স্পন্দন

তুলিরেখা এর ছবি
লিখেছেন তুলিরেখা (তারিখ: শুক্র, ০৪/০১/২০১৩ - ৯:৪৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মনে করো তুমি চলেছ নদীর উপর দিয়ে, তোমার নৌকা আস্তে আস্তে হেলতে দুলতে এগিয়ে চলেছে। তুমি দেখছ নদীর পাড়ে বসে আছে একটা অদ্ভুতদর্শন দীর্ঘচঞ্চু পাখি, চুপ করে দেখছে তোমায়। তুমি এগিয়ে চলেছ দু'পাড়ে সবুজ দেখতে দেখতে, এ নদীতে জোয়ার ভাঁটা খেলে, মোহনার খুব কাছে কিনা! তুমি শুনছ বাতাসের শব্দ, এখন শান্ত, কিন্তু কেজানে কখন ঝড় আসে? তুমি চলেছ সমুদ্রের দিকে।

একটা জটিল গ্রন্থি, যেটাকে খুলতে পারলেই সহস্র বছরের যবনিকা উঠবে। বছরগুলো যেন শক্ত হয়ে জমে আছে, গিঁট খোলার মন্ত্রটা উচ্চারিত হলেই সব গলে যেতে থাকবে বসন্তের সূর্যের তাপে গলে যাওয়া বরফের মতন। গলে গিয়ে তখন সব স্বচ্ছ, যার ভিতরে দেখা যাবে নদীর তলদেশের নুড়ি পাথর বালি, জলজ আগাছা, এঁকে বেঁকে স্রোতের মতন সাঁতার কাটতে থাকা রুপোলি মাছের ঝাঁক।

অন্ধকার। রাত্রি নেমে গেছে অনেকক্ষণ। সমুদ্রতীর এখন নির্জন। বালির উপরে অবিরাম আছড়ে পড়ার ঢেউয়ের শব্দ শুধু। ঝাউবনের মধ্যে শোঁ শোঁ করছে হাওয়া।এগিয়ে আসা ঢেউগুলো কেমন জ্বলজ্বল করে, রাত্রির সৈকতে কেমন একটা চাপা আলো। সমুদ্র থেকে বা আকাশ থেকে আসে ঐ আলো।

বিকেলে তুমি দেখেছিলে বালির উপরে পদচিহ্ন, মানুষের, পাখির, কাঁকড়ার। এসব চিহ্ন মুছে যায় একেকটা বড়সড় ঢেউ আসলেই। কিন্তু তোমার মনে পড়ে পাথরের মধ্যে অক্ষয় হয়ে থাকা মিলিয়ন বছরের পদচিহ্ন, বিপুল সরীসৃপরা যা রেখে গেছে। চিহ্ন রয়ে গেছে, তারা বিলুপ্ত হয়ে গেছে সবাই। হয়তো তারা ফিরে এসেছে অন্যরূপে, কেজানে! পৃথিবীর ভাঙা গড়া চলছিল তখন। কী বিপুল ধ্বংস! তার পরে জেগে ওঠে কী বিপুল সৃষ্টি। ঠিকই ভোর হয়, দীর্ঘ রাত্রি শেষে ভোর হয়। জীবন থেমে থাকে না।

তুমি বসেছ এখন আগুনের সামনে, বন্ধুদের সঙ্গে। আগুন ঘিরে গোল হয়ে বসেছ তোমরা সবাই। এখন কালপুরুষ আকাশের প্রায় মাঝখানে, তাকে অনুসরণ করছে তার হরিণমাথা কুকুর, লুব্ধক। তুমি তুলে নাও তোমার পানীয়, চুমুক দাও, একবার, দুইবার। অনুভব করো উষ্ণতা, তোমার ভিতরে এক অদ্ভুত উষ্ণতা। তুমি মাছভাজায় কামড় বসাও, অনুভব করো স্বাদ গন্ধ আর তারও বেশী কিছু। তোমার মনে পড়ে একটা দিন, বহুদিন আগের এক ডুবসাঁতার। নদীটার নাম যেন কী ছিল? চন্দ্রাবতী না?

রাত্রি বহে যায় শান্ত নদীর মত
আকাশে ভেসে থাকা ঘুমেলা চাঁদ
স্বপ্নের ঘোরে এলোমেলো কথা বলে,
জ্যোস্নারঙের কথা সব।
এই কি অমরত্বের টুকরোটাকরা?
অনন্তের বৃষ্টিবিন্দু?

সোনালী অগ্নিশিখা লাফিয়ে ওঠে অজস্র সোনালী ফুলের মতন
আলো আর ছায়া হাত ধরাধরি করে নাচছে-
শত শত নীল পদ্মের পাপড়ি খুলে যায় কোথায় যেন
দরজা খোলার শব্দ হয়-
দূর আকাশের প্রান্ত থেকে এসে পৌঁছায় প্রথম সূর্যের আলো-
ভোর হয়ে যায়।
এই কি অমরত্বের স্পর্শ?
এই কি অনন্তের তুষারকণা?

তোমার উষ্ণতা আমাকে ঘিরে ধরে তুলোর পোশাকের মতন,
আমি তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখি-
দেখতে দেখতে তলিয়ে যাই গভীরে,
সেখানে দেখতে পাই তোমার রক্তিম হৃদয়,
তার মধ্যে জ্বলছে উজ্জ্বল লাল আগুন
সৃষ্টির শুরু থেকে জ্বলছে অনির্বাণ।
এই কি অমরত্বের স্পন্দন?
এই কি অনন্তের কথামালা?

*******


মন্তব্য

আইলসা এর ছবি

কেজানে কি এক শব্দ? কে জানে হওয়া উচিৎ না! আমি অবশ্য বাংলায় "অ-অক্ষর গো-মাংস"

আপনার এই লাইনগুলো, "পাথরে মধ্যে অক্ষয় হয়ে থাকা মিলিয়ন বছরের পদচিহ্ন... হয়তো তারা ফিরে এসেছে অন্য রূপে" আমার চিন্তার সাথে মিলে গেলো।

দেশ থেকে দূরে, সমুদ্রের মাঝে এক দ্বীপে বসে মাছ ভাজা খাওয়ার সময়, আমার মনে হয়েছিল, আমার আগে কত শত মানুষ এই খানে এসেছিলো! কাঠের জাহাজে করে বা শুধু ডিঙ্গি নৌকায়, তাদের জীবন কেমন ছিল, কি নিয়ে হাসতো তারা, আনন্দ করতো কিভাবে? তারো ও আগে ছিল কত বড় বড় প্রানী!
তারা আজ নেই, তাদের ও অনেক আগে থেকে আলো যাত্রা শুরু করেছে দূরের তারাগুলো থেকে। সে আলো ওই মুর্হুতে আমার চোখে পড়ছিল। এতদিনে সেই তারা হয়তো মিলিয়ে গেছে... আরো কত হাজার নক্ষত্র থেকে আলো মাত্র রওয়ানা হলো, আমি পৃথিবী ছাড়ার হাজার বছর তারা পৌছবে পৃথিবীতে। আমি জানবো ও না, তখন মানুষ কিসে আনন্দ পাবে, কি গান শুনবে... - ভাবতে ভাবতে প্রায় মনটা খারাপ করেই ফেলছিলাম, তখন গাইড একটা এক্সটা মাছ দেয়ায় সব তত্ত্ব কথা ভুলে, গান ধরলাম, "ম্যায় বদনাম হুয়ি মুন্নী তেড়ি লিয়ে"...

যাহোক আসল কথা বলতে ভুলে গেছি, আপনার লেখাটা ভালো লেগেছে।

তুলিরেখা এর ছবি

এক্সট্রা মাছভাজা? বলেন কী! তাইলে তো গান ধরবেনই। হাসি
লেখাটা আপনার ভালো লেগেছে জেনে খুব খুশি হলাম। ভালো থাকবেন।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

ফাহিম হাসান এর ছবি

বিকেলে তুমি দেখেছিলে বালির উপরে পদচিহ্ন, মানুষের, পাখির, কাঁকড়ার। এসব চিহ্ন মুছে যায় একেকটা বড়সড় ঢেউ আসলেই। কিন্তু তোমার মনে পড়ে পাথরের মধ্যে অক্ষয় হয়ে থাকা মিলিয়ন বছরের পদচিহ্ন, বিপুল সরীসৃপরা যা রেখে গেছে। চিহ্ন রয়ে গেছে, তারা বিলুপ্ত হয়ে গেছে সবাই। হয়তো তারা ফিরে এসেছে অন্যরূপে, কেজানে! পৃথিবীর ভাঙা গড়া চলছিল তখন। কী বিপুল ধ্বংস! তার পরে জেগে ওঠে কী বিপুল সৃষ্টি। ঠিকই ভোর হয়, দীর্ঘ রাত্রি শেষে ভোর হয়। জীবন থেমে থাকে না।

এই কথাগুলো চমৎকার লাগল।

তুলিরেখা এর ছবি

আপনাকে ধন্যবাদ অনেক।
ভালো থাকবেন।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।