ঘোর শীতের দিনে ভ্রমণে বেরোতে হলো একবার, ঠিক মুক্ত ভ্রমণ নয়, মাধুকরীতে বেরোতে হলো বলা যায়। ঘটনাচক্রে থাকতে হলো উত্তরের এক শহরে, সেখানে তখন অবিরাম তুষার ঝরছে।
জীবনে সেই প্রথম তুষারপাত দেখা। তখন শেষ রাত, সূর্য উঠতে দেরি আছে কয়েক ঘন্টা। বিদ্যুৎবাতিগুলোর উজ্জ্বল আলোর পাশ দিয়ে নেমে আসছে তুষার, আকাশ থেকে যেন নিঃশব্দ শ্বেতপুষ্পবর্ষণ বা যেন দ্যুলোকের লাজাঞ্জলি। লঘুদেহিনী নৃত্যপরা অপ্সরার মতন নেমে আসছে তুষারকণারা, এত হাল্কা যে অল্প বাতাসেই উড়ে উড়ে যাচ্ছে ডাইনে বাঁয়ে সামনে পিছনে, জ্বলে জ্বলে উঠছে আলোর প্রতিফলণে, ঝিকমিকিয়ে উঠছে ত্রসরেণুর মতন।
বন্ধ কাচের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতন দেখছিলাম সেই তুষারপাত। জীবনের প্রথম তুষারবর্ষণ। পরে কতবার দেখেছি নানা জায়্গায়, দিনের পর দিন তুষার ঝরেছে, তখন বিরক্তি লেগেছে, কিন্তু সেই প্রথম তুষারের রোমাঞ্চস্মৃতি একই রয়ে গেছে। কে বলে দেবে স্মৃতির রহস্য?
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তুষারকণাগুলো ঝাঁপিয়ে পড়ছিলো কাচের গায়ে, জমা হচ্ছিলো কোণায় কোণায়। ছয় পাপড়ি ফুলের মতন গঠন, অতুলনীয় নকশা সেই পাপড়িতে। সুগঠন তুষারকণার অপরিসীম বৈচিত্র, বর্ণনার অতীত। প্রত্যেকটি কণা দেখতে পৃথক, কিন্তু সেই ষড়ভূজ আকৃতি ঠিক একই।
পরদিন সকালে বেরিয়ে দেখি মাটি ঢেকে গেছে সাদা বরফে, সাদা তুলোর আস্তরণের মতন পড়ে আছে চরাচর ঢেকে। কতকাল এই রকম তুষারের গল্প শুনেছি পর্বতারোহী বন্ধুর কাছে। এ শহুরে বরফে ধ্যানগম্ভীর তুষারমুকুটিত পর্বতচূড়ার শুভ্র সৌন্দর্য বোঝা অসম্ভব, তবু চোখ বন্ধ করতেই ফুটে ওঠে পাইন ফার স্প্রুস বার্চ জুনিপারের সীমাহীন অরণ্য শীতস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তপস্বীর মত আর সেই ধ্যানলীন অরণ্যের তপোভঙ্গ করতে নৃত্যপরা অপ্সরাদের মত নেমে আসছে তুষারকণারা, নামতে নামতে নিজেরাই তপোস্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে, মাটি ঢেকে যাচ্ছে সাদা কঠিন বরফে।
ঐ দূরে নীল আকাশে মাথা তুলে অচল অটল প্রাচীন বৃদ্ধ প্রপিতামহের মতন এক সুগঠন পর্বতচূড়া স্নিগ্ধ হাসিমুখে চেয়ে আছে, নবোদিত সূর্যকিরণ করুণার মত ছলছল করছে সেই চূড়ার তুষারমুকুটে। পৃথিবীটা কী আশ্চর্য সুন্দর! কী বিরাট! কী গভীর এর মায়া! কী অপরিসীম করুণাময় এর হৃদয়!
স্মৃতিতে দগদগে হয়ে থাকা সব ক্ষত ছাপিয়ে জেগে ওঠে করুণাময়ী দুটি চোখ, কালচিহ্ন তাকে বদলাতে পারে নি, স্নেহটলটল চোখ দুটি ধ্রুবতারকার জ্যোতি নিয়ে চেয়ে থাকে। সব ক্ষত সব ক্ষতি পেরিয়ে চিরঞ্জীব স্নেহসুধা।
লেবুগন্ধী ঘাসগুলোর মধ্যে মুখ নামিয়ে দিই, স্বপ্নের মতন ফিরে আসে ফেলে আসা সাগরবেলা, সুখ দুঃখের আলোছায়া। অনেক অনপনীয় বেদনা, অনেক রক্তমুখ ক্ষত ধীরে ধীরে সেরে যেতে থাকে অবিরল কৃপাবর্ষণে, মনে হয় জীবনের দুঃখ রাত্রি শাশ্বত নয়, এই রাত্রি ভোর হবে। এমন করুণা কি কোথাও আছে যা পুড়ে যাওয়া ডানা নতুন করে গজিয়ে দিতে পারে?
ক্ষুদ্র জলফড়িং এর মতন এই জীবন। কার অন্যমনস্ক হস্ততাড়না একদিন ঘষে ধ্বংস করে দিয়েছিলো এই ক্ষুদ্র কোমল ডানাগুলো, সে কি বুঝতে পেরেছিলো? হয়তো পেরেছিলো, হয়তো পারে নি। ছিন্ন ডানা নতুন করে গজিয়ে দেবার মতন কৃপাবর্ষণ কি এই পাথুরে দুনিয়ায় থাকতে পারে?
মধ্যশীতের করুণাবর্ষণ নামে জীবন জুড়ে, সব ক্ষতি সব ক্ষত মিলিয়ে যায়। কী বিপুল এ তরঙ্গ! খরনদীর স্রোতে চন্দনসাজের মতন ধুয়ে যায় তুচ্ছ অহংকার ও অভিমান। নিরভিমান শিল্পী এসে এইবারে বুঝি বীণার মতন বাজাবে এ সদ্যধৌত হৃদয়।
মন্তব্য
আরে! কী সুন্দর সব ছবি! কত কত বরফ পড়েছে! সাইকেল রাখার জায়গাটা তো একেবারে মেরু হয়ে গেছে!
গত বছরের আগের বছর এখানে খুব বরফ পড়েছিল কয়েকদিন, তখন ইস্কুল ছুটি দিয়ে দিয়েছিল।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
আগেও আপনার লেখা পড়েছি। অসাধারণ সব শব্দ, বাক্য। সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুভূতিগুলোর কি বাঙময় প্রকাশ!
আপনার লেখা পড়ে ছবির অভাব অনুভূত হয় না, তবু কৌস্তভদার দেয়া ছবিগুলো এ লেখাটাকে আরও সমৃদ্ধ করেছে।
সাযুজ্য-পূর্ণ হবে কিনা জানিনা, তবু মনে পড়ছে ফ্রস্টের সেই লাইনগুলো:
Whose woods these are I think I know.
His house is in the village, though;
He will not see me stopping here
To watch his woods fill up with snow./
The woods are lovely, dark, and deep,
But I have promises to keep,
And miles to go before I sleep,
And miles to go before I sleep.
অনেক ধন্যবাদ। কবি ফ্রস্টের এই আশ্চর্য কবিতার লাইনগুলো মন্তব্যটাকে যেমন সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি গোটা পাতাটাকেই। ঐ শেষ লাইন দুটো, And miles to go before I sleep,/And miles to go before I sleep "একেবারে অশেষ, অফুরান একটা ভাব এনে দে্য, মানুষের জীবনের শেষহীন চলা।
ভালো থাকবেন।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
দারুণ! আপনি শব্দ দিয়ে জীবন্ত ছবি আঁকতে পারেন।
ফারাসাত
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
কৌস্তুভদার ছবিগুলোর মত অবস্থা এখন আমার জানালার ঠিক বাইরে।
প্রথম স্নো দেখার অভিজ্ঞতা ছিল অসাধারন। খুব ভালো লেগেছিল। স্নো পড়া দেখতে এখনও খুব ভালো লাগে। কিন্তু টানা ৫-৬ মাস দেখলে শেষ দিকে গিয়ে আর ভালো লাগেনা।
তুষারের উপর হাঁটা আসলেই কষ্টের। আমি কেবলি আছাড় খাই, কপাল খারাপ।
আপনার লেখার কথা নতুন করে আর কি বলব তুলিদি।
শুধু বলি- আপ্নেরে আর আপনার লেখারে আমি ভালা পায়!
আমিও একবার বরফে পিছলে পড়ে গেছিলাম, জাব্বাজোব্বা মোটা পোশাক থাকায় তেমন লাগে নি হাড়ে। নইলে আরো ঝামেলা হতো। কেমন পিছল যে হয়ে যায় গলতে থাকা তুষার।
প্রথম দেখতে ভালো লাগে- চিনি-চিনি তুষার পড়ছে, বালি-বালি তুষার পড়ছে, তুলো তুলো তুষার পড়ছে , কিন্তু পারে তাল তাল বরফে তাল সামলে চলে খুব কঠিন।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
সৌরভ কবীর
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
আমি প্রথম যেদিন তুষার দেখি কি আনন্দ যে পেয়েছিলাম! এখনও প্রতিবছর প্রথম তুষার পড়া দেখতে ভাল লাগে, আর সেটা যদি উইকএন্ড হয়। আমার বাড়ীর পেছনের বনে সামারে যাই না , পোকা মাকড়ের ভয়ে। কিন্তু তুষার পরে সেই বন যখন সাদা পুরু চাদরে ঢেকে যায়, তখন আমরা বুট পরে ঘুরে বেড়াই। চারিদিকে বরফ, রাস্তা পরিস্কার, তখন গাড়ী করে ঘুরে বেড়াতেও ভাল লাগে।
কিন্তু খারাপ লাগে যখন বরফ গলতে শুরু করে।
লেখা খুব ভাল লেগেছে ।
অনেক ধন্যবাদ নীলকমলিনী।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
ক্ষুদ্র জলফড়িং এর মতন এই জীবন। কার অন্যমনস্ক হস্ততাড়না একদিন ঘষে ধ্বংস করে দিয়েছিলো এই ক্ষুদ্র কোমল ডানাগুলো, সে কি বুঝতে পেরেছিলো? হয়তো পেরেছিলো, হয়তো পারে নি। ছিন্ন ডানা নতুন করে গজিয়ে দেবার মতন কৃপাবর্ষণ কি এই পাথুরে দুনিয়ায় থাকতে পারে?
মধ্যশীতের করুণাবর্ষণ নামে জীবন জুড়ে, সব ক্ষতি সব ক্ষত মিলিয়ে যায়। কী বিপুল এ তরঙ্গ! খরনদীর স্রোতে চন্দনসাজের মতন ধুয়ে যায় তুচ্ছ অহংকার ও অভিমান। নিরভিমান শিল্পী এসে এইবারে বুঝি বীণার মতন বাজাবে এ সদ্যধৌত হৃদয়।
facebook
হ্যাঁ, আশা করতে ইচ্ছে করে, সেই অসম্ভব সম্ভব করার মতন করুণাও কোথাও আছে।
পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
আপনার লেখা, কৌস্তুভের ছবি আর কাজি মামুনের সংযোজন, সব মিলিয়ে দারূণ একটা পোস্ট হয়েছে।
আপনাকে ধন্যবাদ।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
নতুন মন্তব্য করুন