দেশবিদেশের উপকথা- ঘূর্ণিজলের নাগপ্রহরী (মধ্য আফ্রিকা)

তুলিরেখা এর ছবি
লিখেছেন তুলিরেখা (তারিখ: শুক্র, ১৩/০৫/২০১১ - ৩:৩৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ঐ যে নীল পাহাড়ের চূড়া, তার কাছে আছে এক বিরাট হ্রদ, সেই হ্রদ থেকে পাড়ের একটা দিকের পাথরের বাঁধন কাটিয়ে নেমে এসেছে ঝর্ণা, সেই ঝর্ণা নদী হয়ে বয়ে এসেছে নিচে, তিনকূট পাথরের কাছে এসে হয়েছে সরোবর, সেই সরোবরে আছে ঘূর্ণী। জল সেখানে নিশিদিন ঘুরপাক খায়।

আর সেই ঘূর্ণীর নিচে, অনেক নিচে ঠান্ডা ঝুপসি ঝুপসি আঁধার তলদেশে কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে মহানাগ, সে ঘূর্ণিজলের সরোবরের নাগপ্রহরী। রূপো চকচকে তার গা, কুচকুচে কালো তার চোখ, তার চেরা জিভ যখন হিস হিস করে বেরিয়ে আসে তখন ঝিলিক দেয়। ভয়ঙ্কর সুন্দর সে। তার কুন্ডলিত গায়ে আছে সর্বরোগনিরাময়স্পর্শ, পৃথিবীর যেকোনো মানুষের যেকোনো অসুখ ভালো হয়ে যায় সেই নিরাময়ছোঁয়ায়। কিন্তু কার এত সাহস যে যাবে জলের নিচে নেমে তাকে ছুঁতে?

ঘূর্ণীজলের সরোবরের পাড়ে সেদিন বসে ছিলো নগমা, গাঁয়ের এক কিশোরী মেয়ে। মা তার খুব অসুস্থ, মৃত্যুশয্যায়। সব জরিবুটি বৃথা হয়েছে, এখন একমাত্র এই মহানাগের নিরাময়স্পর্শ ছাড়া তাকে বাঁচানো যাবে না। নগমা চেয়ে দেখে নিচে মহানাগ, তার হিস হিস চেরা জিভ আগুন ছেটায়। ভয়ে নগমা অবশ হয়ে যায়, কিন্তু ফিরেও যেতে পারে না।

তার মায়ের মুখ মনে পড়ে, ফ্যাকাশে হয়ে মা শুয়ে আছে বিছানায়, মায়ের চোখ বোজা, চেতনাও নাই ভালো করে। এই অসুখে মৃতপ্রায় মাকে ছাড়িয়ে তার মনে পড়ে আরেক সময়ের মাকে। অনেক আগের মা, নগমা তখন এইটুকুনি, মা তাকে কোলে নিয়ে ঘুরে ঘুরে ঘুমপাড়ানি গান গেয়ে গেয়ে ঘুম পাড়াতো। মনে পড়ে একবার নগমাকে কাঁকড়াবিছায় কামড়েছিলো, তখন মা কতদূর বন থেকে তুলে এনেছিলো ওষুধের কন্দ। মনে পড়ে বেবুন দৈত্য উঠানে শোয়ানো তার ছোট্টো ভাইটাকে নিয়ে যাচ্ছিলো, তখন মা জ্বলন্ত কাঠ দিয়ে লড়াই করেছিলো ভাইকে ছাড়িয়ে আনতে। সেই মা আর উঠবে না, চোখ মেলবে না, কথা কইবে না?

নগমা বুক ভরে শ্বাস নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঘূর্ণীতে, নামতে নামতে নেমে পড়ে মহানাগের কাছে। নাগ তার জিভ ভিতরে টেনে নেয়, চোখ বুজে ফেলে। নড়ে না চড়ে না, চুপ করে থাকে। সাহসী মেয়েটিকে সে একটুও ঘাবড়ে দিতে চায় না। নগমা হাত বাড়িয়ে সাপের গা ছুঁয়েই পড়িমরি করে উঠে পড়ে উপরে, তারপরে সাঁতরে গিয়ে উঠে পড়ে পাড়ে। দৌড়াতে দৌড়াতে সে বাড়ী পৌঁছে মায়ের গায়ে ছুঁয়ে দেয় হাত, মা ভালো হয়ে যায়। চোখ মেলে, কথা কয়, উঠে বসে।

সেইদিন সাঁঝবেলায় সূর্য ডুবে পশ্চিম আকাশ লালে লাল হলো, তারপরে মিলিয়ে গেল সেই আলো। একে একে ফুটলো তারারা আর বাঁকা চাঁদ উজল হয়ে উঠলো। সেই রূপোলি জ্যোৎস্নায় সরোবরের জল থেকে উঠে এলো এক ঝকমকে তরুণ।

তার সুঠাম বাদামী চেহারা, মাথা ভরতি কোঁকড়ানো কালো চুল। তার কালো চোখ ঝকঝক করছে। গলায় তার নীলচে সাদা চন্দ্রোপলমণির মালা। পাড়ে উঠে সে বুক ভরে শ্বাস নেয়, বাতাসের স্পর্শ নেয় লোভীর মত, আহা কতদিন পরে! পৃথিবীটা কত সুন্দর!

সে বড়ো বড়ো পা ফেলে আসে গাঁয়ের কাছে, একসারি কুটির সেখানে। নগমাদের কুটিরের সামনে গিয়ে সে ডাকে," নগমা নগমা"

অবাক হয়ে বেরিয়ে আসে নগমা, কে ডাকে তাকে?

বেরিয়ে সে দেখে আশ্চর্য সুন্দর এই তরুণকে, কে এ? চেনা চেনা মনে হয় তবু চিনতে পারে না কেন? কোথায় একে দেখেছে নগমা?

তরুণ তাকে বলে, " আমি ঘূর্ণীজলের সরোবরের মহানাগ। তোমার সাহসের জন্য আমি শাপমুক্ত হয়েছি। এখন আমি রাতেরবেলা মানুষরূপ ফিরে পাবো। দিনের বেলা অবশ্য সাপ হয়েই থাকতে হবে জলের নিচে। আমি তোমাকে আমার মালাটা উপহার দিতে চাই, নেবে তুমি নগমা?"

নগমা কিছু বলতে পারে না, শুধু মাথা হেলিয়ে সম্মতি দেয়। নিজের গলা থেকে নীলচে সাদা চন্দ্রোপলমণির মালা খুলে নগমার গলায় পরিয়ে দেয় সেই ছেলে। তারপরে বিদায় নিয়ে চলে যায়।

পরদিন থেকে দেখা যায় সরোবরতীরে সারাদিন বসে বসে মহানাগকে গান শোনায় নগমা। সাঁঝেরবেলা জল থেকে সাপ উঠে আসে মানুষ হয়ে। আকাশভরা তারার নিচে হাত ধরাধরি করে মাঠে মাঠে ঘুরে বেড়ায় আর গল্প করে নগমা আর নাগকুমার। আজও তারা তেমন ঘোরে হাত ধরাধরি করে, তাদের গল্প ফুরায় না কখনো।

***


মন্তব্য

অপছন্দনীয় এর ছবি

হাসি

তুলিরেখা এর ছবি

হাসি :-) হাসি

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

আয়নামতি1 এর ছবি

ভারী মিষ্টি গল্প হাসি 'নেবে তুমি নগমা?' হবে তুলিদি। এসব গল্পগুলো কী সব স্মৃতি থেকে মনে করে করে লেখা? দারুণ একটা সিরিজ হচ্ছে কিন্তু! শুভেচ্ছা।

তুলিরেখা এর ছবি

আরে তাইতো! "নেবে তুমি" হবে। ঠিক করে দিলাম। হাসি
এগুলো স্মৃতি থেকে না, ইংরেজি সারসংক্ষেপ থেকে।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

কৌস্তুভ এর ছবি

(গুড়)

ঐ যে নীল পাহাড়ের চূড়া, তার কাছে আছে এক বিরাট হ্রদ, সেই হ্রদ থেকে পাড়ের একটা দিকের পাথরের বাঁধন কাটিয়ে নেমে এসেছে ঝর্ণা, সেই ঝর্ণা নদী হয়ে বয়ে এসেছে নিচে, তিনকূট পাথরের কাছে এসে হয়েছে সরোবর, সেই সরোবরে আছে ঘূর্ণী। জল সেখানে নিশিদিন ঘুরপাক খায়।

আর সেই ঘূর্ণীর নিচে, অনেক নিচে ঠান্ডা ঝুপসি ঝুপসি আঁধার তলদেশে কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে মহানাগ, সে ঘূর্ণিজলের সরোবরের নাগপ্রহরী। রূপো চকচকে তার গা, কুচকুচে কালো তার চোখ, তার চেরা জিভ যখন হিস হিস করে বেরিয়ে আসে তখন ঝিলিক দেয়। ভয়ঙ্কর সুন্দর সে।

এইখানে লেখার স্টাইলটা এক্কেবারেই সোভিয়েত উপকথার অনুবাদগুলোর মত লাগল!

তুলিরেখা এর ছবি

মিষ্টি গুড় দিলে? চিনি দিও পরেরবার। হাসি

আরে এই গল্পটার আবহটাই ছিলো এরকম। হাসি

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

কৌস্তুভ এর ছবি

দেঁতো হাসি

সেইগুলোর সঙ্গে কি সুন্দর সুন্দর অলংকরণও থাকত! বইয়ের সময় সেইরকম ছবিও চাই...

তুলিরেখা এর ছবি

ওরে ব্বাবা! সেই সোভিয়েত আঁকা গুলো? ওগুলো তো এত সুন্দর ছিলো আর এমন একটা বিশেষ স্টাইল যে দেখলেই বোঝা যেতো সোভিয়েত অঙ্কন। সেগুলো আর কি আছে? সব তো ভেঙে গেল!
কনস্পি থিওরির লোকেরা বলে দু'পাশেই যত ভালো ভালো কাজকর্ম আবিষ্কার সবই নাকি বাইরের গ্রহের কারা দিয়ে গেছে বা সেই 'ওরা' তখন বাস করতো এখানেই, লোকে ভাবতো মানুষ। হাসি
সেই হিসাবে আঁকাগুলো ও সেই ওরাই একেছে, এখন হয়তো ওরা নিজেদের গ্রহে ফিরে গেছে। এখন আর সেই ছবি পাইবেন কই?????

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

আশফাক এর ছবি

আপনার অনুবাদগুলো মুগ্ধ হয়ে পড়ি। কমেন্ট করা হয়ে ওঠে না সবসময়।
অনুবাদ জারি থাকুক। অদূর ভবিষ্যতে মলাটবন্দী অবস্থায় অনুবাদগুলো দেখতে চাই

তুলিরেখা এর ছবি

ধন্যবাদ আশফাক।
দেখা যাক সেই অদূর ভবিষ্যৎটা কতদূরে। হাসি

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

প্রখর-রোদ্দুর এর ছবি

বর্ননার সূক্ষতায় ভালো লাগা আরো বেড়ে গেলো ।

অনেক শুভ কামনা । আরো এগিয়ে চলুন

তুলিরেখা এর ছবি

ধন্যবাদ প্রখর রোদ্দুর। হাসি

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

আসমা খান, অটোয়া। এর ছবি

তুলি, অক্ষর দিয়েই আপনি চমৎকার ছবি আকঁছেন, অনুভুতিকে, কল্পনাকে এত রঙ্গিন করে লিখছেন যে আমার মলাটবাধাঁ উপকথা গুলি কবে পাবো সেই অপেক্ষায় আছি! খুব খুব ভালো লাগছে!!! ধন্যবাদ।

তুলিরেখা এর ছবি

আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। হয়তো আপনাদের আশীর্বাদ আর শুভেচ্ছাতেই একদিন সঙ্কলনটা মুদ্রিত আকারে ছবিসমন্বিত হয়ে বেরোবে। সচলের শিল্পীরা (এখানে অনেকেই ভালো ভালো শিল্পী, কেউ কেউ লুকিয়ে রাখেন গুণ, কেউ কেউ প্রকাশ করেন হাসি ) যদি রাজি থাকেন। হাসি

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

ফাহিম হাসান এর ছবি

চমৎকার গল্পের জন্য আপনাকেই আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

তুলিরেখা এর ছবি

আপনাকেও ধইনাপাতা। হাসি

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

গল্পটা এমন কিছুই ছিলো না, কিন্তু বর্ণনাতে যা দেখিয়েছেন তাতেই এটা চমৎকার একটা গল্প হয়ে গেছে। পাঠকের চাহিদার মাত্রাটা কিন্তু বাড়িয়ে দিলেন। সুতরাং সামনে যা লিখবেন সেটার ভাষা নিয়ে পাঠক কিন্তু এই গল্পের সাথে তুলনায় বসবে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

তুলিরেখা এর ছবি

আফ্রিকার উপকথাগুলো এমনই, এখানে মানুষের ভূমিকা আর চারপাশের গাছগাছালি পাখপাখালি সাপখোপ নদী দিঘি হাওয়া মেঘ এদের ভূমিকা একেবারে কমপারেবল, কারোর ভূমিকা কারোর থেকে কম না।
তাই আমি এই ধরনের গল্পগুলো লেখার আগে ভয়ে ভয়ে থাকি। হাসি

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

রাতঃস্মরণীয় এর ছবি

চমৎকার লিখেছেন। ধন্যবাদ। হাসি

------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।

তুলিরেখা এর ছবি

আপনাকেও ধন্যবাদ রাত:স্মরণীয়।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।