগন্ধ আমাকে ঘিরে ফেলছে, ছবিতে আঁকা অন্ধকারের মতন সেই দীর্ঘদেহ মানুষটা, শেষরাতে যাকে দেখেছিলাম বিছানার পাশে-তাকেও দেখতে পাচ্ছি, তার হাতে লম্বা একটা দন্ড, ডগায় চকচকে তিনটে ধাতব ফলা। সকালের আলো ঝকঝক করে উঠছে তাতে। ফটকের বাইরে রিকশা দাঁড়িয়ে আছে, আমাকে নিয়ে উঠে বসে মা, পাশে কে? বাবা?

মনে মনে বলি, " আমি তাকে চিনি দূত, এবারে দেখা হওয়া মাত্র আমি চিনতে পারবো ঠিক। আঁধার রূপে এসেছিল বলে কি আলো হয়ে দেখা দিলে চিনতে পারবো না?"

আমাদের যাওয়া শুরু হয়, কাছের আকাশ থেকে দূরে দূরে দূরে, আরো দূরে। আমরা ভেসে যাই অশেষ আকাশে।

*****


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।