কেমন একটা অবাক-ঠান্ডা লাগছিল, যেন এইমাত্র জন্মালাম। মায়ের উষ্ণ গর্ভগৃহ থেকে বেরিয়ে যেন এসে পড়েছি এক বিপুলবিস্তার জগতে। সেখানে অনেক আলো, অনেক হাওয়া আর অদ্ভুত কনকনে এক হঠাৎ শীত যাতে অভ্যস্ত হতে আরো সময় লাগবে। একটা পর্দা যেন সরে যাচ্ছিল মনের চোখের উপর থেকে। আর, এক আশ্চর্য কোমল সম্মোহনী শব্দ আসছিল, কোনো স্রোতের শব্দ। পরে সেই স্রোতের উৎস খুঁজে পেয়েছিলাম, একটা ছোট্টো ঝর্ণার মতন, দু'পাশে সারি সারি পাইনের ছায়ায় ঢাকা। দু'ধার থেকে সবুজ ফার্ণেরা ঝুঁকে পড়েছে ওর উপরে, স্রোত নিজের মনে বয়ে চলেছে আলোছায়ার বাঘডোরার ভিতর দিয়ে। গোল গোল কালো, সাদা, বাদামী পাথরে লেগে ফেনার ফুল ফুটে উঠছে।
সেই প্রথম ভোরে এত সব দেখতে পাই নি, শুধু দরজা খুলে বেরিয়ে এসে দেখেছিলাম পাইন গাছের পাতায় ভোরের আলো ঝলমল করছিল। আকাশটা কী তীব্র নীল ছিল! এর পরে কতবার দেখেছি ঐ নীল আকাশ, কিন্তু প্রথমদিনের মতন অমন আশ্চর্য নীল আর লাগে নি কখনো। সব অভিমান মুছে যাচ্ছিল। হারিয়ে যাচ্ছিল। সমস্ত পুরানো জীবনটাকে ফেলে আসা প্রিয় ছবির মতন দেখতে পাচ্ছিলাম আর যে ছবির উপরে হাত রাখা যাবে না।ও যে অনেক দূরে, ও যে অগম্য এক দেশে! ও যে অতীত! সে আর আমি নই। সে যেন অন্য মানুষের জীবন! সে যেন একটা কাহিনী, অন্য কারুর লেখা। " কতবার বর্তমান হয়ে গেছে ব্যথিত অতীত-/ তবুও তোমার বুকে লাগে নাই শীত/ যে-নক্ষত্র ঝরে যায় তার!/ যে পৃথিবী জেগে আছে, তার ঘাস-আকাশ তোমার/ জীবনের স্বাদ লয়ে জেগে আছো- "-নির্জন স্বাক্ষর(জীবনানন্দ দাশ)
ভালোবাসাকে বুঝতে পারি না
কখনো মনে হয় সে যেন কোনো অলীক ফুলের মত,
যাকে খররোদ থেকে আড়াল করে রাখে
বিশ্বাসের সবুজ পাতার নিবিড় ছায়া।
আবার তাকে কখনো মনে হয়
ফুঁসে ওঠা নদীর মতন সর্বনাশী,
এই বুঝি সব ভাসিয়ে দেবে চরাচরব্যাপী বন্যায়।
কখনো আলোর কথা মনে হয়, জ্যোৎস্নার কথা-
শান্ত বসন্তের রাত্রে টলটলে দিঘিতে
রুপো-চকচকে জ্যোৎস্নার ছলছল টলটল আলো।
ভালোবাসা অমন বুঝি?
তাকে ঘিরে রাখে নির্জন রাত্রির শান্তি?
হেঁটে যেতে যেতে অচেনা পাখির ডাক শুনে পথ ছেড়ে মাঠে নামি। সে এক তৃণরোমাঞ্চিত প্রান্তর, ঐ দূরে নীল পাহাড়ের ঢেউ পর্যন্ত তার বিস্তার, সবুজ সমুদ্র যেন এক। বাসন্তী কমলা সাদা লাল নীল রঙের প্রজাপতির মত ঘাসফুলেরা আমার দিকে চেয়ে হাওয়ায় মাথা দুলিয়ে হাসে। হঠাৎ মনে হয় কে যেন ফিসফিসিয়ে বলে, " আমি আছি, বুঝতে পারো না? " কে বলে? সেই সে? যে অপার্থিব ফুলের মতন, সর্বনাশী নদীর মতন, অলীক জ্যোৎস্নার মতন?
ঐ চাঁদ আর এই পৃথিবী কী যেন শলাপরামর্শ করে, অজানা মহাকর্ষ ভাষায়। সমুদ্র ফুলে ওঠে, ফেঁপে ওঠে, চরাচর ভাসিয়ে এগিয়ে আসে অদ্ভুত বন্য অতিথির মতন। তারপরে ভাসাভাসি শেষে আবার সরে যায় সব ফেলে রেখে। মনে পড়ে এক সমুদ্র এসেছিল আমার কাছেও তো, সব বাধা ভেঙে, সব বিরুদ্ধতা অগ্রাহ্য করে। কিন্তু তারপরে? জোয়ার শেষে লোনা মাটি ফেলে রেখে চলে গেছে। দোপাটিফুল তুলে প্রতিদিন ভোরে রেখেছি পাথুরে বেদীতে, প্রতিদিন সন্ধ্যায় ফিরে এসে দেখেছি শুকিয়ে গেছে ফুল। দিনের পরে দিন গেছে, বারে বারে চন্দ্রভুক অমাবস্যা বদলে গেছে নিটোল গোলচাঁদের পূর্ণিমায়, সে ফিরে আসে নি।
বিনিদ্র চন্দ্রলেখা দাঁড়িয়ে থাকে অন্ধকার শিমূলগাছের তলায়। কেউ নেই কোথাও, সবাই ছেড়ে গেছে। শুধু আছে শনশন হাওয়া, শিরশিরিয়ে দিচ্ছে তার ভিতর-বাহির। আর উপরে আছে খোলা আকাশ। চিরদিনের অচঞ্চল সাথী। সেখানে ভাসছে একফালি চকচকে চাঁদ আর জ্বলজ্বল করছে হাজার হাজার তারা।
*******
মন্তব্য
-------------------
সুবোধ অবোধ
-------------------
শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি কেন এত বোকা হয়?!!
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
বাহ
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
নতুন মন্তব্য করুন