সুদক্ষিণ

তুলিরেখা এর ছবি
লিখেছেন তুলিরেখা (তারিখ: রবি, ৩১/০৩/২০১৩ - ৬:৩৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বিরাট এক স্পন্দনশীল অন্ধকার আমায় আষ্টেপৃষ্ঠে পেঁচিয়ে ধরেছে, চারিদিকে কালো জল ছলছল করছে। ওর মধ্য দিয়ে সাঁতার কাটতে কাটতে বেরিয়ে আসতে চাইছি আলোয়। তখনও কালো বা আলোর কথা ঠিক বুঝতে পারি না, কিন্তু একটা অদ্ভুত তাড়না আমায় ঠেলা মারে, আমার সদ্য তৈরী হওয়া মগজে কোটি কোটি বছর আগের যে স্মৃতি খোদাই হয়ে আছে, সেই স্মৃতিই আমার পূর্বসংস্কার, সেই আমাকে জানায় আলো আর কালোর গল্প।

কিন্তু কোথায় আলো? অন্ধকারের জরায়ু কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে? সুড়ঙ্গের শেষ কোথায়? কোথায় ঝিকমিক করছে জোরালো আলো? আমি প্রাণপণে সাঁতরাই, ডাইনে বাধা বাঁয়ে বাধা, ঠোক্কর খেতে খেতে এগিয়ে যেতে থাকি প্যাঁচালো সর্পিল পথ ধরে। ঠিক দিকে যাচ্ছি কি? কেজানে!

ঘুম ভেঙে যায়, ঘামে ভিজে গেছে সারা গা। সেই স্বপ্নটা! আবার!!! কেন দেখি এটা বারে বারে?

নিজেকে সামলে নিতে নিতে উঠে বসি সাবধানে, পাশে শেষরাতের অঘোর ঘুমে অচেতন হিন্দোল। ঘরের মধ্যে অদ্ভুতুড়ে নীল আলো, ফ্যানের হাওয়া মশারির চালে হালকা ঢেউ তুলছে। বিছানা ছেড়ে উঠে ব্যালকনির দিকের দরজাটা আলতো করে খুলে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াই। আহ, বাইরে কী হাওয়া! সেই কতদূর দক্ষিণ সমুদ্র থেকে আসছে। খোলা বাতাসে শরীর জুড়িয়ে নিতে নিতে চোখ তুলে তাকাই উপরে, আকাশে তারা আর তারা, সেই কোন পুরাকাল থেকে একইভাবে চেয়ে আছে পৃথিবীর দিকে। কত যুগের কত মানুষের কত আনন্দ কত যন্ত্রণার নীরব সাক্ষী ওরা।

ঘাম শুকিয়ে গেলে ঘরে এসে আবার শুয়ে পড়ি, ঘুমের মধ্যে ডুব দিতেই দৃশ্য বদলে যায়। দেখি, হামাগুঁড়ি দিয়ে অন্ধকার গুহা থেকে বার হচ্ছি। বাইরে এসে দেখি উপরে আকাশ আর পায়ের নিচে রুখু বাদামী পাহাড়ের গা। পাহাড় বেয়ে বেয়ে নেমে আসি, এখানে ওখানে পাথরের খাঁজে পা রেখে, এখানে ওখানে গাছ গাছড়া আঁকড়ে বা শক্ত লতা ধরে ধরে। পথ তো নেই এই পাহাড়ে।

নামতে নামতে নীল সমুদ্রের কথা মনে পড়ে, এই তো মাত্র কয়েকদিন আগেই ছিলাম সমুদ্রে, ভেজা বালির উপরে ঝাঁক ঝাঁক সীগাল আর তাদের অদ্ভুত সুন্দর ডাক। পাহাড় বেয়ে নামতে নামতে করতে করতে হাঁপ ধরে যায়। দেখি পৌঁছেছি পাথরের একটা চাতালের মতন জায়গায়। লাল ফুলওয়ালা একটা লতা দুলছে হাওয়ায়। হাঁপ ধরা শরীরটা নিয়ে কোনোরকমে লতাটার কাছে গিয়ে বসে পড়ি, তারপরে শুয়ে পড়ি। ক্লান্তি, বড্ড ক্লান্তি। আয় ঘুম, আয়।

এইখানে স্বপ্নের ঘুম আর সত্যিকারের ঘুম মিশে যায়, শান্তি শান্তি শান্তি। যখন পরদিন যখন ঘুম ভাঙে তখন দেখি সকালের রোদে ভেসে যায় দুনিয়া। হিন্দোল ঘুম থেকে উঠে পড়েছে আগেই, খুলে দিয়েছে দক্ষিণের ঐ বড় জানালা-

দক্ষিণের ঐ জানালা খুলে দিলেই
একটা ম্যাজিক হয়।
মেঝেতে আছড়ে পড়ে
এক-জানালা আকাশ-
এক-আকাশ রোদ্দুর
আর এক-চুমুক সমুদ্দুর।
আলো এসে ছুঁয়ে দেয়
ছায়ার মায়াবী আঁচল।

দক্ষিণের ঐ খোলা জানালা দিয়ে আমি
উড়িয়ে দিই আমার এই গৃহবদ্ধ পোষা দৃষ্টি,
চলতে ফিরতে ফণীমনসার কাঁটায় রক্তাক্ত
সেই দৃষ্টি হঠাৎ যেন পেয়ে যায়
দু'খানা সবল উজ্জ্বল সোনালী ডানা।

সে অনায়াসে পার হয়ে যায়
চিবোনো চিবোনো সব বাঁকা বাঁকা কথা,
ক্ষুরের মতন ধারালো সব বাধা আর নিষেধ-
পার হয়ে যায় শত শত মাঠ, বন, নদী, গ্রাম, শহর
যেতে যেতে আলতো ছুঁয়ে দেয় পাহাড়ের চূড়া,
একটুখানি খেলে নেয় নীল আকাশের
তুলো-তুলো মেঘেদের সঙ্গে-
আর অক্লান্ত উড়তে থাকে ঐ
আদিগন্ত ছলাৎছল নীল সমুদ্রের দিকে।

*******


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।