এই উপকথা সাইবেরিয়ার। সৃষ্টি বিষয়ক উপকথা। কীভাবে সৃষ্টি হলো পৃথিবীর জমি, গাছপালা, পশুপাখি ও মানুষ। আমাদের উপকথার কারণসলিলে নিমজ্জিত জগতের গল্পের সাথে কিছু কিছু মিল আছে। মানুষ সৃষ্টির গল্পের সাথে মিল আছে বাইবেলের আদিপুস্তকের গল্পের।
সে বহুকাল আগের কথা। তখন সবকিছু জলে ঢাকা, কোনো ডাঙা জমি নেই কোথাও, গাছপালা পশুপাখি কিচ্ছুটি নেই। এমনকি জলেও কোনো জীব নেই।
সৃষ্টিকর্তা উলগান জলের উপর দিয়ে উড়ে বেড়ায় শূন্যে, ভাবে কী করে ডাঙা বানাবে এর থেকে, কী করে সেখানে বানাবে পশুপাখি গাছগাছালি। পরিকল্পনা দিন দিন শক্তপোক্ত হয়ে ওঠে তার মনে, কিন্তু কাজ আর সে শুরু করে না।
দিনের পর দিন যায়, চলে গেল সে যে কতকাল। উলগানের খুব একা একা লাগে, সে ভাবে কেউ যদি থাকতো সাথী। একদিন উলগান দ্যাখে জলের মধ্যে কী যেন ভেসে আসছে। যেন উপরদিকে মুখ করে ভেসে আসছে একটা দেহ। উলগানের কাছে আসলে সে দেখলো সত্যিই তাই। উলগান তাকে প্রাণসঞ্চার করে বাঁচিয়ে তুললো, সে হলো তার সবসময়ের সঙ্গী, উলগান তার এই সঙ্গীর নাম দিলো এরলিখ।
উলগান আর এরলিখ দুই রাজহংস রূপে চরাচরব্যাপী জলের উপর দিয়ে উড়ে উড়ে দেখতে লাগলো। এরলিখ একটু হামবড়া টাইপ, "দ্যাখো আমি কত উঁচুতে উড়তে পারি" বলে সে অনেক উঁচুতে উড়ে গেল। তারপরে দম ফুরিয়ে খুব ক্লান্ত হয়ে ঝপ করে জলে পড়ে গেল। সে ডুবে যায় দেখে উলগান ঝাঁপ দিয়ে পড়ে তাকে তুললো আর ভেসে থাকা একটা হিমশৈলের উপরে তাকে বসতে দিলো।
এরলিখ জিরিয়েটিরিয়ে সুস্থ হলে উলগান তাকে বললো, "এরলিখ, ডুব দিয়ে জলের তলা থেকে মাটি নিয়ে আসতে পারবে একটু? এনে আমার হাতে দেবে, তা থেকে আমি ডাঙা বানাবো।"
এরলিখ রাজি হয়ে ডুব দিলো আর নামতে নামতে ভাবতে থাকলো, কেমন করে ডাঙা বানাবে উলগান? আমি সবটা মাটি দেবো না ওর হাতে, দেখে দেখে শিখে নেবো, তারপরে আমিও বানাবো ডাঙা।
রাজহাঁসরূপী এরলিখ তো মুখে করে জলের তলার মাটি এনে দিলো উলগানকে, কিন্তু খানিকটা মাটি গলায় রেখে দিলো। তার নিজের ডাঙা বানাবার জন্য।
উলগান তো এই লুকানোর বিষয় জানেনা। সে তো মাটি হাতে পেয়েই মন্তর পড়ে সে মাটি প্রসারিত করতে শুরু করেছে। উলগানের হাতের মাটি ছড়িয়ে যাচ্ছে আর এরলিখের গলার ভিতরের মাটিও। এরলিখের দম বন্ধ হয়ে যায় প্রায়, সে মাটি থু থু করে ফেলে দিলো। এভাবেই উলগানের হাতের মাটি থেকে হলো ভালো ডাঙাজমি আর এরলিখের লুকানো মাটি থেকে হলো কাদাভরা জলাজমি সব।
এখন ডাঙা তো হলো। এবারে উলগান গাছপালা পশুপাখি কীটপতঙ্গ সব সৃষ্টি করে জমি ভরিয়ে ফেললো। কত রকমের গাছ, কত রকম তাদের পাতা, কী তাদের ফুলের বাহার, ফলের বাহার। প্রাণীরাও সব কত রকমের! কেউ ডানাওলা তারা ওড়ে, কেউ পাখনাওলা তাঁরা সাতরে জলে নেমে পড়ে। কেউ দৌড়ে দৌড়ে বেড়ায় মাঠ জুড়ে। পাখপাখালি গাছগাছালি ভরা জমি সর্বাঙ্গসুন্দর হলো।
এবারে মানুষ চাই। সে কাজ কঠিন। উলগান পাথরের কাঠামোর উপরে মাটি দিয়ে একটা পুরুষের আরেকটা নারীর দেহ তৈরী করলো। এবারে এদের প্রাণসঞ্চার করতে হবে। উলগান কুকুরকে পাহারায় রেখে নিজে গেল জঙ্গলে, এদের জন্য উপযুক্ত প্রাণসঞ্চারের জিনিস খুঁজে আনতে। এরা মানুষ, সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব, এদের তো আর যা তা একটা জিনিস দিয়ে দেওয়া যায় না। সর্বোত্তম জিনিস চাই।
এদিকে এরলিখ তক্কে তক্কে ছিলো, যেই না উলগান বনে গেল, অমনি সে এসে হাজির। পাহারায় থাকা কুকুরটাকে সে বড় বড় ঝোলা লোম দিয়ে সর্বাঙ্গ ঢেকে দিলো যাতে শীত না লাগে ওর। কুকুর কৃতজ্ঞ হয়ে কী করবে জানতে চাইলো, এরলিখ বাইরের দিক দেখিয়ে বললো, " তুমি ঐদিকে চেয়ে রও ভাই। " কুকুর বাইরের দিকে চেয়ে রইলো।
এরলিখ পাতার চোঙা বানিয়ে ফুঁ দিয়ে মানুষ মানুষীর দেহে প্রাণসঞ্চার করে দিলো। এইভাবে উলগান নয়, এরলিখই হয়ে গেল মানবজাতির স্রষ্টা।
উলগান ফিরে এসে সব দেখে হায় হায় করতে লাগলো কিন্তু তখন আর কিছু করার নেই। সে একবার ভাবলো মানুষ দুটোকে মেরে ফেলে আবার নতুন করে করি সব। কিন্তু শেষ অবধি তা আর পারলো না। জ্যান্ত দু'খানা মানুষ নড়ে চড়ে কথা বলে, তাদের সে কেমন করে মারে ?
কিন্তু কুকুরের এই বেইমানি সে সইলো না, বললো, "তোকে মানুষের হয়ে কাজ করতে হবে অনেক, শীতের মধ্যে বাইরে থাকতে হবে। মানুষে যদি তোকে মারধোর করে, সে দায় তোর।"
এই কান্ডের পরে এরলিখের কাজকর্ম উলগানের পক্ষে আর সহ্য করা সম্ভব হলো না। সে তাকে তাড়িয়ে দিলো। বিতাড়িত এরলিখ পাতালে চলে গেল।
সেই থেকে এই চলে আসছে, লোক আর আলোকভরা জীবজগতে উলগান প্রভু আর পাতালে মৃত্যুলোকে এরলিখ প্রভু। কালের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাদের লড়াই চলতে থাকবে।
মন্তব্য
হেঁহেঁ...
ইউরিনোম-ও ঘুঘু হয়ে উড়ছিলো, পরে হঠাৎ কি মনে হলো ঢেউয়ের উপরে নাচতে নাচতে যাচ্ছিলো - রাস্তায় উত্তরে বাতাসকে ধরে হাতের তালুর মধ্যে ঘষা দিতে সেটা মহাসর্প ওরিয়ন হয়ে গেলো (ব্যাটা লুলপুরুষ!)। কিছু 'কর্মের' ফলে তাদের সন্তান সন্ততি হলো বারো জোড়া টাইটান আর সব গ্রহনক্ষত্র... ইউরিনোম সবকিছু বানালো, খানিকটা ডাঙা, তার মধ্যে সবকিছু, সে আর ওরিয়ন পর্বতের চূড়ায় থাকছিলো। ব্যাটা ওরিয়ন সেখানে বেয়াদবি করায় লাথি মেরে তার দুইটা বাদে সব দাঁত খসিয়ে দিয়ে শরীরে কালশিরে ফেলে ইউরিনোম তাকে পাতালের গর্তে থাকতে পাঠিয়ে দিয়েছিলো। সেই থেকেই সেই সাপ গর্তে থাকে আর তার গায়ে বিভিন্ন রঙের 'কালশিরে' আর তার দাঁত নেই। (গ্রীকপূর্ব Pelasgian উপকথা)
একটু অদল বদল করে নিলে আপনার এই সাইবেরিয়ান গপ্পের কাছাকাছি, সাথে যদি আরো দুই একখানা ক্রিয়েশন মিথ জুড়ে দেয়া যায়, যেমন মিশরের 'রে'-এর মাটি দিয়ে মানুষ বানিয়ে সেখানে ফুঁ দিয়ে 'কা' - অর্থাৎ প্রাণসঞ্চারের কাহিনী, তাহলে মিশ্র ভার্সনটা ঠিক এই গপ্পই হবে।
চালিয়ে যান
গল্পগুলো পড়ে পড়ে আমার গভীর সন্দেহ হয় হয়তো বাপু এরিক ফন দানিকেন কিছু কথা ঠিকই কইসিলেন।
সুপ্রাচীন কালে কিছু ঘোটালা ঘটেছিলো ঠিকই, গ্লোবাল স্কেলে, সেই কাহিনি সারা পৃথিবীতে নানা নামরূপে ছড়িয়ে গেছে। যেমন মহাপ্লাবনের কাহিনি চীনেও পাওয়া যায়, ব্যবিলনেও, বাইবেলেও, ভারতীয় উপমহাদেশেও আবার সুদূর মায়া সভ্যতাতেও। ঘোর গ্লোবালাইজড কাহিনি।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
ওই একই মহাপ্লাবনের কাহিনী ইজিপশিয়ানেও পাবেন, এমনকি বিশাল এক নৌকা বানিয়ে সেটাতে সব প্রাণীর একজোড়া করে নিয়ে ভেসে পড়ার কাহিনীও প্রচুর পাওয়া যায়, ভারতীয় পুরাণে এবং ইজিপশিয়ান মিথে।
সম্ভবত বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত কাহিনীগুলোও এইসব মিথ থেকেই উঠে এসেছে, যদিও অনেকে মানতে রাজি হন না, বলেন ওগুলো আকাশ থেকে খসে পড়েছে আর ওগুলোর হাজার বছর আগেও লোকজন ওই হাজার বছর পরের ঘটনা থেকেই কপি মেরেছে। তারপরেও, আমার মত নরকবাসী লোকজন মিল খুঁজে পেলে অবাক হয় বই কি।
প্রথম ধর্মতত্ত্বের উপর আগ্রহ জন্মেছিলো লোককাহিনী পড়তে গিয়েই - ঘাঁটতে গিয়ে দেখি বাহবা, বেচারা কেঁচোর গর্তে রীতিমত অজগরবাবাজী বসে ডিমে তা দিচ্ছেন।
আরে তখন সবকিছু ইন্টারডিসিপ্লিনারি ছিলো। কী বা মিথ, কী বা ধর্ম, কী বা সমাজ, কী বা চিকিৎসা কী বা যাদুবিদ্যা কী বা কারিগরী।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
ধইনবাদ নজরুল ভাই।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
উলগান = আহুরা মায্দা/ওহরমায্দ/আওরমায্দ/হরমায্দ/আরামায্দ/আজ্জানদারা
এরলিখ = অঙ্রা মাইন্যিউ/আহ্রিমান
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
পান্ডবদা, এটা কী ঘটলো?
কী ঘটলো মানে কী?
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
মানে লাইন দুটোর অর্থ ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না এই আর কি...
এক ভাষা থেকে ধ্বনি পরিবর্তন হয়ে হয়ে অন্য ভাষায় অন্য কিছু হওয়া কি?
এই আহুর-মাজদা/ আহরিমান কাহিনির সমান্তরাল তো দেখি অনেক জায়গাতেই। মিশরে ওসাইরিস/ সেথ, বাইবেলে গড/সেটান, উপমহাদেশ সুর-অসুর, ঘোর সন্দেহ হয় এ একই গল্প, একটু অদলবদল হয়ে গিয়ে নানা রূপ নিয়েছে।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
আহুর মাজদা / আহরিমান - টা জানা ছিলো না, তাই পান্ডবদার মন্তব্যের অর্থ ধরতে পারিনি :)।
একই বস্তুই মনে হয়... কিন্তু ওই যুগে ছড়ালো কী করে সেটাই বুঝতে পারি না। তখন তো আর ইন্টারনেট-সচলায়তনের যুগ না...
আরে সেই জন্যই তো ফন দানিকেনের বক্তিমে শুনছি এখন।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
নতুন মন্তব্য করুন