নীল একটা বৃষ্টিকণা, আকাশ থেকে তাকে দিঘিতে পড়তে দেখেই আমিও ঝাঁপ দিই। আস্তে আস্তে ডুব দিতে থাকি দিঘির ভিতরে, টুপটুপে নীল বৃষ্টিকণাটার সঙ্গে ডুবতে থাকি, ওটা মিলিয়ে যায় নি, অদ্ভুত একটা নীল রত্নের মতন আমার সামনে সামনে ঝিলিক দিতে দিতে ডুবছে, কোথা থেকে আলো পড়ছে ওর উপরে যে এত ঝিকমিক? চারপাশে সোনালী লাল কালো মাছেরা পাখা ঝটপটিয়ে সাঁতরায়, আমি ডুবতে থাকি, ডুবতে থাকি। নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের জরুরী ব্যাপারটা একেবারেই যেন অপ্রয়োজনীয় হয়ে গেছে।
তারপরে একেক স্তরে দেখা দিতে থাকে ওরা, আকাশবাড়ির বারান্দায় ওদের আমি দেখেছিলাম। তখন ওরা হৈ হৈ করে বেঁচে ছিলো সেখানে। ওদের চিনতাম। সত্যি করে চিনতাম কি?
প্রথমে ঊষা। ও কবিতা লিখতো। অদ্ভুত কোমল আর উদাসী কবিতা। একজন বলেছিলো ওর কবিতা পড়লে অনেক পরিশ্রমের পর ঘরে ফিরে স্নান সেরে নরম বিছানায় শুয়ে থাকার অনুভূতি হয়। আমার অবশ্য ওর কবিতা পড়ে আশ্চর্য একটা ভোরবেলার কথা মনে হতো, শরৎকালের শিশির ঝলমল সোনা-রোদ্দুরমাখা নীল আকাশওয়ালা একটা ভোর, আশ্চর্য একটা হাওয়ায় সেখানে দুলছে একটা লতা, একটা মস্ত বাড়ীর থাম জড়িয়ে দোতলা তিনতলা পেরিয়ে একদম উপরের ব্যালকনিতে চলে এসেছে সেই লতা, শরৎসকালের অদ্ভুত নীল আকাশের মতন উজ্জ্বল নীল ফুলের গোছা দুলছে সেই লতায়।
আকাশবাড়ী তখন ছিলো শুধু লেখার জায়্গা, ছবি বা গান বা ভিডিও কিছুই তখন সেখানে আসতো না, সব কিছু কল্পনা করে নিতে হতো লেখা থেকে। ঊষার চেহারাও কল্পনা করে নিয়েছিলাম। মস্ত ঘের ওয়ালা রেশমের সাদা ঘাঘড়া আর গলায় ঝালর কুঁচি দেওয়া সাদা রেশমের থ্রী কোয়ার্টার হাতা জ্যাকেট পরে দাঁড়িয়ে আছে তিনতলার ব্যালকনিতে, সদ্য ওঠা সূর্যের আলো পড়েছে ওর সদ্যস্নাত মুখে আর পিঠের উপর মেলে রাখা ভেজা চুলে, ওর চোখের পক্ষ্মগুলোতে বিন্দু বিন্দু জল লেগে আছে তখনো। কেজানে কেন ওকে এইরকম কল্পনা করতাম! বাস্তবে সে কেমন ছিলো কেজানে! তাতে কী ই বা আসে যায়?
ওর উদাসী কোমল কবিতাগুলো থেকে এইরকমই একটা মূর্তির আভাস আসতো, ঐ তো ব্যালকনি থেকে সূর্যপ্রণাম সেরে সে এবার ফিরে যাচ্ছে লেখার টেবিলে, দেওয়ালজোড়া মস্ত ফ্রেঞ্চ-উইন্ডোর সামনে মস্ত মেহগিনি কাঠের টেবিল, তার উপরে একটা ঘন খয়েরী রঙের টেবিল ক্লথ, চারকোণে সাদা রেশম কাপড় বসিয়ে করা অ্যাপ্লিকের কাজ, ফুল পাতা নকশা। টেবিলের উপরে থাক দিয়ে সাজিয়ে রাখা বইপত্র আর ওর লেখার খাতা। থার্মোকলের কলমদান, নিপুণ গেলাস আকৃতিতে কাটা। তার মধ্য থেকে নীল কলম তুলে নিয়ে বাঁপাশের থাক থেকে কবিতা লেখার খাতা তুলে নিয়ে লিখতে শুরু করলো সে। এইরকম মনে হতো ওর লেখা দেখে। হয়তো এসব কিছুই না, আজকাল কে আর কাগজের উপরে কলম দিয়ে কবিতা লেখে? সেও হয়তো লিখতো না, সেও হয়তো তার টেবিলের উপরে রাখতো ছোটো ল্যাপটপ, কীবোর্ডে-আঙুলেই লিখতো, তুলে রাখতো ফাইলে বা ব্লগে, কেজানে! কিন্তু ওর কবিতাগুলো পড়লেই পুরানোদিনের সেই ঝরা শেফালি ভরা মাটি, কাশফুল দোলা মাঠ আর কীবোর্ডহীন সেই কাগজ কলমের দিন মনে পড়তো।
ডুবতে থাকি, পরের স্তরে ভেসে ওঠে আকাশবাড়ীর আরেকজনের মুখ। সুনন্দা। সে গল্প লিখতো, অদ্ভুত সব ফ্যান্টাসি।তার গল্পে চাঁদের আলোর ভিতর দিয়ে উড়ে নেমে আসতো দুধসাদা পক্ষীরাজ, আসলে সে মেয়ে পক্ষীরাজ, পক্ষীরাণী ও বলা যায়। দুইপাশে তার দুই ডানা মেলা। মন্দুরার কিশোর পক্ষীরাজটির কাছে এসে সে বলতো, "অ্যাই ভোঁদু, দড়ি কাটতে পারিস না? চিবিয়ে কেটে ফ্যাল, তারপরে-- তুই তো উড়তে পারবি না, দৌড়ে পালাই চল ঝাঁঝার জঙ্গলে।"
আরো ডুবি, ডুবতে থাকি। দেখা দেয় ইমনের মুখ। সেও লিখতো, কল্পজগতের কথা। তার কথা ভাবতে গেলে কেবল তার গল্পের সেই অভিমানী কিশোরের কথাই মনে হয় যে জ্যোৎস্না থেকে পালাতে পালাতে চলে গেছিলো দীঘাইপাহাড়ে। চূড়ার কাছে এক গুহা, সেখানেই সে থাকতো। শুক্লপক্ষে বেরোতো না চাঁদ না ডোবা পর্যন্ত, কৃষ্ণপক্ষে কোনো কোনোদিন একটুখানি বেরোতো সাঁঝের বেলা, আকাশের কোণে চাঁদের গলুইটুকু দেখা দিলেই আবার গুহার ভিতরে সেঁধিয়ে যেত।
কিন্তু অমাবস্যায় সে সারারাত থাকতো খোলা আকাশের নিচে। আকাশ জুড়ে তারা ফুটফুট করতো, নতুন ফোটা খইয়ের মতন সব তারারা, আকাশটা যেন উপুড় করা কড়াই, সে কড়াই থেকে ছড়িয়ে পড়ছে কেবলি ছড়িয়ে পড়ছে তারার খই। সে হাত বাড়াতো খই নেবার জন্য।
অলৌকিক বৃষ্টিকণার মায়ায় দেখি অনন্ত সাদা খই ছড়ানো নীল মাঠের উপর দিয়ে হাঁটছে থাকে ইমন, দূরে কোথায় দূরে দিগন্ত, সেখানে উপুড় হয়ে পড়েছে সবুজ আকাশ। সেইদিকে চলেছে সে। পায়ে সুড়সুড়ি দেয় নীল আংটিদূর্বা, নীল চোরকাঁটা বিধে যায় পরণের কাপড়ে। মাঠের একপাশ দিয়ে বইছে লাল নদী, তার কিনারে বেগুণী বালিতে উঠে রোদ পোহাচ্ছে দুটো গোলাপী কাছিম। সবুজ আকাশে অলস ভাসছে ম্যাজেন্টা রঙের মেঘেরা। সবুজ আকাশ জুড়ে দুলতে থাকে কার যেন চকচকে নীল বিণুনী। এক থেকে দুই, দুই থেকে চার, চার থেকে আট, আট থেকে ষোলো ---জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকে বিণুনীর সংখ্যা, বদলে যেতে থাকে রঙ, সোনালী লাল কমলা কালো বিণুনীরা পাক খুলে খুলে মিশে যেতে থাকে ম্যাজেন্টা মেঘে।
কাঁচকড়ার পুতুল বুকে চেপে সবুজ ফুটি ফুটি ফ্রক পরা বুন্টুলি এসে তাকে বলে, আমার ভালোনাম বিদ্যা, আগে ছিলো, কিন্তু আমি তো আর নেই। ঐ নীলকমলিনীর ঝাড়ের কাছে মাটির নিচে আমার ছাই আছে। আমি এখন যেখানে থাকি, সেখানে আকাশে একজোড়া কমলা চাঁদ, কমলা রঙের জ্যোৎস্না হয় সেখানে। তুমি দেখতে চাও?
ঐ যে যখন শব্দজব্দ মাথার ভিতর সাঁতার কাটে
ঘুমের ভিতর আস্তে আস্তে লালমাছেরা মারছে ঘাই
খাদের অত কাছে ঝুঁকে কিশোর যখন খুঁজছে গান-
তখনই কি সন্ধ্যে নামার মাঠের শেষের সে গড়খাই?
এবার আমার বোতামছেঁড়া শার্টে তোমার সূচের ফোড়
ফোড়ন কাটা শেষ না হতেই ফোড়ন পড়ে ঝাল কড়াই
পিটুলিগোলার আল্পনারা লুকিয়েছে কোন বইপাতায়
শেকড়বাকড় ধুয়ে নিয়ে জল বলেছে সাগরযাই।
মন্তব্য
আপনার লেখাটি পড়তে পড়তে কল্পলোকে চলে গিয়েছিলাম।
শুনে ভালো লাগলো।
মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
তুলিদি আপনার লেখায় ডুবে গিয়েছিলাম, অদ্ভুত ভাল লাগলো।
আপনার ভালো লেগেছে জেনে আমারও ভারী আনন্দ হলো।
ভালো থাকবেন।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
নতুন মন্তব্য করুন