দাঁড়িয়ে আছি একটা মস্ত ঘরের মধ্যে, হা হা করছে ফাঁকা ঘর, কোনো জানালা নেই, শুধু অদ্ভুত সবুজ রঙের দেওয়াল ঘরের চারিদিকে। ছাদ অনেক উঁচুতে। ছাদ থেকে ঝুলছে একটা সোনালি শিকলি, তার ডগায় একটা অদ্ভুত আকৃতির পলকাটা ঝাড়বাতির মতন জিনিস, কিন্তু আলো জ্বলছে না সেখানে। শুধু কোথা থেকে লুকানো আলো এসে ওটার উপরে পড়ে চিকমিক করছে।
একদিকের দেওয়ালে একটা মস্ত দরজা, মেঝে থেকে ছাদ অবধি উঠে গেছে। ভারী ভারী পাল্লা দরজায়। ঠেলা দিতেই খুলে গেল। খোলা দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসে পড়লাম একটা লম্বা করিডরে, তারও চারদিকেই দেওয়াল, হাল্কা রহস্যময় সবুজ আলো করিডর জুড়ে। একদিকে চলতে শুরু করলাম, গিয়ে পৌঁছলাম একটা গোল বারান্দার মতন জায়্গায়। সেটারও চারিদিক বন্ধ। এ কোথায় এলাম? ভুলভুলাইয়া? কেউ কোথাও নেই। কারুর সাড়াশব্দও নেই। শুধু কান পেতে শুনলে কুলকুল করে জল বয়ে যাওয়ার শব্দ পাই।
কী করে এই ভুলভুলাইয়া থেকে বার হবো? গোল বারান্দার চারিদিকে কোনো দরজা জাতীয় কিছু নেই, পিছিয়ে গেলে পাবো সেই করিডর, যে করিডর ধরে এখানে এসেছি। কিন্তু আমার এখান থেকে বেরোতে হবে যে ! নাহলে দম বন্ধ হয়ে আসছে। পিছন ফিরে সেই করিডরেই যাবো মনে করে দৌড় দিলাম, কিন্তু গিয়ে পড়লাম একটা অদ্ভুত জায়গায়, সেখানে শত শত থাম উঠে গেছে হাজার বছরের পুরানো গাছের মতন। এটা আবার কোথায় এলাম?
ভয়ে চিৎকার করে উঠলাম, আঁ আঁ আঁ। অমনি সেই চিৎকার ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো শত শত স্তম্ভে, ঐ স্তম্ভময় বিশাল ঘরের চারিদিকের পাথুরে দেওয়ালে। যেন অদ্ভুত ব্যঙ্গহাসির মতন। একজন মানুষ কোনোদিন আর এই ভুলভুলাইয়া থেকে বেরোতে পারবে না জেনে কারা যেন হাসছে সবুজ দেওয়ালের ওপার থেকে।
ঘামে জবজবে হয়ে জেগে উঠি, খানিকক্ষণ সময় লাগে বুঝতে যে পুরোটাই ছিল স্বপ্ন। উফ, কী ভয়ানক স্বপ্ন! উঠে গিয়ে বারান্দায় দাঁড়াই, খোলা হাওয়ায় প্রাণ ভরে শ্বাস নিই, আকাশে জ্বলজ্বল করছে কালপুরুষ নক্ষত্রমন্ডলী। জেগে জেগেই স্বপ্নের মতন মনে পড়ে-
নীল নক্ষত্র থেকে নেমে আসছে অভিযাত্রী কৃষ্ণ অশ্ব।
তার কেশরে ঝলকাচ্ছে বিন্দু বিন্দু শুভ্র হীরককণা।
তার পিঠে সওয়ার রহস্যমানুষের হাতে দীর্ঘ বর্শা,
বর্শাগ্রে তীক্ষ্ণ ফলা ঝকমক করছে।
ওরা কোথায় যাবে?
এক ঘর থেকে আরেক ঘর, এক পথ থেকে আরেক পথ, এক নদী থেকে অন্য নদী, এক সমুদ্র থেকে অন্য সমুদ্র, এক পৃথিবী থেকে অন্য পৃথিবীতে আমরা আসা যাওয়া করে যাচ্ছি অনবরত।
তুমি আছো অনেক দূরের একটা ঘরে। মাধবীলতার বারান্দা পার হয়ে সেই ঘর। সেই ঘরে ঢুকেই চোখে পড়ে মুখোমুখি দুই দেওয়ালে মস্ত মস্ত দুই আয়না পরস্পরের দিকে চেয়ে আছে। মাঝে দাঁড়ালে দেখা যায় অনন্ত প্রতিবিম্ব সারি।
অনেক দিনের পর, অনেক বছর পর মাধবীলতার বারান্দা পার হয়ে তোমার ঘরের দরজা ঠেলে ঢুকেছিলাম। সেখানে তোমাকে পেলাম না, তোমার সব লেখা, তোমার আঁকা সব ছবি রয়ে গেছে সেখানে। এককোণে যত্নে রাখা আছে তোমার তানপুরাও। তোমার হাতে সাজানো সেইসব ফুলদানি, ফুলদানিতে কৃত্রিম ফুলের গোছা, যা কখনো শুকায় না-রয়ে গেছে। রয়ে গেছে কুরুশের টেবিলঢাকনা যা তুমি নিজের হাতে বানিয়েছিলে।
শুধু তুমি ওখানে ছিলে না। ওখান থেকেই কি তুমি চলে গেছ তোমার গোপণ বেলাভূমিতে, যেখানে চিকচিক করে লালচে-সোনালি বালি, হেঁটে বেড়ায় ঝাঁক ঝাঁক লাল কাঁকড়া? যেখানে বিরামবিহীন অনন্ত ঢেউ আসে ঢেউ ভাঙে দুধসাদা ফেনা ছড়িয়ে?
একদিন সেইখানের আকাশে আমিও গিয়ে হাজির হবো। হয়তো।
মন্তব্য
শেষটায় এসে মনটা খারাপ হয়ে গেলো রে দিদি!
আয়নামতি,
মন খারাপের কী আছে বলো? জীবন আর জগত এমনই তো।
ভালো থেকো।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
আয়নামতি-দিদি যতই আমায় বকা লাগাক আমি পটরপটর করি, এমন মায়াময় লেখার সমাদর না করলে চলে! তাই -
****************************
কাল রাতে খুব বৃষ্টি হল। বাজ পড়েনি কোন। কেন পড়বে? আমি তো শুধু বৃষ্টি চেয়েছিলাম। আমি তো শুধু তোমায় চেয়েছিলাম। বাজ পড়লে তোমার ভাল লাগত না। আমার উন্মাতাল হাসির শব্দ ছাড়া আর কোন বড় শব্দ তোমার ভাল লাগতনা। কাল এলে তুমি। সানরুমের ছাদে দূরের ঘোড়ার খুরের চলার মত জলের ফোঁটার আওয়াজ আসছিল। একটা-দুটো আওয়াজ আলাদা হয়ে যাচ্ছিল। বুঝলাম তুমি আসছ। মাথার পাশের জানালাটা খুলে রেখেছিলাম। তুমি এলে।
আমার মুখের উপর ঝুঁকে আছ তোমার মুখ। তোমার গাল-কপাল বেয়ে ঝরে পড়া জলে আমার চোখ, নাক, ঠোঁট ভেসে যাচ্ছিল। তুমি মিশে এলে আমার উপরে, তোমার শক্ত হাতের নিশ্চিন্ত বাঁধনে আমার ঘুম আসছিল। কতকাল ঘুমাইনা আমি! কিন্তু তুমি যে এসেছ এখন! আমার চোখ ফেটে জল এল। আশ্চর্য, এখনো জল আসে আমার!
তোমার গা থেকে জল পড়ছিল টুপ, টুপ, টুপ। বাইরে দূরের খুরের আওয়াজ নিয়ে ঘোড়া ছুটে যাচ্ছিল টপ-টপ, টপ-টপ। আমার চোখ থেকে জল পড়ে যাচ্ছিল শব্দহীন । যত বার তোমার হাতে আমার চোখ মুছলাম, চুমু খেলাম, বালিশ ভিজে গেল। তোমার ভেজা হাত আমার ঠোঁটে - চোখের পাতায় - ঘুম - জল - ঘুম -
****************************
- একলহমা
অনেক ধন্যবাদ একলহমা।
খুব ভালো লাগলো আপনার মায়াময় কমেন্ট।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
সুন্দর
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
ইসরাত
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
আমারো একটু মন খারাপ হলো। কেন বুঝতেছি না! (স্বপ্নীল সমন্যামবিউলিসট)
মন খারাপের কিছু নাই স্বপ্নীল, মন ভালো করে ফেলুন।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
হ্যাঁ, ভাল লাগলো।
অনেক ধন্যবাদ।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
নতুন মন্তব্য করুন