ইস্কুলবেলার গল্প (২৮)

তুলিরেখা এর ছবি
লিখেছেন তুলিরেখা (তারিখ: সোম, ২৮/০৪/২০১৪ - ৮:০৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বাক্সের ভিতরে বাক্সের মতন নতুন নতুন স্মৃতি বার হয়ে আসছে কিন্ডারগার্টেন ক্লাসের কথা লিখতে বসলেই, রঙীন সব ছবি আঁকা বাক্স। তখন জীবন ছিল বিস্ময়ে ভরা, প্রতিটা দিন ছিল অদ্ভুত রকমের আশ্চর্য, প্রতিটা সকাল যেন হাতের মুঠোয় লুকিয়ে আনতো অচেনা উপহার। তখন তো বেশীরভাগই অচেনা আমাদের। নিজেদের পাড়ার বাড়ীঘর মাঠ রাস্তাগুলো পার হয়ে গেলেই অচেনা রূপকথার রাজ্য। আমবাগান কুলবাগান জোড়া পুকুর গাছপালায় ঘেরা অদ্ভুত অদ্ভুত বাড়ীঘর-সব যেন রূপকথার রাজ্যের এক একটা টুকরো, ছোট্টোবেলার ইস্কুলটাও যেন সেই রূপকথার রাজ্যের মধ্যেই।

মনে পড়ছে একটা মজার ঘটনা, এও নিয়তি দিদিমণির ক্লাসের গল্প। মুখে মুখে বিবেকানন্দের ছোটোবেলার গল্প বলে বলে শোনাচ্ছেন দিদিমণি, তারপরে আবার প্রশ্নও করছেন। দিদিমণি বলছেন ছোট্টো বিলের কথা, বিবেকানন্দের ছোটোবেলার ডাক নাম ছিল বিলে, সে নানা দুষ্টুমী করে বেড়াতো, আবার পড়াশোনায় ছিল তুখোর। তার বাবার কথা আর মায়ের কথাও কথাও বলেছিলেন দিদিমণি।

গল্প আরো খানিক এগিয়ে যাবার পরে কী মনে করে দিদিমণি থামলেন আর জিজ্ঞেস করলেন, "তোমাদের মধ্যে কেউ বলো তো দেখি বিলের মায়ের নাম কী ছিল? "

অমনি ছাত্রছাত্রীর দঙ্গল থেকে তমালী পড়ি কী মরি করে এগিয়ে গিয়ে বলেছে, "জানি জানি দিদিমণি, ভুবনেশ্বর।"

সব্বাই হেসে ফেলেছে, দিদিমণি সমেত। তারপরে দিদিমণি বুঝিয়ে দিলেন, "তমালী, তোমার উত্তর প্রায় ঠিক। ঠিকের কাছাকাছি। কিন্তু ভুবনেশ্বর একটা জায়্গার নাম, তাছাড়া মেয়েদের নামও নয় ওটা, বিলের মায়ের নাম ছিল ভুবনেশ্বরী দেবী। "

কিন্ডারগার্টেন ক্লাসে লেখাপড়া ছিল বেশ খেলাধূলা আর গল্পের সঙ্গে মেশানো। ভারী চমৎকার ছিল সব। বাংলা অংক এইসবের পাশাপাশি হতো গল্প বলার ক্লাস।

স্কুলের গেটের দুইপাশে দুই আমগাছ আর গেটে দাঁড়িয়ে থাকে খাকি রঙের পোশাক পরা দারোয়ানজী, তাকে রতনদা বলে ডাকে সবাই। রতনদা শুধু গেট কীপারই না, সে বাচ্চাদের দেখাশোনাও করে। যেসব বাচ্চারা নতুন নতুন স্কুলে গিয়ে খুব কাঁদে, রতনদা তাদের ভুলিয়ে ভালিয়ে শান্ত করে। বলে, "কান্দিস না, কলা দিমু।" ক্রন্দনরত বাচ্চারা কলা পাবার আশায় কান্না থামিয়ে দে্য়।

দুপুরের টিফিন খাওয়া আর খেলা শেষ হলেই ঘুমের ক্লাস, মেঝেতে পাতা ঢালাও বিছানায় সবাই ঘুমের ভান করে পড়ে পড়ে পাশের জনের সঙ্গে ফিসফিস করতাম আর দিদিমণিরা দুইজন গল্প করতে করতে মাঝে মাঝে, "তোমরা সবাই ঘুমিয়েছো ও ও ও?" বলে প্রশ্ন করতেন।

আমরাও সবাই যারা ঘুমাই নি, সবাই দিব্যি বলতাম, "হ্যাঁ অ্যা অ্যা " আর দিদিমণিরাও আবার নিশ্চিন্ত হয়ে গল্প করতে থাকতেন। বাচ্চারা সত্যি করে ঘুমোচ্ছে না বটে কিন্তু ঘুমের আন্তরিক চেষ্টা তো করছে-এই ভাবতেন মনে হয়।

আমাদের কয়েকজনকে রিকশা চালিয়ে স্কুলে যে পৌঁছে দিত তার নাম ছিল বিশাল নস্কর। সে তেমন বিশাল চেহারার ছিল না, রোগাটে গড়নের সাধারণ মানুষের মতনই ছিল, আমরা তাঁকে ডাকতাম বিশালদা। ঐ ছোট্টো রিকশার মধ্যে এক এক ট্রিপে পাঁচ ছ'জন করে বাচ্চা নিয়ে যে কীভাবে রিকশা চালিয়ে নিত বিশালদা, ভাবতে গেলে অবাক লাগে। রাস্তাও তো ছিল অমসৃণ, খোয়া আর ইঁটে পাথরে ভরা।

সকাল সাড়ে দশটায় স্নানখাওয়া সেরে স্কুলের ইউনিফর্ম পরে হাতে টিনের সুটকেস আর কাঁধে জলের বোতল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম আমরা কয়েকজন। বিশালদা এলেই রিকশায় ওঠা। সীটে তিনজন আর উল্টোদিকে কাঠের বেঞ্চ বসানো, সেখানে তিনজন। সুটকেশগুলো সব বেঞ্চের নিচের খোপে। এখন ভেবে দেখলে অবাক লাগে, ঐ রিকশাও তো একরকম ম্যাজিকই ছিল, এতগুলো ছেলেমেয়ে ঐটুকু জায়্গায় ধরতো কেমন করে? তার উপরে বর্ষাকালে আবার ত্রিপল ঢাকা দেবার ব্যবস্থাও ছিল বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য।

সকলে উঠে বসলে ঝক্কর ঝক্কর রিকশা চলতে থাকতো, বড়োমাঠের পাশ দিয়ে জোড়াপুকুরের পাশ দিয়ে আমবাগানের পাশ দিয়ে কচুরিপানায় ভর্তি একটা ছোটো ডোবার পাশ দিয়ে চলতে চলতে এসে যেত ইস্কুল। কচুরিপানার ফুলগুলো ভারী সুন্দর দেখতে লাগতো, কেমন সাদার মধ্যে অতি হাল্কা বেগুনী মেশানো রঙ! পরে অনেক চেষ্টা করেছি আঁকা ছবিতে ঐ রঙ আনতে, পারিনি। ও আসে না। প্রকৃতির প্যালেটে যে রঙের ছড়াছড়ি তার সঙ্গে তো আলোর গোপণ চুক্তি আছে, সে কি করে আনবো আমার শুকনো কাগজের উপরে কেমিক্যাল রঙ দিয়ে?

ছোটোবেলার ঐ স্কুলে নানারকম নিয়ম টিয়ম ছিল, তারমধ্যে একটা হলো স্কুলের ব্যাজ লাগাতে হতো শার্টের বাঁদিকে, কাঁধের কাছে। কেন জানিনা একটা রুমালকে তেকোনা করে ভাঁজ করে ঐ ব্যাজের সঙ্গে আটকে দিতে হতো। বাড়ী থেকেই করে দিতো। দুপুরে স্কুল থেকে দেওয়া টিফিন খেয়ে হাত ধুয়ে ঐ রুমালে মুছতে হতো।

আর স্কুল থেকে একটা স্কুল ডাইরি দিতো, সেটার মধ্যে স্কুলের নিয়মাবলি, সারা বছরের ছুটির তালিকা ইত্যাদি সব জিনিস থাকতো। তখন আমরা বুঝতাম না অত, শুধু জানতাম ঐ ডাইরি প্রত্যেকদিন সঙ্গে করে নিয়ে যেতে হবে। কারণ দিদিমণি যেকোনোদিন ঐ ডাইরি চাইতে পারেন আর কিছু লিখে দিতে পারেন। সেরকম হলে বাড়ীতে দেখিয়ে বাবার থেকে বা মায়ের থেকে সই করিয়ে নিয়ে যেতে হবে, সেরকমও বলে দিয়েছিলেন দিদিমণিরা। আসলে ডাইরিটা মনে হয় ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকদের সঙ্গে শিক্ষিকাদের যোগাযোগের একটা উপায় ছিল।

(চলবে)


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

আরে আপনিতো আমাকেও আমার কিন্ডারগার্টেনের কথা মনে করিয়ে দিলেন। তবে আমাদের দুপুরে ঘুমানোর ক্লাস ছিল না।

গোঁসাইবাবু

তুলিরেখা এর ছবি

তাই নাকি? হাসি
আমাদের ঘুমের ক্লাসগুলো দারুণ ছিল, তবে তখন মোটেই ভালো লাগতো না। দুপুরে ঘুমাতে ইচ্ছে করতো না। শুধু স্কুলেই বা কেন, ছুটির দিনে বাড়ীতেও দুপুরে ঘুমাতে ভালো লাগতো না। দুপুরে খেলতে ইচ্ছে করতো বা গুঁড়োদুধ চুরি করতে ইচ্ছে করতো। হাসি

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

গান্ধর্বী এর ছবি

বিলে মানে বিবেকানন্দের বইটার কথা মনে পড়ে গেল লেখাটা পড়ে। আর কিন্ডারগার্টেন এর কথাও। নস্টালজিয়া!

শুভকামনা হাসি

------------------------------------------

'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)

তুলিরেখা এর ছবি

ধন্যবাদ আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-
বিলের বইটা মনে পড়ছে আমারও, সেই যে সাপ দেখে সব বাচ্চা "বিলে পাইলে আয়" বলে দৌড়ে পালালো আর বিলে ধ্যান করছে, কিছু বুঝতেই পারে নি সাপ টাপ এসেছে কিনা। হাসি

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

তাহসিন রেজা এর ছবি

এই ইস্কুলবেলার গল্পগুলো আমার খুব ভালো লাগে।
আমি কিন্ডারগার্টেনে পড়িনি!! সরাসরি ক্লাস টুতে ভর্তি হয়েছিলাম হাসি

খুব ভালো লাগল কিন্ডারগার্টেন নিয়ে স্মৃতিচারণ হাসি

------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”

অলীক জানালা _________

তুলিরেখা এর ছবি

এখন কেজি-ওয়ান আর কেজি-টু এর কথা মনে পড়লেই মনে হয় আমার শিক্ষাজীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময়গুলো যদি বাছতে হয় কোনোদিন, এই কিন্ডারগার্টেনের দুই বছর তার মধ্যে পড়বে। হাসি

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

দীনহিন এর ছবি

বিশালদা এলেই রিকশায় ওঠা। সীটে তিনজন আর উল্টোদিকে কাঠের বেঞ্চ বসানো, সেখানে তিনজন।

এই রিকশাগুলি কি স্কুল কোচের মত দেখতে?

ইস্কুলবেলার গপ্প চলুক!

.............................
তুমি কষে ধর হাল
আমি তুলে বাঁধি পাল

তুলিরেখা এর ছবি

না, এই রিকশা এমনি সাধারণ রিকশাতেই বেঞ্চি বসিয়ে করা হয়েছিল স্কুলের বাচ্চাদের আনা নেওয়ার জন্য। তবে ছোটো ছোটো বাক্সের মতন স্কুলকোচ ছিল, লোকে মুড়ির টিন বলতো, সেই কোচ আমাদের পাড়া অবধি আসতো না কেন জানি।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

আয়নামতি এর ছবি

ধন্যি মেয়ে! ধন্যি তোমার স্মৃতিশক্তি!! আমি তো নিজের চেহারাটা ঠিক কেমন সেটাই মনে রাখতে পারিনা।
বার বার আয়নায় মুখ দেখে নিজেকে মনে রাখি দেঁতো হাসি ছাড়ো আমার কথা।
তুমি কবে তোমার আঁকা ছবি নিয়ে পোস্ট দিবে সেকথা কও?
পোস্ট যথারীতি রাবড়িসম মিষ্টি হইয়াছে হাসি

তুলিরেখা এর ছবি

সেইজন্যেই বুঝি তোমার নাম আয়নামতি? হাসি
আমার আঁকা ছবি? সে যা বস্তু! কাকের ঠ্য‌াঙ টাইপ হিজিবিজি, নিচে লিখে দিতে হয় কী জিনিস এঁকেছি। হাসি

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

আয়নামতি এর ছবি

আবার জিগস্ চোখ টিপি সে আমরা বুঝবো, তুমি আগে দাও তো বাপু!
দিদি তুমি লক্ষি! নেও একটা গান
দিলুম ওটা শুনে ঝটপট ঠিক করে ফেলো কোন কোন ছবি পোস্টাবে হাসি

তুলিরেখা এর ছবি

অনেক ধইন্যাপাতা গো আয়নামতি। হাসি

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।