শূন্য প্রাসাদে সাইকি এদিকে চায় ওদিকে চায়, যতদূর চোখ যায় চেয়ে চেয়ে দ্যাখে। না, নেই নেই কিউপিড নেই কোনোখানে। সে আসবে না। মনকে শক্ত করে সাইকিও বেরিয়ে পড়ে প্রাসাদ ছেড়ে। বাকী জীবনটা সে হারানো স্বামীকেই খুঁজবে। তাছাড়া তার জীবনের আর প্রয়োজন কী?
চলতে চলতে সাইকি গিয়ে পৌঁছায় দেবী জুনোর মন্দিরে। ভক্তিভরে পূজা দেয়। দেবী খুব সন্তুষ্ট হন। কিন্তু তিনি জানান তিনি নিরুপায়, সাইকিকে প্রত্যক্ষ কোনো সাহায্য করতে পারবেন না তিনি তার এই বিপদে। কারণ দেবী ভেনাস রেগে আছেন সাইকির উপরে, কিউপিড খুব অসুস্থ, বেশ খানিকটা পুড়ে গেছে তার কাঁধের কাছে। আর, মনেও নাকি খুব একটা ধাক্কা লেগেছে। ভেনাস নাকি সাইকিকে গালাগাল করতে করতে কিউপিডের চিকিৎসার ব্যবস্থা করছেন আর প্রাণপণে সেবা করছেন সারিয়ে তুলতে।
সাইকি আত্মগ্লানিতে ম্লান হয়ে বলে, "আমার ভুল, আমার দোষ। আমি অধৈর্য হয়ে বারণ না শুনে তার মুখ দেখতে গিয়েছিলাম। কিন্তু কী করবো দেবী, সামান্য মানুষ আমি, ভয়ে আর অনিশ্চয়তায় কতদিন কাটানো সম্ভব?"
দেবী করুণায় সাইকি মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, "সাইকি, এক কাজ করতে পারিস?"
সাগ্রহে মুখ তুলে সাইকি বলে, "কী কাজ?"
দেবী বলেন, "তুই সরাসরি ভেনাসের কাছেই যা। তার কাছে দাসী হবার আর্জি জানা। তাঁকে কাজে সন্তুষ্ট করতে পারলে হয়তো তোর সমস্যার সমাধান হবে। তাঁকে সন্তুষ্ট করা অবশ্য খুব কঠিন ব্যাপার।"
সাইকি মনকে দৃঢ় করে বলে, "যতই কঠিন হোক, আমি চেষ্টা করবো। ঠিক আছে বিদায় দিন দেবী, আমি তাঁর কাছে যাই।"
চলতে চলতে একসময় পথ ফুরায়। দেবী ভেনাসের কাছে এসে হাজির হয় সাইকি। ভেনাস একেবারে অগ্নিগর্ভ ভিসুভিয়াসের মতন এসে দাঁড়ান সাইকির সামনে। তারপরে অনেকক্ষণ অনেক বকাবকি করে যান। সাইকি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
সব বলা হয়ে গেলে ভেনাস বলেন, "সর্বনাশ যা করার তো করেইছিস আমার ছেলেটার, এখন এখানে কী মনে করে?"
সাইকি বলে, "আপনার দাসত্ব করতে চাই। প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই। আপনি যা করতে বলবেন, আমি যথাসাধ্য করবো।"
নিজে এত আগুনের ঝাপটা দেওয়ার পরেও সাইকির এমন কোমল বিনীত করুণ গলা শুনে কেমন একটু থমকে যান দেবী, এ মেয়ে তো সোজা না! এইটুকু একটা মেয়ে, সামান্য মানুষ, কিন্তু এতদূর এসেছে, আবার দাসত্ব করতে চাইছে! "যাক, একটু বাজিয়ে দেখা যাক।" ভাবেন দেবী।
সাইকিকে গম্ভীর গলায় বলেন, "বেশ। আমার কাছে কাজ করতে চাস, করবি। তবে কাজ ঠিকমতন করতে না পারলে কিন্তু কপালে দুঃখু আছে তোর, তা বলে দিলাম।"
সাইকি মাথা কাত করে বলে, "হ্যাঁ, জানি। কাজ না পারলে আপনি যা শাস্তি দেবেন, আমি নেবো। আপনার যা খুশি শাস্তি দেবেন।"
ভেনাস সাইকির হাত শক্ত করে চেপে ধরে নিয়ে যান একটা গোলাঘরের পাশে, সেখানে স্তূপাকারে শস্য রাখা। একটা বিরাট শস্যস্তূপে গম, ধান, তিল, মুসুর, সর্ষে---এই পাঁচ রকম দানা একেবারে ঘেঁটে মেশানো।
হুঙ্কার দিয়ে ভেনাস বলেন, "এই পাঁচরকম দানা আলাদা আলাদা করে রাখবি সন্ধ্যের মধ্যেই। এই তোর আজকের কাজ। না পারলে--হুঁ হুঁ, বুঝতেই পারছিস কী হবে।"
দেবী চলে যান, আর হতাশ চোখে পাহাড়ের মতন শস্যস্তূপের দিকে চেয়ে থাকে সাইকি। এই পাহাড় থেকে বেছে আলাদা করা কি একদিনের কাজ? এ যে অমানুষিক ব্যাপার!
একপাশ থেকে সে পাঁচরকম দানা আলাদা করতে শুরু করে আর পাহাড়ের মতন শস্যস্তূপের দিকে চেয়ে চোখ জলে ভরে যায় তার।
হঠাৎ সে শোনে কে যেন কথা বলছে, খুব সরু আর আস্তে গলা। কে?
চারিদিকে ঠাহর করে সে দ্যাখে একটা ছোটো পিঁপড়ে কী যেন বলছে। কান পেতে সাইকি শোনে, সে বলছে, "সাইকি, সাইকি, তুমি কেঁদো না, আমার কথা শোনো। আমি তোমাকে সাহায্য করতে চাই। আমি এখানের পিঁপড়েদের সর্দার। আমি লাখে লাখে পিঁপড়ে ডেকে আনছি। পাঁচদলে ভাগ হয়ে একদল তুলবে ধান, একদল গম, একদল সর্ষে, একদল তিল আর আরেকদল মুসুরডাল। দ্যাখো না কী মজা হয়।"
লাখে লাখে পিঁপড়ে এসে কাজে লেগে গেল। দেখতে দেখতে শস্যের পাহাড় যেন জীবন্ত হয়ে উঠলো। কয়েক ঘন্টার মধ্যে পরিষ্কার পাঁচভাগে ভাগ হয়ে গেল পাঁচরকম দানা। সর্দার পিঁপড়ের পিছনে লাখে লাখে কর্মী পিঁপড়ে এসে সাইকির কাছে বিদায় নিয়ে গর্তে গর্তে অদৃশ্য হয়ে গেল। সাইকি বিস্ময়ে এমন বোবা হয়ে গেছিল যে ধন্যবাদ সে যখন দিল, তখন তারা সবাই চলে গেছে।
দেবী ভেনাস এসে সব দেখে তো চক্ষু চড়কগাছ করে ফেললেন। আরে সত্যি সত্যি আলাদা করে ফেলেছে দেখি!
কিন্তু দুর্বলতা প্রকাশ করলেন না একদম, গম্ভীর গলায় বললেন, "কাজ তো দেখি ঠিকঠাক করেছিস। নে, এখন এই রুটি আর জল নে, এই তোর পারিশ্রমিক। ওপাশে খড়ের বিছানা আছে, খেয়ে দেয়ে ওখানে গিয়ে শুয়ে পড়িস। আমার আর এখানে থাকার অবসর নেই, অনেক কাজ। কালকে সকালে এসে কালকের কাজ দেবো।"
দেবী চলে গেলেন, সাইকি রুটি আর জল খেয়ে খড়ের বিছানায় শুয়ে পড়লো। কিন্তু ঘুম আসে না, সে ভাবে আগামীকাল না জানি কপালে কী আছে।
পরদিন সকালে দেবী ভেনাস আসেন আর সাইকিকে বলেন, "নদীর ধারে চরতে আসে সোনার পশমওয়ালা বুনো ভেড়ার পাল, ওদের থেকে সোনার পশম আনতে হবে কেটে। সন্ধ্যের মধ্যে আনা চাই। নাহলে বুঝতেই পারছিস---"
সাইকি বিমর্ষচিত্তে রওনা হয়, সে জানতো ঐ বুনো ভেড়ার পাল ভীষণ হিংস্র, কোনো মানুষকে কাছে ঘেঁষতে দেয় না। ওদের গা থেকে সোনার পশম কেটে আনা অসাধ্য কাজ।
নদীর ধারে এসে সাইকি জলের দিকে চেয়ে চুপ করে বসে থাকে, দূরে সোনার ভেড়ার পাল চরে বেড়াচ্ছে। কাছে যাওয়া যাবে না, গুঁতো দিয়ে মেরে ফেলবে।
নদীর দিকে চেয়ে সাইকি ভাবে, এই কাজ তো পারবো না। সন্ধ্যেয় দেবীর মুখোমুখি হওয়ার চেয়ে নদীতে ডুবে মরাই ভালো।
হঠাৎ সে শোনে, গুণগুণ সুরে কে জানি কথা বলে,"সাইকি সাইকি, শোনো শোনো শোনো।"
হতবিহ্বল হয়ে সাইকি এদিকে তাকায় ওদিকে তাকায়, কোনো জনমনিষ্যি দেখতে পায় না। কে কথা বলে?
তারপরে তার চোখ পড়ে নদীর পাশে একঝোপ শনগাছের উপর। সেই শনগাছ তাকে বলে, "সাইকি, তুমি হতাশ হয়ো না। ঐ ডাকাবুকো ভেড়ারা এমনিতে কাছে কাউকে ঘেঁষতে দেয় না বটে, কিন্তু সারাদিন কাঁটাঝোপে ওরা খেলা করে, তখন ওদের গা থেকে সোনার পশম ছিঁড়ে ছিঁড়ে কাঁটাঝোপে আটকে থাকে। সন্ধ্যের মুখে ওরা সব নদীতে নামে। তখন তুমি চুপি চুপি গিয়ে ঐ কাঁটাঝোপের থেকে পশম খুলে নিলেই কেল্লাফতে।"
সাইকি শনগাছকে অনেক অনেক ধন্যবাদ দিয়ে তার কথামতন কাজ করে। সন্ধ্যেবেলা অনেক অনেক সোনার পশম নিয়ে দেয় দেবী ভেনাসকে।
দেখে তো দেবীর চোখ নাটা নাটা। ঐ দুর্ধর্ষ ভেড়াদের কাছ থেকে সোনার পশম এনেছে এই লিকপিকে মানুষের মেয়ে?
(চলবে)
এখানে প্রথম পর্ব
এখানে দ্বিতীয় পর্ব
মন্তব্য
এত পপ্পন খান কেন? :?
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
কি মজা! সাইকি লড়ে যাচ্ছে আর জিতে যাচ্ছে। কি মজা!
গল্প খুব ভাল লাগছে, তুলি-দিদি। পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম।
- একলহমা
গল্পের মজা তো ঐখানেই।
এর পরের কাজগুলো আরো কঠিন।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
এরম চিটিংবাজি ভালু নয়...
পপ্পন শেষ হবার আগে পরের পর্ব দেন.
..................................................................
#Banshibir.
আহা, চিটিং কেন, এ হলো সাপোর্টিং টেকনোলজির ব্যবহার
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
প্রতি লেভেল এতো পিচ্চি ক্যান?
কই তেমন পিচ্চি, মোটামুটি ঠিকঠাক লম্বাই তো, বেশী বড় হলে লোকের ধৈর্য থাকে?
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
ছেলেবেলায় শোনা এক রূপকথার গল্পের সাথে বেশ মিলে গেলো সাইকির সাথে ভেনাসের আচরণ, কাজের নমুনা আর কীটপতঙ্গ/গাছগাছালির সহায়তায় সাইকির জয়।
বেশ লাগছে কিন্তু। তুলিদি, পর্বগুলো আরেকটু বড় করা যায় না?
হ্যাঁ, আমারো এই গল্পটা পড়ে সুখী দুখী আর তুলারাজার গল্পের কথা মনে পড়ছিল।
পরের পর্বেই সমাপ্ত হবে, আর বেশী দেরি নাই।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
এইবার নো কমেন্ট - শুধু অপেক্ষা।
পরের পর্বেই সব কৌতূহলের সমাপ্তি।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
বেশ লাগছে পড়তে! 'নাটা বনের চোরা কাঁটা বিঁধেছে,,,' গানে শুনেছি শব্দটা।
এখন পড়লাম ভেনাসের চোখ 'নাটা নাটা' নাটা জিনিসটা ঠিক কী গো দিদি?
নাটা হলো নাটাফলের গোটা, গোল গোল। ফলটায় বেশ কাঁটা দেখলাম।
এই যে ফলের লিংক আর এই যে নাটা
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
চোখ আমারও নাটা নাটা হয়ে গেলো কিন্তু! ফলটা বাইরে থেকে দেখতে একটু ভীতকর, কিন্তু ভেতরে কেমন কিউটি সুইটি টিকটিকির ডিমের মত, বলো! দারুণ জিনিস দেখালে দিদি।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
বেশ, চলুক।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
নতুন মন্তব্য করুন