আমি আর অন্বেষা জাঁকিয়ে বসি আড্ডা দিতে। পরদিন আর তারপরদিনও ছুটি, আজ অনেক রাত অবধি আড্ডা দিলেও ক্ষতি নেই। সেই কলেজের দিনগুলোর আড্ডাস্মৃতি মনে পড়ে, অবশ্য তখন অন্বেষাকে পাই নি।
অন্বেষা এখনো আগের মতনই আছে প্রায়, ঘাড় পর্যন্ত ছাঁটা চুল, কিশোরীর মতন মুখ। ওর কথা যখন শুনি, তখন সেই ইস্কুলবেলার কন্ঠস্বর মনে পড়ে। অন্বেষা বলছিল, "মুখস্থ করে করে রচনা লেখার ব্যাপার বিপজ্জনক, কিন্তু তারচেয়েও বেশি ভয়ের ব্যাপার কোন্টা জানিস তুলি? ঐ মুখস্থ করার যে সংস্কৃতিটা তৈরী হয়ে গিয়েছিল, সেটা গ্রাস করে ফেলেছিলো আমাদের ভাষাশিক্ষা আর সাহিত্যকেই শুধু না, গ্রাস করে ফেলেছিল গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ণ, জীববিজ্ঞানকেও। অথচ এইসব বিষয়গুলো হলো বিজ্ঞান, যাচাই করে দেখার বিদ্যা, চিন্তাকে মুক্ত করতে শেখার বিদ্যা, নতুন প্রশ্ন করতে শেখার বিদ্যা। বইয়ে যা পড়লাম সেসব সত্যি সত্যি হয় কিনা তা যাচিয়ে বাজিয়ে দেখার বিদ্যা। এটাই ছিল না আমাদের কোথাও। গোটা সমাজে এক অদ্ভুত বাধ্যতার সংস্কৃতি-মেনে নাও মেনে নাও,প্রশ্ন নয়, কোনো প্রশ্ন নয়।" অথচ তাহলে তো এইগুলো শেখার কোনো অর্থই আর থাকে না! তোতাপাখির মতন বুলি তুলে যাওয়া শুধু!
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলতে গিয়েও হেসে ফেলি, বলি, "তুই আগের মতই আছিস।আগেও এইসব আদর্শবাদী কথাবার্তা বলতিস আর বাকীসব বুদ্ধিমতী চৌকোশ মেয়েরা রেগে যেত শুনে। ওরা বলতো অত যাচাই বাছই করে দেখে কোন ডঙ্কাটা বাজবে আমার কেরিয়ারে? আরে বাবা মুখস্থ করে উগরে দিয়ে যদি কোনোক্রমে জয়েন্ট এন্ট্রান্সের বেড়াটা টপকাতে পারি, তাহলেই কাফি। একবার ইঞ্জিনিয়ারিং এ চান্স পেয়ে গেলে মার দিয়া কেল্লা, ও একেবারে শিওর শট লাইন। ক্যাম্পাস থেকেই রিক্রুট করে নিয়ে যায় বড়ো বড়ো কোম্পানি। তারপরেই লাখ বেলাখ মাইনে। "
অন্বেষা হাসতে থাকে, বলে, "ঐ লাখ বেলাখই ছিল মূল আকর্ষণ। কী কাজ যে করতে হবে, কী ধরণের স্কিল যে শিখতে হবে, সেই ব্যাপারে কারুর তেমন হেলদোল দেখিনি, যেন সেটা নিতান্ত বাইরের ব্যাপার। যেন কাজকর্ম, ভাবনাচিন্তা বা নতুন কিছু উদ্ভাবন সব করবে "অন্য কেউ বা কারা" আর আমরা শুধু লাখ বেলাখ কামাবো। এরকম হয় কখনো? হয়েছে জগতের কোথাও? "
আমি নিমতেতো মুখে বলি, "সেই লাখ বেলাখ প্রত্যাশিনীরা এখন অনেকেই গৃহবধূ, এখন অবশ্য নতুন শব্দ আছে একটা এর জন্য, "হোম মেকার ", ওদের স্বামীরা চাকরি করে, ওরা সংসার সামলায়, বাচ্চা মানুষ করে। আমাদের মা কাকীমা বা তারও আগের ঠাকুমাদিদিমাদের আমলের থেকে তাহলে কোথায়ই বা তেমন তফাৎ হলো?"
অন্বেষা বলে, " অনেকে তো রীতিমতন ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে বেরিয়েছিল, চাকরি শুরুও করেছিল। তারপরে বিয়ে ঠিক হয়ে যেতেই চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো, শ্বশুরবাড়ীর লোকেরা নাকি চান না। আর ব্যস, অমনি ওরাও ছেড়ে দিল। অবাক লাগে! তাহলে এতকিছুর কী প্রয়োজন ছিল বা? "
আমি বলি, "আর সেইসব প্রমিসিং ফার্স্ট সেকেন্ড হওয়া ছেলেরাও তো সেই কোনো বড়ো বা ছোটো কোম্পানীর কর্মচারী। তাদের অনেকেই তো শুনি নিজের কাজে নিজেই সন্তুষ্ট নয়, কিন্তু নিরুপায়, একটা উপার্জনের পথ তো চাই।"
অন্বেষা বলে, "জানিস, অনেকের মধ্যে নানারকম ন্যাচেরাল ট্যালেন্ট ছিল। এই তো আমি যাদের চিনতাম, তাদের মধ্যেই আশিস, সুনন্দা, ঋভু, তাপসী ভালো ছবি আঁকতো, হয়তো আর্ট কলেজে ভর্তি হলে এর সেখানে শাইন করতে পারতো, কাজেও শান্তি পেত। হাজার হোক মানুষ তো শুধু টাকা কামানোর যন্ত্র না, একটা মনের শান্তিও তো চাই। কিন্তু তখন এই পড়াশোনায় ভালো ছেলেমেয়েরা যদি বলে বসতো আর্ট কলেজে ভর্তি হবো, শিল্পী হতে চাই-তাহলে হয়তো বাড়ীতে কুরুক্ষেত্র লঙ্কাকান্ড টাইপ কিছু বেঁধে যেত। মারধোর কান্নাকাটি দরজা বন্ধ করে রেখে দেওয়া, সবই হতে পারতো। ভেবে দ্যাখ, কী প্রচন্ড সামাজিক চাপ ছিল এইসব ছেলেমেয়েদের উপরে। "
আমার মনে পড়ে যায় গৌরব বলে ছেলেটির কথা, আমাদের এক ক্লাস উপরে পড়তো, পড়াশোনায় ভালো বলে এমন চাপেই তাকে রাখলো তার অভিভাবকরা যে ওর আসল যে আকর্ষণ ছিল সাহিত্য, সেটার কথা কাউকে বলতেই পারলো না ও। এখন মানসিক স্থিতিশীলতা হারিয়ে ফেলেছে, চাকরি ছেড়ে এখন বাড়ীতেই আছে, মাঝে মাঝে বাড়াবাড়ি হলে রিহ্যাবে নিয়ে যান ওর বাবা।
অন্বেষাকে ওর কথা বলতে সে বলে, "আমাদের ঐ এগারো বারো ক্লাসে যখন আমাদের নিজস্বতা, সৃজনশীলতা, মৌলিক ক্ষমতা এগুলোর গুরুত্ব পাবার কথা, ঠিক তখনই ওগুলোকে একটা বিরাট গ্রাইন্ডিং মেশিনে গুঁড়িয়ে দিয়ে বাছা বাছা সব ছেলেপুলেকে ডাক্তারি আর ইনজিনিয়ারিং এর লাইনে জোর করে ঠেলে দিয়ে কী মারাত্মক ক্ষতি যে করেছে সমাজ, সে আর বলার না। তুলনায় যারা সো-কলড মাঝারি মানের ছাত্রছাত্রী ছিল, তারা কেউ কেউ বেঁচে গিয়েছিল ঐ চাপ থেকে। যদিও ওদের অনেকভাবেই আত্মবিশ্বাস নষ্ট করে দিতো চারপাশের লোকেরা, "ওরে তোর আর কিছু হবে না" বলে বলে, কিন্তু তবু কেউ কেউ সেসব পার হয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠতে পেরেছে। আমাদের ক্লাসের সঞ্চিতাকে মনে আছে কি তোর? হয়তো মনে নেই, ও তো একেবারে সাধারণ মানের ছাত্রী ছিল। কিন্তু ও ভালো ছবি আঁকতো, পরে তো আর্ট কলেজে পড়েছে, এখন ওর নিজের আঁকার স্কুল আছে একটা , ছোটো বাচ্চাদের আঁকা শেখায়। নিজেও ছবি আঁকে আগের মতন। নানা জায়গায় নিজের ছবির প্রদর্শনী করে। খুব ভালো লাগে আমার।"
আমার মনে পড়লো সঞ্চিতাকে, কিশোরীবেলার সঞ্চিতা। গোলগাল মুখ, চশমা পরা, ফরসা মেয়েটা চুপ করে বসে থাকতো পিছনের দিকের বেঞ্চিতে। ও ছবি আঁকতো ? কখনো জানতে পারিনি তখন।
(চলবে হয়তো)
মন্তব্য
নাহ, গপ্পসপ্প এত্তো সিরিয়াস হলে চলে?
আরে তোমার তো দেখাই পাই না, আছো কেমন? "মাঝে মাঝে তব দেখা পাই- চিরদিন কেন পাই না? "
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
তুলিদিদির গল্পগুলোর মধ্যে এই ইস্কুলবেলার গল্পগুলো আমার সবচেয়ে প্রিয়। পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
অনেক ধন্যবাদ একলহমা।
আসলে নিয়মিত এই লেখা দেবার ইচ্ছা হয়, সাধ্যে কুলায় না।
ভালো থাকবেন।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
জ্ঞানী মানুষেরা এমন কাঠখোট্টা আড্ডায়! এট্টুও কুটনামি নেই, কুন নায়কটা বেশি 'খুল'।
কে হাসলে গালে চমৎকার টোল পড়ে। গতমাসে কেনা নতুন আনারকলিটা কেমন জুশ এসব কিচ্ছু নেই
'হয়ত চলবে' কেন গো দিদি? চলতেই হবে।
এই তুমি কোথায় ডুব দিয়েছিলে? ভালো আছো? অনেক ভালো থেকো
আরে সেসব "খুল" জিনিস তো আছেই, আড্ডার সব তো আর বলতে পারি না।
কিন্তু আনারকলি জিনিসটা কী? ঝোল্লা কানের দুল, জরোয়া হার, জমকালো শাড়ী, টকঝাল আচার?
এই চলছে আমার, তোমার ও তো দেখা পাই না।
ভালো থেকো।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
তাই তো বলি দুই সখীতে আড্ডা চলছে আর একটুও কুটনোটি কাটা হচ্ছে না!
ঠিকই সব কী আর বলে ফেলতে হয় আনারকলি সেরাম একটা ড্রেস রে দিদি ফটুকটা দেখা যাবে কিনা বুঝতে পারছিনা। আমি তো এখন সারাক্ষণই সচল আছি দিদি ভালো থেকো তুমি।
ফুটুকটা দেখতে পাই নাই, তবে আনারকলি দিয়া সার্চ দিলাম। চমৎকার ড্রেস তো!
আশালতা কই গেলেন গো? অনেকদিন দেখি না।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
এসব পড়লে কেন যেন ছোটবেলার কথাই মনে পড়ে। কি জানি কি জাদু ছিল সেসব দিনগুলোতে!
শুভেচ্ছা
ঠিক বলেছেন মেঘলা মানুষ, জাদুময় ছিল সেসব দিন।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
"When we grew up and went to school
There were certain teachers who would
Hurt the children any way they could
By pouring their derision
Upon anything we did
And exposing every weakness
However carefully hidden by the kids
But out in the middle of nowhere
When they got home at night, their fat and
Psycopathic wives would thrash them
Within inches of their lives
We don't need no education
We dont need no thought control
No dark sarcasm in the classroom
Teachers leave them kids alone
Hey! Teachers! Leave them kids alone!
All in all it's just another brick in the wall."
এরচেয়ে ভালো করে বলার সাধ্য আমার কখনো হবে না। তাই দরকারী পুরো অংশই তুলে দিলাম।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
ষষ্ঠ পান্ডব, এর মতন চমৎকার করে বলতে পারতাম না, অনেক ধন্যবাদ।
তবে এই বিদ্রোহস্বর, এই শক্তি আমাদের সমাজে বিরল। সেখানে তো বরং ম্যাসকিস্টদের দেখি, "আহা গো ঐ মাষ্টার আমাদের ভালোবেসে কী মারা মেরেছিলেন গো, তাই তো মানুষ হয়েছিলাম গো" এই বলে দেখি লুটাপুটি খায়। আমার বলতে ইচ্ছা করে, "ভেড়া হয়েছিলেন গো, ছাগল হয়েছিলেন গো,এখন ম্যা ম্যা করুন গো " । নেহাত বলেও কোনো লাভ নেই বলেই বলিনা। কারণ এরা বুঝবেন না, বুঝতেই যদি পারবেন, তাহলে বলতে তো হতো না।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
ইস্কুল বেলার গল্প ।
পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম তুলি দিদি ।
তাহসিন
অনেক ধন্যবাদ তাহসিন।
দেখি কবে পরের পর্ব আসে। আসলে লেখালিখি সেভাবে আর হয়ে উঠছে না আজকাল, নানা হাবিজাবি কাজে কোথা দিয়ে সময় চলে যায়!
ভালো থাকবেন।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
আপনার ইস্কুলবেলার গল্পগুলো দারুন লাগে পড়তে তুলিদি, আরও ঘন ঘন লেখা আসুক।
অনেকদিন কিন্তু রুপকথার গল্পও শোনা হয়না।
__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---
ধন্যবাদ সাফিনাজ আরজু।
উপকথা/রূপকথা আমার নিজেরও দেবার ইচ্ছা, কিন্তু হয়ে উঠছে না।
ভালো থাকবেন।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
আহারে, এত্ত সুন্দর করে লিখতে পারলে আমিও "মাস্টরবেলার গপ্প" লিখে ফেলতাম
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
আপনি লিখুন, খুব আনন্দ করে পড়বো।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
নতুন মন্তব্য করুন