২।বাগানে এসে আক্ষরিক অর্থে মুগ্ধ হয়ে গেলো নীলা। নদীটা এত সুন্দর! বাগানটাও দারুণ! আহ, তাহলে এত কষ্টের পরে স্বর্গের দেখা মিললো! এখানেই সারাজীবন থাকতে হলে ক্ষতিটা কিসের? বরং অনেক শান্তি, অনেক সুখ! চাইনা তার শহরের হইহট্টগোল, শতশত বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে সিনেমাথিয়েটারে যাওয়া রেস্তরাঁয় খেতে যাওয়া, অনর্গল উল্টোপাল্টা বকবক করা, বন্ধুত্ব বাঁচাতে অন্যায়ের প্রশ্রয় দেওয়া, দলাদলি, ঝগড়াঝাঁটি, কিছু তার চাইনা--- এই নিরিবিলিতে নির্জন শান্তিতে কাটিয়ে দিতে পারলে সে আর কিছু চায়না।
একাকীত্ব তার কাছে কষ্টের কিছু না, সকলের মধ্যেও সে একাকীত্ব নিয়েই বেড়ে উঠেছে, এমনি সাধারণ বন্ধু তার ছিলো অনেকই, অনেকেই নীলাকে পছন্দ করে ওর হাসিখুশী মিশুকে আর শান্ত স্বভাবের জন্য, কিন্তু সেরকম প্রকৃত বন্ধু কি ছিলো কোথাও? যার কাছে হৃদয়ের কথা উজার করা যায়? নাহ, নীলার মনে পড়ে না, হয়তো সেরকম বন্ধু মাটির পৃথিবীতে পাওয়ার আশা করা অনুচিত। এখানে সবকিছু বড়ো ভঙ্গুর, বড়ো অনিশ্চিত। বড়ো সাবধানে ভয় ভয়ে চলতে হয়, এই বুঝি ভেঙে পড়ে, এই বুঝি ক্ষয়ে যায়, এই বুঝি বিশ্বাসী সঙ্গী পিছন থেকে ছুরি মারে! একজনকে বড়ো বেশি বিশ্বাস করতে গিয়েই তো-
নাহ, সেকথা আর ভাববে না নীলা। এই শান্ত নদীটির তীরে ভোরের হাওয়া বুক ভরে টেনে নিতে নিতে নীলার মনে হয় অতটা হতাশার হয়তো কারণ নেই। হয়তো সত্যিই মাটির পৃথিবী এত দুঃখের নয়, এই যে করুণাময়ী প্রকৃতি নীলাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে মায়ের মতন-এ হয়তো সব জানে, সব বোঝে। নীলাকে বলতে হবে না, সেই হৃদয়ভার না বললেও বুঝে নেবে।
ঐ যে একটা পাখি পাতার আড়ালে বসে কোথা থেকে কী অদ্ভুত সুরেলা গলায় টুইকি টুইকি করে ডাকছে, ঐ যে একটা কাঠবেড়ালি আমগাছ থেকে তুরতুরিয়ে নেমে এসে ঘাসের উপর দিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে সজনেগাছের দিকে যাচ্ছে আর যেতে যেতে ভয়ে নীলার দিকে তাকিয়ে দেখছে-এইসব ছোট্টো ছোট্টো দৃশ্যগুলো এত দামী আগে কখনো মনে হয় নি নীলার!
সকালবেলাতেই বলাইবাবু দেখাতে নিয়ে এসেছেন বাড়ী আর নীলা বাড়ীঘর দেখে বাগানে এসে মুগ্ধ আত্মহারা। সে বললো জিনিসপত্র পরে আনালেই হবে, এখন সে বাগানে কাটাতে চায়। এই ছেলেমানুষী দেখে ভদ্রলোক হাসতে হাসতে নীলার জিনিসপত্র আনানোর ব্যবস্থা করতে চলে গেছেন আর গৃহকর্মের জন্য একজন কাজের লোকের ব্যবস্থা করতেও। ঘরদোর বহুদিন ব্যবহার না হওয়ায় ধুলাময় হয়ে আছে তাছাড়া রান্নাবান্না, জল তোলানোর ব্যবস্থাও করতে হবে। এখানে তো স্নানটানের জল সব কুয়োর জল আর খাবার জল আসে টিউবওয়েল থেকে। যাবার আগে বলে গেছেন যে নীলাকে আজকে শনিবার করে আর কাজে যোগ দিতে হবে না, একেবারে কালবাদে পরশু সোমবার ভালো দিনে যোগ দিলেই হবে। এখানে স্কুলগুলো সোম থেকে শুক্র পুরো হয়, শনিবারে হাফ স্কুল আর রবিবারে ছুটি। মাঝে মাঝে কোনো বিশেষ প্রোগ্রাম টোগ্রাম থাকলে অবশ্য শনিবারে হাফছুটির পরেও কাজকর্ম হয়।
নদীর একেবারে কাছে একটা ঘাট, পাথরের ধাপগুলোর একেবারে শেষ কটা জলের নীচে। আগেরদিন বৃষ্টি হয়ে ধাপগুলো একেবারে পরিষ্কার। নীলা উপরের ধাপে বসে নদীর দিকে চেয়ে রইলো। আগে কখনো নদীর এত কাছে জীবন কাটায় নি সে, কিন্তু নদী ও খুব ভালোবাসে। একবার মনে পড়ে পরীক্ষা দিতে যেতে হয়েছিলো নৌকা করে, সেই দিনটার কথা মনে আছে নীলার। ফেরার পথটার কথা, আকাশ ভর্তি এলেমেলো মেঘ আর একটা টুকরো রামধনু। সারাদিনের পরে সন্দেশ আর মুসুম্বিলেবুর টুকরো খেতে খেতে ফিরছিলো নীলা, বাবা ওকে আনতে গেছিলেন। পরীক্ষার দিনগুলোতে কিছুতেই পরীক্ষা দিতে যাবার সময় খেতে পারতো না নীলা, টেনশনে খিদে থাকতো না। জোর করে খেলে ব্যাপারটা ভালো হবে না বলে মা নীলাকে জোর করতো না, সঙ্গে টিফিনবাক্সে কিছু খাবার দিয়ে দিতো। ফেরার পথে সেদিন জব্বর খিদে পেয়েছিলো । সেই শেষ দুপুরের খেয়ায় বেশী যাত্রীও ছিলো না। অমন নদীর উপরে বসে ঢেউয়ের দোলায় দুলতে দুলতে আগে কোনোদিন খাওয়া হয়নি নীলার। চমৎকার লাগছিলো সব। কেন মনে পড়ছে কেজানে! কোনোদিন হয়তো মা-বাবা, শ্যামলী, মণিদীপা, কুট্টিমাসী, মেসো... একদিন যদি তারা আসতো সবাই! হবে না, ব্যর্থ কল্পনা শুধু। নীলা দুইবিন্দু অশ্রু মুছে নেয় আঁচলে।
বলাইবাবু এসে গেছেন কাজের লোক নিয়ে। কাজের লোক একজন মধ্যবয়সী মহিলা, একহারা চেহারা, তেলচাপ্টি চুল খোপা করা, বেশ শক্তসমর্থই মনে হয় দেখে। কোমরে আঁচল গোঁজা, বেশ কাজে লেগে পড়ি লেগে পড়ি একটা প্রস্তুতি। কালচে মুখে কঠিন সহিষ্ণুতা।
নীলা নাম জানতে চায়-মহিলা নাম বলেন আন্না। সবাই আন্নামাসী ডাকে। অনেকদিন পরে এই আন্না নামের ইতিহাস শুনেছিলো নীলা, তখন অনেক কাছের হয়ে গেছে সে আন্নামাসীর। সেকালের ঘরের ব্যাপার, ছেলের আশায় আশায় তিনটে পর পর মেয়ে হয়েছিলো-নাম ছিলো দোলা, মালা আর বুলা। তারপরেও যখন মেয়ে হলো, তখন আরও মেয়ে হওয়া ঠেকাতে বাড়ীর লোকে নাম রাখলো আন্না-আর না। মানে আর মেয়ে যেন না দেন ভগবান। ভগবান শুনলেন, পরেরবার হলো তাদের স্বর্গে বাতি দেয়ার পুত্তুর, নাম রাখলো গোপাল। সেই গোপাল লায়েক হয়ে নিজের ঘরসংসার পেতে বুড়ী মাকে দিলো খেদিয়ে, বাপ অবশ্য ততদিনে চোখ বুজেছেন। সেই মা এই ছাই ফেলার ভাঙা কুলো, চারনম্বুরে ফ্যালনা মেয়ে আন্নার ঘরেই ঠাঁই পেলে।"কী করবো দিদিমুণি, বুড়ী মানুষ, ফেলতে তো পারিনে। আমিই সবচেয়ে কাচে থাকি। দোলা মালা বুলা রা কোথায় কোথায় দূরে দূরে আচে, তাদের নিজের সোমসারেও হাজার প্যাঁচ...আমি হেথা ঝাড়া হাতপা, ছেলে রাজমিস্ত্রীর যোগাড়ের কাজ করে, কবচ্ছর পরে নিজে রাজমিস্ত্রী হবে-মেয়ের বে দিয়ে দিয়েচি, নিজেও কাজ করি, তো বললাম থাকো, দু'বেলা দুমুঠো দিতে কি আর পারবুনি?" শুনতে শুনতে এই পোড়খাওয়া শক্ত চেহারার মহিলার অন্তরের ফল্গুধারার পরিচয় পাচ্ছিলো নীলা। সচ্ছল অসচ্ছল উচ্চনিম্ন সব ঘরেই মেয়েদের প্রতি জেনে বা অজান্তে এত অবহেলা এত তুচ্ছতাচ্ছিল্য যে কেন! মণিদীপা আর শ্যামলীই কি কম জানে? কিন্তু কিছু করার নেই, সব মেনে নিয়ে ওদের একদিন বাপমায়ের কথা মেনে লক্ষ্মী বৌ হয়ে চলে যেতে হবে স্বামী যেখানে নিয়ে যায়।মাঝে মাঝে নীলার মনে হয় মধ্যযুগেই কি পড়ে আছে আজো সমাজ? নইলে মেয়েদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার এত কম কেন আজো?
সেদিন প্রথম কাজে লেগেই আন্না প্রথমেই ঘরদোর ঝাঁট দিতে শুরু করে, ঝাঁট দেয়ার পরে জল তুলবে। তারপরে রান্নাবান্না। বলাইবাবু সেদিনের মতন বাজারও করে এনেছেন। নীলার কেমন একটা সংকোচ হয়েছিল, এরা এভাবে সবদিকে সাহায্য করছেন! কেজানে কতদিন লাগবে নীলার নতুন জীবনে অভ্যস্ত হতে! স্কুলে পড়ানো শুরু হয়ে গেলে নিশ্চয় সুবিধে হবে মূলস্রোতের সঙ্গে মিলতে। সহকর্মিণী শিক্ষিকাদের কাছ থেকে সব জেনে নিতে পারবে।
আন্না যখন রান্না করছে, নীলা আয়েস করে সোনাই নদীতে নাইলো, এই প্রথম তার নদীতে স্নান। এই নদীর জলও খুব স্বচ্ছ, আগে আগে যা সব নদী নীলা দেখেছে সব ঘোলাটে জলের নদী, এ নদী তেমন নয়। নীচে বালি আর পাথরনুড়ি চকচক করে তাও দেখা যায়। এরকম নদীর গল্প সে শুধু শুনেছিলো ঠাম্মার স্মৃতিচারণে। তাদের সেই শীতলক্ষ্যা নদী, জলের নীচে বালি চিকচিক করে। কোথায় চলে গেলো সেইসব গল্পে বোনা দিন!
(চলবে)
এখানে আগের পর্ব
মন্তব্য
বা:! পরের সংখ্যার অপেক্ষায় থাকলাম।
- একলহমা
ধন্যবাদ আপনাকে। দেখি কবে দিতে পারি পরের পর্ব।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
সুন্দর একটি উপন্যাসের দিকে ধাবিত হচ্ছে লেখাটি। অপেক্ষায় থাকলাম।
____________________________________________________________________
ইতিহাস পড়ি না, জন্মলগ্ন থেকে বাংলাদেশকে প্রতিদিন যেভাবে দেখেছি, সেটাই বাংলাদেশের প্রকৃত ইতিহাস।
উপন্যাসের দিকে? তাই? কেজানে, এখনো তো কিছুই বুঝতে পারছি না। দেখা যাক কী হয়।
আপনাকে ধন্যবাদ।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
শহুরে হৈচৈভিড়গ্যাঞ্জাম থেকে পালিয়ে বাগানের স্তব্ধতায় পৌঁছুনোর পরে, শব্দের অভাব কানের মাঝে শোঁ শোঁ করে বাজতে থাকে। মুগ্ধতা যেমনটা মনের ভেতরে গুড়িগুড়ি পায়ে ঢুকে পড়ে, সেটার জন্য কোনও টুকরো টাকরা শব্দও পাওয়া যায় না। অনির্বচনীয় বোধহয় তাকেই বলে!
পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
_____________________________________________________________________
বরং দ্বিমত হও, আস্থা রাখো দ্বিতীয় বিদ্যায়।
আপনাকে ধন্যবাদ।
দেখা যাক কবে নাগাদ আসে পরের পর্ব।
ভালো থাকবেন।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
_______________
আমার নামের মধ্যে ১৩
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
নতুন মন্তব্য করুন