একবার ঠিক হলো পরদিন টিফিনে একটা খুচরো চড়ুইভাতির মতন ব্যাপার হবে, কে কে কী কী আনবে ঠিক করে নেওয়া হলো। আলুকাবলি বানানো হবে। সবাইই আনবে গোটা আলুসেদ্ধ, কেউ নিলো কুচানো পেঁয়াজ, ধনিয়াপাতাকুচি আর কাঁচালঙ্কার দায়িত্ব, কেউ ভিজানো ছোলা, কেউ চানাচুর, ঝুরিভাজা, পাপড়িচাট। আর অবশ্য করে একজনকে বলে দেওয়া হলো বড় ঢাকনাওলা খালি টিফিনবাক্স আনতে, সেটা না হলে হবে না। ওটার মধ্যেই সব মিলিয়ে আসল বস্তুটি বানানো হবে কিনা।
ইস্কুলবেলার সেইসব দিনগুলোতে টিফিনের ঘন্টা পড়তো বেলা দুটোয়। আমরা তখন একেক দলে দশ বারোজন বন্ধু, সবাই মিলে টিফিন মিলিয়ে দিয়ে ভাগাভাগি করে খাওয়া হতো রোজই। সবাই সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে, টিফিন মোটামুটি সবারই রুটি-আলুভাজা বা রুটি-তরকারি, কেউ কেউ চাউমিন আনত মাঝে মাঝে।
সেদিন টিফিনের আগের ক্লাস খুবই দীর্ঘ মনে হতে লাগলো, ভূগোলের ক্লাস চলছে তো চলছেই, সুব্রতাদি প্রশ্নের পর প্রশ্ন করেই যাচ্ছেন একের পর এক ছাত্রীকে, ঘন্টা আর পড়ে না। একসময় আমাদের ধৈর্যের শেষ সীমায় পৌঁছে ঢং ঢং ঢং করে ঘন্টা পড়ে গেল।
ঘন্টা পড়ে যেতেই আর আমাদের পায় কে! গোটা গ্রুপ লটবহর নিয়ে সো ও জা স্কুলের পুবদিকের নির্মীয়মান ভবনে। ওখানে তখন নতুন ঘর বানানো হচ্ছে, সেগুলোতে তখনো প্লাস্টার, চুনকাম কিছু হয় নি, কোনো ক্লাস ওখানে হবার প্রশ্নই নেই তখন (বেশ কয়েকবছর পরে ওখানেই আমরা ইলেভেন টুয়েলভের ক্লাস করেছি ) অথচ কিছু পুরানো বেঞ্চি ঘর গুলোতে ছিলো, ওখানেই আমাদের প্রত্যেকদিনের টিফিনের আসর বসতো।
সেদিন বিশেষ উত্তেজনা, প্রত্যেকদিনের ঠান্ডা রুটি-সব্জি তো না, আজ আলুকাবলি! আবার নিজেদের বানানো! সেদ্ধ আলুগুলোর খোসা ছাড়িয়ে স্টিলের টিফিনবাক্সের ধারগুলোর সাহায্যে টুকরো টুকরো করে কাটা হলো। তারপরে সব টুকরো পিয়ালির আনা বড় টিফিন বাক্সটায় ঢালা হলো, পেঁয়াজকুচি, ধনিয়াপাতা আর কাঁচালঙ্কাকুচির প্যাকেট খালি করে ঢালা হলো ওর মধ্যে, ছোলাভেজানো ঢালা হলো, চানাচুর ঝুরিভাজা আর পাপড়িচাটও ঢালা হলো। তারপরে ঢাকনা বন্ধ করে রামঝাঁকুনি! তেঁতুলজলও এনেছিলো একজন ছোটো বোতলে করে, সেটাও মেশানো হলো। তারপরে ভাগ করে খাওয়া। ওফ, কোথায় লাগে দুনিয়ার সেরা স্বাদ। লিখতে লিখতে জিভ জলে ভরে যাচ্ছে।
আহা চোখের সামনে ফুটে উঠছে যেন, ঝালে হু হা করতে করতে সবকটা মেয়ে আলুকাবলি খাচ্ছে আর নাকের জলে চোখের জলে হয়েও আনন্দে ভেসে যাচ্ছে। সেইসব দিনে কেন জানিনা ঝাল আর টক খাবারের প্রতি আমাদের গ্রুপের প্রায় সব মেয়েরই ঘোর আসক্তি ছিলো। কী আশ্চর্য দিনকাল ছিলো, কত স্বল্পমূল্যের সামান্য উপকরণে কত আনন্দ উছলে পড়তো, ধরতো না।
সব সুস্বাদু সময়ই তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যায় কী এক অদ্ভুত নিয়মে । সেদিনের আলুকাবলি-টিফিনবেলাও ফুরিয়ে গেল ঢং ঢং ঘন্টায়, যেন তাড়াতাড়ি পড়ে গেল ঘন্টা। চক্রবৎ পরিবর্তন্তে সুখানি চ দুখানি চ এর ব্যাকরণ মেনে টিফিনের পরের ক্লাস ইতিহাস। আর সেদিন দুর্জয় উৎসাহে সুলগ্নাদি গিয়াসুদ্দিন বলবন, আলাউদ্দিন খলজী, মহম্মদ বিন তুঘলক, পৃত্থিরাজ চৌহান, মহম্মদ ঘোরী এঁদের বিষয়ে নানা প্রশ্ন করে করে আমাদের মাথা বন বন করে ঘুরিয়ে ছেড়ে দিলেন। তাতেও রেহাই নেই, উনি ওরকম ইন জেনেরাল ক্লাসের সবাইকে প্রশ্ন করে উত্তর টুত্তর ভালো না পেয়ে এক পর্যায়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে একেক জন মেয়েকে দাঁড় করিয়ে করিয়ে প্রশ্ন করা শুরু করলেন। আমাদের নিভু-নিভু পারফরম্যান্স দেখে তিনি খুবই চটে গিয়ে একচোট বক্তৃতা দিয়ে ফেললেন আমাদের অন্ধকার ভবিষ্যৎ নিয়ে।
যাই হোক, দুঃসময় যত দীর্ঘই হোক, একসময় ফুরায়। ইতিহাসের ঝড় শেষ হলো ঢং ঢং ঘন্টায়। শেষ ক্লাসে আর বিশেষ ঝামেলা নেই, পিটি(ফিজিকাল ট্রেনিং) ক্লাস। লাইন করে সবাই ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে একপাশের বড় পিটি রুমে, সেখানেই হতো আমাদের সমবেত পিটিশিক্ষা। শিক্ষিকা আগমণীদি চমৎকার ছিলেন, নিজেই করে করে দেখাতেন নানারকমের ব্যায়াম ও আসন। পদ্মাসন, পশ্চিমোত্থাসন, উষ্ট্রাসন, বৃক্ষাসন এইসব। আর নানাধরণের গ্রুপ ব্যায়াম লাইনের সামনে দাঁড়িয়ে নিজে করে দেখাতেন, সবাই তাঁকে অনুসরণ করতো। আগমণীদিকে আমরা খুব বেশীদিন পাই নি, আমরা ক্লাস এইটে ওঠার পরেই উনি কলকাতার ভালো স্কুলে চাকরি নিয়ে চলে গেছিলেন।
( চলবে মনে হয়, না? )
মন্তব্য
এমন জিভে জল আনা লেখা চলবে না ।। যদি কেবল মাত্র তেমন চানাচুর ভাজা খাবার আশ্বাসটুকু মিলে তবেই কেবল
facebook
আরে আপনেরে আশ্বাস? আপনে তো রাইতের ভেনিসে, গন্ডোলার উপ্রে ডেসডিমোনার পাশে বইসা বইসা সামনের বাটির থিকা দুইজনে চানাচুর খাইতে খাইতে গান গাইতেছেন,চাইরদিকে ফটফটা চান্নি।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
ইস ইস আপনার লিখে পড়েই মনে পড়ে গেলো ইস্কুল শেষে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা তেতুঁলের দোকান থেকে এক টাকার তেতুঁল কিনে কামড়াকামড়া করে খেতাম বন্ধুরা মিলে। আহ কিসব দিন ছিলো তুলিদি।
আহ, আমাদের ইস্কুলের সামনে বসতো বিনোদদা নামে এক ফুচকাওলা। আমরা ক্লাস ফাইভ থেকে টুয়েলভ অবধি মেয়েরা দলমতচেহারারুচিপ্রতিভানির্বিশেষে এত ফুচকা খেতাম যে কী বলবো, তার ব্যবসা রে রে করে চলতো।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
যখন পড়ি, ইসকুলবেলা তখন ফের ফিরে ফিরে আসে মনে।
আপনার এ সিরিজতা দেখলে ইসকুল নিয়ে লিখতে ইচ্ছে হয় খুব, হয় আর না। আপনার লেখা ধরেই না হয় ইসকুল যাত্রা চলুক।
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
লিখুন না আপনিও। বেশ ভালো হবে তাহলে। সুন্দর বিচিত্র হয়ে উঠবে স্কুলের কথা।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
জিবে রীতিমতো জল এনে গেল ভার্চুয়াল আলুকাবলি চেখে
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
এবারে রিয়েল আলুকাবলি খান গিয়ে।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
আলুকাবলি খাবো! বানিয়ে দাও!
আরে মণিরত্নম, তুমি তো দেখলাম রিয়েল ঘুগনি আর কচুরি খাচ্ছ! আর এক কৌতূহলী বিদেশী যুবককে এসবের উপযোগিতাও বোঝাচ্ছ!
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
'বলি' শব্দ দেখলেই ডরে অন্তরাত্মা শুকায়ে খাঁচাছাড়া হয়ে যায়। তারপরেও মনে অনেক সাহস সঞ্চয় করে বলি, এতো করে যখন বলছেন, ঠিকাছে। আলোকবলি বানায়ে পাঠায়ে দিয়েন। খেয়ে দেখবোনি।
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
না না এ ভালো জিনিস। নিশ্চিন্তে খান।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
আমাদের স্কুলে একটা মজার জিনিস ছিল। মেয়েদের ছুটির আগে কোনভাবেই গেটের বাইরে যাওয়ার অনুমতি ছিলনা। টিফিনের সময় দেখা যেত গেটের নিচ দিয়ে শুধু হাত আর হাত ! আর বাইরে আচারওয়ালা, ঝালমুড়িওয়ালারা সেইসব হাতে ঠোঙ্গা তুলে দিচ্ছে। নিজে যখন স্কুলে ছিলাম এই দৃশ্য বাইরে থেকে দেখা হয়নি কখনো। ভিতর থেকে ধাক্কাধাক্কি করে কোনমতে একটা হাত বের করে দেয়া আর কাঙ্খিত ঠোঙ্গা হাতে পেলে দ্রুত সরে যাওয়া, এই ছিল কাজ। কিন্তু স্কুল পাস করার পর একদিন রাস্তার ওপার থেকে এই দৃশ্যটা দেখে কেন যেন খুব দর্শনীয় একটা ব্যাপার মনে হচ্ছিল। পরে আরো কয়েকবার টিফিন টাইমে শুধু গেটের নিচ দিয়ে বাড়িয়ে দেয়া হাতগুলোর নড়াচড়া দেখার জন্যই গেছি।
গতবছর অনেক অনেক দিন পর যেয়ে আর দেখতে পারলাম না দৃশ্যটা। নতুন বিশাল গেট লাগানো হয়েছে, তার নিচে ফাঁকা নাই, আর এখনকার দিনের মেয়েরাও হয়ত স্বাস্থ্য সচেতন, এইসব খায়না !
দিন কত বদলে গেল দেখতে দেখতে।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
লেখাটা পড়ে আর পারা গ্যালো না, এই চললুম আলু সিদ্ধ দিতে।
ইশকুলবেলা চলতে থাকুক!
কেমন হয়েছিলো সেদিন আপনার আলুকাবলি? ঝাল ঠিকমতো দিয়েছিলেন?
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
কী মিষ্টি লেখা; ঠিক লাড্ডুর মত
আমি টিফিন বেলায় খালি লাড্ডু আর আইস্ক্রিম খেতাম
আরে আমি ভেবেছিলাম তুমি বুঝি ঝালভক্ত ! যা চমৎকার ঝাল ঝাল লেখা লেখো!
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
সুলুপ সুলুপ...
_______________
আমার নামের মধ্যে ১৩
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
নতুন মন্তব্য করুন