ইস্কুলবেলা লিখতে গিয়ে অনেক পাওয়া হলো আমার, কতকালের পুরানো বন্ধুরা উঠে এলো স্মৃতির জলরাশি সরিয়ে। মুখবইয়ে সত্যি করে উঁকি দিলো ছোটোবেলার বন্ধুরা। কাউকে চিনতাম প্রাইমারি স্কুলে, কাউকে পেয়েছিলাম সেকেন্ডারির বছর ছয়েক কাউকে বা এগারো-বারোতে।
তারপরে সময়ের স্রোতে জীবনের খরধারে কে কোথায় ভেসে গেছি নিজের নিজের কক্ষপথে। সেইসব ধূমকেতুরা যাদের কক্ষপথ অধিবৃত্ত বা পরাবৃত্তের মতন, যারা একবারই কাছে আসে তারপর চিরকাল দূরে সরে যায়, সেইরকম দেখা হয়েছিলো কতজনের সাথে। আবার কারুর কারুর পথ যেন উপবৃত্তের মতন, ফিরে ফিরে দেখা হয়েছে নির্দিষ্ট সময় পর পর। লিখতে গিয়ে যেন সময়ের স্রোতে উলটোবাগে নাও বাইছি, মনে পড়ে যাচ্ছে আগের থেকেও আগের কথা।
পাহাড়ে আমাদের সেই পিকনিকে ঘুরে ফিরে ইস্কুলবেলার কথাই আসছিলো শুধু। বারে বারে ছড়িয়ে যাচ্ছিলো আগে আর পরে। কিছুতেই যেন ফাইভ থেকে টেন এই ছয় বছরের গন্ডীতে তারা থাকবে না, বারে বারে গড়িয়ে যাচ্ছিলো আগের স্কুলে, সেই কেজি-ওয়ান কেজি-টু থেকে শুরু করে ক্লাস ফোর পর্যন্ত যেখানে ছিলাম সে স্কুলে, সেখানেও আমি আর অন্বেষা দু'জনেই ছিলাম কিন্তু তখন ওকে খুব ভালো করে চিনতে পারি নি। তাই সেখানে আমাদের স্মৃতিটুকরোগুলো আলাদা আলাদা।
অন্বেষা বলে কেজি ওয়ানের সেই প্রথম স্পোর্টসের কথা, বিস্কুট দৌড়। সুতোয় বাঁধা বিস্কুট ঝুলছে, দু'পাশ থেকে দিদিমণিরা দোলাচ্ছে আর দু'হাত পিছনে নিয়ে রুমাল দিয়ে বাঁধা অবস্থায় প্রতিযোগীরা কামড়ে বিস্কুট খুলে নেবার জন্য লাফঝাঁপ করছে। আমার নিজের স্মৃতিতে সেই খেলার কিছুই নেই, কিন্তু কল্পনায় দেখতে পাই ঠিকই। শীতের রোদে ঝকঝকানো সবুজ মাঠ, সাদা সবুজ ইউনিফর্ম পরা একঝাঁক উজ্জ্বল শিশু। সত্যি কি আমরাই ছিলাম অমন?
আমার আবার মনে পড়ে কেজি-টু তে সেই ইঞ্জেকশান দেবার দিন। কী একটা ভ্যাকসিন যেন দেওয়া হবে ক্লাসের সব বাচ্চাকে। সবাই ভয়ে জড়োসড়ো আর ধীরস্থির ভারিক্কী চেহারার দীপাবলি দিদিমণি বলছেন, "কিছুই না, সামান্য পিঁপড়ের কামড়ের মতন লাগবে একটু।" এক এক করে বলির পাঁঠার মতন এক একজন এগিয়ে গিয়ে টেবিলের কাছে দাঁড়াচ্ছে, ওখানে তুলো স্পিরিট আর সিরিঞ্জ নিয়ে এক ভদ্রলোক রেডি আর দীপাবলি দিদিমণি ডানপাশ থেকে নানারকম মজার কথা বলে বলে বেচারা বাচ্চাটির মনোযোগ অন্যদিকে আকর্ষন করছেন। এর কথা অন্বেষার কিছু মনে নেই, কিন্তু তাতে আমাদের উপভোগে অসুবিধে হচ্ছে না, দুজনেই দিব্যি হাসছি।
হাসির ভিতরে হঠাৎ হানা দেয় অন্ধকার, কাহিনি ছড়িয়ে যেতে চায় অন্যদিকে, উৎসবময় মাধ্যমিকের পরেরদিকে। মাতাল কবির মতন তখন আমরা বাকীর খাতায় শূন্য রেখে পুরস্কারের সাকীর হাতে আপাতসাফল্যের সুরা পান করছি। জানি না সামনে কী আছে, সুদেআসলে কী ভয়ানক দাম দিতে হবে।
" টেঁপি, মাধ্যমিকের পরে আমাদের স্কুল বদলানো উচিত ছিলো, তাই না রে? "
এবারে আর ও ডাকনামে ডেকেছি বলে প্রতিবাদ করে না, ওর চোখ দূরে চেয়ে আছে, দেখছে তবু দেখছে না। আস্তে আস্তে যেন অনেক দূর থেকে শব্দ খুঁজে খুঁজে এনে কথা বললো, " টাউনের ভালো স্কুলে কেন তোরা গেলি না? আমার বাড়ীর লোকেরা না হয় আমাকে ডিসকারেজ করলো, সময় নিয়ে নাকি টানাটানি পড়বে অতটা জার্নি করলে, আরো কত হ্যানো হবে ত্যানো হবে, কিন্তু তোরা কেন কেউ গেলি না?"
আমি বলি, "তা কি হয় রে? তুই ছিলি আমাদের দৃষ্টান্ত, তোর মাধমিকের রেজাল্টের জন্য দুইদিন ছুটি দিয়েছিলো স্কুল, সব অভিভাবকেরা তোর উদাহরণই দেখাতো। সেই তুই যখন রয়ে গেলি ওখানেই এগারো-বারোতে, তখন আমরা কেমন করে যাই? "
ও দীর্ঘশ্বাস ফেলে, বলে, " বাড়ীর লোকের দোহাই দিলেও এতদিন পরে বুঝতে পারি আসলে আমারি দোষ। যে আমি এর আগে সব কিছুতে লড়াই করেছি, সে কেন ওরা বাড়ী থেকে যা বললো শুনে রয়ে গেলাম? আসলে নতুন জায়গা, নতুন চ্যালেঞ্জ নিতে চাইলাম না। বিজয়ের সুরা তারিয়ে তারিয়ে খাবার জন্য রয়ে গেলাম। তার দামও দিতে হলো দু'বছর পরে, ঠিক হয়েছে, বেশ হয়েছে। তার পরেও বেহায়ার মতন বেঁচে রইলাম। তখনই ক্লিওপেট্রার শরণ নেওয়া আমার উচিত ছিলো।"
"অন্বেষা!!!" আমি শকড, ওর চোখে জল টলটল করছে। এর আগে আমি ওকে কোনোদিন কোনো অবস্থাতে কাঁদতে দেখিনি।
আমাদের চারপাশে অবারিত বসন্তসৌন্দর্যের মাঝখানে সময়ের ঋণশোধ করতে থাকি আমরা দু'জন। কবেকার- সেই কত বছর আগের আটকে থাকা কান্না, মিলিয়ে যেতে থাকে বাতাসে, কতদূরের এক অচেনা ভূমির করুণাভরা বাতাসে। সূর্যের উপরে উড়ে আসে একখন্ড মেঘ, স্নিগ্ধ ছায়া পড়ে। পৃথিবী তার কোমল হাত বাড়িয়ে আমাদের মনের অন্ধকার ছাড়িয়ে নিতে থাকে।
(চলবে মনে হয় )
মন্তব্য
আরে আরে, কান্নাকাটি কেন? কী ঘোটালা হয়েছিল সেই ইস্কুলজীবনে? সেসব গল্প কই?
দেখেছ কান্ড! ঘুরে ফিরে সেই ঘোটালা! কার মন যেন বোঁচকার দিকে থাকে?
আহা, গল্প হলো গিয়ে সেই নৌকাযাত্রা, একেক জায়গায় গিয়ে ঠেকবে হাটের ঘাটে। কিন্তু পথের কথাও তো বলতে হবে, নাকি?
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
হুমমম...মনে হয়
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
আসলে কী হয়েছিলো সে কথা বিস্তারিত না বলে স্পোর্টস জার্নালিস্টদের মতো কেবল এই কথা - সেই কথা বলে কাটিয়ে দিলে চলবে? সরাসরি অ্যাকশান চাই। নো ঘ্যানাপ্যাঁচা।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
না না জার্নালিস্টদের তুশচু করবেন না! ওনারা না থাকলে এই এত কনটিনিউয়াস কান্ড কোথা থেকে পেতেন? অ্যাকশন তো, সেই হিন্দি সিনামার কেস! ম্যয় খিলাড়ী তু আনাড়ীতে সেই "আরে, অ্যাকশন বোলো।"
তারপরে তো সেই দুম করে মেরে দিলো হুম করে উড়ে গেল ( বেশীরভাগ লড়াই হোতো বাজারে, একগাদা আপেল কমলা ভরা ঝুড়ির উপরে গিয়ে পড়তো ভিলেন, সব ছড়িয়ে পড়তো ), ব্যস। তারপরে?
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
আগ্রহ নিয়ে পড়ছি ইস্কুল বেলার গল্প।আপনার বর্ননা ভংগিটা আমার অসম্ভব ভালো লাগে।
অনেক ধন্যবাদ আসমা। খুব ভালো লাগলো আপনার কথা শুনে। ভালো থাকবেন।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
নতুন মন্তব্য করুন