দেশবিদেশের উপকথা-কুমুশের গল্প(নেটিভ আমেরিকান)

তুলিরেখা এর ছবি
লিখেছেন তুলিরেখা (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৬/০৫/২০১১ - ৭:২১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

এটা মোডকদের গল্প। মোডকরা হলো নেটিভ আমেরিকান জনজাতি, থাকতো ক্যালিফোর্নিয়া আর ওরিগনের সংযোগস্থলের বনপাহাড়ের মধ্যে। এদের সৃষ্টি বিষয়ক উপকথায় আছে পৃথিবীতে মানুষ কীভাবে এলো সেই কাহিনি।

সৃষ্টিকর্তা কুমুশ অমর, তিনি আকাশে আলোর প্রাসাদ বানিয়ে আছেন। কিন্তু আগে তিনি ছিলেন আমাদেরই ভুবনে, একেবারে মানুষের মতন দেখতে ছিলেন তখন। তিনি ঘুরে বেড়াতেন এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায়, কিছুতেই বেশীদিন থাকতে পারতেন না নিজের গ্রামে। তবে নির্দিষ্ট সময় পরে পরে ফিরেও আসতেন।

একবার কুমুশ চলে গেল দূর দিগন্তের দিকে, গেল যে গেলই। দিন যায় মাস যায় বছরের পর বছর যায়, কুমুশের ফেরার নাম নেই। যারা তাকে চিনতো সেই লোকেরা সব বুড়ো হয়ে মরে গেল। আর কেউ রইলো না যে কিনা কুমুশকে স্বচক্ষে দেখেছিলো। শুধু গল্পে কথায় রয়ে গেল কুমুশের স্মৃতি, হ্যাঁ সে একটা লোক ছিলো বটে, কেবলই ঘুরে বেড়াতো দুনিয়া জুড়ে।

তারপর একদিন কুমুশ ফিরে এলো, সঙ্গে একটা ফুটফুটে মেয়ে। সে মেয়ে কোথা থেকে এলো কেউ জানে না। কুমুশ কি তাকে কারুর কাছে দত্তক নিয়েছিলো নাকি সে মেয়ে কুমুশের নিজের মেয়ে কেউ জানলো না তা। শুধু সবাই বোঝে কুমুশের চোখের মণি এই মেয়ে। খুব ভালোবাসে তাকে কুমুশ।

মেয়ে দিনে দিনে বাড়ে। কুমুশ তার জন্য পোষাক বানায়, তার জীবনের প্রতি পর্যায়ের জন্য একটা করে পোশাক। যখন সে পূর্ণ নারী হবে, সেইসময়ের পোষাক, যখন তার বিয়ে হবে সেই সময়ের পোষাক, যখন সে প্রথম মা হবে সেই সময়ের পোষাক-- এইরকম সব। শেষ পোষাকটা সবচেয়ে সেরা, হরিণের চামড়া থেকে তৈরী সেটা, উপরে চকচকে ঝিনুকের খোলা সেলাই করে করে জুড়ে দিয়ে মনজুড়ানো নকশা, এটা হবে মেয়ের শেষপোষাক, কাফন, এটা পরিয়ে দিয়ে তাকে কবরে শোয়ানো হবে।

দিন যায় দিনের নিয়মে। একদিন মেয়ে পূর্ণ নারী হয়ে ওঠে। কুমুশ তাকে সেদিনের উপযুক্ত পোষাকটা দেয়, কিন্তু মেয়ে সেটা নেবে না। সে চায় সেই কাফনটা। কুমুশ তাকে একে একে অন্য সব পোষাকগুলো দিতে চায় কিন্তু মেয়ে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদে, সে ওগুলোর একটাও চায় না। সে চায় শেষ পোষাকটি।

কুমুশ বোঝে ভবিতব্য খন্ডানো যাবে না। সে বিমর্ষচিত্তে পোষাকটি দেয় মেয়েকে। অপরূপ সেই পোষাক পরে প্রথম পূর্ণনারী হওয়া অপরূপা সুন্দরী সেই কন্যা নাচতে শুরু করে আশ্চর্য সুরে গান গাইতে গাইতে। কুমুশ চোখভরা জল নিয়ে চেয়ে থাকে, সে জানে কী হবে। গান থামে একসময়, নাচও বন্ধ হয়। মেয়ে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। কুমুশ এসে নাড়ি ধরে দেখলো মেয়ে মারা গেছে।

মেয়েকে কবরে শুইয়ে দিয়ে মাটিচাপা দিয়ে নিয়মমত সব কাজ সেরে কুমুশ ফিরে আসে তার কুটিরে, সে কুটির শূন্য, খোলা দরজার পাল্লা দু'টি যেন হাহাকার করছে। কুমুশ কুটিরে ঢোকে না, সে রওনা হয় মৃত্যুলোকের দিকে। সেখানে মেয়ের আত্মার সাথে সে দেখা করতে চায়।

অনেক অনেক পথ পার হয়ে ঘূর্ণীজলের নদী। সেই নদী পার হয়ে পাহাড়, সেই পাহাড়ের ঘুরঘুট্টি অন্ধকার গুহার ভিতর দিয়ে কুমুশ চলে আর চলে, একসময় এসে পৌঁছায় মৃত্যুলোকে।

সে এক আশ্চর্য সুন্দর জায়গা। কষ্ট নেই বেদনা নেই ক্ষুধা নেই তৃষ্ণা নেই তাপ নেই শৈত্য নেই। অগণন বিদেহী আত্মা সেখানে মনের সুখে নেচে চলেছে ভেসে চলেছে হেসে চলেছে গেয়ে চলেছে। তার মেয়ের বিদেহী আত্মার সাথেও কুমুশের দেখা হলো, কিন্তু কুমুশকে দেখে তার কোনো হেলদোল হলো না।

কুমুশ বহুকাল সেই বাসনাশূন্য মরণলোকে বিদেহী আত্মাদের সাথে নেচেগেয়ে কাটালো। তারপরে একদিন পৃথিবীর জীবনের জন্য তার মনকেমন করে উঠলো। সেই আকাশভরা আলো, সেই যে প্রাণজুড়ানো বাতাস, সেই গোধূলির স্বর্ণ যা ক্ষণিকের তরে দিগন্ত রাঙিয়ে কোথায় মিলিয়ে যায়, সেই সব সামান্য জিনিসের জন্য প্রাণ কেঁদে উঠলো তার। সেই জীবন যা কিনা সুখদু:খের কুসুমেরতনে গাঁথা, তার জন্য আকুল হয়ে উঠলো সে।

এক ঝুড়ি হাড় নিয়ে সে ফিরে চললো জীবলোকে, হাড়গুলো থেকে সে মানুষজাতি বানাবে আবার। হাড়েরা যেতে চায় না, তারা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় কুমুশকে, ঝুড়ি উলটে যায়, হাড়েরা লাফ দিয়ে গর্তে পড়ে পাতালে পালায়। কুমুশ আবার যায়, আবার হাড় কুড়িয়ে ঝুরি ভরে আনে, আবার একই ব্যাপার ঘটে। তিনবারের বার হাড়েরা পালাতে পারে না, কুমুশ তাদের বলে, "জীবনে অনেক বেদনা থাকলেও জীবন সুন্দর। একইরকম করে বয়ে চলা মরণলোকের একঘেয়ে সময়ের চেয়ে জীবলোকের বিচিত্র আলোছায়া আর নিত্য নতুন ঘটতে থাকা সব ঘটনা অনেক বেশী আকর্ষণীয়। সেখানে আছে ভালোবাসা, সেখানে আছে আকুতি, বাসনাশূন্য মরণলোকে তা পাওয়া যাবে না। "

কুমুশ উঠে আসে আলোভরা জীবলোকে। একে একে হাড়গুলো পুঁতে দেয় জমিতে, মন্তর পড়ে। একেকটা হাড় থেকে সৃষ্টি হয় একেকটা জনজাতি। সবশেষে মোডকরা তৈরী হয়। তারা ছোট্টো জাতি কিন্তু কুমুশের সবচেয়ে প্রিয় তারা। তাই কুমুশের আশীর্বাদে তারা সবচেয়ে সাহসী।

কুমুশ মানুষদের চাষবাস করতে, বস্ত্র বানাতে, ঘর বানাতে শেখায়, শেখায় দিন মাস বছরের বিভাজন, শেখায় ঋতু পরিবর্তন ও তার ফলাফল। শেখায় আরো অনেক কিছু যা জীবনযাপনে প্রয়োজন। তারপরে সব শেখানো হলে কুমুশ পৃথিবী ছেড়ে আকাশে চলে যায়। সেখানে আলোর ঘর বানিয়ে আছে অমর কুমুশ, থাকবে সৃষ্টিচক্রের শেষদিন পর্যন্ত।


মন্তব্য

ফাহিম হাসান এর ছবি

(গুড়) (গুড়)

কুমুশ বহুকাল সেই বাসনাশূন্য মরণলোকে বিদেহী আত্মাদের সাথে নেচেগেয়ে কাটালো।

লাইনটা আরেকটু সহজ করে লেখা যায় না?

তুলিরেখা এর ছবি

আসলে সেই আত্মালোকের আবহ ফোটাতে মনে হয়েছে আরো জটিল ভাষার দরকার। তবুও কিছুই ফোটানো যায় না। এক অদ্ভুত " নাহি জন্ম নাহি মৃত্যু নাহি রবে কাল/ নাহি রাত্রি নাহি দিন নাহয় সকাল" ধরনের ব্যাপার, গদ্যভাষায় ফোটে না, কবিতার ভাষা খানিকটা ধরতে পারে।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

hodolraja এর ছবি

চমৎকার!

তুলিরেখা এর ছবি

ধন্যবাদ।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

সজল এর ছবি

মোডকদের চিন্তা ভাবনা তো বেশ দারুণ ছিলো! এদের ঈশ্বরকে বেশ পিঠ চাপড়ে দিতে ইচ্ছা করছে।

একইরকম করে বয়ে চলা মরণলোকের একঘেয়ে সময়ের চেয়ে জীবলোকের বিচিত্র আলোছায়া আর নিত্য নতুন ঘটতে থাকা সব ঘটনা অনেক বেশী আকর্ষণীয়।

এটা পুরাই আমার ফিলোসফি, আমার কাছেও মনে হয় বেহেশতের মত বোরিং জায়গা আর হতে পারে না।

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

তুলিরেখা এর ছবি

ঠিক বলেছেন। নানা ভালোমন্দ উত্তমমধ্যম উত্তমরূপে মাধ্যমিক চিকিৎসা টাইপ ঘটনা যদি নাই ঘটলো তাহলে ব্যাপার খুব বোরিং হয়ে যায়। হাসি

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

সচল জাহিদ এর ছবি

আপনার উপকথাগুলো পড়া হয় নিয়মিত কিন্তু মন্তব্য করা হয়না। আমার ছেলের রূপকথার গল্প বেশ পছন্দের। ওকে মাঝে মাঝে শুনাই, সেগুলো সহজ সেগুলো।

বিঃদ্রঃ আপনি কি এগুলো অনুবাদ করেন? সেক্ষেত্রে মূল উপকথাগুলোর লিঙ্ক দিতে পারেন।


এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ অভ্র।

তুলিরেখা এর ছবি

ধন্যবাদ সচল জাহিদ।
এগুলো ঠিক অনুবাদ নয়, কোনোটা ছায়া-অবলম্বনে, কোনোটা পুনর্কথন কোনোটা বা ছোট্টো একটুখানি কাহিনি ভাব বুঝে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বড় করা। এগুলোর তো লিঙ্ক নেই, লাইব্রেরীর হার্ড কপি বই থেকে পাওয়া মালমশলা। এগুলোর কোনোদিন যদি সঙ্কলন হয়, তখন বিবলিওগ্রাফিতে বইগুলোর নাম দেওয়া হবে।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

অপছন্দনীয় এর ছবি

হুম... এটা দিব্যি...মেয়েটা এত মূঢ় কেন?

তুলিরেখা এর ছবি

মেয়েটা মূঢ় কে কইলো? আর কটাদিন থাকলেই তো রাতদিন ঘ্যান ঘ্যান শুরু হবে, সুটারের ভীড়ে বেচারীর বাঁশবনে ডোমকানা কেস হবে আর তারপরে একজনকে চুজ করতেই হবে, তারপরে সেই "কর্ম" আর তারপরে ডজন ডজন ছানা একটা কাঁখে একটা পিঠে একটা চিমটায় একটা খামচায়----এইসব ও মেয়ে হাড়ে হাড়ে জানতো। আলগোছে সরে পড়েছে। হাসি

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

গ্রীক, জাপানী আর চাক্‌মা উপকথার সাথে ব্যাপক মিল পেলাম।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

তুলিরেখা এর ছবি

পেলেন? জাপানী আর চাকমা গল্প তো জানি না, আমার সেই গ্রীক গল্পটা মনে পড়ছিলো, ড্রাগনের দাঁত পুঁতে জমি থেকে মানুষ ফলানো। হাসি

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

পাগল মন এর ছবি

আপনার এই বিভিন্ন দেশের উপকথাগুলো বেশ ভালো লাগে পড়তে।
এগুলোর সংকলন যদি করেন তাহলে সেটা সংগ্রহে রাখতে হবে, ভবিষ্যত বংশধরদের জন্য। হাসি

------------------------------------------
হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস
তবুও তো ভাই কারোরই নাই, একটুখানি হুঁশ।

তুলিরেখা এর ছবি

ধন্যবাদ।
দেখা যাক কবে একশোটা হয়, তারপরে স্পনসর মশাইকে কষে চেপে ধরতে হবে। হাসি

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

একটু ভুল হয়েছে "স্পন্সর মশাই" নয় "স্পন্সর ম্যাডাম" বা "স্পন্সর ঠাক্‌মা" হবে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

ওডিন এর ছবি

এইটা খুবিই ভাল্লাগলো।

আগেও অনেকবার বলেছি, আবারো বলি- এইসব উপকথাটথা এইভাবে মনিটরে পড়া যায়না, পড়তে হয় হাতে নিয়ে, খাটে বালিশ উচু করে তাতে হেলান দিয়ে আরেক হাতে চায়ের মগ নিয়ে। ঠিক কিনা? চিন্তিত

অপছন্দনীয় এর ছবি

এবং সেই সাথে যদি একটা বাটিতে বেকারীর মুড়ি বিস্কুট (এক সেন্টিমিটার কিউব) থাকে...

তুলিরেখা এর ছবি

আরে আমারও একই মত। শুধু চা না, উপকথার বই পড়তে হয় মুঠো মুঠো ঝালমুড়ি খেতে খেতে। চা ফুরিয়ে যেতে পারে ঠান্ডা হয়ে যেতে পারে, কিন্তু ঝালমুড়ি আরো বেশীক্ষণ টেঁকে। হাসি

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।