দেশিবিদেশের উপকথা-পিরেমুজ ও থিসবি(ব্যাবিলন)

তুলিরেখা এর ছবি
লিখেছেন তুলিরেখা (তারিখ: বিষ্যুদ, ২১/০৭/২০১১ - ১:৩৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

এই উপকথা ব্যাবিলনের। তবে লিখিত গল্প হিসাবে এটাকে আমরা প্রথম পাই রোমান কবি ওভিদের লেখায়। পিরেমুজ আর থিসবির করুণ মধুর কাহিনি। এ কাহিনি আসলে চিরকালের, যুগে যুগে দেশে দেশে এই কাহিনি আমরা পেয়েছি নানা আঙ্গিকে। মানুষের ভালোবাসার কাছে সংঘবদ্ধ বিষয়বুদ্ধি কীভাবে পরাজিত হয়েছে, তার গল্প!

বহুকাল আগে মালবেরী গাছের ফল ছিলো দুধসাদা। কেমন করে সেই ফল হয়ে গেল টকটকে লাল, তার নেপথ্যে আছে এক করুণ-মধুর কাহিনি। পিরেমুজ আর থিসবির কাহিনি।

ব্যাবিলন নগরীতে যেখানে ভবনগুলি ঘনসন্নিবদ্ধ হয়ে নগরশ্রী বাড়িয়ে তুলেছিলো, সেখানে পাশাপাশি দু'টি বাড়ীতে থাকতো পিরেমুজ আর থিসবি। পিরেমুজ তখন এক চমৎকার তরুণ আর থিসবি এক আশ্চর্য সুন্দরী তরুণী। ছোটোকাল থেকে পাশাপাশি বেড়ে উঠেছে তারা দু'জন, বড় হয়ে তারা পরস্পরকে ভালোবাসলো। বিয়ে করতে চাইলো।

শুনে তো দুইজনের বাবামাই রেগে চটে ক্ষেপে একাকার! তারা একেবারেই রাজি হলেন না এতে। এ কেমন করে হবে? বংশ কুলমর্যাদা এসবও তো দেখতে হবে! পিরেমুজ আর থিসবিকে খুব বকাবকি করলেন বাবামায়েরা, "ছি ছি পাশাপাশি বাড়িতে ভাইবোনের মত বড় হয়ে এ কী ব্যবহার? শিগগির এসব ভুলে যা, খবরদার ওসব কথা ভুলেও মনে স্থান দিবি না।" কিন্তু এত বকাবকিতেও ছেলেমেয়ে দুটো মানে না দেখে তাদের দেখা-সাক্ষাৎ বন্ধ করে দিলেন উভয়পক্ষের বাবামা।

পিরেমুজ আর থিসবির দেখাসাক্ষাৎ বন্ধ হয়ে গেল উভয়ের পিতামাতার কঠোর আদেশে। আর তারা পরস্পরের দেখা পায় না, কথা বলতে পারে না, মনমরা হয়ে ঘুরে বেড়ায় নিজের নিজের বাড়িতে। বাড়ী তো নয়, জেলখানা যেন!

এদিকে হয়েছে কী, ওদের দুই বাড়ীর মাঝের দেয়ালে ছিলো একটা ছোটো চিড়, কেউ তা লক্ষ ও করে নি কোনোদিন। দু:খী পিরেমুজ আর থিসবির সাবধানী আর অনুসন্ধানী চোখে অচিরেই সেই বন্ধু চিড়টি ধরা পড়ে গেল।
তারপর থেকে প্রতিদিন খুব ভোরে উঠে চুপি চুপি সেখানে গিয়ে দু'জনে দু'পাশ থেকে ফিসফিস করে কথা বলতো। কত কথা! সুখের কথা দু:খের কথা রাগের কথা ভালোবাসার কথা---সব। সবই খুব আস্তে ফিসফিস করে, কেউ না শোনে। একটু বেলা হলেই অবশ্য ওদের সরে যেতে হতো কারণ বাড়ীর লোকেরা একে একে উঠে পড়তে থাকতো। দু'জনে দু'জনকে হাত বাড়িয়ে ধরতে পারতো না, দেয়ালের গর্ত দিয়ে পরস্পরের মুখের খুব সামান্য একটু দেখতে পেতো খালি। কিন্তু কথা বলতে আর শুনতে যে পারতো সেই জন্যই দু'জনে দু'জনের ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিতো।

এইভাবে দিন যায়, লুকিয়ে লুকিয়ে এভাবে ফিসফিস করে কথা বলা আর কতদিন সহ্য হয়? একদিন পিরেমুজ আর থিসবির অসহ্য লাগলো। ওরা ঠিক করলো সেদিন সন্ধ্যাবেলা দু'জনেই বাড়ী থেকে পালাবে। নগরী থেকে বার হয়ে দু'জনেই চলে যাবে বাইরে, স্বাধীন উন্মুক্ত দেশে। হাত ধরাধরি করে তারা চলে যাবে সব অন্যায় নিষেধের বাইরে, সেখানে সুখে ঘর করবে তারা।

ঠিক হলো সন্ধ্যাবেলা ওরা দু'জনেই নগরীর প্রান্তে নিনাস এর সমাধিতে দেখা করবে, জায়গাটা দু'জনেরই চেনা, একটা খুব বড় মালবেরী গাছ আছে সেখানে, দুধসাদা ফলে ভরে আছে বছরের এই সময়ে। কাছেই একটা জলকুন্ড, ঝিরঝির করে জল বেরিয়ে আসছে পাতাল থেকে। ঠিক হলো যে আগে গিয়ে পৌছাবে সে অপেক্ষা করবে, আরেকজন গেলেই দু'জনে একসাথে রওনা হবে বাইরের পথে।

সারাটা দিন যে কী উদ্বেগে উৎকন্ঠায় গেল তাদের তা তারাই জানে। দিন যেন আর ফুরায় না। অবশেষে সূর্য পাটে বসলো। সন্ধ্যা হলো, একে একে জ্বললো তারারা। বাড়ীর সকলের নজর এড়িয়ে থিসবি তার জরিদার ওড়নাটা দিয়ে মাথা ঢেকে রওনা হলো চুপি চুপি, এই ওড়নাটা পিরেমুজ খুব পছন্দ করে, ঝামেলা হওয়ার আগে যখন রোজ দেখা হতো, তখন এই ওড়না না পরলে পিরেমুজ বলতো--- সেই সুন্দর ওড়নাটা কোথায়?

কিছুক্ষণ পরেই থিসবি এসে গেল নিনাস এর সমাধিতে। পিরেমুজ তখনো আসে নি। থিসবি অপেক্ষা করতে লাগলো মালবেরী গাছের নিচে। আকাশে পুষ্ট চন্দ্র, হাল্কা জ্যোৎস্না চারিদিকে। সেই আলোতে হঠাৎ থিসবি দেখলো একটা সিংহী, সদ্য শিকার করেছে বুঝি, মুখে রক্তমাখা, আসছে মালবেরী গাছের দিকেই। থিসবি ভয়ে শিউড়ে উঠলো, কী হবে এখন? থিসবি দৌড়ে পালালো সেখান থেকে, কিন্তু পালাবার সময় ওড়নাটা পড়ে গেল মাটিতে।

সিংহী কিন্তু তেষ্টা মেটাতে আসছিলো জলকুন্ডে, অন্য কোনোদিকে সে ভ্রূক্ষেপ করেনি। জলপান করে ফেরার পথে দেখলো থিসবির ওড়না পড়ে আছে পথে। সিংহী কী মনে করে সেটাতে খুব করে মুখ ঘষে কামড়ে খিমচে ওড়নাটা ছিন্নভিন্ন করে চলে গেল বনের দিকে। ওড়নায় লেগে রইলো সিংহীর মুখের থেকে লাগা রক্তের দাগ।

সিংহী চলে যাওয়ার কয়েক মুহূর্ত পরেই এসে হাজির পিরেমুজ। সে দেখলো পড়ে আছে থিসবির রক্তমাখা ছিন্ন ওড়না, চারিদিকের মাটিতে সিংহের থাবার দাগ। শিউরে উঠে সে ভাবলো থিসবি মরে গেছে, সিংহের শিকার হয়েছে থিসবি। সেই উত্তেজিত আর দুঃখে অভিভূত অবস্থায় দ্বিতীয় কোনো চিন্তা সে করতে পারলো না। সে ভাবলো হায় হায় একলা মেয়েটা এসেছিলো, সে নিজে কেন আগে এলো না? সে এখানে থাকলে তো থিসবি ওভাবে---

থিসবির অসহায় মৃত্যুর জন্য পিরেমুজ নিজেকেই দায়ী করলো। থিসবির ছিন্ন ওড়নাখানা তুলে নিজের বুকে চেপে ধরে সে অস্ফুটে বললো, "আমিও আসছি থিসবি, আমিও আসছি।" তারপরেই নিজের তলোয়ার খুলে নিজের বুকে বসিয়ে ঘ্যাচ করে টান দিয়ে বার করে নিলো। পিরেমুজের তাজা রক্ত ছিটকে উঠে মালবেরী গাছের সাদা ফলগুলোকে টকটকে লাল করে দিলো।

এদিকে সিংহীর ভয়ে দৌড়ে গিয়ে থিসবি তো লুকিয়েছিলো, কিন্তু বেশীক্ষণ থাকতে পারলো না। পিরেমুজ কি এসেছে, নাকি আসে নি? কী হলো সেখানে, এইসব ভাবতে ভাবতে থিসবি লুকানো জায়গা থেকে বার হয়ে গুটি গুটি এসে হাজির হলো মালবেরী গাছের কাছে।

সে এসে দেখলো এই হৃদয়বিদারক দৃশ্য। মৃত্যুপথযাত্রী পিরেমুজ পড়ে আছে মাটিতে, চারিদিক রক্তে রাঙা হয়ে গেছে। থিসবি ছুটে গিয়ে পিরেমুজের মাথাটা কোলে নিয়ে বসলো। পিরেমুজের চোখ বোজা, নিঃশ্বাস ভারী হয়ে গেছে, সে আচ্ছন্ন গলায় কোনোরকমে বললো, "কে?"
থিসবি অশ্রুচ্ছন্ন গলায় বললো, "আমি থিসবি।"
শুনে পিরেমুজ মৃতপ্রায় চোখের পাতা কোনোক্রমে খুলে একবার দেখলো, তারপরেই তার চোখ বুজে গেল চিরকালের মত।

পিরেমুজের তরবারিটা পড়ে ছিলো পাশেই, তার পাশে থিসবির ছিন্ন ওড়না। থিসবি বুঝলো পিরেমুজ নিজেই নিজেকে হত্যা করেছে, কারণ এই ছিন্নভিন্ন রক্তমাখা ওড়না দেখে সে ভেবেছিলো থিসবি মরে গেছে। থিসবিও একই কাজ করলো, পিরেমুজের তরবারি নিজের বুকে বসিয়ে সেও মৃত্যুকে বরণ করলো।

পরদিন সন্ধান করতে করতে দু'জনের বাবামা আর বাড়ীর অন্য লোকেরা এসে এই তরুণ তরুণীর মৃতদেহ পেল। পাশাপাশি পড়ে আছে তাদের নশ্বর দেহ দুটি, পৃথিবীতে মিলন হতে পারলো না বলে তাদের আত্মা পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়ে চিরকালের মত মিলে গেল।

উভয়ের বাবামাই অনেক হাহাকার করলো, তখন আর হাহাকার করেই বা কী হবে? তারা তো ফিরবে না। দু'জনের বাবামাই তখন বলছিলেন আহা যদি বাধা না দিতাম আমরা! এখন যে আমাদের কিছুই রইলো না।

একই সাথে অন্তেষ্টি হলো পিরেমুজ আর থিসবির, একই স্ফটিকপাত্রে রাখা হলো দুজনের ভস্ম। আর মালবেরীর ফল চিরকালের জন্য হয়ে গেল টকটকে লাল, এই লাল ফল হয়ে রইলো পিরেমুজ আর থিসবির ভালোবাসার অমর স্মৃতি।

*******


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।