নিঃশব্দ নীল স্বপ্নের ভিতরে ঝরছিল কান্না, মোহনা-নিকটের নদীর মতন শান্ত। সন্ধ্যাবেলার তারা ফুটতে থাকা আকাশের মতন নীরব, গহীন রহস্যময়। সন্ধ্যাতারার ছায়া যখন নদীর শান্ত ঘুমেলা স্রোতের ভিতর কাঁপে, সেইরকম। সেই নীলস্বপ্নের মধ্যে ঘাই দিয়ে উঠলো একটা মাছ, একটা অদ্ভুত দ্রুতগতির মাছ, রুপোলী রঙ ঝলকাচ্ছে তার গায়ে। সে সাঁতরে চলেছে পাশে পাশে তার চঞ্চল ছায়াটিকে নিয়ে।
স্মৃতিতে একটা নদী ছিল সত্যিই। সেই নদীর পারে ছিল একটা অদ্ভুত অসমাপ্ত মূর্তি, মাটির এক মাতৃকাদেবী। খড়ের চালার আচ্ছাদনের তলায় বৃষ্টি থেকে বাঁচিয়ে সেই মূর্তি গড়া হচ্ছিল। কিন্তু শেষ হয় নি গড়া, চোখ-মুখ-নাক-বিহীন একটা অদ্ভুত মসৃণ গোল মুখমন্ডল, আধা আধা হাত, মাথায় কুন্ডলী করা চুল, গলার নিচে থেকে আর গড়া হয় নি, সেখানে শুধু বাঁশের খাঁচা।
মনে পড়ে আমাদের বানভাসি প্রহর। সে প্রহর শেষ হবার পরে তুই ঘুমিয়ে গেলি। অদ্ভুত নীল আলোর তলায় চুপ করে বসে ছিলাম আমি, চেয়ে ছিলাম তোর ঘুমন্ত মুখের দিকে। তোর বন্ধ চোখের পাতায় ছায়ার রঙ, নীলাভ লাগছিল ঐ আলোয়। তোর ঠোঁট দুটো অল্প অল্প কাঁপছিল, যেন তুই ঘুমের ঘোরে কথা বলছিস। তোর মর্মরপাথরের মতন মসৃণ গলা ঘিরে ছিল সবুজ পাথরের পুঁতিওয়ালা একটা হার , কেন কেজানে ঐ রঙের পাথরই তোর পছন্দ ছিল। নীল আলোয় সবুজ বোঝা যায় না, কেমন অদ্ভুত দেখায়। তোর রেশমী চুল ছড়িয়ে পড়েছিল বালিশ ছেয়ে। তোর গলার পর থেকেই ঢাকা ছিল হাল্কা আকাশি রঙের চাদরে। তোর দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে কেবলই সেই অসমাপ্ত দেবীমূর্তি মনে পড়ছিল, কেন কেজানে!
পূর্ব-মাতৃকা ঋণ বাকী রয়ে গেছে বহুকাল
নদীনীরে ঊষাস্নানও ভুলে গেছি একা চুপচাপ,
দিগন্ত ধোঁয়াশা ঢাকা, তারারা বিষাদ-ম্লান
মনে পড়ে কবেকার ভোরমেঘে আলোর আলাপ।
ভিতরপুকুরে রাখা লবণ ও রঙীন পাথর
সবুজ-মলাট শারদীয়া, হাওয়া ওড়া গল্পের ঘুড়ি
শরবনে ডাহুকের ঘর, দিঘিতে শালুককলি
বুক-নিঙরানো নীল ঐ আকাশ করেছিল চুরি।
পূর্ব-মাতৃকা ঋণ বাকী রয়ে গেছে বহুকাল--
মন্তব্য
নতুন মন্তব্য করুন