পার্সিফোনি ছিল এক ফুটফুটে সুন্দরী মেয়ে। সে ছিল শস্যের দেবী দিমিত্রার মেয়ে। দিমিত্রা(Demeter) ছিলেন করুণাময়ী দেবী,তাঁরই করুণায় পৃথিবীর মাঠে মাঠে শস্য ফলতো, গাছে গাছে ফুল ফুটতো আর ফল ধরতো। পৃথিবীর মানুষেরা তাঁকে ভক্তিভরে পূজা দিতো, নৈবেদ্য দিতো।
পার্সিফোনি ছিল মায়ের নয়ণের মণি। সে খেলা করে বেড়াতো তার সখীদের সঙ্গে, ফুল তুলতো, মালা গাঁথতো, গান গাইতো, নাচতো-আনন্দময়ী বালিকা ছিল সে। তার কন্ঠস্বর ছিল নদীর কলস্বরের মত, বাতাসের মর্মরের মত, কোকিলের কুহুতানের মতন-যে শুনতো সেই মুগ্ধ হতো। দেখতে সে ছিল নববসন্তের দিনের মতন অপরূপ সুন্দরী। সে যেখানে যেত সেখানে পশুপক্ষী গাছপালা মাঠ নদী বন পাহাড় সবাই খুশি হয়ে উঠতো। দেখতে দেখতে সে কিশোরী হয়ে উঠলো, মঞ্জরিত বৃক্ষের মতন সুন্দর, চোখে আকাশের নীল, চুলে রোদ্দুরের ঝিকিমিকি।
একদিন সে ফুল তুলতে তুলতে সখীদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একটু দূরে চলে গেছে, হঠাৎ ভূমি বিদীর্ণ হয়ে গেল তার সামনে। সেই বিদীর্ণ ভূমি থেকে উঠে এলো এক বিরাট স্বর্ণরথ, সেই রথ টানছে চারটি দুর্ধর্ষ কৃষ্ণ অশ্ব। রথে বসে আছেন পাতালের অধীশ্বর দেবতা হেডিজ। একপলকের মধ্যে পার্সিফোনিকে টান দিয়ে রথে তুলে নিয়ে হেডিজ চলে গেলেন পাতালে। পার্সিফোনির চিৎকার পাথরে লেগে বন্ধ হয়ে গেল, বিদীর্ণ ভূমি ততক্ষণে জুড়ে গিয়ে আগের মতন হয়ে গেছে আবার। শুধু পার্সিফোনির একখানি ফুলের মালা ছিঁড়ে গিয়ে আটকে রয়েছিল একটা গাছে।
এদিকে পার্সিফোনির সখীরা এই অপহরণ বৃত্তান্ত কিছুই বুঝতে পারে নি, তারা ওকে খুঁজতে খুঁজতে ওখানে এসে ওকে ডাকে, সাড়া পায় না। শেষে ঐ মালাটি খুঁজে পেয়ে বুঝতে পারে কিছু একটা হয়েছে, অতঙ্কিত সখীরা দ্রুত গিয়ে জানায় দিমিত্রাকে।
দিমিত্রা সব শুনে কেমন উন্মাদিনীর মতন হয়ে গেলেন। ধূলিধূসরিত ছিন্নবেশে দুইখানি মশাল দুইহাতে নিয়ে তিনি খুঁজে ফিরতে লাগলেন কন্যাকে। না খেয়ে না ঘুমিয়ে নয়দিন নয়রাত্রি ধরে পার্সিফোনিকে খুঁজলেন দেবী, কিন্তু তাকে পেলেন না। দুনিয়ার এধার থেকে ওধার, কেউ কিছু বলতে পারে না কোথায় গেছে হারানো মেয়ে তাঁর।
দশদিনের দিন দিমিত্রা এলেন হেলিয়সের কাছে, হেলিয়স হলেন সূর্য, তিনি সর্বলোকে দৃষ্টি রাখেন আকাশের উচ্চতা থেকে। হেলিয়স বললেন, "তোমার কন্যাকে নিয়ে গেছেন পাতালের অধীশ্বর হেডিজ। তিনি ওকে বিবাহ করেছেন। পার্সিফোনি এখন পাতালের রাণী, সিংহাসনে হেডিজের বামে বসে সেই রাজ্য শাসন করছেন। "
এই শুনে দিমিত্রা প্রচন্ড রাগে দিশাহারা হয়ে গেলেন। কী, এতবড়ো সাহস! তাঁর নয়নের মণি, হৃদয়ের আনন্দ কন্যাকে কিনা নিয়ে গেছে ঐ পাতালের মৃত্যুলোকের রাজা? তাও কিনা চুরি করে, কোনো অনুমতির তোয়াক্কা না করে?
দিমিত্রা রাগে তাঁর করুণা প্রত্যাহার করে নিলেন ভূমির উপর থেকে, আর শস্য ফললো না, কোনো গাছে ফুল ফুটলো না, ফল ধরলো না। সারা দুনিয়ায় মাটি হয়ে রইলো শক্ত উষর, তাতে প্রাণ জাগলো না। সমগ্র মানবজাতি ভয়ানক অবস্থায় পড়লো। তারা কী খাবে? ঐভাবে চললে মৃত্যু তাদের অনিবার্য।
এইসব দেখে স্বর্গে দেবতারা পড়লেন মহা চিন্তায়। পৃথিবীর মানুষ যদি সবই মারা যায়, তবে তো মহা মুশকিল! পূজাপার্বন করবে কারা? নৈবেদ্যই বা দেবে কারা?
দিমিত্রাকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলেন দেবতারা, বললেন, "হেডিজ খুব উচ্চপর্যায়ের দেবতা, দেবরাজের সঙ্গে প্রায় সমান আসন তাঁর। সেই দেবতার স্ত্রী হয়েছে পার্সিফোনি, এতো খুবই আনন্দের কথা। সে তো কষ্টে নেই, সে বরং পরম গৌরবে আছে। কন্যাকে একদিন তো বিবাহ দিতেই হতো--"
কিন্তু দিমিত্রা এইসব শোনবার পাত্রী নন। তিনি রেগে গিয়ে বলেন, "আমাকে খুব সোজা পেয়েছ, না? যা খুশী একটা ভুজুং ভাজাং দিয়ে গেলে, আর আমি শুনে গলে গেলাম? এসব নেহি চলেগা। আমার কন্যাকে হেডিজ যদি ভালোয় ভালোয় ফিরিয়ে দেয় তো ভালো, নইলে সব শেষ হয়ে যাক, আমি কেয়ার করিনা। কন্যাকে ফিরে পেলে তবেই আমি আবার পৃথিবীকে শস্যশালিনী করবো।"
অনেক বোঝানোর চেষ্টা, কাকুতিমিনতি, শেষে ধমকচমক দিয়েও যখন কিছুই হলো না, তখন দেবরাজ বুঝলেন এইবার আর উপায় নেই। হেডিজকে পার্সিফোনি-প্রত্যর্পণের নির্দেশ দেওয়াই দরকার।
তাই হলো, নির্দেশ নিয়ে দেবদূত চলে গেল পাতালে। সেখানে গিয়ে হেডিজকে সব শোনানোর পরে হেডিজ বিষন্নচিত্তে রাজী হলেন পার্সিফোনিকে ফেরৎ দিতে।
পার্সিফোনি তো মনের আনন্দে লাফিয়ে উঠেছে, এতদিন সে এখানে নিরানন্দ হয়ে ছিল, এখন মাকে আবার দেখতে পাবে শুনে সে একেবারে আনন্দময়ূরী হয়ে উঠলো। এতদিন সে এখানে কিচ্ছুটি খায় নি, শুধু চার দানা ডালিম ছাড়া।
রথ এসে গেল, চারটে ঘোড়া জোড়া হয়ে গেল, বিদায় দেবার সময় হেডিজ ম্লানমুখে পার্সিফোনিকে বললেন, "আর কোনোদিন আসবে না? আমি কিন্তু তোমাকে --আমি তোমাকে জোর করে ধরে এনেছিলাম, তার জন্য ক্ষমা চেয়েছি, তুমি তো ক্ষমা করেছ বললে---আর কি আমি কোনো খারাপ ব্যবহার করেছি? আমাকে দয়া করো, আবার এসো। তুমি এখানে না থাকলে আমার---আমার খুব কষ্ট হবে। যদি মাঝে মাঝে আসো---মাত্র কয়েকদিনের জন্যও যদি আসো, তবে মনে শান্তি পাবো। আসবে তো? জানি আসবে না, তোমার মায়ের কাছে ফিরে গিয়ে আমাকে ---আমাকে ঘেন্না করবে, জানি। ঠিক আছে, না আসলে না আসবে, কিন্তু আমি এইখানে প্রতিদিন প্রতিরাত তোমার অপেক্ষা করবো। "
পার্সিফোনি অবাক হয়ে চেয়ে রইলো হেডিজের দিকে, সে এতদিন এখানে আছে, কিন্তু এই রাজাকে যেন এখন প্রথম দেখলো! এতদিন সে কেবল ভাবতো কবে এখান থেকে মুক্তি পেয়ে মায়ের কাছে যাবো? কিন্তু যাবার সময় কেন তবে এমন পিছুটান? রথে চড়ার আগে হঠাৎ কী মনে করে সে হেডিজের কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিল। তারপরেই দৌড়ে গিয়ে রথে উঠলো, দেবদূত রথ চালিয়ে দিল পরক্ষণে।
দেখতে দেখতে তারা চলে এলো দিমিত্রার কাছে। পার্সিফোনি ছুট্টে গিয়ে মায়ের বুকে আছড়ে পড়লো, দিমিত্রা মেয়েকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন, দুইজনের অশ্রুতে দুইজনে সিক্ত। সারাদিন মেয়ে মাকে বললো কী হয়েছিল তার, মা মেয়েকে বললেন মেয়ে যখন ছিল না তখন কী করেছেন তিনি। বলতে বলতে দুইজনেই হেসে কেঁদে অস্থির।
পৃথিবী আবার শস্যশালিনী হলো, গাছে গাছে ফুল ফুটলো, ফল ধরলো। নতুন জীবন জেগে উঠলো সারা দুনিয়ায়।
পার্সিফোনি ঐ যে চারটে ডালিমদানা খেয়েছিল পাতালপুরীতে, সেই জন্যেই সে সারাবছর মায়ের কাছে থাকতে পারে না, চারটি মাসের জন্য তাকে যেতে হয় পাতালে হেডিজের কাছে। এই চার মাস মা দিমিত্রা শোকপালন করেন, তখন পৃথিবীতে শীত, গাছপালা বিবর্ণ পত্রপুষ্পহীন, জমি শক্ত, শস্যহীন। বসন্তে মেয়ে ফিরে আসে মায়ের কাছে, দিমিত্রা আবার খুশী হয়ে ওঠেন, দুনিয়া ফুলেফলেশস্যে ভরে ওঠে। তারপরে গোটা গ্রীষ্মবর্ষাশরত পার্সিফোনি মায়ের সঙ্গে থাকে, তখন সর্বত্র আনন্দ আর প্রাণময়তা। হেমন্তের ঝরাপাতার সঙ্গে পার্সিফোনিও মায়ের কাছে বিদায় নিয়ে চারমাসের জন্য চলে যায় পাতালে, আবার সামনের বসন্তে ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে।
*******
মন্তব্য
আজ হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান পড়ছিলাম আবার, অনেকদিন পর। উপকথা, রূপকথা আর চুপকথার স্বাদ কখনো ফিকে হয় না বোধহয়...
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
ঠিক বলেছ তিথীডোর, এইসব উপকথা রূপকথা আর চুপকথা চিরন্তন, চিরদিন নতুনও, কোনোদিন পুরানো হয় না।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
চমৎকার হয়েছে! খুব, খুব, খুব খুব, খুব, খুব, খুব খুব সুন্দর লেগেছে।
(কি করে যে তোমরা সবাই এত সুন্দর লেখো!)
- একলহমা
অনেক অনেক অনেক অনেক অনেক ধন্যবাদ একলহমা।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
আপনার পার্সিফোনের কাহিনী পড়ে আমার খুব লোভ হচ্ছে- আমি গ্রীক মিথলজি নিয়ে যে সিরিজটা লিখছি- সেখানে পার্সিফোনের পর্বে আপনারটা হুবুহু ঢুকিয়ে দিবো কি না! অসাধারণ লিখেছেন আপনি, স্যালুট।
ভালো থাকুন সবসময়ের জন্য।
-এস এম নিয়াজ মাওলা
ধন্যবাদ আপনাকে। আপনিও ভালো থাকুন।
আপনার গ্রীক মিথোলজি সিরিজ চমৎকার হচ্ছে।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
অসাধারণ তুলিরেখা, অসাধারণ।
অনেক শুভকামনা আপনার জন্য।
--------------------------------------------
কামরুজ্জামান পলাশ
ধন্যবাদ রাত-প্রহরী।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
দারূন! পার্সিফোনির কাহিনীটা আমাদের দেশীয় ঢঙে চমৎকার বলেছেন! খুবই ভালো লাগলো।
____________________________
ধন্যবাদ প্রোফেসর হিজবিজবিজ।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
আপত্তি আপত্তি
ছবি ছাড়া গ্রিক কাহিনী যে পড়তে মন চায় না
আপত্তিতে সহমত।
স্বয়ম
অসাধারণ
স্বয়ম
ধন্যবাদ স্বয়ম।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
ছবি তো আর্টিস্টরা আঁকবেন। আমি কোথায় পাবো সেসব?
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
কি সুন্দর সব উপকথা, লেখা পড়ে শৈশবে বাবার মুখে শোনা গল্পের কথা মনে পরে গেল
ইসরাত
ইসরাত, অনেক ধন্যবাদ। শৈশবে শোনা গল্পগুলো ভোলা যায় না। ঐসব রূপকথা, উপকথা একরকমের যাদু যেন, মুহূর্তে তুলে নিয়ে যেত এক নতুন জগতে।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
ভাল লাগল। একটা ছবি দিলাম কিজানি দেখা যাবে কিনা । এইটা সচলে প্রথম কমেন্ট
ধন্যবাদ। খুব সুন্দর ছবি। শিল্পী কে? রেনেসাঁর সময়ের আঁকা কি?
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
ছবিটা ফ্রেডরিক লেটনের আঁকা। সময় ১৮৯১। উইকি বলছে যে, রোমাণ্টিসিজম আর নিওক্লাসিসিজম এই দুই ধারার মিশেলে লেট-ভিক্টোরিয়ান যুগে ইওরোপের বিভিন্ন আর্ট-আকাডেমিগুলোয় "আকাডেমিসিজম" নামে একটা ধারা চলেছিল। ফ্রেডরিক এই ধারার আঁকিয়ে। মূল বিষয় ছিল ইওরোপীয় পুরাণ-ইতিহাস, বাইবেল, এসবের নানান কাহিনী।
ধন্যবাদ আপনাকে। নতুন কতগুলো জিনিস জানতে পারলাম আপনার দেওয়া লিঙ্কগুলো থেকে।
ভালো থাকবেন।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
নতুন মন্তব্য করুন