লামেহা অব্যয়বোঝাই ঝোলাটা কাঁধে তুলে নিয়ে রওনা দেয় সবুজ-জমি বালি-জমি পাথর-জমি পার হয়ে নীল পর্বতের দিকে। সে চলে, চলে আর চলে। ভোরবেলার কোমল টুকটুকে সূর্য ঝকঝকে রাগী হয়ে আকাশের কত উপরে উঠে গেছে, লামেহার চলা থামে না তখনো। অব্যয়গুলো তার ঝোলায় কোলাহল করে। আঁ আঁ আহ আহ ঈশ কিংবা সুতরাং এবং ইত্যাদিরা নানারকম সুরে গান ও কথা চালাতে থাকে। ঠিক দুপুরবেলায় ক্লান্ত লামেহা ঝোলা নামিয়ে শুয়ে পড়ে পান্থপাদপের ছায়ায়।
ঘুমের ভিতরে তার গহীন আকাশ জুড়ে গোলাপী রং গাঢ় হয়ে ওঠে, তারপরে চারপাপড়ি ফুলের চারখানি পাপড়ির মতন খুলে যায় সেই গোলাপী, চারটি ফুলপরীর মতন চারদিকে উড়ে যায় শ্রী হ্রী স্বাহা ও স্বধা, উড়ে যায় খোলা আকাশ দিয়ে, সেই আকাশ তখন এক্কেবারে নীলকান্তমণির মত ঘন নীল।
তারপরেই লামেহার চোখ খুলে যায়, দ্যাখে, যাহ, সব স্বপ্ন! আকাশে জ্বলন্ত সূর্য, চারিদিক দুপুরবেলার ঘুমেলা নির্জনতায় ঘেরা। পান্থপাদপের ছায়াটি একটুখানি বড় হয়েছে আর একটুখানি পুবে হেলেছে।
কিংবা-আ, সু-উ-উতরাং, থেকে এ এ এ, দিয়ে এ এ এ আহ, উহ, ছোঃ অথবা-আ আ ঈশ টাপ্পুর টুপ্পুর ক্রিং ক্রিং টুপটাপ ঝমঝম ঝুপঝুপ কড়কড়াৎ ঝিক ঝিক---এইসব আওয়াজ আসছে ক্রমাগত। প্রথমে সদ্য স্বপ্ন থেকে জাগা লামেহা বুঝতে পারে না কোথা থেকে এইসব আসে, তারপরে ঝোলাটার দিকে চোখ যায়, ঝোলাটা নড়ছে একটু একটু। অব্যয়দের কথা মনে পড়ে যায় ওর। সস্নেহে চাপড় মারে ঝোলায়, বলে, "ঘুমো ঘুমো ঘুমো তোরা।"
তারপরে পুবে সরে ছায়ার তলায় গুটিসুটি মেরে লামেহা শুয়ে পড়ে আবার, চোখ জড়িয়ে আসে ঘুমের আঠায়।
রোদের তেজ কমে এলে তার ঘুমও আস্তে আস্তে ছানাকাটা মেঘের মতন পাতলা হয়ে আসে, তারপরে পালিয়ে যায়। উঠে বসে লামেহা। পান্থপাদপের জলে তৃষ্ণানিবারণ করে আঁজলার বাকী জলটুকু মুখচোখে ঝাপ্টা দিয়ে সে ঝোলা নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। ঝোলাভরা ঘুমন্ত অব্যয়দের নিয়ে সে আবার চলা শুরু করে নীল পর্বতের দিকে। দীর্ঘ, বড়ই দীর্ঘ সেই পথ-
আগুনের অদ্ভুত শিল্প,
রক্তিম সোনালী শিখার লাফ-
অনন্ত ক্ষুধা ও অশেষ তৃষ্ণা
নিরবচ্ছিন্ন যন্ত্রণার আলোড়ন।
তার পা দুটো ভারী হয়ে আসে,
আকাশপাতাল ক্লান্তি-
মুখ গলা থেকে শুরু করে বুকের ভিতর
পর্যন্ত শুকিয়ে আসে বালি-বালি তৃষ্ণায়।
জীবন, তুমি কোথায় ?
আঁধারের ছায়াময় হাত এগিয়ে আসছে
সে ছুঁয়ে ফেলার আগেই
তুমি এসো মৃত্যুঞ্জয়।
*******
মন্তব্য
প্রথমেই বলি চমৎকার হয়েছে।
আপনার লেখা যে ক'টা এখানে পেলাম সব কটাই পড়ে ফেললাম। খুব ভালো লাগল। সবচেয়ে ভালো লেগেছে, পূর্ব-মাতৃকা আর এইটি। দুটি গল্পের আঙ্গিক-এ বেশ আকর্ষণ আছে। তবে এই গল্পটি একটি জায়গায় মনে হয় আরো একটু মনোযোগ পেলে ভাল হত। সেটা হচ্ছে, গল্পের চল যত এগিয়েছে, খুব সুন্দরভাবেই মনে হয়েছে যে লামেহা একটা নির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে, একটা উদ্দেশ্য নিয়ে এগোচ্ছে আর সেই উদ্দেশ্যের অন্তরালে বিশেষ একটা কোন কারণ আছে। কিন্তু তার পরেই গল্প দ্রুত শেষ হয়ে গেল আর সেই কারণের জায়গাটি ফাঁকা রয়ে গেল। উদ্দেশ্যটা বুঝতে পারার আগেই গল্প শেষ হয়ে গেল। একটু তাড়াহুড়ো হয়ে গেল মনে হয়। অবশ্য এই কথাগুলো সবটাই আমার যেমন মনে হয়েছে, তত কিছু গুরুত্ব দিতে হবে এমন কোনো ব্যাপার নয়। আরো এই রকম গল্প লিখুন, লিখতে থাকুন।
- এক লহমা (অমিত)
এক লহমা(অমিত), আপনাকে ধন্যবাদ। আসলে এই ধরনের লেখাগুলো ঠিক গল্প নয়, আবার পুরোপুরি কবিতাও নয়, একরকম এক্সপেরিমেন্ট বলতে পারেন। ট্যাগে দেখবেন লেখা আছে "কথা ও কবিতা"। খানিকটা কথা তারপরে খানিকটা কবিতা, বা খানিকটা কবিতা খানিকটা কথা-এইরকম। একটা আরেকটাকে জড়িয়ে আছে, পাঠকের মন ঠিক করবে কোনটুকু কবিতা কোনটুকু গদ্যকথা।
ভালো থাকবেন।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
নতুন মন্তব্য করুন