নাগরাজ থাকতো এক বিরাট জলাশয়ে, গভীর সেই জলাশয়ের নিচে পাথুরে গুহায় সে থাকতো, তাকে দিনের বেলা দেখা যেতো না। কিন্তু রাতে সে উঠে এসে চারিপাশের গ্রামের গরু ছাগল ইত্যাদি তো ধরে নিয়ে যেতোই, মানুষের শিশুদেরও ধরে নিয়ে যেতো। আক্রমণের সময় তার ভয়াবহ চেহারা দেখে লোকে আতঙ্কে নীল হয়ে যেতো, বাধা দেওয়া তো দূরস্থান। সে দিনে দিনে সব লোকের কাছে হয়ে উঠলো মূর্তিমান বিভীষিকা, তার ধ্বংসতান্ডবে হাহাকার পড়ে গেলো গ্রামে গ্রামে।
করুণাময়ী জীবনদেবী বেন্তেন এইসব দেখেশুনে খুব রেগে গেল, কতদিন আর এই ধ্বংসলীলা চোখে দেখা যায়? বেন্তেন নাগরাজের জলাশয়ের পাশের গ্রামে প্রস্তুত হয়ে অপেক্ষা করতে থাকলো, নাগরাজ আক্রমণ করলেই তার সাথে যুদ্ধ করে তাকে সাবাড় করবে বলে।
বেন্তেন অপেক্ষা করে, কিন্তু নাগের দেখা পায় না। পরপর তিনরাত কেটে যায়, নাগরাজকে দেখা যাচ্ছে না, বেন্তেন খুব রেগে গেলো। ভাবলো, ব্যাটা জানতে পেরেছে নাকি কোনো সূত্রে? "দাঁড়াও দেখাই মজা," বলে দেবী ভয়ানক ভূমিকম্প ঘটিয়ে নাগরাজের জলাশয় তোলপাড় করে তুললো, তারপরে মেঘে চেপে জলাশয়ের পাড়ে এসে নামলো। হুংকার দিয়ে বললো, "কই হে নাগরাজ, লুকিয়ে কেন? বেরোও তোমার গর্ত থেকে, আজকে তোমাকে কেটে পঞ্চাশ টুকরো যদি না করেছি তো আমার নাম বেন্তেন নয়।"
নাগরাজ বেরোলো, সে দেখতে ছিলো খুব সাংঘাতিক, ইয়া বিশাল চেহারা, সারা গায়ে কাঁটা কাঁটা আঁশ, চেরা জিভ লকলক করছে। বেন্তেনের তো তাকে দেখেই খুব বিচ্ছিরি লাগলো, একেই এত বিচ্ছিরি, তার উপরে আবার এত অত্যাচার করেছে। আজই ওর শেষদিন, ভাবলো দেবী।
কিন্তু নাগরাজের সর্পচক্ষুতে জিঘাংসা ছিলো না, চোখ দুটো খুব ক্লান্ত, লালচে। আস্তে আস্তে আসছিলো সে, যেন ঠিক সুস্থ নয়। বেন্তেনের সামনে এসে খুব ধীর ক্লান্ত গলায় বললো, "ঠিক আছে, মেরে ফ্যালো। যুদ্ধ করতে হবে কি? আমি খুব ক্লান্ত আজকে, পারবো না ভালো করে লড়তে। তুমি এমনি ই মেরে ফ্যালো। আমার আপন বলতে কেউ নেই, কেউ দুঃখ পাবে না আমি না থাকলে। বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য সংগ্রহ করতে হতো, তাই গ্রাম থেকে ---ওরা কষ্ট পেতো, আমি কীই বা করতে পারতাম? আমি তখন বুঝতে পারিনি, এখন বুঝতে পারছি সমাধান তো ছিলো, আমি না খেয়ে মরে গেলেই সমাধান হতো সমস্যার। বেন্তেন, কই দেবী, তোমার অস্ত্র কই? আমি প্রস্তুত, নাও গলাটা কেটে ফ্যালো।"
নাগরাজ চোখ বুজে ফণা নামিয়ে শুয়ে পড়লো, সে সত্যি খুব ক্লান্ত। বেশ ক'দিন সে উপবাসী, এমনিতেই মনে করেছিলো না খেয়ে মরে যাবে।
বেন্তেনের মনটা কেমন করতে লাগলো, সত্যি তো কেমন অসহায় দেখাচ্ছে নাগরাজকে। কেমন রোগা মতন, খায় নি নাকি ক'দিন? শান্ত আত্মসমর্পণের মতন পায়ের কাছে পড়ে আছে, চোখ বুজে শুয়ে আছে ফণাটা মাটিতে রেখে। ওর পিঠের উপরে কতগুলো ক্ষত, রক্তাক্ত। আহা, কেটে গেছিলো নাকি?
বেন্তেন নতজানু হয়ে বসলো ওর পাশে, খুব সাবধানে ওর ঘাড়ের কাছে হাত রাখলো। বললো, "নাগরাজ, ওঠো।"
চোখ মেলে নাগরাজ বলে, "কী? মারবে না? বুঝেছি, এমনি এমনি মারতে তোমার সঙ্কোচ হচ্ছে, লড়াই করতে হবে। তিনদিন কিছু খাই নি, পারবো না লড়াই করতে। এমনিই মেরে ফ্যালো, আমি কিছু মনে করবো না। এমনিতেই তো মরে যাচ্ছিলাম, অনেকদিন লাগতো আরকি। এখন তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে। এই ঘৃণিত জীবন বহন করতে আর ভালো লাগে না। দেবী, আমাকে মেরে ফ্যালো, আমি বাঁচি।"
বেন্তেন ঝরঝর করে কাঁদতে লাগলো, নাগরাজের ফণায় হাত বোলাতে বোলাতে বললো, " তোমাকে মারবো না নাগরাজ, আমার সঙ্গে চলো, আমার সঙ্গে থাকবে, তোমাকে আমি বিবাহ করবো।"
নাগরাজ খুব ব্যথার হাসি হেসে বলে, "ঠাট্টা করছো? কী হবে আমাকে ঠাট্টা করে? আমি তো মরার জন্য তৈরী হয়ে আছি। "
বেন্তেন বলে, "না, ঠাট্টা নয়। তুমি ভুলে গেছ, তুমি শাপভ্রষ্ট হয়ে এইখানে নাগ হয়ে রয়েছ, শাপমুক্তি হবে এইবার তোমার। চলো আমার সঙ্গে, স্বর্গে ।"
নাগরাজ শাপমুক্ত হয়ে দিব্যদেহ পেয়ে গেল আর বেন্তেনের সঙ্গে স্বর্গে গেলো। সেখানে মহাধূমধামে তাদের বিবাহ হলো। অতঃপর তারা সুখেশান্তিতে বসবাস করতে লাগলো।
ডিসক্লেমারঃ ঘটনা এইরকমই ঘটেছিলো, কিন্তু মূল গল্পে এদের মধ্যকার কথোপকথনের ব্যাপারটা পাই নি, একটা যুক্তিসঙ্গত কথাবার্তা জুড়ে দিলাম আরকি। ঃ-)
মন্তব্য
শুরুর আগেই শেষ হয়ে গেল
এই গল্পটা আসলে বেশ ছোটোই, তবু কিছু কথাবার্তা জুড়ে বাড়ানো গেছে খানিক।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
খুব ইন্টারেস্টিং লাগল। জাপানে বিরাট আকারের সাপ নিয়ে গল্প বেশ আগ্রহ উদ্দীপক।
সাধারণত যেসব জায়গায় বড় সাপ পাওয়া যায় যেমন - দক্ষিণ আমেরিকার অ্যানাকোন্ডা, উপমহাদেশের রেটিকুলেটেড পাইথন সে সব জায়গায় নাগরাজ বা বড় সাপ নিয়ে ফোক অনেক গল্প থাকে। জাপানে কী ওরকম বড় কোন স্পিশিজ আছে বা ছিল?
সংযোজন -
আরেকটা বিষয় আমাকে খুব ভাবায়। এ ধরনের বড় সাপ আসলে অ্যাম্বুশ হান্টার, ওঁৎ পেতে শিকার ধরার কথা। কিন্তু বিভিন্ন উপকথাতে উল্লেখ পাই বি-রা-ট সাপ তেড়ে এসে ধরে নিয়ে যায় - ব্যাপারটা বেশ খটকার।
------------------------
[ওয়েবসাইট] [ফেইসবুক] [ফ্লিকার ]
আপনার মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ। এই গল্পে আসলে সমুদ্রের বা হ্রদের একটা ব্যপারও রয়েছে, নাগরাজ হ্রদের জলের নিচে থাকতো। নাগরাজকে পুরোপুরি সাপও বলা ঠিক যায় না, খানিকটা কুমীর কুমীর ড্রাগন ড্রাগন ফ্লেভারও আছে। জাপানে কিন্তু ড্রাগনরাজের গল্প বিরাট পপুলার লোককথা, বিরাট তার প্রাসাদ, মহাসাগরের তলায়, তিনি খুব সজ্জনও, জলে ডুবে মরে যাওয়া নাবিকদের নিজের রাজ্যে সমাদরে নিয়ে নেন প্রজা হিসাবে।
নাগদের নিয়ে লোককথাগুলো বেশ রহস্যময়। উপমহাদেশে প্রচুর আছে নাগকুমার ও নাগকন্যাদের গল্প। কোথাও কোথাও নাগকুমাররা এমন সুন্দর দেখতে আর এত ভালো ব্যব হার যে স্বর্গের কন্যাদের সাথে তাদের বিবাহ হয়। একজনকে তো গরুড় হত্যা করতে এসেছিলো, বিবাহের আগেই, স্বর্গকন্যা তখন তাকে সারারাত জাপটে ধরে রেখে বাঁচিয়ে দিলো, গরুড় থাবা দিতে পারলো না, তাইলে কন্যাটিকে আগে মারতে হতো। সকালবেলা ব্যর্থ হয়ে ফেরার সময় গরুড় খুব রেগে মরাল পুলিশের মতন বকে গেল সেই স্বর্গকন্যাকে, বললো "ছি ছি লজ্জা নেই তোমার? এত বড় বংশের মেয়ে হয়ে এ কী ব্যবহার?"
খুবই ইন্টারেস্টিং সব গল্প।
রুশ উপকথাতেও নাগদের গল্প অনেক, তারা আবার ডানাওয়ালা, উড়তে ও পারে।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
আর আছে নানা রূপে বিশালকায় গিরগিটির গল্প, প্রায় সব অঞ্চলেই।
facebook
ঠিক বলেছেন। ইয়া বিশাল চেহারা হতো তাদের, পিঠে তিনকোণা তিনকোণা কাটা কাটা মতন বসানো, বিশাল লেজ, থাবায় বড় বড় নখর---এইরকমের চেহারার উপরে কারু কারু আবার বিরাট বিরাট ডানা থাকতো। এদের অনেকের আবার খুব বড়লোক অবস্থা, ধনরত্ন ভর্তি প্রাসাদে থাকতো।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
খুবই দয়ালু জীবনদেবী বলতে হবে। তবে এই সাধারন ক্ষমাপ্রদর্শন নাগরাজের ভূতপূর্ব শিকার ছোট শিশুদের পিতামাতাদের সুনজরে দেখার কথা না
..................................................................
#Banshibir.
সে আর বলতে!
হাঁসমুরগী বাপমায়েরাই কি আর ডিমচোর আমাদের সুনজরে দ্যাখে?
তবে নাগরাজের মনে হয় দেহান্ত হলোই হরেদরে, কারণ সে তো স্বর্গে গেল, নইলে বেন্তেনের সাথে বিবাহ হবে কী করে?
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
"হাঁসমুরগী বাপমায়েরাই কি আর ডিমচোর আমাদের সুনজরে দ্যাখে?"
..................................................................
#Banshibir.
তবে?
আপনার সেই আওরংগজেব আর শিবাজীর গল্পের দ্বিতীয় পর্বের আশায় আছি।
এদিকে "তারাবাঈ" বলে এক উপন্যাসে আফজল খাঁ কে খুবই পরম রূপবান, শক্তিমান এইরকম করে বর্ণনা করা ছিলো, তো আমি ভাবলাম কী না জানি, কিন্তু আপনার ভিডোব্লগের ছবিতে তেমন সুন্দর তো কই দেখা গেল না!
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
ভিড্যু ব্লগ আটকে আছে মাইক্রোফোনের জন্য, আমারটা একদম যা তা। নতুন একটা চমৎকার মাইক্রোফোন অর্ডার দিসি, ওইটা আসলে পরের পর্বের কাজ ধরব তুলিদি
..................................................................
#Banshibir.
এদিকে আমি কিছুদিন যাবত বাংলার ইতিহাস খুঁজছি, সেই সেনেদের আমলের গৌড় থেকে শুরু করে---সেই বখতিয়ারের সময়ের---ঐ সময়ের পরিষ্কার ইতিহাস কি পাওয়া যায়? উপন্যাস টুপন্যাস তো কিছু আছে, ঠিক আনবায়াসড নয়, কিন্তু জানতে ইচ্ছে হয়, ঐভাবে বুড়ো রাজা পালালো এদিকে ইনভেডাররা ঢুকে গেছে, লুটপাট হলো, লোকজন মরলো, কিন্তু তারপরে সাধারণ লোকের অবস্থা স্টেবিলাইজ করলো কী করে? রাজা নাহয় বুড়ো ছিলো, কিন্তু তার কি ছেলেপিলে ভাইপো টাইপো কি ঐরকম সব যুবকেরা ছিলো না? সেনাপতিরা? তারা কী করছিলো? ঐ সময়টা নিয়ে একটা পোস্ট দিবেন?
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
আমার মূল আগ্রহ ঔপনিবেশিক আর মোগল ভারতবর্ষ, এই মূহুর্তে ড্যানিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আর জাহানারাকে নিয়ে দুটা পোস্ট দেবার হোমওয়ার্ক করছি। আপনি যে সময়টা খুঁজছেন ওই সময় নিয়ে পাণ্ডবদার একটা পোস্ট আছে, না পড়া থাকলে পড়ে নিতে পারেন। এইটা নিয়ে পোস্ট অদূর ভবিষ্যতে দিবার প্ল্যান নাই। দূর ভবিষ্যতের কথা কেই বা বলতে পারে
..................................................................
#Banshibir.
পান্ডবদার লেখাটার জন্য ধন্যবাদ, খুবই ভালো লেখা।
আর, জাহানারাকে নিয়ে বহুদিনের কৌতূহল, ভদ্রমহিলা কবিতা লিখতেন শুনেছি, রাজ্যশাসনের ব্যাপারেও নাকি স্কিল ছিলো, খুব ভালো লাগবে ওঁর কথা নিয়ে আপনি পোস্ট দিলে। নূরজাহান আর সুলতানা রিজিয়া (ইনি অবশ্য মোগল আমলের অনেক আগে) এই দুইজনকে ও খুব ইন্টারেস্টিং লাগে। নূরজাহানও কবিতা লিখতেন শুনেছি, আরো নানা সূক্ষ্মশিল্প কলাবিদ্যা আর রাজনীতি কূটনীতি তো বটেই--এসবেও নাকি দড় ছিলেন। আপনি পোস্ট দিলে দারুণ হয়।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
নূরজাহানের রান্নাঘরের তেলেসমাতি নিয়ে একটা অনুবাদ করব ভাবছিলাম, কিন্তু খাওয়াদাওয়া নিয়ে আবার পোস্ট দিলে মানুষ ধরে গণপিটুনি লাগাবে মনে হয়
জাহানারাকে নিয়ে পোস্ট দীর্ঘ হবে মনে হচ্ছে, ভারি চমৎকার একটা লেখা পেয়েছি
..................................................................
#Banshibir.
এখন জাহানারা বিষয়কই পোস্ট দ্যান, খাবারদাবারের পোস্ট সইত্য সইত্যই খিদা পাওয়াইয়া দ্যায়, বিদেশে বিভুইয়ে সেই এলাহী খানা সবসময় পাওয়া শক্ত।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
উপকথা চলুক। পড়ছি।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
ছোটদের জন্য ছোট্ট উপকথা...
ঠিক।
তবে উপকথা অনেক বড়রাও ভালোবাসেন।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
নতুন মন্তব্য করুন