দেশবিদেশের উপকথা- মেঘবতী ও রাখাল (সোয়াজিল্যান্ড)

তুলিরেখা এর ছবি
লিখেছেন তুলিরেখা (তারিখ: সোম, ১৯/০৩/২০১২ - ৫:১১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

এই উপকথা আফ্রিকার সোয়াজিল্যান্ডের। আশ্চর্যভাবে আমাদের দেশের উপকথার সাথে কোথায় যেন মিল আছে। বাঙালী নামধাম দিয়ে গল্পটা বলতে চেষ্টা করলাম। আজকে প্রথমার্ধ।

এক গাঁয়ে এক ছেলে ছিলো। তার নাম ছিলো রাখাল। রাখালের ভাইবোন কেউ ছিলো না, বাবা আর মা ও মারা গেলেন দু'দিনের জ্বরে। রাখাল একলা হয়ে পড়লো। তাকে সাহায্য করে এরকম আত্মীয়স্বজনও কেউ ছিলো না। এ বাড়ী ও বাড়ী থেকে দুটো চালডাল কি লাউকুমড়ো চেয়েচিন্তে প্রথম ক'দিন চললো, কিন্তু এরকম আর ক'দিন চলে? চাইলে লোকে বিরক্ত হয় দেখে চাওয়া বন্ধ করলো সে। কিন্তু বাঁচতে গেলে তো খাবারাদাবার চাই। গাঁয়ের মোড়লের কাছে সে কাজ চাইলো। মোড়ল তাকে কাজ দিলো বটে কিন্তু ভালো করে খেতে দিতো না, কাজে ভুল হলে কর্মচারীদের দিয়ে মারধোরও করাতো। বেশ কিছুদিন দাঁতে দাঁত চেপে কাজ করেছিলো, শেষে আর সইতে না পেরে কাজ ছেড়ে দিলো রাখাল।

কাজ ছেড়ে দিয়ে মাইনেপত্তর বুঝে নিয়ে মুখ নিচু করে ভাবতে ভাবতে বাড়ি এসে সে দাওয়ায় বসলো। সামান্য কুটির, চারিপাশে একটুখানি জমি। সেই জমির একপাশে একটুখানি পরিষ্কার করে সে একটা ছোটো সব্জিক্ষেত করলো। সেখানে লাউকুমড়ো শশা পালং মিষ্টি আলু বরবটি টোম্যাটো বেগুন এসব লাগালো। এই এখনকার টাকাকড়ি ফুরালে তখন সব্জিখেতে যা ফলবে তার কিছু হাটে বিক্রি করে দিন চলে যাবে তার।

দিন যায়, রাত যায়। সব্জিক্ষেতে ভালো ফলন হয়। আনাজ নিয়ে হাটে বিক্রি করে সে হাট থেকে চালডাল আনে, নিজেই রেঁধে খায়। এভাবে তার দিন চলে যায়। সে ভাবে, মোড়লের বাড়ি কাজ করার থেকে এ অনেক ভালো, নিজের মতন থাকা, স্বাধীন, মার খাবার ভয় নেই। শুধু মাঝে মাঝে ভারী একলা লাগে তার।

একদিন ভোরবেলা রাখাল দেখলো তার সব্জিক্ষেতের নরম মাটিতে কাদের পায়ের দাগ, প্রচুর সব্জি হাপিস, গাছের ডাল ভাঙা, পাতা ছেঁড়া। কী আশ্চর্য, রাত্রে চোর এসেছিলো নাকি? রাখাল খুব সুকৌশলে একটা ফাঁদ বানিয়ে রাখলো।

পরদিন ভোরবেলা উঠে সে দ্যাখে ফাঁদের মধ্যে একটা পাখি, ভারী সুন্দর রঙীন পালকে ঢাকা তার গা, ডানা ঝটপট করছে সে ফাঁদের মধ্যে। উপরে আরো কয়েকটা পাখি চক্কর কেটে উড়ছে, ডাকছে। এইসব পাখিগুলোই চোর তবে? ফাঁদে পড়া পাখিটাকে রাখাল ফাঁদ থেকে খুলে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে, "কী, আমার ক্ষেত থেকে আর চুরি করবি? আজ তোকে পুড়িয়ে খাবো।" পাখিটা অসহায়ভাবে একটু ঝটপট করতে চেষ্টা করে তারপরে চোখ বুজে এলিয়ে পড়ে।

পাখিটার ডানদিকের ডানায় একটা ঘন লালচেবাদামী রঙের বড় পালক, সোনালী-সাদা ডানার উপরে লালবাদামী পালকটা খুবই ঝলমল করছে বড় আর উজ্জ্বল বলে। রাখাল ভাবলো এটা খুলে নিয়ে একটা বাঁশের ডগায় আটকে আমার ক্ষেতের পাশে পুঁতে দেবো। ভয়ে অন্য চোরপাখিরা আর আসবে না। এই ভেবে যেই না সে ঐ পালকটা খুলে নিয়েছে, অমনি কী কান্ড! সে দ্যাখে তার বন্দী পাখি আর নেই। তার জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে এক অপরূপ সুন্দরী মেয়ে, সে মেয়ে হাঁপুসনয়নে কাঁদতে কাঁদতে বলে, " পালকটা ফেরত দাও দয়া করে। ওটা যাদুপালক। ওটা ছাড়া আমি আর পাখি হয়ে উড়ে যেতে পারবো না। "

রাখাল তো একেবারে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে খানিকক্ষণ শুধু এত বড় বড় চোখ করে চেয়েই রইলো, কিছু বলতে পারলো না। ছিলো পাখি, হয়ে গেল মানুষ! তা আবার এমন সুন্দরী মেয়ে একটা। এত সুন্দর মানুষ হয়?

একটু সামলে ধাতস্থ হয়ে নিয়ে সে বললো, "কে তুমি? কোথায় থাকো ? "

চোখ মুছে মেয়েটা বলে, " আমি মেঘবতী। ঐ উপরে মেঘের ওপারে আমাদের রাজ্য। আমার বাবা সে রাজ্যের রাজা। ঐ যে উপরে পাখিগুলো উড়ছে ওরা সবাই আমার সখী আর পারিচারিকা। এখন সবাই পাখিবেশে আছে। আমরা সবাই গতরাত্রে পাখি হয়ে পৃথিবীতে বেড়াতে এসেছিলাম। বেশ কয়েক রাত ধরেই আসি। তোমার ছোট্টো ক্ষেতটা খুব ভালো লেগেছে আমাদের, কেমন টকটক মিষ্টি মিষ্টি আঙুর-টোমাটো হয়েছে! ওগুলো চুরি করতে গিয়েই তো---উঁ উঁ। পায়ে পড়ি তোমার, ছেড়ে দাও গো আমায়। পালকটা দাও, পাখি হয়ে চলে যাই। শপথ করে বলি, আর কোনোদিন চুরি করতে আসবো না। "

"আহা, ছেড়ে দাও বললেই হোলো আরকি! কেন ছাড়বো? আমার এত কষ্টের ক্ষেত! তোমাকে আমার এখানেই বন্দী থাকতে হবে। চাও আর না চাও থাকতেই হবে, বুঝলে মেঘবতী?"

মেঘবতী অনেক কাঁদলো, মিনতি করলো, কিন্তু রাখাল ছাড়বে না। অগত্যা মেঘবতী রয়েই গেল রাখালের কুটিরে। রাখাল চাষবাস ঝুড়িবোনা এসব করে, হাটে যায় আর মেঘবতী রাঁধে, ঘর গোছায়, উঠান ঝাড় দেয়, আর টুকিটাকি নানা কাজ করে। দেখতে দেখতে রাখাল আর মেঘবতীর দিব্যি বন্ধুত্ব হয়ে যায়।

ওদিকে মেঘবতীর সখীরা ফিরে গিয়ে মেঘরাজকে সব জানিয়েছে। রাজা তো শুনে রেগে আগুন। কী, পৃথিবীর মানুষ কিনা মেঘরাজ্যের রাজকন্যাকে বন্দী করেছে! ব্যাটাকে সাবাড় করা দরকার!

রাজা দুই গুপ্তচর পাঠালো, তাদের থলিতে লুকানো রইলো তেজালো বিষ। এই গুপ্তচরেরা বনের এক কাঠঠোকরা আর ইঁদুরের সঙ্গে দোস্তি করে নিয়ে ওদের বুঝিয়ে দিলো কী করতে হবে। বললো ওরা আগে রাখাল আর মেঘবতীর সঙ্গে বন্ধুত্বের ভান করে ওদের ঘরে যাতায়াতের ব্যবস্থা করে নেবে। তারপরে তাক বুঝে একদিন রাখালের খাবারে দেবে বিষ মিশিয়ে।

কাঠঠোকরা আর ইঁদুর সব বুঝে নিয়ে সঙ্গে করে বিষ লুকিয়ে নিয়ে এসে রাখালের কুটিরের কাছে এসে বাসা বাঁধলো। আস্তে আস্তে ওদের সঙ্গে পরিচয় করলো, বন্ধুত্ব তৈরী করলো, ঘন ঘন যাতায়াত করতে থাকলো। কিন্তু বিষ মেশাতে পারলো না খাবারে, রাখাল আর মেঘবতী দু'জনকেই ওরা সত্যি সত্যি ভালোবাসতে শুরু করেছিলো। গুপ্তচরেদের সঙ্গে দেখা করে সাফ সাফ বলে দিলো, "এই পাপকাজ আমরা করতে পারবো না। কেন তোমরা ওই ভালো মানুষটাকে মারতে চাও? তোমাদের রাজকন্যের সঙ্গে ওকে বিয়ে দিয়ে দিলেই তো সব গোলমাল চুকে যায়, কন্যাও তো খুবই ইচ্ছুক বলেই মনে হয়। "

গুপ্তচরেরা শিউরে উঠে কান চাপা দেয়, পৃথিবীর মানুষের সঙ্গে মেঘরাজ্যের মানুষের বিয়ে হতেই পারে না, বংশমর্যাদা ঐতিহ্য পাপপুণ্য ধর্মাধর্ম এইসব হাজারো ব্যাপার আছে না?

(পরের বারে সমাপ্য )


মন্তব্য

তারেক অণু এর ছবি

চলুক ভাল লাগছে,
যদিও সোয়াজিল্যান্ডের রাজার উপরে এখনো মহা চটে আছি, কিন্তু সেখানকার গল্প উপভোগে এক পায়ে খাড়া।

তুলিরেখা এর ছবি

আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের লোককথা আর উপকথাগুলো অসাধারণ। সহজ সরল সব ঘটনা থেকে কেমন করে অদ্ভুত সুন্দর সব ‌ফ্যা্ন্টাসির মধ্যে চলে যায়, সোজাসরল কথা বলতে বলতে গভীর কত কথা জানিয়ে দেয়।

ভালো আছেন? সামনের কোনো মাসেই আবার দূরে কোথাও যাবার প্ল্যান কষছেন? হাসি

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

ভাল লাগছে, বাচ্চাকে শোনানো যাবে।

"ফায়ার " জাতীয় শব্দ এরকম গল্পে একটু বেমানান লাগলো হাসি

তুলিরেখা এর ছবি

ধন্যবাদ।
"রেগে আগুন" করে দেবো এডিট অপশনটা ফিরে পেলেই। হাসি

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

চমৎকার হবে। হাসি

সত্যপীর এর ছবি

ঠিকই বলেছেন, আমাদের গল্পের সাথে আশ্চর্য মিল। বলে না দিলে বাংলা গল্পই মনে হত। আরো অনেক আসুক!

..................................................................
#Banshibir.

তুলিরেখা এর ছবি

অনেক মিল। চাষবাস, কুটির, গ্রাম, গরুবাছুর, ইঁদুর, কাঠঠোকরা---সব নিয়ে যেন বাংলার গ্রাম। হাসি

আপনার সেই "অল ইউ ক্যান ইট মুড়কি হাঁড়ি"র মতন গল্প আর দিবেন না?

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

সত্যপীর এর ছবি

হাহা নিচ্চয় দিব তুলি আপু। দুইটা সিরিজ শুরু করলাম একসাথে এই সপ্তায়, একটু ধরে এলেই আবার লোককাহিনী দিব। তাই বলে আপনি আমার মত লেট লতিফ হয়েননা, রেগুলার গল্প চাই।

..................................................................
#Banshibir.

ধুসর গোধূলি এর ছবি

ঘুমানোর আগে গল্প শোনা আমার ছোটবেলার অভ্যাস। অভ্যাসটার চর্চা না থাকলেও এখন আমার ঘুমাতে যাবার সময়... আর এখনই রূপকথাটা পড়লাম! হাসি

তুলিরেখা এর ছবি

আরে হ্যাঁ, আপনি তো আগেও নায়নাতিনদের শোনাবার জন্য এইসব গল্প শুনে জমা করে রাখতেন। হাসি

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

অনিন্দিতা চৌধুরী এর ছবি

আহ্! তুলিরেখা , কতদিন পর এলেন!
কতদিন আপনার এই গল্প পড়া হয় না।
আর কত বইমেলা অপেক্ষা করতে হবে?বই কবে বেরুবে ? মন খারাপ

তুলিরেখা এর ছবি

সেই।
মাঝখানে ছেদ পড়ে গেছিলো, লেখাটেখা কেন জানি আর পারতাম না। মন খারাপ
এখন আবার শুরু করলেও আগের খেই এখনো পাই নি, হিসাব টিসাবও সব হারিয়ে গেছে।
তবে স্পনসর পান্ডবদা আর স্নিগ্ধা ঠাকুমা আছেন, ওনারা ঠিকই হিসাব রাখছেন। হাসি
স্নিগ্ধা বহুদিন আসেন না, ওনার কোনো খবর জানেন?

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

তদানিন্তন পাঁঠা এর ছবি

যাহ। মাত্র এইটুকু? মন খারাপ তাড়াতাড়ি পরের পর্ব আসুক।

তুলিরেখা এর ছবি

আসবে, আসবে শিগগীরই। হাসি
ভেবেছিলাম পুরোটা করেই একবারে দেবো, কিন্তু কালকে সময়ে কুলালো না।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

বাহ!
ভালো লাগল।
পরের পর্বের অপেক্ষায়......

তুলিরেখা এর ছবি

ধন্যবাদ।
শীগগীরই বাকি অংশটা দিতে পারবো আশা করছি।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

Jajaria এর ছবি

Good

তুলিরেখা এর ছবি

Thanks.

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

সচল জাহিদ এর ছবি

আমার ছেলে প্রায়ই বায়না ধরে রূপকথার গল্পের। এক্ষেত্রে তুলিদিই ভরসা।


এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ অভ্র।

তুলিরেখা এর ছবি

একটা বিষয় দেখুন কী আশ্চর্য! একদম ছোটোদের রূপকথা ভালো লাগে, একটু বড় হয়ে কৈশোরে ডিটেকটিভ গল্প বা সাই-ফাই বা ঢিসুম ঢিসুম। তারপরে আরো বড় হয়ে আবার অনেকের সেই পুরানো রূপকথার কাছে ফিরে আসতে ইচ্ছে হয় তখন রূপকথার ভিতরের হৃদয় বুঝতে পারা যায় বলে। হাসি

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

অনিন্দিতা চৌধুরী এর ছবি

স্নিগ্ধার খবর আমিও জানি না। হয়ত ব্যস্ত আছেন।
জানেন আপনার আজকের লেখা পড়তে গিয়ে আমারও মনে হচ্ছিল কী এক প্রচন্ড ভাললাগা কাজ করছে এই রূপকথাগুলোয়। সময়ে তা মোটেও বদলায় নি।

তুলিরেখা এর ছবি

স্নিগ্ধাকে মিস করি, ওঁর লেখাগুলোকেও।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।