রক্তহৃদয়

তুলিরেখা এর ছবি
লিখেছেন তুলিরেখা (তারিখ: শনি, ১৯/০১/২০১৩ - ৪:৫৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমি তোর চোখে চোখ রাখি,
দৃষ্টি মেলে দিই ভিতরে, আরো ভিতরে-
যেখানে তোর রক্তিম হৃদয় দপদপ করছে।.....

নীলরঙের পর্দার উপরে সাদা মেঘের মতন ভেসে উঠলো তোর মুখ, তোর দুটো চোখ, ঈষৎ বাদামী চোখের মণির আকুল গভীরতা। তোর অল্প স্ফীত অভিমানী ঠোঁট দুটো। কীসের এত অভিমান ছিল তোর যা কোনোদিন দূর হয় নি? ভাবলে আশ্চর্য লাগে, কোনোদিন জানাও হয় নি তখন, কোনোদিন তোকে জিজ্ঞেস করা হয় নি। দিনগুলোর গতি তখন ছিলো তরতরে নদীর স্রোতের মত, থামার অবকাশ ছিল না। এখন, এতদিন বাদে, কর্মহীন পূর্ণ অবসরে, বারে বারে জাগরস্বপ্নে ফিরে আসে তোর ঐ অভিমানী মুখের রেখা।

অনোমা নদীর তীর ধরে বালি ভেঙে ভেঙে আমরা যাচ্ছিলাম, কোথায় যেন চর জেগেছে বলে খবর এসেছিলো, সেইদিকেই যাচ্ছিলাম। শ্রাবণী পূর্ণিমার জ্যোৎস্নায় চরাচর ভেসে যাচ্ছিলো। যেতে যেতে আমরা তর্ক করছিলাম রোহিণী থেকে শতভিষায় যেতে চাঁদের কতদিন লাগে? সেই চরে আর আমাদের পৌঁছানো হয় নি, শেষরাত্রে ফিরে এসেছিলাম বাসায়।

তারপরের বসন্তেই আমাদের শহরে হলো ভূমিকম্প। অনেক বাড়ীঘর ভেঙেচুরে বরবাদ হয়ে গেল, আমাদের বাসাও ভেঙে গেল। শহরের বাইরে আমাদের সাময়িক বাসস্থান দেওয়া হলো। সেখান থেকে কেবলই আমরা বেরিয়ে পড়তাম চারিপাশে, শহরের সবুজটুকু ছাড়িয়ে মরুভূমির মধ্যে। সেখানেই একদিন আমরা খুঁজে পেয়েছিলাম এক লুপ্ত শহরের চিহ্ন। পাথরের ভাঙা থাম, ভাঙা দেয়াল, দেয়ালে আর থামে নানা খোদাই ছবি। খুঁজে পেয়েছিলাম পোড়ামাটির বাসনপত্রের টুকরো, রঙীন পুঁতি, নানা আকারের ছুঁচালো করা পাথর, কাঠের হাতল---এইসব। কয়েক সহস্র বছরের প্রাচীন সভ্যতার অবশেষ। কবে এসবের অধিকারীরা মরে গেছে, সব চাপা পড়ে গেছিলো মাটির গভীরে, খেয়ালী ভূমিকম্প আবার তাদের প্রকাশ করেছিল হাজার বছরের বিস্মৃতির ঢাকনা সরিয়ে, আমাদের দেখানোর জন্য। কী হবে দেখে?

সেই অনামা পুরাশহরের থামগুলো সোজা উঠে গেছিলো শূন্য আকাশে, ওদের মাথার উপরের ছাদ তো কবেই ধ্বংস হয়ে গেছে। তারাভরা রাতের আকাশের নিচে ভাঙা পাথরের থামের পাশে শুয়ে শুয়ে দু'জনে এলোমেলো কত কথা বলতাম! ঐ উপরের তারাগুলো, ওরা হয়তো দেখেছিলো সেই শহরের সূচনা, তার ব্যস্ত জনজীবন, তারপরে তার ধ্বংস, তারপরে বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাওয়া- সবই। কী নির্বিকারে দেখেছিলো! আমাদের হাজার হাজার বছর তারাদের বিরাট বিপুল বিলিয়ন বছরের জীবনের কাছে কত সামান্য, একপলক মাত্র!

রহস্যময় ইতিহাসের ভিতর দিয়ে আমরা এগিয়ে চলেছি অতীত থেকে বর্তমান ছুঁয়ে ভবিষ্যতের দিকে। একমুখী যাত্রা, এর আর পিছনে ফেরা নেই। যা ছেড়ে আসি তা আর ছুঁতে পারি না, সামনে যা আসছে তা একেবারেই অজানা। কুয়াশাময় একটা পথ, শুধু বোঝা যায় কোন ‍দিকে যাচ্ছি। আর কিছু না। পিছনে অধরা অতীত, সামনে অজানা ভবিষ্যৎ। ভবিষ্যৎ সবসময়েই অজানা, নিশ্চিত বলে কিছু নেই, কেবল রয়েছে অসংখ্য সম্ভাবনার সমষ্টি। সবকিছু কাঁপছে দুলছে আর নাচছে এক রহস্যময় ঢেউয়ে। বিপুল সেই তরঙ্গ কীসের তরঙ্গ, তা কি কেউ জানে?

রাত্রি বইছে মধুর নেশার মতন
আধঘুমন্ত চাঁদ ভাসছে আকাশে-
এই কি অনন্তের একটুকরো স্পর্শ?
এই কি শেষহীন স্বপ্নের আঁচল?

তোর উষ্ণ শরীর আমাকে ঘিরে ধরে সম্পূর্ণ
আমি তোর চোখে চোখ রাখি,
দৃষ্টি মেলে দিই ভিতরে, আরো ভিতরে-
যেখানে তোর রক্তিম হৃদয় দপদপ করছে।

সেখানে, সেই রক্তহৃদয়ের ভিতরে দেখতে পাই-
জ্বলছে আগুন, অনির্বাণ আগুন-
সৃষ্টির শুরু থেকে একইরকমভাবে জ্বলছে।
এই কি অমরত্বের এক ঝলক?
এই কি অশেষ আকাশরহস্য?

*******


মন্তব্য

প্রদীপ্তময় সাহা এর ছবি

দৃষ্টি মেলে দিই ভিতরে, আরো ভিতরে-
যেখানে তোর রক্তিম হৃদয় দপদপ করছে।

গুরু গুরু
অসাধারন।

একেবারে তুলিরেখীয়।

তুলিরেখা এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ প্রদীপ্তময়।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

ফাহিম হাসান এর ছবি

কবিতার চেয়ে এলোমেলো গদ্য বেশি ভালো লেগেছে

তুলিরেখা এর ছবি

শুনে ভালো লাগলো। অনেক ধন্যবাদ।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

শাহীন হাসান এর ছবি

দৃষ্টি মেলে দিই ভিতরে, আরো ভিতরে-
যেখানে তোর রক্তিম হৃদয় দপদপ করছে।.....

....................................
বোধহয় কারও জন্ম হয় না, জন্ম হয় মৃত্যুর !

তুলিরেখা এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

তাপস শর্মা এর ছবি

ভালো লাগল

তুলিরেখা এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ। আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

চলুক

তুলিরেখা এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

সাফিনাজ আরজু এর ছবি

দৃষ্টি মেলে দিই ভিতরে, আরো ভিতরে-
যেখানে তোর রক্তিম হৃদয় দপদপ করছে।

চলুক

গদ্যর জন্য হাততালি
ভাল লাগল আপু। হাসি

__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---

তুলিরেখা এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ সাফিনাজ আরজু। ভালো থেকো। হাসি

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

জোহরা ফেরদৌসী এর ছবি

আর কিছু না। পিছনে অধরা অতীত, সামনে অজানা ভবিষ্যৎ।

ভাল লাগল এই মগ্ন চৈতন্যের কথোপকথন ।

__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার

তুলিরেখা এর ছবি

আপনাকে অনেক ধন্যবাদ জোহরা। ভালো থাকবেন।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।