১। একটা স্বপ্ন দেখছিলাম। স্বপ্ন , অথচ এত স্বাভাবিক ঘটনার মত আর এত স্পষ্ট যে স্বপ্ন বলে মনে হয় না প্রথমে। একটা কাহিনি, পরপর ঘটতে থাকা ঘটনামালা, ঠিক যেন একটা বহুমাত্রিক মুভি, ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে চরিত্র গুলোর মনের ভাবও যেন দেখা যাচ্ছে নানা রঙের আলোছায়ায়। গোলাপি-সোনালি আলোর আনন্দ, ধূসরাভ নীল আলোর বিষাদ, সবুজাভ আকাশি আলোর ভালোবাসা, গাঢ় লাল আলোর রাগ, লালচে বেগুনী আলোর অভিমান, কচিকলাপাতা রঙে শিশির দোলা আলোর করুণা। কখনো ঘটনা ঘটছে সমুদ্রের উপরে একটা জাহাজে, আবার কখনো ঘটছে ডাঙার উপরে।
তারপরে জেগে গেলাম, ঘরে হালকা ভোর-ভোর রঙ, উপরের জানালা দিয়ে চৌকো এক টুকরো নরম কমলা আলো পড়েছে দেয়ালে, সকাল হয়ে গেছে। প্রথমে একটা কেমন আধাঘুম আধাজাগা। অন্যদিকে পাশ ফিরে চোখ আবার বুজে ফেলতেই মনে পড়ে সমুদ্র আর ডাঙার সেই স্বপ্নকাহিনি। একটা দুলুনি, একটা কেমন টলটল দুলুনি আর একটা একলা জাহাজ জলের উপরে। নীল জলের উপরে ঝকঝকে রোদের হাজার হাজার হীরাকুচি, চোখ ধাঁধিয়ে যায়।
উঠে বসি। কী আশ্চর্য! এ কার গল্প? কোথা থেকে কেমন করে এলো স্বপ্নের মধ্যে? এ জিনিস কি লিখে ফেলা উচিত নয়? স্বপ্নের জার্নালে না, একেবারে গল্প হিসাবেই?
লিখি আর ছিঁড়ে ফেলে দিই। শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে বাক্য গড়ি, বাক্যের পর বাক্য সাজিয়ে যাই। কিন্তু কিছুতেই ফুটে ওঠে না সেই দুর্দান্ত কাহিনিটা, স্বপ্নের ভিতরে যেটা পড়ছিলাম। তখন কী জ্যান্ত লাগছিলো সব! এখন লিখতে গিয়ে শব্দগুলো যেন শব, কিছুতেই প্রাণসঞ্চার হয় না। তাহলে কি স্বপ্নের ভিতরে আমরা শব্দহীন বাক্যহীন কোনোরকম কথাবিহীন অন্যরকম কোনো ভাষায় বুঝতে পারি? সে ভাষা আমাদের চেনা যেকোনো ভাষার চেয়ে আরো অনেক জটিল অনেক সমৃদ্ধ অনেক প্রাণছোঁয়া?
তিনবার তিনখানা লেখা পাতা ছিঁড়ে ফেলে দিই। নিজের উপরে নিজের বিরক্তি আসে। থাক তাহলে। বরং আরেকটু ঘুমানো যাক। আজ তো রবিবার, সকালে ওঠার দরকার কী এত? সব রেখে আবার চাদর টেনে শুয়ে পড়ি। আর সেই দুলন্ত জাহাজটা চলতে থাকে।
একলা একটা জাহাজ, কেউ নেই তাতে। ভাসছে আর ভাসছে। ও কি আমাকে কিছু বলতে চায়? কিন্তু আমি তো মৌপিয়া না, আমি তো তমালী। শ্রবণ তো আমার না, সে তো মৌয়ের। আমি তো ঘুণাক্ষরেও কোনোদিন কাউকে জানাইনি শ্রবণকে আমার কেমন লাগতো, আমি মনে মনে কী চাইতাম? কাউকে তা জানানোর নয়, শ্রবণ মৌপিয়া দু'জনেই যে আমার খুব বন্ধু, ওরা দু'জনেই যে আমাকে বিশ্বাস করে। কেমন করে সে বিশ্বাসটুকু ভেঙে দিতাম? যদি দিতাম, তাহলে মানুষজন্মের মানে কী থাকতো?
ওদের প্রেমের ব্যাপারটা খুব সাবধানে লুকানো ছিলো মৌপিয়ার বাবা মা আর দাদার কাছ থেকে, জানাজানি হলেই নাকি মৌকে ওর পিসির বাড়ি পাঠিয়ে দেবেন ওঁরা। মেয়ের এই স্বাধীনভাবে প্রেমিক বেছে নেওয়া ওঁরা একেবারেই মেনে নিতে পারবেন না। তার উপর আবার পাশের বাড়ীর ছেলের সঙ্গে! কী সর্বনাশ!
মৌপিয়ার জন্য নাকি পাত্র ওঁরা নিজেরা ঠিক করে রেখেছিলেন, বিরাট বড়লোকের একমাত্র ছেলে। মৌয়ের পিসি-পিসেমশাইদের পারিবারিক বন্ধু নাকি সেই পরিবার। ভাবা যায়? এই একবিংশ শতাব্দীতে এইরকম ব্যাপার?
শ্রবণ যখন ট্রেনিং এ গেল তখন মৌপিয়া ওকে প্রতি সপ্তাহে চিঠি লিখতো, আমি সেই চিঠিগুলোর বানান দেখে দিতাম মৌয়ের অনুরোধে, মাঝে মাঝে যুগিয়ে দিতাম লাগসই কোটেশন। মৌ এতটাই বন্ধু ছিলো আমার। শ্রবণের লেখা উত্তর আসতো আমাদের ঠিকানায়, খামের উপরে আমার নামঠিকানা, ভিতরে আলাদা খামে মৌপিয়ার নাম। ওকে গোপণে সেইসব চিঠি আমি দিয়ে আসতাম, এইসব চিঠি মৌদের বাড়ির আর কারুর হাতে পড়লে সাড়ে সর্বনাশ!
দু'বছর পরে যখন ওদের রেজিস্ট্রি ম্যারেজ হলো তখন সাক্ষী হিসাবে আমি থাকতে পারি নি বলে শ্রবণ আর মৌ পরে কত অভিমান করে চিঠি লিখলো। কিন্তু আমি তো তখন ও শহরেই নেই! আমি তো তখন চাকরি নিয়ে দূরের পাহাড়ী শহরে। ওদের বিয়ের অভিনন্দন জানিয়ে লিখেছিলাম, উপহারও পাঠিয়েছিলাম সাধ্যমত, তাতে কি কোনো সূক্ষ্ম ঈর্ষার বীজ লেগে ছিলো আমার অজান্তে?
মনের কথা মন নিজেও জানে না সবটা, কিন্তু কাজে তো কখনো ভুল হয় নি আমার! তবে? তবে কেন ওদের সংসারে দু:খ এলো? কেন এত সাধের গোছানো ঘর ভালোবাসার স্বামীসন্তান ছেড়ে মৌপিয়া সেখানে চলে গেল যেখান থেকে কেউ ফেরে না? মৌপিয়া, মৌ, কোথায় চলে গেলি তুই, আমার ছোট্টোবেলার সই?
নিজেকেও দুলন্ত লাগে, ঠিক যেন সেই জাহাজটাতে দাঁড়িয়ে আছি। মনে পড়ে একটা আশ্চর্য রাত্রি, আকাশভর্তি তারা ঝমঝম করা রাত্রি। খোলা মাঠের পাশে আমাদের বাড়ি, সেই বাড়ির তিনতলার ছাদ থেকে আকাশ দেখছি আমরা। ছাদের চারিপাশে কেবল উঁচু উঁচু গাছের মাথা, আর সেখানে জ্বলছে অসংখ্য জোনাকি, মাথার উপরে আকাশে তারা আর তারা, দপদপ করে জ্বলছে। মৌপিয়া গাইছে, " আকাশভরা সূর্য তারা বিশ্বভরা প্রাণ--", আহ, কী গভীর ঐশ্বর্যময় সুর যে ছিলো ওর গলায়!
২।
শ্রবণ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিলো, দুলন্ত জানালা। জাহাজ দুলছে, জলের ঝাপটা এসে ডেক ভাসিয়ে দিচ্ছে। উপরের এই জানালা দিয়ে এই অদ্ভুত রাত্রে সব কত অন্যরকম লাগছে! কেমন একটা আবছা-আবছা ঘোলাটে জ্যোৎস্না, সমুদ্রকে মনে হচ্ছে একটা দুলন্ত বালিয়াড়ি, উপরে ঝুলে থাকা চাঁদটা যেন রহস্যময় একটা অন্য জগতের আভাস! আমাদের চেনা জানা দৈর্ঘ্য প্রস্থ উচ্চতার বাইরের অন্য কোনো গহীন গোপণ জগৎ! তেমন জগৎ কি নেই?
বিকেলে ওদের ছাদের উপরে মাদুর বিছিয়ে বসে হারমোনিয়ম বাজিয়ে মৌপিয়া গান গাইতো। পাশের ছাদটাই ছিলো শ্রবণদের বাড়ীর ছাদ। পাড়ায় তখন দোতলা বাড়ী মাত্র দুটো, শ্রবণদের আর মৌপিয়াদের। শ্রবণ বিকেলে একটা বই নিয়ে ফুলের টবগুলোর কাছে যেখানে সিমেন্টের বেঞ্চগুলো, সেগুলোর কোনো একটার উপরে বসে বই পড়তো। আসলে বইপড়ার আছিলায় মৌপিয়ার গান শোনা হতো আর মাঝে মাঝে ওকে দেখাও হতো। পাশাপাশি বাড়ীর দুটো ছেলেমেয়ে তারা, কিন্তু ভালোছেলে হিসাবে শ্রবণ পরিচিত, মৌপিয়াও খুব সিরিয়াস ধরনের মেয়ে, ওরা যে পরস্পরের প্রেমে পড়তে পারে এ নিয়ে কেউ কোনো সন্দেহমাত্র করেনি।
বিকেল আস্তে আস্তে সন্ধ্যায় গড়িয়ে যেতো, গান শেষ করে কখন যেন নিচে নেমে যেতো মৌপিয়া, শ্রবণ বসেই থাকতো। জটিল বিজ্ঞান যে মহাবিশ্বের খবর দিতো তার হাতের বইয়ের মাধ্যমে, আর মাথার উপরে আঁধার আকাশে ঝিকিমিকি যে তারাগুলো ফুটে উঠে আরো রহস্যময় জটিলতর জগতের কথা বলতো, এই দুইয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য করতে গিয়ে তার মন ক্লান্ত হয়ে পড়তো। সেই ক্লান্তির মধ্যে স্নিগ্ধ শান্তির মতন ফুটে উঠতো মৌপিয়ার মুখ।
একসময় গল্পের বই বিনিময় শুরু হয়েছিলো, কেমন করে শুরু হয়েছিলো এটা তাও শ্রবণের মনে আছে। একদিন বিকালে মৌপিয়া গানটান না গেয়ে ছাদের কিনারে এসে ডেকেছিলো, "শ্রবণদা, কী বই পড়ছো?"
শ্রবণ বই থেকে মুখ তুলে উঠে দাঁড়িয়েছিলো, ছাদের কিনারে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলো মৌপিয়ার মুখোমুখি। হাতের বইটা তুলে দেখিয়ে বলেছিলো, "কণিকা থেকে নীহারিকা। একবার পড়া হয়ে গেছে আমার, আবার পড়ছি। তুই পড়বি? নিতে পারিস, ক'দিন পরে ফিরিয়ে দিলেই হবে।"
মৌপিয়া হাত বাড়িয়ে নিয়েছিলো, বইটা উলটে পালটে দেখতে দেখতে বলেছিলো, "শ্রবণদা, তুমি কেবল এইসব জ্ঞান বিজ্ঞানের বই পড়ো? গল্পের বই পড়ো না?"
শ্রবণ হেসে ফেলেছিলো, "পড়ি তো, তোর কাছে আছে কোনো ভালো গল্পের বই?"
মৌ বলেছিলো, "আছে, কালকে এনে দেবো। "
পরেরদিন বিকালে মৌ এনে দিয়েছিলো, সুন্দর একটা নতুন রূপকথা, "রহস্যমিনারের পাখি"।
প্রথম প্রথম শুধু বই ই দেওয়া নেওয়া হতো দু'জনের, তারপরে বইয়ের ভিতরে ছোটো ছোটো চিরকুট, সঙ্কেতে লেখা। মাঝে মাঝে ধাঁধা বিনিময় করতো তারা, এটায় বেশি উৎসাহ ছিলো শ্রবণের, ধাঁধা দিতে আর সমাধান করতে খুব ভালোবাসতো সে সেকালে।
জ্জ্জজজ। চমকে ওঠে শ্রবণ। সেই ভোমরাটা !!!! শ্রবণের মুখের সামনে দিয়ে ঘুরে গেল বিদ্যুতের মতন। কোথা থেকে আসে ও? কোথায় মিলিয়ে যায়? ঝিম ঝিম করে আসে শ্রবণের সব অনুভূতি! ও এলেই এরকম হয়। এখন খানিকটা সময়খন্ড হারিয়ে যাবে তার চেতনা থেকে, সে জানে। আহ, ঘুম, ঘুম, ঘুম। তবু যেন ঘুম নয়, তবু যেন জেগে থাকে তার মনের ভিতরে কোনো অন্য মন, গহীন গোপণে রত্নের মতন যে রেখে দেবে অলৌকিক স্মৃতি।
ভোমরাটা দূর থেকে পাক খেয়ে ঘুরে আসছে শ্রবণের কপালের দিকে, ঝিকমিক করছে তার মাথা, বুক, পেট, ডানা-সবকিছু। যেন বিন্দু বিন্দু আলো লাগানো। শ্রবণ প্রাণপণে জেগে থাকতে চাইছে, পারছে না।
ভোমরাটা আরো কাছে, আরো কাছে, বোঁ করে ঘুরে গেল শ্রবণের কপালের এত কাছ দিয়ে যে ডানার প্রান্ত ছুঁয়ে গেল কপালের চামড়া। ওর দু'চোখের পাতা আঠালো ঘুমে বন্ধ হয়ে আসে। আহ, কেন ঘুম আসে এত? সে জেগে থাকতে চায়, জানতে চায় কী এ? এ কি শুধু ভোমরা?
জেগে থাকতে পারছে না শ্রবণ, ঘুমে জড়িয়ে যাচ্ছে সবটুকু চেতনা। আলো-ঝিকঝিক ভোমরা এসে শ্রবণের কপালে বসেছে, শ্রবণ তখন লুটিয়ে পড়েছে মেঝেয়। গভীর ঘুম, ঘুম ঘুম ঘুম।
গভীর ঘুমে অসাড় হয়ে পড়ে আছে শ্রবণের দেহ, তার চেতনা একটা হালকা একটা সবুজাভ গোলাপী আলোর মধ্য দিয়ে এখন ভেসে যাচ্ছে, স্বপ্নের মত। উড়ে যেতে যেতে একটা নীলচে বিষাদ ছুঁয়ে থাকে শ্রবণের মন, স্বপ্নের তো তবু কিছু মনে থাকে, এর একটু স্মৃতিও কেন থাকে না জেগে উঠলে?
৩।
তমালী-ঈঈঈ, তমালী-ঈঈঈ, তমালী-ঈঈঈ, ---কে যেন ডাকছে। কে ডাকছে? কেন ডাকছে?
নীল সমুদ্রে একলা জাহাজ দুলছে, সেই জাহাজের ডেকে আর খালি কেবিন গুলোতে ঘুরে বেড়াচ্ছি, কাকে খুঁজছি তাও জানি না, তবু ঘুরছি আর ঘুরছি, ঘুরে ঘুরে একই জায়গায় ফেরত আসছি, ডেকের উপরে, সেখান থেকে দেখা যায় দিগন্তবিস্তারী সমুদ্রে লাখ লাখ হীরকুচি ছড়ানো রোদ্দুরের ঝিকমিক। পাখি, কত পাখি! সাদা সীগাল সব। জাহাজের কাছেই উড়ছে দল বেঁধে। তাহলে কি কাছেই ডাঙা?
নীলাভ সাদা একটা আলো চারিদিকে, দুলন্ত জাহাজের ডেকের উপরে দাঁড়িয়ে আছি তবু যেন দাঁড়িয়ে নেই। ডাইনে বাঁয়ে সামনে পিছে কেউ কোথাও নেই, শুধু জলের শব্দ আর বাতাসের শব্দ। কে যেন ডাকছিলো একটু আগে? ভাবতে না ভাবতেই আবার সেই ডাক। কার গলা? চেনা কারুর? মিতুলের মতন গলা। কিন্তু সে তো-
মিতুল হলো মৌপিয়া আর শ্রবণের মেয়ে। বেঁচে থাকলে এখন তার বয়স হতো পাঁচ বছর। মাত্র ছয়মাস আগে সে তার মায়ের কাছে চলে গেছে না ফেরার দেশে। ছয়মাস বয়স থেকেই সে থাকতো শ্রবণের বাবামায়ের কাছে, ওদের সেই আগের বাড়িতেই, আমাদের সেই পুরানো পাড়াতেই। ওদের পাশের বাড়িটা এখন আর মৌপিয়াদের না, সে বাড়ি বিক্রি করে মৌয়ের দাদা স্ত্রী ছেলে আর বাবা-মাকে নিয়ে চলে গেছে দূরের এক শহরে, শুনেছি সেখানে ওঁরা সবাই ফ্ল্যাটে থাকেন। শ্রবণদের সঙ্গে ওঁরা যোগাযোগ রাখেন না।
শ্রবণের সঙ্গে মৌপিয়ার বিয়ে ওঁরা মেনে নিতে পারেন নি, মৌয়ের মা রাজি থাকলেও মৌয়ের বাবা আর দাদা একেবারেই মেনে নিতে পারেন নি, মেয়েকে ত্যাজ্য করেছিলেন ওর বাবা। তখন থেকেই তো কথা বন্ধ হয়ে গেছিলো পাশাপাশি দুই বাড়ির লোকেদের। আশ্চর্য! মানুষে কেন কতগুলো পুরানো ধ্যানধারণা আর রীতিনীতি থেকে বেরুতে পারে না যখন জানে যে বেরুলেই সবদিকে ভালো?
ওদের বিয়ের সময় আমি অবশ্য ছিলাম না বাড়িতে, তার আগে থেকেই তো আমি পাহাড়ে। তবে মৌপিয়া নিয়মিত চিঠি লিখতো আমায়, ওর চিঠি থেকেই জেনেছিলাম, কী মারাত্মক বাধা পার হতে হয়েছিলো মৌপিয়া আর শ্রবণকে। শ্রবণের বাবা-মা উদার ছিলেন বলে আর মৌপিয়ার বয়স আঠেরোর অনেক বেশি ছিলো বলে ওদের বিয়েটা ভেঙে যায় নি, নাহলে মনে হয় মৌয়ের বাবা আর দাদা থানাপুলিশ করে মেয়ে উদ্ধার করে নিয়ে যেতেন।
সেই ডাকটা আবার, "তমালী ঈঈ ঈঈ", কে ডাকে? মিতুল নাকি ছোটোবেলার মৌ? ডাকটা অনুসরণ করে উঠে আসি একটা ঘরে, সে ঘর বেশ উপরে, এখান থেকে খোলা বিরাট জানালা দিয়ে সমুদ্রকে দেখি নিচে দুলছে।
হঠাৎ ঘরটার দিকে ভালো করে দেখতে গিয়ে ভয়ে আমার সর্বাঙ্গ অবশ হয়ে এলো। ঘরটা হাল্কা নীল রঙের, দরজা-জানালাগুলো অপরাজিতাফুলের পাপড়ির মতন ঘননীল৷ ঘরটার আকৃতি ভারী অদ্ভুত, চৌকো না গোল না পিরামিডের মতন কিছুতেই বোঝা যায় না৷ মাঝে মাঝেই আকৃতি বদল হচ্ছে, দেওয়াল কখনো সিলিন্ডারের ঘোরানো তলের মতন হয়ে যাচ্ছে, কখনো সোজা সমতল কখনো এবড়োখেবড়ো, কখনো বোঝাই যাচ্ছে না দেওয়াল আছে ৷ ছাদও বদলাচ্ছে, দরজাজানালা আকৃতি বদল করছে৷
ঘরটা বিরাট বড়ো, এর মাঝখানে কতগুলো আশ্চর্য আকৃতির বসবার আসনে বসে আছে কারা যেন, খুব ব্যস্ত হয়ে কাজ করছে সবাই৷ তাদের আকৃতি অনেকটা মানুষের মতনই, আশ্চর্য সর্বাঙ্গ ঢাকা পোশাক ওদের ৷ পোশাকগুলোর রঙ বদলাচ্ছে ৷ এরা মানুষ কিনা বোঝা যাচ্ছে না, মানুষও হতে পারে, যন্ত্রমানবও হতে পারে, আবার সম্পূর্ণ অন্য কিছুও হতে পারে ৷
ওর কেউ কথাবার্তা বলে না, হাতের আঙুলে চিকমিক করা আংটির মতন বহু যন্ত্র বসানো, তারই মাধ্যমে ওরা কমুনিকেট করছে ৷ এদের সামনে বিশাল দেওয়াল জুড়ে ফুটে উঠেছে দু'জন পার্থিব মানুষের স্নায়ুতন্ত্রের চিত্র, একদম সমস্ত সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম তরঙ্গ ইত্যাদি দেখানো, আরো বহুকিছু আছে আমাদের চেনা নয় সেসব, এদের প্রযুক্তি আমাদের থেকে বহুগুণ উন্নত৷ মাঝে মাঝেই বিশেষ বিশেষ অংশে গিয়ে ওরা আরো ভালো করে বিশ্লেষণ করছে ৷
চারপাশে একটা ঘূর্ণী উঠলো, সমুদ্রের নীল জল যেন সর্পিল ফেনার মতন আমাকে ঘিরে ফেলেছে, শুধু আমাকেই। আর কিছু দেখি না, কেবল নীলঘূর্ণী। সেই ঘর অদ্ভুত ঘর, সেই লোকেরা, সেই জাহাজ, কিছুই আর দেখি না-শুধু নীল আবর্ত। হঠাৎ সেই নীলের মধ্যে হালকা লাল দেখা দিলো, আমার চোখ আর মাথার ভিতরে কোথাও যন্ত্রণায় দপদপ করে উঠলো, নৈঃশব্দ ভেদ করে কোথা থেকে যেন একটা ভোঁ ভোঁ শুনতে পেলাম। ভ্রমরগুঞ্জনের মতন।
আমি দু'দিকে দুহাত ছড়িয়ে ঘূর্ণীদেয়াল ভেদ করে বেরিয়ে আসতে চাইলাম, কিন্তু হাত যেন পুড়ে যাচ্ছে, সেই হালকা লাল এখান গাঢ় হয়ে উঠেছে, আমার দুহাত রক্তে ভেসে যাচ্ছে, গলা চিরে চিৎকার করে চেতনা হারিয়ে পড়ে গেলাম।
৪।
শ্রবণ জেগে উঠে দেখেছিলো সে ওদের জাহাজের এমার্জেন্সি রুমে, বিছানায় সে শয়ান, শরীরের এখানে ওখানে তার আটকানো, সেই সব তার নানা মনিটরের সঙ্গে যুক্ত। কয়েকটা মনিটর নিজের জায়গা থেকেই পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলো সে, মনিটরগুলোতে নানা চঞ্চল রেখার আঁকিবুকি ও দৌড়াদৌড়ি। ডক্টর ছেত্রী কী একটা পরীক্ষা করছেন, মুখ গম্ভীর। শ্রবণ ভয় পেলো, কী হয়েছে তার?
শ্রবণের জ্ঞান পুরোপুরি ফিরে এসেছিলো, সে কথা বলতে চেষ্টা করলো, কিন্তু পারলো না। কোনো শব্দ করতে পারছিলো না সে, সব পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে, ডক্টর ছেত্রী মনিটরের দিকে চেয়ে আছেন, ঘরভরা নানা যন্ত্রপাতি, টেবিলে ওষুধপত্র, ট্রলিতে করে নানা জিনিস নিয়ে ঢুকছেন নার্স মিস এলিনর, শ্রবণ শুনতেও পাচ্ছে ট্রলির ঢোকার শব্দ, নানা মনিটরের থেকে আসা হালকা হালকা শব্দও শুনতে পাচ্ছে, এমনকি এয়ারকন্ডিশনারের শোঁশোঁ শব্দও-কিন্তু কোনো শব্দ করতে পারছে না মুখে।
মাথা নাড়াবার চেষ্টা করে সফল হলো সামান্য, এদিকে তেষ্টায় মুখ-গলা-বুক শুকিয়ে গেছে, জল দরকার? কী করে বোঝাবে? হঠাৎ ভীষণ একটা ভয়ে শ্রবণ অস্থির হয়ে উঠলো ভিতরে ভিতরে। তার কি বাকরোধ হয়ে গেছে? কোনো কারণে হঠাৎ কি তার মরণ কাছে এলো?
মিস এলিনর তার মুখে জল দিচ্ছে চামচে করে, কিছু গলায় যাচ্ছে কিছু গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে মুখ থেকে। শ্রবণ চিৎকার করে জিজ্ঞেস করতে চাইলো, "সিস্টার, আমার কী হয়েছে?" একটু শব্দও করতে পারলো না।
জলপান করার পর ক্লান্তিতে চোখ বুজে এলো তার, সে শুনতে পেলো ডাক্তার বলছেন, "স্ট্রেঞ্জ! সমস্ত নিউরাল পাথওয়ে ঠিকঠাক আছে, ব্রেনের সবই স্বাভাবিক, কোথাও কোনো ইনজুরি নেই, কোনো ইনফেকশন নেই, কোনো ড্রাগের চিহ্নও নেই সিস্টেমে, অথচ হঠাৎ করে হাতপা নাড়তে পারছে না কেন?
মিস এলিনরের গলা এবারে, "পাশও ফিরতে পারছে না। "
শ্রবণ অনুভব করলো তাকে পাশ ফিরিয়ে দিচ্ছে কেউ, কিন্তু চোখের পাতা ভারী লাগে, ঘুম ঘুম ঘুম। ঘুমের ঠিক আগে মনে পড়ে সেই আলো-চিকমিক অলৌকিক ভোমরাটাকে। চেতনা হারাবার আগে তাকেই না দেখেছিলো সে?
শ্রবণ দেখলো সে একটা প্রশস্ত গুহার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে প্রদীপ তুলে ধরে। কোথা থেকে যেন মৃদু বাতাস আসছে, প্রদীপের শিখা অল্প অল্প কাঁপছে৷ ওর অন্য হাতে রংতুলির থালা, এক প্রাচীনা সন্ন্যাসিনী সেখান থেকে তুলি ও রঙ বেছে, রঙের বাটিতে তুলি ডুবিয়ে ছোট্টো চৌকো পাথরপাটায় পরীক্ষা করে নিয়ে তারপরে কোমল করে তুলি বোলাচ্ছেন গুহার দেয়ালে আঁকা ছবিতে। দেয়ালে এক অলৌকিক অগ্নিপক্ষীর ছবি, তার ডানায় রঙ লাগাচ্ছেন সন্ন্যাসিনী, তাঁর মুখ ধ্যানমগ্নের মতন শান্ত সমাহিত, চোখ অর্ধনিমগ্ন ৷ হঠাৎ সন্ন্যাসিনীর মুখ মুছে গিয়ে সেই মুখ হয়ে যায় তার ছোটোবেলার আঁকার দিদিমণির মুখ, কী যেন নাম ছিলো দিদিমণির? তাপসীদি।
জোর বাতাস আসে, এক ঝাপ্টায় নিভিয়ে দেয় প্রদীপ, কাজলকালো অন্ধকারে হঠাৎ অন্য ছবি দেখতে পায় সে, বিশাল দেওয়াল জুড়ে ফুটে উঠেছে দু'জন পার্থিব মানুষের স্নায়ুতন্ত্রের চিত্র, একদম সমস্ত সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম তরঙ্গ ইত্যাদি দেখানো,আরো বহুকিছু আছে শ্রবণের একেবারেই চেনা নয় সেসব, ঐ ছবির প্রযুক্তি আমাদের থেকে কয়েকশো বছর এগিয়ে ৷ একটা তীব্র উজ্জ্বল সোনালি গোল আভা সেই ছবির উপরে ঘুরে ঘুরে পর্যবেক্ষণ করছে।
শ্রবণের চোখে বুকে আর মাথায় তীব্র যন্ত্রণা শুরু হয়, সে বুক চেপে ধরে গোঙাতে গোঙাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। এক মুহূর্তের জন্য তার মনে হয়, ছবিদু'টো যাদের স্নায়ুতন্ত্রের, তাদের সে চিনতে পেরেছে। সঙ্গে সঙ্গে ব্যথার আরেকটা ঢেউ, তারপর সব অন্ধকার।
এইবারে জ্ঞান ফিরে পেয়ে শ্রবণ শব্দ করতে পারলো, পাশও ফিরতে পারলো। চোখ মেলে দেখলো ঝুঁকে আছেন নার্স মিস এলিনর, তাঁর চোখ দু'টো বিস্ময়ে বড় বড় হয়ে গেছে।
"আহ আ-আ- আমার কী হয়েছে সিস্টার?" আগের বারের না বলতে পারা প্রশ্নটা এবারে করতে পারলো শ্রবণ।
এলিনর অবাক হয়ে গেছিলো, পেশেন্ট কথা বলতে পারছে! আস্তে আস্তে এলিনর বলেছিলো, " মনে হচ্ছে এখন ভালো আছেন আপনি। একটু শুয়ে থাকুন, আমি ডক্টর ছেত্রীকে ডেকে আনছি।"
পরে বিস্তারিত সব শুনেছিলো শ্রবণ। শ্রবণের সহকর্মী অর্জুন রাজন ওকে সকালের ডিউটিতে না পেয়ে আর ফোনেও কনট্যাক্ট করতে না পেরে ওর রুমে খুঁজতে যায়। সেখানে শ্রবণকে সে পায় ঘরের মেঝের উপরে লুটিয়ে পড়ে থাকা অবস্থায়, সম্পূর্ণ চেতনাহীন। জলটল ছিটিয়েও কিছু না হওয়ায় সে দ্রুত এমার্জেন্সিতে খবর দেয়।
এমার্জেন্সিতে আনার পর থেকে নানা পরীক্ষা করে দেখেও কোনো গন্ডগোল কিছু ধরা পড়ে নি, এদিকে তার শরীর পুরোপুরি তখন ডেড ওয়েট। হাত পা মাথা নাড়ানোর পুরো মেকানিজমটাই যেন বন্ধ হয়ে গেছে।
অল্পক্ষণের জন্য তার জ্ঞান ফিরে এসেছিলো কিন্তু নড়াচড়ার ক্ষমতা ফেরেনি। একটু জলপান করার পরে সে ঘুমিয়ে পড়লো, ঘুমিয়েছিলো প্রায় ঘন্টা চারেক। একেবারে শান্ত ঘুম। ঘুম থেকে ওঠার পর দেখা গেল সে সুস্থ ও স্বাভাবিক। হাতপা নাড়তে পারছে, কথা বলতে পারছে, হাঁটতেও যে পারছে শ্রবণ নিজেই তখন তা জানে, সে ইতিমধ্যে হেঁটে বাথরুমেও গেছিলো। পুরো ব্যাপার ব্যাখার অতীত। আর সকলের কাছে তো বটেই, এমনকি ডাক্তারদের কাছেও কোনো ব্যাখা নেই।
এমার্জেন্সি থেকে সাধারণ মেডিকেল বেডে শিফট করে দু'দিন অবজারভেশনে রেখে তারপরে ওকে ছেড়ে দিলেন ডাক্তাররা। সে সেদিনই ডিউটিতে ফেরৎ যেতে চেয়েছিলো, কিন্তু জাহাজের বৃদ্ধ সাইকিয়াট্রিস্ট ডক্টর মাধব প্রসাদ মনে করেছিলেন শ্রবণের শারীরিক ও মানসিক বিশ্রাম প্রয়োজন।
ছুটি অনেক জমেও গেছিলো, শ্রবণ ঐ ঘটনার কিছুদিন পরেই দীর্ঘদিনের ছুটি চেয়ে দরখাস্ত দেয়, তার মঞ্জুরও হয়। সেই ছুটিতেই সে আমার শহরে বেড়াতে এলো।
৫।
জেগে উঠে প্রথমে শুনলাম ভ্রমরগুঞ্জনের মতন শব্দ, জঁ জঁ জঁ। একটু ধাতস্থ হয়ে বুঝলাম বালিশের পাশে রাখা মোবাইলটা থেকে আসছে। ভাইব্রেশনে মোডে দেওয়া ছিলো, কাল রাতে নর্মালে আর আনা হয় নি। খুব ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, পাল্টানোর কথা খেয়াল ছিলো না। ফোন তুলে নিয়ে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলাম, শ্রবণ!
শ্রবণের সঙ্গে শেষবার দেখা হয়েছিলো সাড়ে চার বছর আগে, সেই যখন আমি ছুটিতে বাড়িতে আর শ্রবণ বাড়ি ফিরে এলো ছয়মাসের মিতুলকে নিয়ে, একা। মিতুলের জন্মের সময় থেকেই মৌপিয়ার নাকি নানা শারীরিক সমস্যা দেখা দিয়েছিলো, বিদেশ বিভুঁইয়ে একলা একলা ঠিক মতন যত্নআত্তি না পেয়ে ছয়মাস ভুগে চলে গেল সে। ওর বাড়ির লোকেরা তখনই দূরের শহরে থাকে, খবর পেয়ে ওর দাদা এসে শুধু শ্রবণকে দায়ী করে গেছিলো বোনের মৃত্যুর জন্য, কিন্তু ঈশ্বর জানেন শ্রবণ নির্দোষ।
শেষবার দেখা শ্রবণকে মনে পড়ে, দিশাহারা চেহারা, হালভাঙা জাহাজের মতন। শ্রবণের মা তখন দু'হাতে আগলেছেন, ছায়া দিয়েছেন যত্ন দিয়েছেন, নিজে ভরসা হয়ে দাঁড়িয়েছেন, মিতুলকে কোলে তুলে নিয়েছেন, শ্রবণের আহত সর্বস্বান্ত মনকে একটু একটু করে সুস্থ করেছেন। ছুটি বেশিদিনের ছিলো না ওর, দিন পঁচিশ বাদেই ওকে কাজের জায়গায় ফিরে যেতে হলো।
ফোন কানে নিলাম। বললাম, হ্যালো শ্রবণ, কেমন আছো?
" তমালী, আমি ভালোই আছি। তুমি? "
-আমার এই চলে যাচ্ছে দিন নিয়মিত কাজের রুটিনে। তোমার কাজ কীরকম চলছে? এর মধ্যে বাড়ি গেছিলে? মাসীমা মেসোমশাইকেমন আছেন ?"
"মা-বাবা ভালো আছেন, এর মধ্যে বাড়ি যাই নি, তবে কথা হয় প্রায়ই ফোনে। শোনো তমাই, তোমাদের শহরে যাবো আগামী মাসের শুরুতে। তখন তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাই। তুমি সেসময় শহরে থাকছো তো? "
আমি একটু কেঁপে গেলাম ভিতরে ভিতরে, কিন্তু গলায় সেটা আনলাম না, বললাম, " হ্যাঁ, থাকবো। তুমি এলে ভালো লাগবে। "
কথা শেষ করে ফোন বন্ধ করে রেখে দিলাম বালিশের পাশে। জানালা দিয়ে চেয়ে রইলাম বাইরে, দূরে দেখা যায় তুষারচূড়া। ঝকঝক করছে। আজকে আকাশ অপরাজিতার মত নীল, তার উপরে ঐ ঝকঝকে তুষারপর্বত এত আশ্চর্য সুন্দর লাগছে! জানালার বাইরেই একসারি পাইন, হাওয়া এসে ওদের গোছা গোছা সুতোর মতন সরু কোমল সবুজ পাতায় কেমন অদ্ভুত শব্দ করছে! চিরহরিৎ এই পাইন কেমন যেন মনের মধ্যে গভীর শক্তি যোগায়।
উঠে পড়লাম, আর শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করছিলো না। তাছাড়া রবিবারে ঝাড়পোঁছ ও থাকে, কিছু স্পেশাল ডিশ রান্নাও করি সাধারণত রোব্বারেই। সোমবার থেকে শনিবার অবধি তো সেই কোন ভোরে উঠে ইস্কুলে ছোটা, সকালে স্কুলে পড়ানো, দুপুর বিকেল নানা আফটার-স্কুল প্রোগ্রামে বাচ্চাদের নিয়ে নানারকম প্রোজেক্টে জড়িত থাকা, তার উপরে নানা রকম সাধারণ মীটিং , বিশেষ মীটিং চলতেই থাকে সারা হপ্তা জুড়ে। সেসব দিনে সন্ধ্যার পরে ফিরে আর বিশেষ কাজকর্ম করতে ইচ্ছে করে না, কেবল আগে থেকেই রেঁধে রাখা খাবার বা কিনে আনা খাবার গরম করে খেতে খেতে টিভি দেখতে আর গান শুনতে ইচ্ছে করে।
সেই রবিবারে ঘুরে ঘুরে টুকটুক করে কাজ করি আর মনের মধ্যে ঘুরে ঘুরে আসতে থাকে একটা গানের লাইন, "আমি পথভোলা এক পথিক এসেছি" শুধু গান না, এই গানের সঙ্গে নাচের কথা মনে পড়ে আমাদের ক্লাস থ্রীর রবীন্দ্রজয়ন্তী আর তারই জের টেনে মনে পড়ে অবন্তীকে, অবন্তী নেচেছিলো এই গানের সঙ্গে। সেএ ই কত্ত বছর আগের কথা, অবন্তীর কিশোরীমুখ মনে পড়ে। তার পরে তার যুবতীবেলার চেহারাও মনে আছে, তার পরেই মনে পড়ে তার রোগজীর্ণ, শীর্ণ মুখ, চুল প্রায় সব পড়ে গেছে, সে শুয়ে আছে বিছানায়, কেমো চলছে তখন। কেন এমন হয়? অকালে কেন এই প্রাণ গুলো ঝরে যায়?
আনমনে রান্নাবান্না সেরে ফেলি, স্নান-খাওয়াও। ছুটির দিনের অলস শেষ দুপুরে ঘুমিয়ে পড়ি গল্পের বই পড়তে পড়তে। তারপরে দেখি সেই অদ্ভুত কতগুলো দৃশ্য। স্বপ্নের মতন, কিন্তু স্বপ্ন নয় যেন। সন্ধ্যা সন্ধ্যা ধূপছায়া-আলোর ভিতর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি, একটা নীল পর্দা সামনে, আরো কাছে গিয়ে দেখি নীলের উপরে লাল আর সবুজ দিয়ে ইকড়িমিকড়ি নকশা, কীসের ছবি চিনতে পারি না। কখনো মনে হয় ডানা মেলা পাখির দল ফট ফট করে উড়ে যাচ্ছে ঘুরতে ঘুরতে, আবার কখনো মনে হয় লালমাথাওয়ালা শয়ে শয়ে উদয়নাগ, সেই সাপগুলো সব একসাথে ফণা তুলেছে। হাওয়ায় পর্দা সরে গেল, টুক করে ঢুকে পড়লাম একটা ঘরে। সেই ঘরে চারিদিকে আশ্চর্য সব ছবি ঝুলছে, রেশমী কাপড়ের উপরে আঁকা ছবি, দুলছে হাওয়ায়, হাওয়া কোথা থেকে আসছে? ভাসতে ভাসতে হঠাৎ কোথা থেকে আমার সামনে এসে পড়লো এক বিরাট আয়না। আয়নার ভিতরে অন্য একটা দেশ, অন্য একটা কাল।
সেখানে দেখতে পাই রোহন আর অবন্তীকে। রোহণকে চিনতে পারি, সেও আমাদের ক্লাসেই পড়তো, কোচিং ক্লাসে দেখা হতো। ঠিক সেই চেহারাই দেখি। অবন্তীকেও দেখি, সতেজ সুন্দর প্রথম তারুণ্যের অবন্তী। সেই যখন ওরা প্রথম চিনেছিলো এক অপার্থিব অনুভূতিকে। সমাজ সংসার মানে নি, পরিণামের কথা ভাবে নি। কিন্তু সমাজ তো ছাড়বে না, সে তো ওদের আলাদা করেই দিলো। অবন্তীকে ওর বাবা-মা জোর করে বিয়ে দিয়ে দিলো ওর চেয়ে দশ বছরের বড় এক পাত্রের সঙ্গে, রোহণ মারা গেল দুর্ঘটনায়। কেউ কেউ বলে আত্মহত্যা। বিয়ের বছর পাঁচ পরে অবন্তী মারা গেল অসুখ করে।
হেমন্তের শেষ, শিরশিরে বাতাসের ভিতর দিয়ে আস্তে আস্তে হেঁটে চলেছে রোহন আর অবন্তী। ওরা এসে থামলো এক হ্রদের পাড়ে। শান্ত একটা হ্রদ, কাচের মতন মতন স্বচ্ছ সেই হ্রদের জল। ওপারে হেমন্তের অরণ্য, রঙে রঙে রঙীন হয়ে আছে গাছের পাতারা। ঘন কালচে লাল থেকে হালকা লাল, কমলা থেকে হলুদ, বাদামী-কত যে রঙ!
হ্রদের আয়নার মতন স্থির জলের উপরে একটা নৌকো ভাসছে। একলা। অদ্ভুত কোনো ছবির মতন।
রোহণ বললো, " অবন্তী, এই অবন্তী, দেখতে পাচ্ছিস?"
অবন্তী ফিসফিস করে বলে, "হ্যাঁ। কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে একলা নৌকোটাকে। "
রোহণ ওকে কাছে টানে, অবন্তী কেঁপে ওঠে। রোহণ ওকে আরো কাছে আনে, ওর দপদপে ঠোঁটে নিজের ঠোঁট মিলিয়ে দেয়। অবন্তী একবার পাখির ডানা ঝাপটানোর মতন করে ওঠে, তারপরে শান্ত হয়ে যায়। আস্তে আস্তে অবন্তীকে ঘাসের উপরে শুইয়ে দেয় রোহণ, নিজেও শুয়ে পড়ে।
হ্রদের পাড়ের কোমল ঘাসের উপরে ওদের গভীর আকাঙ্ক্ষার বাসরশয়ন, পৃথিবীতে যা কোনোদিন হতে পারে নি, তা কত সহজেই সেখানে সম্ভব হয়। গভীর ভালোবাসা ছাড়া সে জগতে আর কিছু নেই, কোনো নিষেধের রক্তচক্ষু নেই, কোনো শাস্তির ভয় নেই, কোনো বাধা নেই। যুগের পর যুগ কেটে যায়। তরঙ্গায়িত আলো অন্ধকারে জ্বলে জ্বলে উঠছে কোটি কোটি মশাল, উড়ে যাচ্ছে কালো রাত্রির খামের ভিতর দিয়ে দিনবদলের চিঠি।
নৌকোটা ভাসতে ভাসতে পাড়ের কাছে এসেছে। অবন্তী আর রোহণ উঠে পড়লো নৌকায়, ওরা এখন ভেসে যাচ্ছে হ্রদের জলের উপর দিয়ে, ওরা হ্রদ পার হয়ে ওপারের পাহাড়ে যাবে, অন্ধকারে মিলিয়ে যাবার আগে ওরা আমার দিকে চেয়ে হাসলো দু'জনে ।
ঘুম ভেঙে গেল, চারিদিকে ধূপছায়া আঁধার, সন্ধ্যা হয়ে গেছে, উঠে বাতি জ্বাললাম।
৬।
নিজেই স্টেশনে গেছিলাম শ্রবণকে রিসিভ করতে। ট্রেন লেট ছিলো ঘন্টাখানেক, তবে সে তেমন কিছু না। সারারাতের ট্রেনজার্নির পরে যাত্রীদের অবস্থা যেমন উসকোখুসকো হয়, তার চেয়ে বেশী উসকোখুসকো দেখাচ্ছিলো না শ্রবণকে।
সে লাগেজ টানতে টানতে আসছিলো, আমাকে দেখে হাসলো। আমিও হেসে এগিয়ে গেলাম, ট্যাক্সি ভাড়া করে নিয়েই গেছিলাম, শ্রবণকে পথ দেখিয়ে মালপত্তর সমেত তুললাম ট্যাক্সিতে।
আগেরবারে দেখা শ্রবণের চেয়ে একটু বয়স্ক হয়েছে এবারের শ্রবণ। আর কোথায় যেন একটু সূক্ষ্ম পরিবর্তন হয়েছে, ঠিক কোথায়, তা বুঝতে পারলাম না যদিও। শ্রবণও আমায় দেখছিলো একটু যেন বিস্ময়ে, আমিও কি খুব বদলে গেছি এই ক'বছরে?
দীর্ঘ যাত্রার ক্লান্তি কাটাতে শ্রবণ স্নানটান করে ফ্রেশ হয়ে নিতে বাথরুমে ঢুকলো আর আমি কিচেনে ঢুকে চা আর জলখাবার তৈরী শুরু করলাম। শ্রবণের নিশ্চয় জব্বর খিদে পেয়েছে।
খেতে খেতে গল্প হচ্ছিলো টুকটাক, আজকে স্কুলে ছুটি নিয়েছি, সারাদিন আজকে বিশ্রাম, খাওয়া, গল্প, বেড়ানো---এইসবের প্ল্যান মনে মনে ছকে রেখেছি। শ্রবণকে দেখে মনে হচ্ছে কিছু বলতে চায়, কিন্তু বলার জন্য ঠিক সময়টা খুঁজছে। এদিকে আমারও তো কত কী বলার আছে, কিন্তু কীভাবে বলবো, কখন বলবো কিছুই বুঝতে পারছি না।
দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পরে বিশ্রামের সময় মনে হচ্ছিলো শ্রবণ কিছু বলবে, কিন্তু সে ঘুমিয়ে পড়লো বলার আগেই। ঘুমন্ত শ্রবণকে দেখে ক্লান্ত বালকের মতন লাগে, আহা রে বেচারা যেন কত দিন ঘুমায় নি।
ঘুমিয়ে উঠে বিকেলে চা খাবার সময় শ্রবণ বলতে শুরু করলো। চা খাওয়া হয়ে গেছিলো, কাপ নামিয়ে রেখে সে বলতে শুরু করলো," তমাই, তোমাকে যা বলতে যাচ্ছি, হয়তো তুমি বিশ্বাস করবে না, কিন্তু না বলে আমার উপায় নেই-"
কাপ নামিয়ে রেখে শিরদাঁড়া সোজা করে বসলাম, যেন আগে থেকেই জানতাম কী বলবে শ্রবণ, আমার সেই অদ্ভুত স্বপ্নগুলো, সেই একলা জাহাজ, সেই পাহাড়ের পাশে হ্রদ, সেই নীলঘূর্ণী র সঙ্গে যেন ওর বলা এই অলৌকিক ভোমরা, ব্যাখাতীত অসুখ--এগুলোর কোথায় মিল আছে। আমি প্রায় নিঃশ্বাস বন্ধ করে শুনতে লাগলাম।
তারপরে এলো সেই সীমানাহীন ঘরের কথা, সেই অদ্ভুত জীবেদের চিকমিকে আলোয় যোগাযোগ নিজেদের মধ্যে, বিরাট স্ক্রীনে অদ্ভুত ছবি ---আমি ফিসফিস করে বললাম, "আমিও দেখি ওদের শ্রবণ, শুনবে আমার কথা?"
সব কথা বললাম ওকে, সব বলে মনটা হাল্কা লাগছিলো। শ্রবণকে দেখেও ভারমুক্ত মনে হচ্ছিলো।
বেলা পড়ে এলে আমরা বেড়াতে বেরোলাম। দু'জনের কেউই জানতাম না কোথায় যাবো, আবার যেন মনের ভিতর মন ঠিকই জানতো। আমাদের অজান্তেই আমরা যাচ্ছিলাম সেই আশ্চর্য হ্রদের দিকে, সেখানে একলা একটা নৌকা আমাদের অপেক্ষায়, নৌকায় করে হ্রদ পার হয়ে আমরা পৌঁছাবো সেই উৎসশৈলে, সেখানে গিরিগুহার ভিতর দিয়ে আমাদের যাত্রা হবে পূর্ণের দিকে। পৃথিবীর সংসারের নানা নিষ্ঠুর বাধা, ঘৃণা, মৃত্যু, অত্যাচার, দ্বিধা, ভয়, লজ্জা যেসব মিলনের সম্ভাবনাগুলো ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিলো,তারা সবাই পূর্ণ হবে সার্থক হবে আমাদের মধ্যে। তাই তো ওরা আমাদের ডেকে এনেছে। সেই যে ওরা, সেই অসীম করুণার সীমানাহীন ঘরের ভিতর থেকে যারা আমাদের দেহ-মন-আত্মা নিয়ে কীজানি নিরীক্ষা করছে নিরন্তর।
নীরবে আমরা এগিয়ে যেতে থাকি দু'পাশে সরল গাছের সারি রেখে। চলতে থাকি, চলতে থাকি---
(শেষ)
মন্তব্য
গল্পের শুরুটা এতই বিরুক্তিকর যে পড়বার ধৈর্য রাখা কঠিন। প্রচুর কথাবার্তা কিন্তু সারবস্তুহীন।
রাশেদুল ইসলাম ফরহাদ
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। বিরক্তি লাগলে পড়বেন না, মিটে গেল।
কথাটা বিরুক্তিকর না, বিরক্তিকর। মন্তব্য করার সময় বানান শুদ্ধ রাখার চেষ্টা করবেন। ধন্যবাদ।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
গল্প বড়, কিন্তু ভালো লেগেছে। কাহিনীর জন্য যতটা, তার চেয়েও বেশি শব্দপ্রয়োগ, বাক্যগঠনের জন্যে। এত বড় গল্পতেও ধরে রাখতে পেরেছেন।
অনেক ধন্যবাদ দীপ্ত। আপনার ভালো লেগেছে জেনে আমারও খুব ভালো লাগলো।
ভালো থাকবেন।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
আপনার বর্ণনাগুলো এত অদ্ভুত লাগে তুলিদি, মনে হয় শব্দ গুলো রিম ঝিম করে নাচতে নাচতে মাথায় ঢুকে যাচ্ছে। চরিত্রগুলো চেনা চেনা লাগে তবুও কেমন যেন অধরা-- অন্যরকম!
সবমিলিয়ে ভালো লাগা জানিয়ে গেলাম!
অনেক ধন্যবাদ সফিনাজ আরজু।
আসলে স্বপ্নে দেখা একটা জগতের কথা বলতে চেয়েছি গল্পে, আমাদের জগতের সঙ্গে তার কিছু মিল আছে, কিছু ঘোর অমিল। কিন্তু ওই জগতের কথা লেখা খুব কঠিন, মনে হয় খুব একটা সফল হই নি, কারণ কাহিনি হিসাবে পড়তে গেলে অনেকের কাছে দীর্ঘ ও একঘেয়ে মনে হতে পারে। যারা শব্দের ঝঙ্কারের চেয়ে গদ্যে কাহিনি খোঁজেন বেশি, তাঁদের কাছে হয়তো একটু ঝামেলার এরকম লেখা। তবে পরবর্তীতে আবার চেষ্টা করবো আরেকটু অন্যভাবে।
আপনাকে আবারও ধন্যবাদ।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
ভাল্লাগসে
..................................................................
#Banshibir.
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
কিছু কিছু স্বপ্ন শব্দ দিয়ে ধরা ভীষণ কঠিন।
পড়তে পড়তে আমি আপনার স্বপ্নটাই দেখার চেষ্টা করছিলাম...
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
ঠিক বলেছেন, কিছু কিছু স্বপ্ন শব্দ দিয়ে ধরা প্রায়-অসম্ভব।
স্বপ্নটা দেখতে চেষ্টা করলেন শুনে চমৎকার লাগলো, কিছু দেখতে পেলেন?
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
মৌপিয়া নামটা তো বেশ। গল্পটাও ভালো।
------------------------
[ওয়েবসাইট] [ফেইসবুক] [ফ্লিকার ]
আমাদের স্কুলেই মৌপিয়া বলে একজন ছিলো, আমাদের থেকে এক ক্লাস উপরেই।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
নতুন মন্তব্য করুন